ভারতীয় রাজনীতির কর্কট ব্যাধি

লেখক
একর্ষি

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

আধ্যাত্মিকতা রসের রসিক নাহলে উদার চিত্ততার ফলনটা কেমন? একটি দৃষ্টান্ত---১৯০৫ সাল৷ বঙ্গভঙ্গ রোধ করতে  হিন্দু-মুসলিম মিলন ও সমবেত আন্দোলনের পক্ষে---হিন্দু-মুসলিম ভাই ভাই হিন্দু মুসলিম মানিনা বাঙালী ছাড়া জানিনা ইত্যাদি অনেক বড় বড় কথা ও উদার চিত্তের ফুলঝুরি ছুটিয়ে এক সভা থেকে ফিরে দাওয়ায় বসে দুই স্বদেশী নেতা-বন্ধু একজন হিন্দু, ওপর জন মুসলমান৷ ইতোমধ্যে হিন্দুনেতার পিপাসা পেল৷ এক গেলাস জলও এল৷ হিন্দু নেতা জলের গেলাসটা মুখে লাগিয়ে পান করতে যাবেন হঠাৎ খেয়াল হল পাসে বশে স্বদেশী কিন্তু সে যে মুসলমান! থমকে গেলেন, মুসলমান স্বদেশীকে বললেন--- তুই দাওয়া থেকে নেমে যা, আমি জল খাব,তোর ছোঁয়া লাগবে! মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন? কিংবা ধরা যাক গল্পের ভূততাত্ত্বিকের  ভূতে বিশ্বাসের কথা জনমানব শূন্য এলাকার পড়োবাড়িতে দিনের বেলায় অভিযাত্রী বন্ধুদের আলোচনা সভায় ভুত নেই বলে গলা ফাটিয়ে যুক্তির বিষ্ফোরণ, আর রাতের বেলায় গা-ছম্‌-ছম্‌ ভৌতিক পরিবেশে ছাদের একপ্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে কিছু গড়িয়া যাওয়াকে ওই একই লোক বলে---ভূতে গড়াগড়ি খাচ্ছে৷ সবাই চেপে ধরলে সে বলেন---দিনে যেটা বলেছি সেটা ছিল আমার যুক্তির কথা, এখন যেটা বলছি এটা আমার দৃঢ় বিশ্বাসের কথা, ভুত আছে, ছাদে ওটা ভূতই! এটাই বাস্তব৷

তাই সঙ্গত ভাবেই রাজনৈতিক মঞ্চ আধ্যাত্মিকতায় আধারিত নাহলে সামগ্রিক দৃষ্টি বা সংশ্লেষণাত্মক দৃষ্টিভঙ্গী গড়ে ওঠে না, জগতের মানুষের প্রকৃত কল্যাণ করা যায় না, প্রকৃত সমাজসেবী ও হওয়া যায় না৷ রাষ্ট্র-সমাজ-রাজনীতি কল্যাণকামী হতে পারে না৷ সকল স্তরের মানুষকে যে অমৃতস্য পুত্রাঃ মানুষ বলে, মানতে শেখেনি সে মানুষের  প্রকৃত কল্যাণ করবে কী  করে? বলাবাহুল্য আধ্যাত্মিকতা বর্জিত সেবা-পরিষেবা-হিতৈষণা আসলে কোন অভিষন্দি, ধান্দা বা আকাঙ্খা পূরণের বিনিয়োগ (ইনভেষ্টমেণ্ট)৷ কিছু কিছু ক্ষেত্র ছাড়া রাজনৈতিক মঞ্চ থেকে জনসেবার লক্ষ্য নির্বাচন বৈতরণী পার হওয়ার বোটব্যাংক তৈরী করা, ধর্মমতের ধবজাধারীদের লক্ষ্য নিজেদের ধর্মমতের প্রসার ঘটানো৷ তথাকথিত সমাজসেবী ও সমাজসেবী প্রতিষ্ঠানের  উদ্দেশ্য অধিকাংশ ক্ষেত্রে খ্যাতি, কোন পরিচয়ে প্রসার, শংসাপত্র, বা কোন গোপন পরিচয় আড়াল করা৷ কিন্তু আধ্যাত্মিকতায় সমুন্নত মানুষের কাছে জনসেবা ধর্মসাধনার  অপরিহার্য অঙ্গ, নিঃস্বার্থ--- জীবনের ব্রত---‘আত্মমোক্ষার্থং জগৎ হিতায় চ’’৷ কাজেই রাজনীতিকে ত্রুটিমুক্ত করতে, কল্পতরু করে তুলতে, সুষ্ঠু মানবসমাজ গড়তে ধর্মের দৃঢ়ভিত্তিটা চাই--- যার সঙ্গশ্লেষণাত্মক দৃষ্টিভঙ্গী বা কম্‌প্রিহেন্‌সিভ আউট্‌লুক পাথেয় হয়ে থাকবে৷ এই প্রসঙ্গে জানা দরকার যে প্রতিভাষিক জগতে সমাজ কল্যাণে মানব কল্যাণে বর্তমান পৃথিবীর সমস্যা জর্জর আর্থ-সমাজ -রাজনীতিক ক্ষেত্রে ওই দৃষ্টিভঙ্গীটার মধ্যে একটা সৃষ্টিসফল প্রয়োগভৌমিক দিশা রয়েছে৷ দিশাটার মন্ত্র হল--- আঞ্চলিকতার পথ ধরে বিশ্বের আঙিনায় (রিজিওনাল্‌ ইন্‌ এ্যাপ্রোচ, ইউনিবাস্যাল্‌ ইন্‌ আউটলুক)৷ চেতনাগত ভাবে ধর্মকে বিসর্জন দেওয়ায় এই প্রগতিশীল ভাবনা ভারতীয় রাজনীতিতে স্থান পায়নি, রাজনৈতিক চিন্তাধারা প্রসার লাভ করেনি, যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনতান্ত্রিক কাঠামোটাও মজবুত ভিতের ওপর দাঁড়াতে পারেনি, কেননা ভাষা, সংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র-সামাজিক ঐতিহ্য সমন্বিত অর্থনৈতিক স্বয়ম্ভরতার ব্যাপারটা ধর্তব্যের মধ্যেই আসেনি৷ ফলে প্রাদেশিকতা---বিচ্ছন্নতার বিষবাষ্পে ভারতবর্ষের অখণ্ডতা আজ চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি৷

ধর্ম শেখায় ---ব্যষ্টিজীবনে পূর্ণতা লাভ (ধর্ম-অর্থ-কাম-মোক্ষ) ও সমষ্টির বা জগতের সামূহিক কল্যাণসাধনই মানবজীবনের উদ্দেশ্য৷--- আত্মমোক্ষার্থং জগদ্ধিতায় চ৷ /জগৎকল্যাণকর্ম্মণ্ আত্মনং জুহোমি সমাজের প্রতি বা মানুষ প্রজাতির প্রতি মানুষের হিতসাধনের দায়বদ্ধতা আধ্যাত্মিকতার চেতনা ও তার অনুশীলন বা মানুষের  ধর্মসাধনা থেকেই এসেছে৷ ধর্মকে বিসর্জন দেওয়ায় এই দায়বদ্ধতা রাজনৈতিক নেতাদের ঝুড়ি ঝুড়ি প্রতিশ্রুতি, মানুষের দুঃখে কুমীরের কান্না,বোট ফুরালেই তাদের আর পাত্তা পাওয়া যায় না৷ সংক্রামক ব্যাধির মত সমাজের সর্বস্তরে এই দায়বদ্ধতার অভাব৷ পারিবারিক সম্পর্কে, কল-কারখানায় , মাঠে ময়দানে. দফতরে দফতরে, সামাজিক সম্পর্কে, রাষ্ট্র-জনতার সম্পর্কে কোথায় নয়!

আজকের ভারতের সমাজজীবনে সবচেয়ে বড় অভিশাপ হল দুর্নীতিগ্রস্ত নৈতিকতা বর্জিত রাজনীতি৷ মানবকল্যাণ তথা সমাজকল্যাণের শ্রেষ্ঠ মাধ্যম হল রাজনৈতিক মঞ্চ৷ সেই রাজনৈতিক ক্ষেত্রটাই যদি দুর্নীতির চোরাবালিতে ডুবে যায় তাহলে মানুষের আশার কী থাকল!

আধুনিকতা ও অগ্রগতির মাইলস্টোন ভেবে পশ্চিমের অনুকরণে আত্ম সুখবাদ--- জড়মুখী ভাবনা---ভোগসর্বস্ব জীবনবাদের অন্ধ অনুসরণ মানুষকে তাঁর জীবনধর্মের পথ থেকে কক্ষচূ্যত করছে৷ ফলে অনাদরে অবহেলায় অপমানিত নৈতিকতা সমাজ থেকে বিদায় নিয়েছে৷ নীতিবাদ, নীতিবাদী মানুষ সমাজে আজ ব্যাকডেটেড, বোকা, শূচীবায়ুগ্রস্ত পিউরিট্যান! অতি ছোঁয়াচে ব্যাধির মতো তা ছড়িয়ে পড়ছে সর্বত্র৷ তাই ঘুষ নাকি দোষের নয়! বাড়তি রোজগার, উপরি পাওনা, কাজ হাসিল করা লুব্রিক্যান্ট৷ হাতরে হাতিয়ে খাওয়া নাকি যুগের সঙ্গে মানিয়ে চলা৷  ঠিকাদারদের পুকুর চুরিটা ভাল লাভ,জনগণের টাকা আত্মসাৎ করাটা রাজনৈতিক পেশার অঙ্গ৷ (ক্রমশঃ)