উপস্থিত বুদ্ধি

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

‘তন্’ ধাতুর অর্থ হ’ল বেড়ে যাওয়া, অভিব্যক্ত হওয়া । যে মানুষ তার ভাবধারাকে নাচে–গানে অভিনয়ে–আবৃত্তিতে অভিব্যক্ত করতে পারে তার জন্যে ‘তন্’ ধাতুর উত্তর ড প্রত্যয় করে ‘ত’ শব্দ ব্যবহূত হয় । তাই এক্ষেত্রে ‘ত’–শব্দের একটি অর্থ হ’ল ণট বা অভিনেতা ।

অভিনেতার মধ্যেও অনেক সময় অদ্ভুত রকমের উপস্থিত বুদ্ধি দেখা যায় । সে বিচারে তিনি দু’দিক দিয়েই ‘ত’ । অভিনয় জগতের ‘ত’–এদের উপস্থিত–বুদ্ধি সম্বন্ধে বা উপস্থিত বুদ্ধির স্বভাব সম্বন্ধে অনেক গল্প প্রচলিত আছে । দু’একটি গল্প তোমাদের শোনাচ্ছি:

সেটা তখন ইংরেজ আমল । আমি তখন দিনাজপুরে । উত্তর বাঙলার অন্যান্য শহরের মত দিনাজপুরও একটি মাঝারি রকমের ছিমছাম শহর ছিল । শহরটি ছিল আমার খুব প্রিয় । দিনাজপুর–বাসীর স্বভাবের একটি বৈশিষ্ট্য আমার খুবই ভাল লাগত । ওঁরা*(*ওনারা, যেনারা, তেনারা শব্দগুলি গ্রাম্য দোষে দুষ্ট । ওঁরা, যাঁরা, তাঁরা–ই শুদ্ধ ওনারা, যেনারা, তেনারা না লেখাই ভাল ।) ছিলেন খুবই নাচ–গান–ভিনয় প্রিয় । সেকালে স্থায়ী অভিনয়মঞ্চ কোলকাতার বাইরে আর কোনো শহরেই বড় একটা ছিল না । কিন্তু দিনাজপুরে তা–ও ছিল । কয়েকজন স্থানীয় অভিনেতা তখন রীতিমত প্রথিতযশা হয়ে পড়েছেন । কেবল শহরেই নয়, গ্রামাঞ্চলের দিকেও থিয়েটারের রমরমা । সেই সময়টায় ওই দিকটায় ‘সীতা’ নাটকটি জনপ্রিয়তার তুঙ্গে । সীতার ভূমিকায় অভিনয় করে যিনি দু’হাতে যশ কুড়িয়েছিলেন, তাঁর নাম ছিল সম্ভব: আব্দুল লতিফ ।

সীতা নাটকের অভিনয় চলছে । শহরে হাজার হাজার গোরুর গাড়ীর ভীড় । গ্রামের লোক ঝেঁটিয়ে এসেছে অভিনয় দেখতে । হাতে পাট বেচার তাজা টাকা । দরকার পড়লে অভিনয়ের জন্যে বেশ কিছু খরচ করতেও তৈরী ।

অভিনয় চলছে । নাটক তার চরম স্তরে (climax)  এসে পৌঁছেছে । এবার সীতার পাতাল প্রবেশ । ধরিত্রী মাতাকে সম্বোধন করে সীতাকে যা বলতে হবে তার মোদ্দা কথা হচ্ছে–‘‘মা: বসুন্ধরে, দ্বিধা হও, আমি তোমার  স্নেহময় অঙ্গে স্থানলাভ করি’’ । আব্দুল লতিফে.র নাটকের ভাব ষোল আনাই জানা, ভাষাও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ঠোঁটস্থ । এই বিশেষ স্থানটিতে সীতা ধরিত্রী মাতাকে সম্ম্বোধন করে যা বলবেন তার ভাবটিও তাঁর জানা আছে । কিন্তু ভাষা একটু গোলমেলে হয়ে গেছে । সেই মাহেন্দ্রক্ষণে ‘‘মা: বসুন্ধরে’’ বলার পরই স্মারকের (prompter) এসে গেল দারুণ কাশি । সে কাশির চোটে আর কথা বলতে পারছে না অথচ সীতা তো আর তার প্রত্যাশায় মুখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না । সে তখন উপস্থিত বুদ্ধি প্রয়োগ করে বললে–‘‘মা: বসুন্ধরে, তুই ফাঁক হ, মুই ভিতরত্ ঢুকিম্’’ ।

দেখলুম, এ জিনিসটা শ্রোতারা সহজেই গ্রহণ করলেন । নাটকের কিছুমাত্র রসভঙ্গ হ’ল না ।