যুক্তিহীন অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কার নয়, মানবসমাজে অগ্রগতির জন্যে চাই যুক্তিপূর্ণ আধ্যাত্মিকতা

লেখক
সত্যসন্ধ দেব

এবার গঙ্গাসাগরে মকরসংক্রান্তির মেলায় লক্ষ লক্ষ পুণ্যার্থী ভীড় জমিয়েছিলেন৷ পশ্চিমবঙ্গ ছাড়াও বিহার, উত্তরপ্রবেশ, হরিয়ানা, রাজস্থান থেকে – ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে, এমনকি সাগরপার থেকেও কাতারে কাতারে মানুষ গঙ্গাসাগরে স্নান করতে এসেছেন৷ অনেকে সারা জীবন ধরে সঞ্চয় করে সেই সঞ্চিত অর্থ নিয়ে, অনেকে জমি–জমা গোরু–বাছুর বিক্রি করে সেই টাকা নিয়ে, অনেকে ধারকর্য করে গঙ্গাসাগরে এসেছেন সংক্রান্তির দিন বিকেলে মেলা প্রাঙ্গনে এক সাংবাদিক সম্মেলন করে রাজ্যের পঞ্চায়েত ও জনস্বাস্থ্য কারিগরী মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় বললেন, এবারে ৩৫ লক্ষ পুণ্যার্থীর ভীড় হযেছিল৷ ৪ জনের মৃত্যুও হয়েছে৷

কিন্তু প্রশ্ণ, কেন এত বিপুল জনসমাগম? একটা বিশ্বাস যে, এই গঙ্গাসাগরে বিশেষ করে মকর সংক্রান্তির এই বিশেষ যোগে একবার ডুব দিলে সারা জীবনে যত পাপ করেছে সব ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যাবে ও বিপুল পুণ্য সঞ্চিত হবে৷ সেই পুণ্যের বলে মোবলাভ হবে৷ ব্যস, সাধন–ভজন, বা জীবনভোর কোনো মহৎ কর্ম না করলেও এক ডুবেই দুর্লভ পুণ্য অর্জন৷ তাই জমি–জমা, গোরু–বাছুর, ঘটি, বাটি বিক্রি করেও এত শীতে গঙ্গাসাগরে ভীড় জমিয়েছেন৷ অনেকে আবার গোরুর ন্যাজ ধরে পুরোহিতের অনুসরণে কিছু মন্ত্র আউরিয়েই পূর্বপুরুষকে ভববৈতরণী পার করতে ও নিজেরও মুক্তির পথ পরিষ্কার করতে চান৷ তাই গঙ্গাসাগরে গোরু–বাছুর ভাড়া করে’ এনেও অনেকে দু’পয়সা কামিয়ে নিচ্ছেন৷

সত্যিই কি গঙ্গাসাগরে স্নান করলে পাপক্ষয় ও পুণ্য সঞ্চয় হবে? বা গোরুর ন্যাজ (লেজ) ধরে ভববৈতরণী পার হওয়া যাবে? এখন দেখা যাক্, পাপ–পুণ্য কী? ব্যাসদেব বলেছেন, ‘‘অষ্টাদশ পুরাণেষু ব্যাসস্য বচনদ্বয়ম্ / পরোপকারায় পুণ্যায় পাপায় পরপীড়নম্৷’’ অষ্টাদশ পুরাণে ব্যাসদেবের শিক্ষা হ’ল পরোপকার পুণ্য ও পরপীড়ন পাপ৷

মুনীঋষিরা এও বলেছেন কর্মের ফল ভুগতেই হয়৷ সৎকর্মের সুফল ও অসৎকর্মের কুফল – দুইপ্রকার ফলেরই ভোগ হয়৷

এটাও মনে রাখতে হবে, বিভিন্ন সময় লোকশিক্ষার জন্যে অনেকে অনেক পুরাণ, মঙ্গলকাব্য প্রভৃতি লিখেছেন৷ সেগুলিতে আসলে নানান্ কাল্পনিক কাহিনী কথিত হয়েছে – আর সেই কাহিনীর মাধ্যমে পুরাণকাররা কিছু সদুপদেশ দেওয়ার চেষ্টা করেছেন৷ ‘পুরাণ’ মানেই লোকশিক্ষার্থে রচিত কাহিনী৷ এই সমস্ত কাহিনীর মধ্যে অনেক স্ববিরোধী কথাও রয়েছে৷ অনেক ক্ষেত্রে অনেক অযৌক্তিক ও অবান্তর কথাও রয়েছে৷ সেই সব ক্ষেত্রে মুনী–ঋষিরা যুক্তি বিচার করে  সত্যাসত্য নিরূপণের নির্দেশ দিয়েছেন৷ তাই তাঁরা বলেছেন, –

কেবলম্ শাস্ত্রমাশ্রিত্য ন কর্তব্যো বিনির্ণয়ঃ৷   যুক্তিহীন বিচাতের তু ধর্মহানি প্রজায়তে৷৷

তাই কেবল শাস্ত্রের দোহাই দিয়ে কর্তব্য নির্ধারণ করা উচিত নয়, শাস্ত্রে বলা হলেও যদি যুক্তিহীন বিবেচিত হয় তাহলে তা করা উচিত নয়, তা করলে ধর্মহানি হয়৷ আবার শাস্ত্রেই বলা হয়েছে –

যুক্তিযুক্তমুপাদেয়ং বচনং বালকাদপি৷

অন্যং তৃণমিব ত্যজ্যমপ্যুক্তং পদ্মজন্মনা৷৷

একটি বালকও যদি যুক্তিযুক্ত কথা বলে তা মানা উচিত, স্বয়ং পদ্মযোনি ব্রহ্মাও যদি অযৌক্তিক কথা বলেন, তা তৃণবৎ পরিত্যাগ করবে৷

যাইহোক, গীতা, উপনিষদ, তন্ত্র সর্বত্রই অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার ত্যাগ করে ধর্মসাধনা ও পরোপকারে সৎকর্ম করে পুণ্য অর্জনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে৷ পাপক্ষয় ও পুণ্যার্জনের এই ‘সর্টকাট’ পদ্ধতির কথা কোথাও সিদ্ধযোগী, মুনী–ঋষিরা বলেননি৷

আসলে সমাজের এক শ্রেণীর সুবিধাবাদী মানুষ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পুস্তক লিখে বা বিভ্রান্তমূলক উপদেশ দিয়ে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করেছে৷ সরল, অজ্ঞ, সাধারণ মানুষ, এমনকি তথাকথিত অনেক শিক্ষিত মানুষও তাদের কু–মতলবের শিকার হয়েছে আর অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের জালে জড়িয়ে পড়ে ওই  সমস্ত সুযোগসন্ধানী মানুষদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ শোষণের শিকার হয়েছে৷

কালক্রমে ওই শোষণের জাল বৃদ্ধি পেতে

পেতে সারা দেশকে ছেয়ে ফেলেছে৷ এতে  ওই  সমস্ত ধর্ম ব্যবসায়ীদের বংশানুক্রমিকভাবে বা শিষ্যানুক্রমিকভাবে সহজে অর্থ রোজগারের ব্যবস্থা পাকা হয়েছে৷

এমনিভাবেই সমাজে জাত–পাত–সম্প্রদায় ভেদ, বিশেষ বিশেষ তীর্থ মাহাত্ম্য থেকে শুরু করে অজস্র ধরণের অযৌক্তিক আচার–নুষ্ঠান গোটা সমাজকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে৷ এর ফলে স্বাভাবিকভাবে মানুষের স্বচ্ছবুদ্ধির স্রোত নানান্ ভাবজড়তার (ডগ্মার) আবর্জনাস্তূপের মধ্যে রুদ্ধ হয়ে গেছে৷

অনেক তথাকথিত ধর্মগুরুকেও বলতে শোনা যায়, পূর্বপুরুষরা যা মেনে এসেছেন, তোমরা মানবে না? তাহলে তো পিতা–পিতামহ তথা পূর্ব–পুরুষদের অপমান করা হয়৷ এতে ধর্ম নষ্ট হয়৷ তাই কোনো যুক্তি না দেখিয়ে পূর্বপুরুষদের অনুসৃত নীতি মেনে চল৷

তাই যদি হয়, তবে কি রাজা রামমোহন রায় সতীদাহ প্রথা বন্ধ করিয়ে, বিদ্যাসাগরমশাই বিধবা বিবাহ চালু করে’ অনেক মহাপুরুষই অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে লড়াই করে অন্যায় করেছেন? পূর্বোল্লিখিত রক্ষণশীল ধর্মবেত্তারা কি সতীদাহ প্রথা সহ সমস্ত কুসংস্কারগুলিকে সমাজে চালু রাখার পক্ষপাতি? তা নিশ্চয়ই সমাজের পক্ষে কল্যাণকর নয়৷

মনে রাখতে হবে প্রকৃত ধর্ম তথা আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে কোনো প্রকার কুসংস্কার, অযৌক্তিক অন্ধবিশ্বাসের স্থান তো নেই, জাত–পাত–সম্প্রদায় ভেদেরও স্থান নেই৷ আধ্যাত্মিকতার পথ হ’ল প্রকৃত আত্মবিকাশের পথ৷ প্রকৃত আধ্যাত্মিকতা সম্পর্কে শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী বলেছেন,

‘‘আধ্যাত্মিকতা কোন ভিত্তিহীন কল্পনাবিলাস ব্ভব্ধপ্সহ্মন্ত্রু ন্স্তুন্দ্ব্ত্রপ্তগ্গ নয়৷ আধ্যাত্মিকতাকে আমরা আমাদের কঠোর বাস্তব দৈনন্দিন জীবনে অনুশীলন ও উপলব্ধি করতে পারি৷ এই আধ্যাত্মিকতা হ’ল মানবমনের বিবর্ত্তন তথা সর্বোচ্চ স্তরে উত্তরণের ন্দ্বপ্তন্দ্ব্ল্ত্রব্ধন্প্স্ নামান্তর, এর সঙ্গে কুসংস্কার ও নৈরাশ্যবাদের কোনো সম্পর্ক নেই৷ যে সমস্ত বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রবণতা, বা ক্ষুদ্র–গোষ্ঠী–কেন্দ্রীক্ ভাবনা–চিন্তা মানুষের মনকে সংকীর্ণতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে, তার সঙ্গে আধ্যাত্মিকতার কোন সম্পর্ক নেই৷ ওই সব ভাবজড়তাকে মোটেই উৎসাহ দেওয়া উচিত নয়৷ যা মনকে প্রসারিত করে, ও ঐক্যের ভাবনা জাগায়–তাই একমাত্র গ্রহণযোগ্য৷ আধ্যাত্মিকতা মানুষে–মানুষে কৃত্রিম বিভেদকে স্বীকার করে না৷ আধ্যাত্মিকতা বিশ্বভ্রাতৃত্বের কথা বলে৷’’