অথ খারো কাহিনী

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

কোনো নূতন শাড়ি–বাড়ি–গাড়ি আনলে অথবা হাঁড়িতে কোনো নূতন রান্না চাপালে লোকে চায় সে সম্বন্ধে অন্যে কিছু বলুক৷ কারণ নূতন অর্থে ‘কোরা’ মানেই যা ধ্বনিকে উৎসাহ দেয়৷ নূতন শাড়ি পরলে মন চাইবে প্রতিবেশিনী জিজ্ঞাসা করুন, ‘‘হ্যাঁ দিদি, শাড়িটা কবে কিনলে? কত পড়ল?’’ নূতন বাড়ি করলে ইচ্ছে জাগে, ৰন্ধু–ৰান্ধবরা বলুক, বাড়িটা ৰেশ হয়েছে৷ নূতন গাড়ি কিনলে ৰন্ধুর মুখ থেকে শুনতে চাইবে, ‘‘এটা কোন্ বৎসরের মডেল?’’ হাঁড়িতে রান্না চাপালে প্রশ্ণ অপেক্ষিতই থাকবে, ‘‘রান্না কোথায় শিখলি রে?’’

নতুনের সম্বন্ধে জানার আগ্রহ ও প্রশ্ণ পাওয়ার আগ্রহের কথা বলতে গিয়ে আমার সেই ইতিহাসপ্রসিদ্ধ খারো গ্রামের ততোহধিক  প্রসিদ্ধ ঘটনাটির কথা মনে পড়ল৷ খারো একটি বিরাট সুশিক্ষিত গ্রাম৷ কিন্তু দুষ্টুলোকে বলে থাকে, বিদ্বান হলে কী হবে, গ্রামের ৰৌদ্ধিক মান বৈদুষ্যের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগোতে পারেনি৷ যেদিন গ্রামেরপঞ্চাশৎতম ছেলেটি এম. এ. পাস করলে সেদিন গ্রামবাসীরা সর্বসম্মতিক্রমে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করেছিল যে এই উপলক্ষ্যে তারা একটি বিরাট উৎসবের আয়োজন করবে৷ পটনা থেকে লাটসাহেৰকে  আমন্ত্রণ জানানো হবে (তখন ইংরেজ আমল৷ রাজ্য ও রাজ্যপাল শব্দের প্রচলন হয়নি৷ বলা হত প্রদেশ ও প্রদেশের গভর্ণর বা ছোট লাটৰহাদুর)৷ যেমনটি ভাবা, তেমনটি কাজ ৷ খারো গ্রাম উৎসবমুখর  হয়ে উঠল৷ মিষ্টি হেসে লাটসাহেৰ সভাপতিত্ব করে গেলেন......উচ্ছ্বসিত ভাষায় খারো গ্রামের মানুষদের ঐতিহ্যের, তাঁদের বৈদুষ্যের উচ্চকণ্ঠে প্রশংসা করে গেলেন .....নিমন্ত্রিত হয়ে যেমনটি করতে হয়৷ লাটসাহেৰ বলে গেলেন, খারো গ্রাম সম্বন্ধে এদিক ওদিক দু’চারটে উল্টোপাল্টা কথা আমার কানে ভেসে আসত৷ অবশ্য সে সব কথায় আমি কখনই আমল দিইনি৷ আজ চাক্ষুষ দেখে গেলুম খারো গ্রাম সাংস্কৃতিক  দিক থেকে কত উন্নত৷ এখানকার মানুষের ৰৌদ্ধিক স্তর কত গগনচুম্বী৷ আমি রাজধানীতে ফিরেই এ সম্বন্ধে একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তি দোব যাতে সমস্ত কটু সমালোচনার শেষ নির্যাসটুকুও শূন্যে মিলিয়ে যায়৷

লাটসাহেৰ ফিরছেন৷ তিনি গাড়িতে উঠে বসলেন৷ চারিপাশে অনেক শিক্ষিত তরুণদের ভিড়৷ লাটসাহেৰকে সঙ্গে নিয়ে রাজধানী পর্যন্ত পৌঁছে দেবার দায়িত্ব যে তরুণটি নিলেন তিনি আবার ত্ত.ট্ট.–তে তেরস্পর্শ (ত্র্যহস্পর্শ৷

তাঁর সহযোগী হিসেবে ছিলেন আরও দু’টি তরুণ৷ বৈদুষ্যে তারা এ বলে আমায় দ্যাখ, ও বলে আমায় দ্যাখ৷

চারিপাশে দিগন্তবিস্তৃত কৃষিক্ষেত্র.....ফসলে মাঠ লালে লাল৷ লাটসাহেৰ শুধোলেন–ওই লাল লাল ফলগুলি কী? সকলেই উৎসাহের সঙ্গে বলে উঠলেন–মরচাই......মরচাই (লঙ্কা,......লঙ্কা৷ হিন্দীতে ‘মীর্চ্’)৷

লাটসাহেৰ বললেন–বা ভারী সুন্দর দেখাচ্ছে তো তরুণেরা সমস্বরে ড্রাইভারকে বললেন–একটু থেমে যান ড্রাইভার সাহেৰ৷

তাঁরা সবাই মাঠের দিকে ছুটলেন৷ যিনি যতটা পারলেন লঙ্কা তুলে এনে বস্তাবন্দী করে লাটসাহেৰের পাশে রেখে দিলেন৷ বললেন–আমাদের অঞ্চলের লঙ্কা বিশ্ববিখ্যাত৷ ভারতের ও বহির্ভারতের নানান জায়গায় এই লঙ্কা গিয়ে থাকে৷ আপনি যে দয়া করে আমাদের গ্রামে এলেন ও দয়া করে লঙ্কাগুলোকে দেখলেন এতে এদের ‘লঙ্কা’ নাম সার্থক হ’ল৷ রাজধানী কিছুটা দূরের পথ৷ পথে কিছুটা একঘেয়েমি লাগতে পারে৷ এই টুকটুকে লাল লঙ্কাগুলো সঙ্গে দিলুম৷ যখনই মন চাইবে টুকটাক করে মুখে ফেলতে ফেলতে যাবেন৷ পথের ক্লান্তি এতে দূর হবে৷

লাটসাহেৰ বিস্ফারিত নেত্রে তাকিয়ে রইলেন৷

  *              *          *           *

এই সেই ইতিহাসপ্রসিদ্ধ খারো গ্রাম৷ সেই গ্রামের নূতনের পরিচিতি সম্বন্ধে একটা গল্প মনে এল৷

গ্রামের ৰর্দ্ধিষ্ণু কর্ষক ও সুশিক্ষিত মার্জিতরুচি তরুণ শ্রীভূতনারায়ণ সিং মহাশয় তাঁর ৰন্ধু শ্রীভূতনন্দন সিং–এর সঙ্গে আলোচনা করে স্থির করলেন–তাঁদের গ্রাম এত উন্নত, কিন্তু গ্রামে কারো ঘড়ি নেই ৷ একটা ঘড়ি না কিনলে গ্রামের মর্যাদাই থাকে না৷ যেমন ভাবা তেমনি কাজ৷ সিংজী কিছুটা জমি বেচে ৫০০০ টাকা নিয়ে কলকাতায় এলেন৷ ঘড়িওয়ালাকে বললেন–এই ৫০০০ টাকা দিচ্ছি৷ তোমার দোকানের সর্বশ্রেষ্ঠ ঘড়িটি আমি কিনতে চাই৷

দোকানদার খদ্দেরের  নাড়ীর গতি ভালভাবে ৰুঝে নিলেন৷ তিনি দোকানের সর্বশ্রেষ্ঠ একটা ছোট আকারের ঘড়ি সিংজীর হাতে তুলে দিলেন৷

সিংজী তাতে সন্তুষ্ট হবেন কেন তিনি দেখলেন, দোকানে ওই ঘড়িটির চেয়ে অনেক ৰড় ৰড় ঘড়ি রয়েছে৷ তিনি বললেন–৫০০০ হাজার টাকা দিয়ে এত ছোট আকারের ঘড়ি নিতে যাব কেন? সবচেয়ে ৰড় ঘড়িটি আমার পাওয়া উচিত৷

দোকানদার সেই সময়কার বাজারের সবচেয়ে সস্তা দামের হাতঘড়ি সিংজীর হাতে তুলে দিয়ে বললেন, এই ঘড়িটি থেকে আপনি দুই ধরনের কাজ পাবেন৷ প্রথমতঃ এতে সময় দেখতে পারবেন দ্বিতীয়তঃ প্রয়োজনবোধে ঘড়িটিকে ঢ়িলের মত ব্যবহার করে আঁৰ পাড়তে পারবেন৷ সিংজী তো মহা খুশী৷

সিংজী যথাসময়ে খারো গ্রামে ফিরে এলেন৷ দিবারাত্র........অষ্টপ্রহর.......চব্বিশ ঘণ্টা ঘড়ি পরে ঘুরে ৰেড়ান৷ যেখানেই দু’চার জনকে দেখেন পাঞ্জাবীর হাত গুটিয়ে সেইখানে গিয়ে পৌঁছেন৷ কিন্তু সিংজীর মন্দ ভাগ্য কেউ কখনও জিজ্ঞেস করে না–হ্যাঁ সিংজী, ঘড়িটা কবে কিনলেন?

একদিন শেষ রাতে সিংজী নিজের বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিলেন৷ আগুন দেখে পাড়া প্রতিবেশীরা তো এলেনই, এমনকি ভিন্ গাঁয়ের মানুষও ছুটে এল আগুন নেবাতে৷ বাড়ির চারি পাশে মানুষের ভীড়৷ ও ধরনের জায়গায় দমকলের কোনো ব্যবস্থা ছিল না৷ তাই তখন শুধু শোনা যাচ্ছিল কতকগুলি ধবনি ঃ–আগুন–ওদিকে–এদিকে–বালতি–জল–আয়–যা ইত্যাদি, ইত্যাদি৷

                সিংজী যেখানেই দেখছেন ৪৷৫ জন লোক জড়ো হয়েছেন তিনি দৌড়ে সেখানে গিয়ে পৌঁছোচ্ছেন৷ নিজের ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে বলছেন–আগ লগীথী পাঁচ বাজকে পঁচপন মিনিট মে৷ ইয়হ্ ঘড়ি টাইম্ বী দেতী হৈ, ইস্সে আম ভী তোড়ে জা শকতে হৈ৷ সেখানে কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখে তিনি আবার আর একটা জটলার দিকে ছুটে যাচ্ছেন আর ওই  কথাই বলছেন৷ এদিকে আগুন যে নিবে এল শেষ প্রয়াস হিসেবে সিংজী দৌড়োতে দৌড়োতে আর একটা জটলার দিকে পৌঁছোলেন আর চীৎকার করে বলতে লাগলেন–আপনারা শুনেছেন আগুন লেগেছিল ৫টা বেজে ৫৫মিনিটে৷ এই ঘড়ি কত সুন্দর সময় দেয় কী বলব এ দিয়ে আবার আঁৰও পাড়া যায়......আগ লগী থী ৫ বাজকে ৫৫ মিনিট মে৷ ইয়হ্ ঘড়ি টাইম বী দেতী হৈ, আম ভী তোড়ে জা শকতে হৈ৷ হঠাৎ ভিড়ের মধ্যে থেকে কে একজন বলে উঠল–আরে ঘড়ি কবে কিনলি?.....আর একজন বললে–কোত্থেকে কিনলি?.....আর একজন বললে–কত দাম পড়ল?......আর একজন বললে–ভারী সুন্দর তো

ৰাবু ভূতনারায়ণ সিং নিজ শিরে করাঘাত করে বললে–ইয়হ্ ৰাত অগর পহ্লে ৰোলতে তো কোন ৰুদ্ধু আগ লগানে জাতা৷

এই সেই ইতিহাসপ্রসিদ্ধ খারো গ্রাম৷