১) ১৫ই আগষ্ট ১৯৪৭, রাত্রির দ্বিতীয় প্রহর৷ সদ্য দায়িত্বভার গ্রহণ করা ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জহরলাল নেহেরু অত্যন্ত জরুরী কর্মবোধে কতগুলো নির্দেশনামায় সই করলেন--- যার অধিকাংশই সুদীর্ঘফলার ছুরি হয়ে বাঙলা ও বাঙালীর বুকে আমূল বিঁধে গেল৷ যেমন কয়েকটি উল্লেখযোগ্য হল ---
(ক) ব্রিটিশ ভারতে সিংহভাগ বৈদেশিক মুদ্রা আসত পাট ও পাটজাত দ্রব্য রপ্তানি থেকে৷ স্বাভাবিক নিয়মে বাঙলা তার একটা অংশ পেত৷ বাঙালী বিদ্বেষী পশ্চিমা বাদামী পুঁজিপতিদের স্বার্থে ও ইন্ধনে পণ্ডিত নেহেরু এক কলমের খোঁচায় তা বাতিল করে দিলেন৷
(খ) বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের আর একটি বড় ক্ষেত্র ছিল চা রপ্তানি৷ স্বাভাবিক নিয়ম অনুযায়ী বাঙলা তার লভ্যাংশ পেত৷ পণ্ডিতজী ওই মধ্য রাতে সেটাও বাতিল করে দিলেন৷
(গ) কয়লা ও লৌহ আকরিক বাঙলার বাইরে নিলে বাঙলা একটা রয়্যালটি পেত, নেহেরুজী মাসুল সমীকরণ নীতি চালু করে তা রদ্ করে সারা ভারতে একদর করে দিলেন৷ অথচ বাঙলায় তুলো অন্যান্য বর্হিবাঙলার পণ্য আনার ক্ষেত্রে ওই সমীকরণ নীতি প্রয়োগ না করে বাড়তি কর চাপান হল, বৈষম্যের শিকার হল বাঙলা৷
২) খণ্ড বিখণ্ড বাঙলার বুকে আরো দুটো বড় খণ্ড তৈরী হল পশ্চিমবঙ্গ ও পূর্ব পাকিস্তান৷ অথচ ১৯৪৬ পূর্ব জাতীয় কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশনে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল যে স্বাধীনতার পর বাঙলার অঞ্চল বাঙলাকে ফিরিয়ে দেয়া হবে৷ ফিরিয়ে দেয়া তো দূরে থাক, ৪৭ এ আবার বাঙলা ভাগ করা হল৷
৩) ১৫ই আগষ্ট,১৯৪৭ এর পূর্ব পর্যন্ত প্রায় সব বিভাগে সারা ভারতের মধ্যে বাঙলা ছিল ১ নম্বর, ১৫ই আগষ্ট মধ্যরাত থেকে নামতে নামতে এখনও সেই এক নম্বরেই৷ অবশ্য শেষের দিক থেকে৷ ‘‘বর্তমান’’ বাঙলা দৈনিকে এ প্রকাশ বাকী ভারতের সঙ্গে অর্থনৈতিক, কর্মসংস্থান, ঝকঝকে রাস্তাঘাট, মডেল টাউন, স্যাটেলাইট টাউনশিপ ইত্যাদি নির্র্মণের প্রতিযোগিতায় ৭৫ বছর ধরে আমাদের পিছিয়ে পড়ার অন্যতম কারণই দেশ বিভাগ৷
৪) ১৫ই আগষ্ট বাঙালীকে গোদের ওপর বিষফোড়ার মত কতগুলো হাড় হিম-করা শব্দব্রহ্ম, উপহার দিয়েছে৷ যথা কলোনি, ক্যাম্প, রিফিউজি, রিলিফ, পুনর্বাসন, পূর্ববঙ্গ উদ্বাস্তু সরকারি কর্মচারি সংঘ, বাস্তুহারা মহিলা শিল্পকুঠি, চৌহাটি কলোনি কেন্দ্রীয় সমিতি, ইষ্টবেঙ্গল ষ্টল মালিক ফেরিওয়ালা সংঘ, দক্ষিণেশ্বর উদ্বাস্তু ব্যারাক, বিক্রমপুর বাস্তুত্যাগী সংঘ, বাস্তুহারা মঙ্গল সমিতি, প্রফুল্লচন্দ্র পুনর্বাসন সমিতি, সুন্দরবন জি প্লট, সুচেতনা কলোনি, রাণাঘাট কুপার্স ক্যাম্প, ধুবুলিয়া উদ্বাস্তু শিবির, মানা ক্যাম্প, সাবিত্রী কলোনি, বৃন্দাবন কলোনি, বীরভূমের মরাদিহি- বামনি-বাল্যশ্রম্য-তিলপাড়া উদ্বাস্তু কলোনি ইত্যাদি৷ উৎপত্তি?---দেশভাগ (সূত্র বর্তমান)
৫) ১৫ই আগষ্ট বাঙালীর মাথায় একটা নোতুন পালক গোঁজা হল, পালকটির নাম, পেনাল্টি বক্সের ফুটবল৷ আর তার চালন-দণ্ডের নাম হচ্ছে লাথ্৷ বঙ্গভঙ্গে বাঙালী নামধ্যেয় পেনাল্টি বক্সের ফুটবলটি ওপার বাঙলা থেকে লাথ খেয়ে পড়ল এপার বাঙলায়, আবার এপার বাঙলা থেকে লাথ খেয়ে পড়ল গিয়ে ওপার বাঙলায়৷ তবে ব্রিটিশসাম্রাজ্যবাদের্ তক্তপোষ হিন্দিসাম্রাজ্যবাদ পেনাল্টি বক্সের ফুটবলএ চালন-দণ্ডের পীড়ন ও তার পড়ন-এ সমাপ্তি ঘোষণা তো দূরের কথা, ইনজ্যুরিব্রেকও দেয়নি৷ চরৈবেতি সিগনালটা আজো সবুজই আছে৷ তাই আসাম, ত্রিপুরা, বিহার, ওড়িষা, ঝাড়খণ্ড, মিজোরাম, মণিপুর, দিল্লী, মুম্বাই সর্বত্রই বাঙালীর ওপর লাথ নামক চালন দণ্ড সগৌরবে রাজ করছে৷ সাম্রাজ্যবাদের এই পীড়ন ও পড়ন লীলা দেখে উদ্বৈজক বাঙালী কবির কন্ঠে বাজল---পদ্মাপাড়ে মার খেলি, তুই গঙ্গাপাড়েও খেলি/ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে এসে রক্তে ভেসে গেলি৷/ বৈতরণীর পাড়ে তোদের হবে কিরে হাল / তাইতো বসে মহাশূন্যে ভাবছে মহাকাল৷