অসমের বাঙালীদের দুর্দশা, নির্য্যাতন, হত্যা আর কত সহ্য করা যায়? অথচ ১৮৭৪ সালে বাঙলার অঞ্চল বৃহৎ, এই অজুহাতে তৎকালীন ইংরেজ সরকার এই এলাকার উত্তর পূর্বাংশ যথা ধুবড়ি, গোয়ালপাড়া, মিকির পাহাড়ের সমতল অংশ, বড়পেটা, লামডিং, হোজাই, লংকা ইত্যাদি এলাকা কামরূপ-জেলার সাথে জুড়ে দিয়ে অসম প্রদেশ ঘটন করে৷ শুধু তা-ই নয়! ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ আইন চালু করেন লর্ড কার্জন৷ কিন্তু হিন্দু-মুসলমানের মিলিত আন্দোলনে ব্রিটিশ সরকারের টনক নড়ে৷ দেখা যায়---তাদের ভাগ করে ভোগ করার’ রাজনীতিতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়৷ ক্ষুদিরাম ও এক দল যুবক চরমপন্থা অবলম্বন করে৷ বিচারে ক্ষুদিরামের ফাঁশী হয় ১৯০৮ সালে৷ তাই ওরা ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ আইন ‘রদ’ করে৷ এবার ১৯১২ সালে ‘হাতে মারতে পারি না---তো ভাতে মারি’ নীতিতে (১) কলিকাতা থেকে ভারতের রাজধানী দিল্লীতে স্থানান্তরিত করে (২) অসম ঘাটতি অঞ্চল বলে শ্রীহরির ১২টি থানা এলাকা কাছাড় জেলা নাম দিয়ে অসমের সাথে জুড়ে দেওয়া হয় যা বর্ত্তমানে করিমগঞ্জ,হাইলাকান্দি ও (শিলচর) কাছাড় জেলায় বিধৃত৷ (৩) খনিজ অঞ্চল বিশেষত লৌহ আকরিক সমৃদ্ধ অঞ্চল যথা উত্তর বালেশ্বর, উত্তরপূর্ব ময়ূরভঞ্জ, উত্তর কেওনঝাড় ও পূর্ব সুন্দরগড় ইত্যাদি অঞ্চলকে জুড়ে দেয় ওড়িষ্যার সাথে৷ (৪) সিংহভূম, ধানবাদ, দিল্লি,সোনাহাতু, তামার, জামতাড়া, দুমকা, গোড্ডা, দেওঘর, পাকুড়, রাজমহল, পলাশী---ইত্যাদি অঞ্চল কয়লা, লৌহ আকরিক, তামা, এলুমেনিয়াম সমৃদ্ধ জুড়ে দেওয়া হয় বিহারের সাথে যা বর্ত্তমানে ঝাড়খণ্ড রাজ্যের আওতায়৷
(৫) বাঙলা থেকে কেটে ছেঁটে নেওয়া এলাকাগুলিতে বাংলা মাধ্যম স্কুলগুলি বন্ধ করে বাঙালীর ভাষা, কৃষ্টি, সংস্কৃতিও কেড়ে নেওয়া হয়৷
সিংভূম জেলার শতকরা ৯৬ জন অধিবাসী বাঙালী৷ ধলভূম খনিজ, বনজ সম্পদে ভরপুর৷ পটমদা, চাণ্ডিল, ইছাগড়, চন্দনকেয়ারীর কয়লাখনি বিখ্যাত৷ জামসেদপুর শিল্পনগরী৷ এখানকার শতকরা ৮৮জন বাঙালী৷ (১৯৩১ সালের আদমনুসারী রিপোর্ট)৷ বর্তমানে ঝাড়খণ্ড রাজ্যের ২৭শতাংশ আদিবাসী৷ বাকীদের অধিকাংশই বাঙালী৷ তাই বাংলা ঝাড়খণ্ডের অন্যতম প্রধান সরকারী ভাষা৷
অসমের বর্তমান আয়তন---৭৮,৫২৩ বর্গকিমি৷ তারমধ্যে ১৮৭৪ আর ১৯১২ সালে কেটে নেওয়া হয়েছে বাঙলার অঞ্চল---৩৮,১০৪ বর্গ কিমি বা প্রায় অর্ধেক৷ বাঙলার অঞ্চল ঘনবসতিপূর্ণ৷ তাই আজও অসমে বাঙালীরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ৷ অথচ অসমে বাঙালীদের দুর্দশার অন্ত নেই৷ ২০১৪ সালে সেখানে নূতন বিজেপি সরকার হবার পর বলছে---বাঙালীরা বাংলাদেশী৷ বাঙালীদের সেখানে ডি-ভোটার করে তাদের রাজনৈতিক ও অন্যান্য অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে৷ রাখা হচ্ছে ডিটেনশন ক্যাম্পে৷ হায়৷ কী অবিচার!
এসবের কারণ কী? কারণ, ১৯১১ সালে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে বিলাতে ভারতের ব্রিটিশ সচিবের কাছে এক গোপন বার্র্ত পাঠানো হয়েছিল--- তাতে বলা হয়েছিল---
‘‘ভারত ভূখণ্ডে বাঙালীর রাজনৈতিক প্রভাব ক্রমেই বিপজ্জনক হয়ে উঠছে৷ বাঙালীরা ভারতের অন্যান্য প্রদেশে অধিবাসীদের মধ্যেও বিদেশী শাসনের বিরুদ্ধে অসন্তোষ ছড়াচ্ছে৷ এইসব কারণে কার্জনকৃত বঙ্গভঙ্গ পরিকল্পনাকে কিছুতেই বাতিল করা যায় না৷’’---(আগষ্ট ১৯১১/ সিক্রেট ডেসপ্যাব)
১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হলেও ব্রিটিশের সে পরিকল্পনা অর্থাৎ বাঙালী নির্য্যাতন আজও চলছে৷ বলা বাহুল্য, মাত্র ৭৬ বছরের (১৮৭১-১৯৪৭) মধ্যেই বাঙলার নিজস্ব আয়তনকে কেটে টুকরো টুকরো করে বাঙলাকে একটি ক্ষুদ্র আয়তন বিশিষ্ট (মূল আয়তনের আটভাগের এক ভাগ) রাজ্যে পরিণত করা হয়৷ বঙ্গ বিভাগের সিদ্ধান্ত শুধু ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদই নেয়নি,জাতীয় কংগ্রেসের হিন্দুস্থানী নেতৃবৃন্দ, মুসলিমলীগ ও কম্যুনিষ্ট পার্টিগুলির ক্ষমতালিপ্সা ওই একই সুরে সুর মিলিয়েছিল৷
১৯৫৬ সালে ভাষাভিত্তিক রাজ্য বাঙলার অঞ্চল পুর্নগঠন হয়নি বা বাঙলাকে তার এলাকা ফিরিয়ে দেওয়া হয়নি৷ ১৮৭১ সালের বাঙলার অঞ্চল ছিল ৪,৩৫,৪৭১ বর্গ কিমি৷ বর্ত্তমানে (২০১১ সালে) অর্থাৎ ১৪০ বছরে পশ্চিমবঙ্গে শুধু---৮৮,৭৯২ বর্গ কিমি আছে৷ অন্যান্য স্থানের সঙ্গে ১৯৪৭ সালের ভারত ভাগ করে দ্বিখণ্ডিত ভারতের স্বাধীনতা লাভে-১,৪৩,৯৯৮ বর্গ কিমি চলে যায় পূর্ব পাকিস্তান তথা বর্ত্তমান বাংলাদেশে৷
প্রতিবেদনের এই স্বল্প পরিসরে উল্লেখ্য জার্র্মন দেওয়াল ভেঙ্গে দুই জার্র্মন একত্র হয়েছে৷ ১৯৮৮ সালের ৮ই সেপ্ঢেম্বর আনন্দবাজার পত্রিকা প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানা যায় মিজোরামের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ব্রিগেডিয়ার টি সাইলো বলেছেন---‘বাঙালীরাও আমাদের এই আন্দোলন থেকে দুই বাংলা একীকরণ দাবি তুলতে পারেন৷ তাঁদের সেই বিশ্বাস, আগামী ৫০ বছরের মধ্যে দুই বাংলার মিলন হয়ে যাবে৷
পরিবেশ পরিস্থিতি যা দেখা যায়--- এছাড়া বোধহয় বাঙালীদের আর গত্যন্তর নেই৷ কিন্তু, বাঙালীদের সমস্যা, যন্ত্রণা-নিজেরা বুঝলে তো! আর দাবী আদয়ে সক্রিয় হলে তো!
- Log in to post comments