গত ১৪ই সেপ্ঢেম্বর প্রভাত সঙ্গীতের ৩৭ বর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে কলকাতায় আনন্দমার্গ প্রচারক সংঘের কেন্দ্রীয় আশ্রমে মহাসমারোহে প্রভাত সঙ্গীত উৎসব অনুষ্ঠিত হয়৷ এখানে উল্লেখ্য এখন থেকে ৩৭ বছর পূর্বে ১৯৮২ সালের ১৪ই সেপ্ঢেম্বর দেওঘরের শান্ত স্নিগ্দ পরিবেশে মহান দার্শনিক পরম শ্রদ্ধেয় শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার (মার্গগুরু শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী) প্রভাত সঙ্গীত রচনা শুরু করেন৷ সেদিন থেকে ১৯৯০ সালের ২০শে অক্টোবর তাঁর মহাপ্রয়াণের আগের দিন পর্যন্ত ৫০১৮ টি প্রভাত সঙ্গীত রচনা ও সুরারোপণ করেন৷
গত ১৪ই সেপ্ঢেম্বর, প্রভাতসঙ্গীত দিবসে কলকাতায় আনন্দমার্গ আশ্রমের জাগৃতি ভবনে বিকেল ৪টায় অনুষ্ঠান শুরু হয়৷ প্রথমে প্রভাত সঙ্গীত পরিবেশন এর পর কীর্ত্তন ও মিলিত সাধনার পর প্রভাত সঙ্গীত উৎসবের মূল অনুষ্ঠান শুরু হয়৷ অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সংঘের কার্যরত সাধারণ সম্পাদক আচার্য সুতীর্র্থনন্দ অবধূত৷ মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন কার্র্যলয় সচিব আচার্য সুধাক্ষরানন্দ অবধূত, জনসংযোগ সচিব আচার্য তন্ময়ানন্দ অবধূত, মহিলা বিভাগের সচিব অবধূতিকা আনন্দ বিশোকা আচার্যা. অবধূতিকা আনন্দ করুণা আচার্য প্রমুখ৷ প্রভাত সংগীতকার পরম শ্রদ্ধেয় শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকারের প্রতিকৃতিতে সবাই মাল্যদান করেন, এরপর সাধারণ সম্পাদক প্রদীপ প্রজ্জ্বলন করে আনুষ্ঠানিকভাবে উৎসবের সূচনা করেন৷ তিনি তাঁর বক্তব্যে বলেন ১৯৮২ সালে পরম শ্রদ্ধেয় ‘বাবা’ প্রভাত সঙ্গীত রচনা শুরু করার সময় তিনি অষ্ট্রেলিয়ায় ছিলেন৷ ‘বাবা’র সঙ্গীত রচনার সঙ্গে সঙ্গেই সারা পৃথিবীতে সমস্ত ভাষাভাষী আনন্দমার্গীরা আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে উঠেছিলেন ও সবাই প্রভাত সঙ্গীত অভ্যাস শুরু করে দিয়েছিলেন৷ আচার্য সুতীর্থানন্দজী বললেন, তখন তিনি অষ্ট্রেলিয়ার পার্থ শহরে ছিলেন৷ ওখানকার আনন্দমার্গীরা একটা প্রভাত সঙ্গীত অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন৷ সংযোগ বশতঃ কলকাতার ‘আনন্দবাজার’ পত্রিকার এক সাংবাদিক তখন পার্থ শহরে ছিলেন৷ হঠাৎ তাঁর কানে আসে বাংলা ভাষায় গানের সুর৷ বিদেশ বিভুঁইয়ে বাংলা ভাষায় গানের সুর অনুসরণ করে অনুষ্ঠান-হলের সামনে আসেন৷ রিশেপসন অফিসে এসে বাংলা গানের অনুষ্ঠান সম্পর্কে বিস্ময় প্রকাশ করতেই অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তারা তাঁকে অনুষ্ঠান হলে নিয়ে যান৷ তিনি বিদেশীদের কন্ঠে বাংলা প্রভাত সঙ্গীত শুনে আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে উঠেন৷ পরে আনন্দবাজারে তাঁর প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়৷ তাতে অষ্ট্রেলিয়ার বাংলা প্রভাতসঙ্গীতের অনুষ্ঠান শুনে তিনি দারুণ আনন্দ ও বিস্ময়ের ভাব প্রকাশ করেন৷ এইভাবে সব দেশের আনন্দমার্গীদের মধ্যেই প্রভাতসঙ্গীত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে৷
আচার্য তন্ময়ানন্দ অবধূত তাঁর সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে সেই সময়কার বাবার সঙ্গে একটি ঘটনার কথা বলেন৷ তন্ময়ানন্দজী সন্ন্যাসী হওয়ার আগে থেকেই তবলার চর্চা করতেন৷ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তব্লাও বাজাতেন৷ বাবা যখন প্রথম প্রথম প্রভাত সঙ্গীত দিচ্ছেন, সেই সময় তন্ময়ানন্দজী একদিন ভাবলেন, বাবা যদি ক্ল্যাসিক্যাল সুরে প্রভাত সঙ্গীত দিতেন তো খুব ভাল হ’ত৷ সেদিন বাবার সামনে অনেকে বসেছিলেন৷ বাবা একজন সন্ন্যাসীকে বললেন তুমি ঠুংরিতে একটা গান গাওতো৷ সন্ন্যাসীটি বল্লেন, বাবা, আমি তো গান গাইতে পারি না ৷ বাবা তখন দৃশ্যতঃ খানিকটা বিরক্তি প্রকাশ করলেন৷ তারপর তন্ময়ানন্দজি বসেছিলেন৷ তন্ময়ানন্দজীকে বললেন, তুমি ক্ল্যাসিক্যাল সুরে একটা গান গাও৷ তন্ময়ানন্দজী বললেন, বাবা আমি তবলা বাজাই ক্ল্যাসিক্যাল সুর আমার খুবই প্রিয়, কিন্তু আমি তো গান গাইতে পারি না৷ তখন বাবা দৃশ্যতঃ বিরক্তি প্রকাশ করে একটু গম্ভীর হয়ে গেলেন৷ এরপর বাবা নিজেই মালকোষ সুরে আলাপ শুরু করলেন৷ তন্ময়ানন্দজী বললেন, আমি তো বাবার কন্ঠে অত্যন্ত সুমধুর সুরে এই আলাপ শুণে আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠলুম৷ বাবা এবার থেমে তন্ময়ানন্দজী দিকে তাকালেন৷ তন্ময়ানন্দজী আবেগ তাড়িত হয়ে বলে উঠলেন, এইটাই তো মালকোষ সুর বাবা, দারুণ ভাল লাগছে৷ বাবা একটু মুচকি হাসলেন বললেন, আমিও তাহলে একটু আধটু মালকোষ জানি৷ কী বল!
এরপর বাবা একের পর এক বিভিন্ন ভাব, ভাষা, সুর ও ছন্দে প্রভাতসঙ্গীতের ডালি পূর্ণ করে চললেন৷ এইভাবে ধ্রুপদী, ঝুমুর, বাউল, টপ্পা, গজল, কীর্ত্তন প্রভৃতি সুরের পাশাপাশি পার্সিয়ান, চাইনিজ, ইজরায়েলী,স্ক্যাণ্ডিনেভিয়ান, আইবেরিয়ান সুরেও বাবা গান দিয়েছেন ৷ এমনকি আড়াই হাজার বছর আগে লুপ্ত হওয়া বৌদ্ধ সুরও তিনি বাদ দেননি৷ সমস্ত সুর মিলেমিশে প্রভাত সঙ্গীতের ঝর্ণাধারায় এক অপূর্ব সিঞ্জিন সৃষ্টি হয়েছে৷
প্রভাত সঙ্গীত ও প্রভাত সঙ্গীতের স্রষ্টার ওপর সংক্ষিপ্ত আলোচনার পর রাওয়া (রেণেশাঁ আর্টিষ্ট এ্যণ্ড রাইটার্স এ্যাসোসিয়েশন) শিল্পিদের দ্বারা প্রভাত সঙ্গীতের বিপুল ভাণ্ডার থেকে কয়েকটি সঙ্গীত পরিবেশন ও কিছু সঙ্গীতের ওপর নৃত্য পরিবেশনের মাধ্যমে এদিনের প্রভাত সঙ্গীত উৎসব আনন্দমূখর হয়ে ওঠে৷ প্রভাত সঙ্গীত পরিবেশন করেন এককভাবে আচার্য প্রিয়শিবানন্দ অবধূত, শুভেন্দু দাশ, অসিতিমা দেবনাথ, কণিকা দেবনাথ, শুভঙ্কর হালদার ও শিশু শিল্পী দিব্যজ্যোতি রায়৷
এছাড়া অবধূতিকা আনন্দ অভীষা আচার্যা ও কলকাতার ভুক্তিপ্রধান শ্রীমতী সুনন্দা সাহার পরিচালনার সমবেত কন্ঠেও প্রভাত সঙ্গীত পরিবেশিত হয়৷
প্রভাত সঙ্গীত অবলম্বনে বেশ কয়েকটি নৃত্য পরিবেশন করে নরেন্দ্রপুর আনন্দমার্গ শিশুসদনের মেয়েরা, তারা সমবেত কন্ঠে প্রভাত সঙ্গীত পরিবেশন করে ও দর্শকদের আনন্দ দেয়৷ উৎসব শেষে সবাই প্রসাদ গ্রহণ করেন৷