শুভ নববর্ষ

লেখক
আচার্য সত্যশিবানন্দ অবধূ্ত

আগামী সোমবার বাংলার শুভ নববর্ষ৷ বাংলা ১৪২৫ সাল পেরিয়ে ১৪২৬ শুরু হবে৷ আমরা নোতুন বছরে পা দেব৷ এমনি এক বাংলা নববর্ষের প্রবচনে প্রাউট–প্রবক্তা পরম শ্রদ্ধেয় শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার যিনি একাধারে মহান দার্শনিক, ইতিহাসবিদ্, ভাষাতত্ত্ববিদ্, শিক্ষাবিদ্, সঙ্গীতকার, যিনি মহাসম্ভূতি শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী রূপে সমধিক পরিচিত, তিনি আত্মবিস্মৃত বাঙালী জাতি সম্পর্কে বলেছেন, ‘‘বাঙালী নামধেয় জনগোষ্ঠী অতীতে জীবিত ছিল, আজও জীবিত ও আমি আশা করব, ভবিষ্যতে আরও দুর্দান্তভাবে জীবিত থাকবে৷ সেই জনগোষ্ঠীকে নোতুন করে শপথ নিতে হবে–এই নোতুন বছরটা তারা কীভাবে আরও সফল করে তুলবে৷ নিজেদের অস্তিত্বকে কীভাবে আরও প্রাণবান, প্রাণোচ্ছল করে তুলবে৷’’

প্রাউট–প্রবক্তা শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার তাঁর ‘বাঙলার নদী ও সভ্যতা’ বিষয়ক প্রবচনে সভ্যতার ক্রমবিকাশ সম্পর্কিত এক মৌলিক তত্ত্বে বলেছেন, সভ্যতার উৎপত্তি হয় নদীর পার্বত্য স্তরে৷ তারপর নদী বেয়ে ওই সভ্যতাও এগিয়ে চলে৷ নদী যতই এগিয়ে যায়, অন্যান্য বিভিন্ন নদী ও উপনদী তার সঙ্গে মিলিত হয়, এর সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন নদী–উপনদী বাহিত সভ্যতাগুলিও একসঙ্গে মিশে বিমিশ্র সভ্যতার সৃষ্টি করে৷ একাধিক মৌলিক সভ্যতার মিলনে ওই বিমিশ্র সভ্যতা সমৃদ্ধতর হয়৷ এইভাবে উন্নততর সভ্যতার সৃষ্টি হয়৷ আর নদীর শেষ স্তরে বদ্বীপ স্তরে ওই সভ্যতা চরম উৎকর্ষ লাভ করে৷ সেদিক থেকে, বিচার করে দেখা যাচ্ছে, উত্তর ভারতের গাঙ্গেয় সভ্যতা চরম পরিণতি লাভ করছে বাঙলায় এসে৷ বাঙলায় প্রবেশের সাথে সাথে গঙ্গার বদ্বীপীয় স্তর শুরু হয়ে যাচ্ছে৷ কারণ, এখান থেকে গঙ্গার নানান শাখানদী বের হতে থাকে ও এইভাবে সংক্ষিপ্ত পথে এগুলি সাগরে গিয়ে মিলিত হয়৷ ওদিকে ব্রহ্মপুত্র নদী  তার সঙ্গে বয়ে আনে তিব্বত–চীন সভ্যতা৷ আর এই ব্রহ্মপুত্র বাহিত সভ্যতা চূড়ান্ত রূপ নেয় বাঙলায় এসে৷ মানব সভ্যতার আদি পীঠস্থান যে ‘পশ্চিম রাঢ়’ সেখানকার সভ্যতাও রাঢ়ের বিভিন্ন নদীবাহিত হয়ে গাঙ্গেয় সভ্যতার সঙ্গে মিশে সভ্যতার আরও উৎকর্ষ সাধন করেছে৷ তাই বাঙলার সভ্যতা রাঢ়ীয় সভ্যতা, উত্তর ভারতের গাঙ্গেয় সভ্যতা ও মঙ্গোলীয় (চীন–তিব্বতীয়) সভ্যতার মিলনে সৃষ্ট এক অতি উন্নত বিমিশ্র সভ্যতা৷ শ্রদ্ধেয় শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকারের ভাষায়, বাঙলায় তিনটে ব–দ্বীপীয় সভ্যতার বিমিশ্রণ ঘটেছে–গাঙ্গেয় সভ্যতা, ব্রহ্মপুত্র সভ্যতা ও রাঢ় সভ্যতা৷ জগতের সভ্যতার ইতিহাসে এটাই সর্বোত্তম বিমিশ্র সভ্যতার উৎকৃষ্ট উদাহরণ৷

তাই বাঙলার সভ্যতা অতি উন্নত সভ্যতা৷ চৈতন্যদেব, রাজা রামমোহন রায়, স্বামী বিবেকানন্দ, নেতাজী, রবীন্দ্রনাথ বাঙালী জাতির ঐতিহ্যকে বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দিয়েছে৷ বাঙলাদেশের ভাষা আন্দোলন ও তার পরিণতিতে বাঙালীদের মুক্তিসংগ্রামের স্বীকৃতি জানিয়ে রাষ্ট্রসংঘ ‘বাংলা ভাষা দিবস’কে ‘বিশ্ব মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে৷ ওপার বাংলার বাঙালী তরুণ প্রজন্ম বাঙালী জাতীয়তা বিরোধী ইসলামী মৌলবাদের সঙ্গে আপোষহীন সংগ্রাম করে চলেছে৷

এই পরিস্থিতিতে সমস্ত আলস্য ও আত্মস্বার্থের কূপমণ্ডুকতা ত্যাগ করে পরানুকরণ ত্যাগ করে বাঙালী জাতিকে আত্মসচেতন হয়ে ঐক্যবদ্ধ ভাবে সার্বিক আত্মবিকাশের পথ  ধরে দ্রুত পদবিক্ষেপে এগিয়ে চলতে হবে৷

বিশ্বসভ্যতার ভাণ্ডারে বাংলার অনেক কিছু দেওয়ার আছে৷ আজ সারা পৃথিবী জুড়ে যে সার্বিক অবক্ষয়ের অধোগামী স্রোত দেখা দিয়েছে, এই উন্মার্গগামী প্রবণতাকে রোধ করে বিশ্বমানবতা তথা বিশ্বজুড়ে মানবতার প্রতিষ্ঠাকল্পে বাঙালীকে সক্রিয় ভূমিকা নিতে হবে৷ বাঙলার সমুন্নত সভ্যতা–সংস্কৃতির মধ্যে সেই অন্তর্নিহিত সম্ভাবনা রয়েছে৷

বর্তমানে এটা বাস্তব সত্য যে, বাংলা ও বাঙালী আজ শোষিত৷ ভাষাগত ভাবে, সংস্কৃতিগত ভাবে, অর্থনৈতিক ভাবে সব দিক থেকে বাঙলার ওপর বর্তমানে অবদমন চলছে৷ অর্থনৈতিক শোষণ বাঙালীর মেরুদণ্ডকে ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়েছে৷ বাঙলার অর্থনীতি, শিল্প–কারখানা–ব্যব এখন একশ্রেণীর অবাঙালী পুঁজিপতিদের কুক্ষীগত৷ বাঙলাকে শোষণ করে তারা একে ছিবড়েতে পরিণত করে দিচ্ছে৷ বাঙলার কৃষিজাত কাঁচামাল, বাঙলার বাইরে চলে যাচ্ছে৷ বাঙলা থেকে অর্থেরও বহিঃস্রোত সমানে চলেছে৷ এই বাঙলার অর্থনীতিকে আবার নিজের পায়ে দাঁড় করতে গেলে ও সমৃদ্ধ করতে গেলে প্রাউটের অর্থনৈতিক গণতন্ত্রের বিকেন্দ্রিত অর্থনীতি ও সর্বপ্রকার শোষণমুক্ত স্বয়ংসম্পূর্ণ সামাজিক–অর্থনৈতিক অঞ্চল তত্ত্ব ও তার বাস্তব রূপায়ণ চাই৷

এখানে একটা অতি গুরুত্বপূর্ণ কথাও বলতে চাই৷ একতা ও শুভবুদ্ধি–সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মূল চাবিকাঠি৷ বাঙালী ঐক্য নষ্ট করার জন্যে বিভিন্ন সময় শোষকগোষ্ঠী বহু চেষ্টা করেছে, বহুলাংশে ষড়যন্ত্রকারীরা সফলও হয়েছে৷ আজ যদি শোষকদের সমস্ত ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে বাঙালীকে এগিয়ে চলতে হয়, তাহলে বাঙালীকে ঐক্যের মন্ত্রেই উদ্বুদ্ধ হতে হবে৷ বাঙালীদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ সৃষ্টি করে বাঙালী ঐক্যের যেটুকু অবশিষ্ট রয়েছে, তাও নষ্ট করার ষড়যন্ত্র হচ্ছে৷ এ ব্যাপারে সাবধান হওয়া উচিত৷ বাঙালী বিপ্লবী কবি নজরুল বলেছিলেন, ‘‘হিন্দু না ওরা মুসলিম ওই জিজ্ঞাসে কোন্ জন? / কাণ্ডারী বল, ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মার৷’’ সবাই বাঙালী বাংলা আমাদের ভাষা, বাংলা আমাদের সংস্কৃতি৷ বাংলা ভাষার জন্যে প্রাণ দিয়েছিলেন ওপার বাঙলার আবদুল জব্বর, বরকত, আবদুস সালাম, রফিকউদ্দিন ও সালাউদ্দিন৷ সাম্প্রদায়িক বিভেদ ভুলে ভাষা সংস্কৃতির জন্যে তাদের এই আত্মত্যাগ বাঙালীর কাছে গর্বের৷ এই আত্মত্যাগ ইতিহাসের স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে৷ বাঙালী জাতি মানবেতিহাসে বিশ্ব মানবতার মুক্তি আনবে৷ তাই  নববর্ষের পুণ্যলগ্ণে আসুন সমস্ত বাঙালীরা একতা ও শুভবুদ্ধির প্রদীপ জ্বেলে–নব্যমানবতাবাদের জয়গান গেয়ে বিশ্বমানবতাকে আজ মুক্তির পথ দেখাই৷