আনন্দনগর, পুরুলিয়া ঃ আন্তর্জাতিক নববর্ষ উপলক্ষ্যে গত ১লা, ২রা ও ৩রা জানুয়ারী ২০২০ এই তিন দিন ধরে আনন্দনগরে মহাসমারোহে ধর্মমহাসম্মেলন অনুষ্ঠিত হ’ল৷ পাহাড়–নদী ঘেরা সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশে উৎসাহী হাজার হাজার আনন্দমার্গীর যোগদানের মধ্য দিয়ে আনন্দমার্গের কর্মকেন্দ্র আনন্দনগরে তিনদিনের বিশাল ধর্মমহাসম্মেলন সুসম্পন্ন হ’ল৷ সংঘের অধিকাংশ কর্মী ও দেশের বিভিন্ন প্রান্তের হাজার হাজার আনন্দমার্গী সদস্যরা এই ধর্মমহাসম্মেলনে যোগ দিয়ে ধর্মমহাসম্মেলনটি সাফল্যমণ্ডিত করে তোলেন৷ এছাড়া বহির্দেশের ভক্তমার্গীরাও সম্মেলনে যোগ দেন৷ দেশের ও বহির্দেশের মার্গীদের যোগদানে মহাসম্মেলন আনন্দমুখর হয়ে ওঠে৷ তাঁদের সম্মিলিত কীর্ত্তন–ভজনে আনন্দনগরে এক স্বর্গীয় পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছিল৷ মনোরম আধ্যাত্মিক পরিবেশে অনুষ্ঠানের প্রতিদিন সকাল ও সন্ধ্যায় আনন্দমার্গের পুরোধা প্রমুখ আচার্য কিংশুকরঞ্জন সরকার মার্গগুরুর প্রতিনিধি হিসেবে আধ্যাত্মিক প্রবচন দেন৷
তিনি বলেন–মনকে তার পরম লক্ষ্যকে সামনে রেখে ঠিক রাস্তায় পরিচালিত করতে হবে৷ যদি আমরা তা না করি–যদি পরমপুরুষের সৃষ্টিধারার গতির বিরুদ্ধে চলি তাহলে মহতী বিনিষ্ট ঘটবে৷ মানুষ আবার পশুর স্তরে নেবে যাবে৷ সৃষ্টিধারাতে জড় বস্তু প্রাণাঃ (vital energy)তে রূপান্তরিত হয়ে ধীরে ধীরে এককোষী প্রাণী থেকে বহুকোষী প্রাণী হয়ে আর বিকশিত হয়ে উদ্ভিদ কীট –পতঙ্গ, পশু জীবন লাভ করার পর মানুষ হয়েছে৷ প্রতিসঞ্চর ধারায় স্বাভাবিক গতিতে জড় সত্তা মানবের স্তরে এসেছে৷ প্রাকৃতিক শক্তি তাকে মানবের স্তরে এনে দিয়েছে৷ এই প্রাকৃতিক শক্তির দ্বারা আর উন্নতি সম্ভব নয়৷ এখন মানুষের মনের সম্যক বিকাশ ঘটেছে৷ মনের বিচার বুদ্ধি এসেছে৷ মনের এই বিচার বুদ্ধিকে ঠিকভাবে পরিচালিত করে মানুষকে এগিয়ে চলতে হবে৷
পরমপুরুষই জীবনের পরম লক্ষ্য৷ পরমপুরুষ থেকে সবাই এসেছে আর একদিন সবাইকে পরমপুরুষে মিশে যেতে হবে৷ এই পরমপুরুষে মিশে যাওয়াই চরম গতিলাভ–একেই বলে পরমাগতি৷ তাই মানুষকে থেমে থাকলে চলবে না৷ গুরু–শক্তির সাহায্যে নির্ধারিত বিধি–বিধান মেনে প্রতিসঞ্চর ধারার পথ ধরে পরিশেষে পরমপুরুষে মিলে যেতে হবে৷ এটাই হ’ল মনকে ঠিক পথে পরিচালিত করা৷
যেখানে নিয়ম–কানুন বিধি–ব্যবস্থা থাকবে সেখানে একটা কেন্দ্রবিন্দু থাকবেই৷ আমরা যে এই নিয়ম–কানুন মেনে চলি এর কেন্দ্রবিন্দু হলেন গুরু৷ সৌরজগৎ এক বিশেষ নিয়মে চলে চলেছে৷ তাই এই সৌরজগতেরও কেন্দ্রবিন্দু আছে৷ তা হ’ল সূর্য৷ সূর্যকে কেন্দ্র করেই গ্রহ–উপগ্রহ ঘুরে চলেছে৷ তেমনি এই সৃষ্ট জগতের সঞ্চর–প্রতিসঞ্চর ধারার আবর্তন আছে৷ সঞ্চর প্রতিসঞ্চর ধারার কেন্দ্রবিন্দু আছে৷ এই কেন্দ্রবিন্দু হলেন পরমপুরুষ বা পরমাত্মা৷ আবার গতিশীল কোন কিছুর কেন্দ্র থাকতে হলে সেখানে শক্তিও থাকতে হবে৷ সৃষ্টির পেছনে যে শক্তি কাজ করছে তাকে শাস্ত্রে বলা হয় প্রকৃতি৷ এই প্রকৃতি– শক্তির সাহায্যে সঞ্চর–প্রতিসঞ্চর ধারা হয়ে চলেছে৷
এখন এই সঞ্চর ধারাতে যে শক্তি কাজ করছে তাকে বলা হয় অবিদ্যা মায়া৷ অর্থাৎ যা কেন্দ্র থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যায়৷ এই অবিদ্যা মায়ার দুটি রূপ৷ (১) বিক্ষেপী শক্তি ও (২) আবরণী শক্তি৷ বিক্ষেপী শক্তি হ’ল যা কেন্দ্র থেকে দূরে নিক্ষেপ করে৷ আর আবরণী শক্তি হ’ল যা ঠিক, যা সত্য তাকে ঢেকে রাখে৷ যার ফলে মানুষ সত্যকে জানতে পারে না৷ এই অবিদ্যা মায়াতে মানুষ ফেঁসে যায় ও তার ঠিক চলার রাস্তা থেকে বিচূ্যত হয়ে যায়৷
প্রতিসঞ্চর ধারাতে যে শক্তি কাজ করছে তা হ’ল বিদ্যা শক্তি৷ এ শক্তির কাজ হ’ল কেন্দ্রের দিকে চলা৷ তাই একে কেন্দ্রানুগা শক্তি বলে৷ এই শক্তির দুটি রূপ–
(১) সম্বিৎ, (২) হ্লাদিনী৷ যেমন মানুষ মানুষের শরীর পেয়েছে, উন্নত মন পেয়েছে কিন্তু অবিদ্যার প্রভাবে পড়ে কুকর্ম করে চলেছে৷ মানবোচিত কাজ করছে না৷ হঠাৎ তার মনে হ’ল–মানুষ হয়ে মানুষের মত কাজ না করে এ কি করে চলেছি৷ না না আর এমন করব না৷ এ হ’ল ওই মানুষটির সম্বিৎ জেগে গেছে৷ আর হ্লাদিনী শক্তি–ওই শক্তির প্রভাবে সাধনার মধ্যে আনন্দ অনুভূতি লাভ করতে থাকে৷ যতই যে সাধনা করতে থাকে আনন্দ অনুভূতি বৃদ্ধি পেতে থাকে৷ যতই সে সাধনা করে আর আনন্দের অনুভূতি পেতে থাকে – এরই আকর্ষণে সে পরমপুরুষের দিকে এগিয়ে চলতে থাকে ৷ এইভাবেই মানুষ একদিন পরমপুরুষকে পেয়ে যাবে৷ হ্লাদিনী শক্তি মানুষকে মানসিক জগৎ থেকে আধ্যাত্মিক জগতে পৌঁছে দেয়৷
তাই মানুষকে সচেতন হয়ে পথ চলতে হবে৷ যেন সে অবিদ্যার প্রভাবে পড়লে তাকে কাটিয়ে উঠে এগিয়ে চলতে পারে বিদ্যাশক্তির সাহায্যে৷ অবিদ্যার প্রশ্রয়ে থাকলে মানুষের অধঃপতন ঘটে৷ আর জীবনে আসে মহতী বিনষ্টী৷ তাই জীবনের পরম লক্ষ্য সম্পর্কে সচেতন থেকে পথ চললে আমরা ঠিক জায়গায় অর্থাৎ পরমপুরুষের কোলে পৌঁছে যাব৷
প্রতিদিন সন্ধ্যায় আনন্দনগরে রাওয়া গোষ্ঠীর পরিচালনায় প্রভাত সঙ্গীত ও প্রভাত সঙ্গীত অবলম্বনে অনুষ্ঠিত সাংসৃক্তিক অনুষ্ঠান ও নাটক সকলকে মুগ্ধ করে৷ শীতকালীন সম্মেলনের এই দিনগুলিতে মেঘলা আকাশ, ঝিরঝিরে বৃষ্টি, শীতের প্রকোপ সত্ত্বেও মুক্ত আকাশের নীচে আনন্দনগরে নিঃসন্দেহে এক অপূর্ব সুন্দর মনোরম আধ্যাত্মিক পরিবেশ গড়ে উঠেছিল৷ তিনদিনের এই মনোরম আধ্যাত্মিক পরিবেশে কয়েক হাজার ভক্ত মার্গী ভাই–বোন ও সন্ন্যাসী দাদা–দিদিরা স্বর্গীয় আনন্দে ধর্মমহাসম্মেলনকে উপভোগ করেন৷
(পুরোধা প্রমুখ প্রদত্ত প্রবচনের সারসংক্ষেপ করেছেন আচার্য মোহনানন্দ অবধূত)