উদীচী

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

এক ভদ্রলোক থাকতেন কলকাতায়৷ তাঁর নাম–ধরো, মনোরঞ্জন ঘোষ–দস্তিদার৷ বাড়ী তাঁর বাখরগঞ্জ জেলার গাভা গ্রামে৷ এক বার তিনি গ্রামে যাবেন৷ গ্রামে যে লোকটি তাঁর অনুপস্থিতিতে তাঁর পরিবারকে দেখাশোনা করে, ধরো তার নাম গোপাল দাস৷ মনোরঞ্জনবাবু গোপালকে চিঠি লিখে জানালেন, অমুখ তারিখে গ্রামে যাচ্ছি৷ তুমি ষ্টীমার ঘাটে উপস্থিত থেকো৷

মনোরঞ্জনবাবুর অনুপস্থিতিতে ও অজ্ঞাতে তাঁর পরিবারে এমন অনেক ঘটনাই ঘটে গেছে যা এখনো পর্যন্ত তাঁর জানবার ও শোণবার সুযোগ হয়নি৷ ষ্টীমার থেকে নেবে মনোরঞ্জনবাবু গোপালকে জিজ্ঞেস করলেন–হ্যাঁ গোপাল, বাড়ীর সব খবর ভাল তো?

গোপাল বললে–হ্যাঁ কত্তা, সবাই ভাল, সব কিছুই ঠিকঠিক চলছে৷

তারপরে একটু ঢ়োক গিলে একটু উদীচী করে বললে–কেবল সেই এ্যাল্সেশিয়ান* কুকুরটি মারা গেছে৷

* আমরা প্রায় সকলেই এ্যালসেশিয়ান কুকুরের সঙ্গে পরিচিত৷ এ্যাল্সেশিয়ানকে কুকুর বলেই আমরা ধরি কিন্তু আসলে এটি ঠিক কুকুর নয়, এটি নেকড়ের একটি অতি নিকট প্রজাতি৷ তবে নেকড়ের সঙ্গে এর কয়েকটি মৌলিক পার্থক্যও আছে৷ বিশেষ করে চারটি পার্থক্য খুবই লক্ষণীয়৷

প্রথম পার্থক্য হল, নেকড়ের ঘ্রাণশক্তি অতি প্রবল সত্য কিন্তু এ্যাল্সেশিয়ানের ঘ্রাণশক্তি নেকড়ের চেয়েও তীব্র দ্বিতীয় পার্থক্য এই যে নেকড়ে কুকুরকে দেখলেই খাক বা না খাক, হত্যা করে৷ এ্যাল্সেশিয়ান অতটা কুকুরবিদ্বেষী নয়৷ পোষমানা এ্যাল্সেশিয়ান তো একেবারেই নয় তৃতীয় পার্থক্য হ’ল, নেকড়ে নিজের ওজনের আড়াই গুন ওজন খাদ্য খেতে পারে৷ তারপর অবশ্য কয়েকটা দিন মড়ার মত পড়ে থাকে৷ এ্যাল্সেশিয়ান কিন্তু অত বেশী খায় না চতুর্থতঃ নেকড়ে সহজে পোষ মানতে চায় না৷ কিন্তু এ্যাল্সেশিয়ান পোষ মানে ও অত্যন্ত প্রভুভক্ত৷ প্রাচীনকালে নেকড়ে ও শৃগালের বিমিশ্রণে যখন কুকুরের উৎপত্তি হয়েছিল এ্যাল্সেশিয়ানেরও উৎপত্তি তখন হয়েছিল কি না কাগজে–কলম তার কোন প্রমাণ নেই৷ তবে এ্যাল্সেশিয়ান নেকড়ে–শৃগালের বিমিশ্রণ হলেও তার মধ্যে নেকড়ের প্রভাব বেশি৷

পৃথিবীর সমস্ত প্রাচীন ভাষাতেই নেকড়ের উল্লেখ আছে, নামও আছে, কিন্তু এ্যাল্সেশিয়ানের নেই৷ সংস্কৃতে নেকড়েকে বলা হয় ‘বৃকব্যাঘ্র’৷ বৈদিক যুগের কিছু কিছু মানুষ নেকড়ে বাঘকে হত্যা করে তার মাংস, বিশেষ করে তার হূৎপিণ্ড খেত–এমন কিছু কিছু ভাসা ভাসা তথ্য পাওয়া যায়৷ অতি ঔদারিক হিসেবেও নেকড়ের কথা সংস্কৃত সাহিত্যে তো

 আছেই, প্রাচীন বাংলা সাহিত্যেও আছে৷

অতি ঔদারিকতার জন্যে মধ্যম পাণ্ডব ভীমের একটি নাম ছিল বৃকোদর (‘বৃকের  উদরের ন্যায় উদর যাহার’ এই ব্যাসবাক্যে বহুব্রীহি সমাস)৷ সেই মহাভারতে আছে না, পাণ্ডবরা যখন অজ্ঞাতবাসে ছিলেন তখন পাঁচ ভাই ভিক্ষালব্ধ অন্ন মাতা কুন্তীকে যখন এনে দিতেন তখন কুন্তী সেই অন্ন দু’ভাগে বিভক্ত করতেন৷ এক ভাগ কুন্তী ও চার ভাই মিলে খেতেন, অন্য ভাগ খেতেন ভীম একাই৷ ‘অর্ধ্ব খান কুন্তী সহ চারি সহোদরে/অর্ধেক ব’টিয়া দেন বীর বৃকোদরে৷৷’

সেই যে গল্প আছে না, কুন্তী ও চার ভাইকে একাদশীর ব্রত পালন করতে দেখে এক শুভক্ষণে ভীমেরও ইচ্ছা হ’ল একাদশীতে উপবাস করবার৷ ভীম বললে–মা, আম্মোও একাদশী করবো৷ সবাই যখন পারে আম্মোও পারি৷

কুন্তী বললেন–না বাবা, তোমার কষ্ট হবে, তোমাকে করতে হবে না৷

ভীম বললে–মা, কষ্টের জন্যেই তো জীবন৷ কষ্ট করতে এই মধ্যম পাণ্ডব পিছপা নয়৷ ‘‘দেহ আজ্ঞা করি উপবাস/ব্রত আমি পালিব নিশ্চয়৷’’

কুন্তী বললেন–আচ্ছা, তুমি চেষ্টা করো৷ তবে আমি তোমার জলখাবার তৈরী রাখব৷

ভীম সকাল ছ’টায় ঘড়ির দিকে তাকিয়ে কুন্তীকে বললে–এই তো মা, দেখ ছ’’টা বাজল৷ এখনও আমি খাইনি৷ সওয়া ছ’টার সময় বললে, মা দেখ, ছ’টা বেজে পনের মিনিট, এখনও আমি তোমার কাছে জলখাবার চাইনি৷

কুন্তী বললে–আমি কিন্তু জলখাবার তৈরী রেখেছি৷ কেবল দুধটা একটু জ্বাল দিয়ে দোব৷

সাড়ে ছ’টার সময় ভীম বললে–মা, একটু যে ক্ষিদে পাচ্ছে৷ ‘‘তবু আমি দমিব না মাতঃ’’৷

কুন্তী বললেন–জলখাবার কি দোব?

ভীম বললে–মা, আরও একটু দেখি৷

ভীমের হাতঘড়িতে তখন পৌনে সাতটা৷ ভীম বললে–মা, আর যে থাকতে পারছি না৷ এতক্ষণ পেটের ভেতর ছুঁচোয় কেত্তন গাইছিল, এখন যে কীৎ কীৎ খেলছে৷

কুন্তী বললে–বাবা, একটু ধৈর্য ধরো, আমি দুধটা জ্বাল দিয়ে নি’৷

দুষ্ট লোকেরা বলে, ভীম তারপর গরম দুধে ভিজিয়ে সাড়ে সাত মণ খই খেয়ে একাদশীর ব্রত উদ্যাপন করেছিল৷

ভীমের স্মরণে আজও সেই তিথিকে লোকে ভৈমী একাদশী বলে থাকে৷ যাই হোক, ভীমের নামে কেন ভৈমী একাদশী হয়েছিল বুঝলে তো

হ্যাঁ, বলা হচ্ছিল এ্যাল্সেশিয়ান কুকুরটির কথা৷ এ্যাল্সেশিয়ান কুকুর মারা গেছে শুণে মনোরঞ্জনবাবু মুষড়ে পড়লেন৷ তারপরে টাল সামলে নিয়ে গোপালকে শুধোলেন–হ্যাঁ গোপাল, তা কুকুরটার হয়েছিল কী?

গোপাল বললে–কী আর হবে কত্তা বাঘের লেখা ও সাপের দেখা, জন্ম–মৃত্যু–বিয়ে তিন বিধাতার নিয়ে–এই ব্যাপারে মানুষ আমরা কী করতে পারি ওই পোড়া মাংস খেয়েই কুকুরটা মরল৷

মনোরঞ্জনবাবু বললেন এ্যাঁ পোড়া মাংস কীসের পোড়া মাংস?

গোপাল উদীচীর পথ ধরে চলেছে৷ সে বললে–ওই যেদিন আপনার বাড়ীটা পুড়ে গেল না সেদিন আস্তাবলের ভেতরে থাকা ঘোড়াটাও যে পুড়ে মরে গেল৷ ওই পোড়া ঘোড়ার মাংস খেয়েই এ্যাল্সেশিয়ানটা মরল৷

মনোরঞ্জনবাবু বললেন–এ্যাঁ আমার অমন প্রাণচঞ্চল আরবী ঘোড়াটা আর নেই৷ তুই বলিস কী রে

গোপাল বললে–ওই যেদিন বুড়ী মা কলেরায় মারা গেলেন তার ঠিক দু’দিন পরে৷

মনোরঞ্জনবাবু বললেন–এ্যাঁ মা–ও নেই৷ বলিস কী গোপাল উদীচী করতে করতে গোপাল বললে–হ্যাঁ কত্তা, বুড়ী মা–ও গত হয়েছেন৷

মনোরঞ্জনবাবু বললেন–কবে কলেরা হয়েছিল? আমি যে কিছুই জানি না৷

গোপাল বললে–তারিখটা ঠিক মনে নেই কত্তা৷ তবে খোকাবাবু যেদিন মারা গেল তার হপ্তা খানেকের মধ্যে৷

মনোরঞ্জনবাবু বললেন–এ্যাঁ খোকাটাও নেই তবে তুই যে বললি সব কিছুই এক রকম চলছে৷

গোপাল বললে কত্তা, উদীচী করছিলুম, ধাপে ধাপে বলছিলুম৷

মনোরঞ্জনবাবু কাঁদতে কাঁদতে বললেন–খোকার কী হয়েছিল রে?

গোপাল বললে মা–মরা বাচ্চা ছেলে কি বাঁচে গিন্নী–মা মারা যাবার পর থেকেই তার ঠিক মত দেখাশোনা হচ্ছিল না৷ তাই খোকাকে আর বাঁচানো গেল না৷

স্ত্রীও মারা গেছেন শুনে মনোরঞ্জনবাবু বললেন–এ্যাঁ বলিস কী সেও নেই৷ তবে আর কাদের জন্যে গ্রামে যাব চল্, ষ্টীমার ঘাটেই ফিরে যাই৷