এই মুহূর্ত্তে সারা দেশে আলোড়িত হচ্ছে হায়দ্রাবাদে ঘটে যাওয়া একটি অমানবিক আচরণের প্রতিবাদে, বিক্ষোভ আছড়ে পড়ছে হায়দ্রাবাদ ছাড়িয়ে সারা দেশে৷ বাদ যায়নি রাজধানী শহর দিল্লীও৷ দিল্লীর নির্ভয়া কাণ্ডের পর হায়দ্রাবাদ, মাঝের সময়গুলিতে এতটা তোলপাড় না হলেও এই ধরণের ঘটনা কিন্তু ঘটেছে, ভবিষ্যতেও ঘটবে৷ বিক্ষোভ আন্দোলনও চলবে৷ এটা যেন একটা রেবাজ হয়ে গেছে৷ নির্ভয়া কাণ্ডের মত ঘটনা ঘটবে৷ মানুষ ক্ষোভে পথে নামবে৷ রাজপথে মোমবাতি জ্বলবে৷ অপরাধীর কঠোর সাজার দাবী উঠবে৷ জনপ্রতিনিধিরা গণতন্ত্রের দেবালয় সংসদে দাঁড়িয়ে হুঙ্কার দেবে, তারপর যথাপূর্বম্....৷
প্রতিবাদে যাঁরা পথে নামেন তার পেছনেও এই ধরণের লজ্জাজনক ঘটনা বন্ধের আন্তরিক কামনা যতটা না থাকে তার চেয়ে অনেক বেশী সামাজিক মর্যাদার দায়বদ্ধতায় প্রতিবাদে পথে নামতে হয়, মুখর হতে হয়৷ তাই ঘটনা ঘটে, প্রতিবাদ হয়, প্রতিবাদ থেমে যায়, আবারও ঘটনা ঘটে৷ তাই সংশয় জাগে৷ যাঁরা প্রতিবাদে সরব হন তাঁরা কতখানি আন্তরিকতার সঙ্গে তা করেন৷ কতটা পবিত্র মন নিয়ে করেন৷ আন্তরিকতাহীন, চিত্তহীন এই প্রতিবাদও একদিন থেমে যায়, আবারও ঘটনা ঘটে৷ বার বার ঘটে৷ তাই সংশয় জাগে৷ যাঁরা প্রতিবাদে সরব হন তাঁরা কতখানি আন্তরিকতার সঙ্গে তা করেন৷ কতটা পবিত্র মন নিয়ে করেন৷ আন্তরিকতাহীন, চিত্তহীন এই প্রতিবাদও অসার আস্ফালন দেখিয়ে থেমে যায়৷ কবির ভাষায়---
শুচিত্ত্ব কেবল
চিত্তহীন অর্থহীন অভ্যস্ত আচার
সন্তোষের অন্তরেতে বীর্য নাহি আর,
কেবল জড়ত্বপুঞ্জ ধর্ম প্রাণহীন
ভার-সম চেপে আছে আড়ষ্ঠ কঠিন৷
এই কঠিন আড়ষ্ঠ ভেদ করে নির্মল হৃদয়ে নির্মল সমাজ গড়ার কঠিন ব্রত যদি না থাকে তো সব প্রতিবাদই হয় নিস্ফল৷
এত কথা বলার কারণ সবাই অপরাধীর কঠোরে শাস্তি চায়, কিন্তু মানুষ কেন অপরাধী হয়, কেন এই ধরণের পাশবিক আচরণ করে, তার কারণ খঁুজতে গেলে দেখা যাবে প্রতিবাদের মুখগুলো একেবারে নিষ্পাপ নয়৷ বিস্তারিত কথায় না গিয়ে ইতিহাসের দৃষ্টান্ত তুলে ধরে কিছু প্রশ্ণ করি---ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের তরঙ্গে ভীত বিদেশী শাসক ‘নীলদর্পণ’ নাটক, বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠ’, শরৎচন্দ্রের ‘পথের দাবী’ নিষিদ্ধ করেছিল৷ একথা বলার প্রয়োজন নেই যে এই বইগুলো দেশপ্রেমে সমাজকে খুব উদ্বুদ্ধ করেছিল, জীবন পণ করে অকুতোভয়ে স্বাধীনতার জন্যে ঝাঁপিয়ে পড়তে প্রেরণা যুগিয়েছিল৷ রুশ বিপ্লব, ফরাসী বিপ্লবের কথা লিখতে গিয়ে সে দেশের কবি সাহিত্যিকদের অবদানের কথা ফলাও করে ইতিহাসে লেখা হয়েছে৷ আজকের যে বিপরীতধর্মী শিল্প, সাহিত্য, চলচ্চিত্র যুব সমাজকে গ্রাস করানো হচ্ছে তার পরিণতিতে যুব সমাজ বিপথগামী হচ্ছে৷ আজকের কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, টলিউড-বলিউডের কুশীলবরা কী বলেন?বিদেশী শাসক বন্দেমাতরম্ মন্ত্রটা উচ্চারণ করা ভয়ে বন্ধ করে দিয়েছিল৷ তাই অপরাধীর কঠোর সাজা হোক, পাশাপাশি সমাজে অপরাধী তৈরীর উৎসগুলি খুঁজে বার করে বন্ধ করা হোক, তবে এ কাজ সহজে হবে না৷ কারণ পুঁজিবাদী রাষ্ট্র ব্যবস্থায় কিশোর, তরুণ সম্প্রদায়কে চটুল রসে কুরুচিকর শিল্প-সংস্কৃতিতে মাতিয়ে রেখে শোষণ চালিয়ে যাওয়া শোষকের একটা কৌশল, আজকের সাংস্কৃতিক জগৎ থেকে রাজনীতিবিদ্, নেতা মন্ত্রীদের এক বিরাট অংশ এই পুঁজিবাদী কৌশলের যাঁতাকলে বন্দী৷ মনে রাখবেন৷ দেশের অর্থনীতির বিপর্যয় যখন চরম অবস্থায় পৌঁছেছে, নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস যখন বাজারে অগ্ণিমূল্য ঠিক তখনই হায়দ্রাবাদের নক্কারজনক ঘটনা নিয়ে দেশ তোলপাড় হচ্ছে৷
সুধীজন, যাঁরা সত্যিই সমাজের এই ব্যধিগুলো দূর করে এক নির্মল পৃথিবীর স্বপ্ণ দেেেখন, কথাগুলো একটু ভেবে দেখবেন৷ হায়দ্রাবাদের ঘটনার নিন্দার ভাষা নেই, অপরাধীর কঠোর সাজা নিশ্চয়ই হোক, কিন্তু পুঁজিবাদী রাষ্ট্র ব্যবস্থায় ভদ্রবেশী মুখোশের আড়ালে যে বর্বতা লুকিয়ে আছে, তার নক্কারজনক বহিঃপ্রকাশ সমাজে ঘটবেই৷ সেটাই ঘটে চলেছে৷ পুঁজিবাদী শোষণের অবসান না হলে শুধু অপরাধীর কঠোর সাজায় সমাজ কলুষমুক্ত হবে না৷
- Log in to post comments