ভগবান শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী, কীর্ত্তন কথা ও কিছু অজ্ঞাত কাহিনি

লেখক
সমর পাল

১৯২১ সালের বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে বিহারের জামালপুরে পিতা লক্ষ্মীনারায়ণ সরকার ও মাতা আভারাণী সরকারের কোল আলোকিত করে জন্মগ্রহণ করেছিলেন প্রভাতরঞ্জন সরকার৷ সেই হিসেবে ২০২১ সাল তাঁর জন্ম শত বার্ষিকী পালন করা হচ্ছে বিবিধ অনুষ্ঠানসূচীর মাধ্যমে৷

এখন কথা হলো প্রভাতরঞ্জন সরকার কেন ‘‘আনন্দমূর্ত্তি’? সমকালের মহা সত্যস্রষ্টা রবীন্দ্রনাথ তাঁর ঈশ্বর ভাবনা তথা জীবন-দেবতার কথা জানাতে গিয়ে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ‘আনন্দমূরতি’ কথাটি উল্লেখ করে গেছেন৷

যেমন বলছেন---‘সত্যের আনন্দরূপ এ ধূলিতে নিয়েছে মূরতি, এই জেনে এ ধুলায় রাখিনু প্রণতি’’ কিংবা ‘...তোমার আনন্দমূর্ত্তি নিত্য হেরে যদি এ মুগ্দ নয়ন, কোনো ভয় নাহি করি বাঁচিতে মরিতে৷’’ বিশ্ব কবির লিখনিতে এই সত্যস্বরূপ আনন্দমূর্ত্তির আগমণী বার্র্ত্তও আমরা পাই--- ‘‘ওই মহামানব  আসে, দিকে দিকে রোমাঞ্চ জাগে/মর্ত্ত্যধূলির ঘাসে ঘাসে’’!

আনন্দস্বরূপ অনাদি অনন্ত পরমব্রহ্ম মানবসমাজকে বেদনাদায়ক পরিস্থিতি থেকে রক্ষা করতে ও অধর্মের বিনাশ করে ধর্মপ্রতিষ্ঠা করতে মর্ত্ত্যভূমিতে জন্ম নিয়েছেন৷ তিনিই আনন্দমূর্ত্তি নামে পরিচিত৷

বিশ্বব্যাপী লক্ষ কোটি  মানুষের আধ্যাত্মজীবনের দিশারী  শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তিজীর প্রথম দীক্ষা দান তথা ‘সদ্‌গুরু’ হিসাবে আত্মপ্রকাশ হয়েছিল ১৯৩৯ সালে শ্রাবণী পূর্ণিমা তিথিতে৷ তখন তিনি কলকাতায় বিদ্যাসাগর কলেজে পাঠরত বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র৷ সান্ধ্য ভ্রমণে প্রতিদিন একাকী বেরোতেন কাশীমিত্র ঘাট থেকে হাওড়া পুল পর্যন্ত গঙ্গার ধার নিয়ে৷ জামালপুর থাকাকালীন বালক প্রভাতরঞ্জন যেমন সূর্যাস্তের  পর কালিপাহাড়ের দিকে একাকী ভ্রমণ করতেন, এখানে গঙ্গার পাশ দিয়ে বিভিন্ন শ্মশানঘাট, নির্জন বন-জঙ্গলের পরিবেশে সন্ধ্যায় ভ্রমণ করতেন৷

ঠিক তেমন একদিন, শ্রাবণের পূর্ণিমা রাতে কল-কল্লোলিনী গঙ্গার তীরে কাশীমিত্র শ্মশান ঘাটে নীরবে তন্ময় হয়ে বসেছিলেন প্রভাতরঞ্জন৷ ঠ্যাঙ্গাড়ে, ডাকাত ও ছিনতাইবাজদের কর্মক্ষেত্র ছিল ওই এলাকাটি৷

এক দুধর্ষ ডাকাত কালীচরণ তার উন্মুক্ত ছোরা হাতে নিয়ে প্রভাতরঞ্জনের দিকে এগিয়ে এল, ও তাকে বললো---‘তোমার কাছে যা কিছু আছে আমাকে দিয়ে দাও৷ তোমার প্রাণকে যদি মূল্যবান মনে কর---তবে সময় নষ্ট না করে যা বলছি তাই কর৷’’

প্রভাতরঞ্জন পিছনের দিকে না তাকিয়ে বললেন---‘‘কালীচরণ তুমি সামনে চলে এসো৷’’ প্রথমে পকেটমার, তারপরে চোর, তারপরে ডাকাত৷ নিজের জীবনটাকে কেন এভাবে নষ্ট করে দিলে? মুহূর্তে কালীচরণ বিহ্বল হতবাক্‌ হয়ে পড়ে৷ এই কী আশ্চর্য্য৷ কোথা হতে এলো সৌম্যদর্শন এই বালক! অনির্বচনীয় আকর্ষণ তাঁর কন্ঠস্বরে , আর আমার নামই বা জানলে কি করে? তৎক্ষণাৎ তার ভেতরে  সবকিছু যেন লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল৷

জবাব দিলো--- আমি যা করছি তা পাপ --- যদি ছাড়তেও চাই ছাড়তে পারবো না৷ প্রভাতরঞ্জন---‘‘তোমার এই অভ্যাস তুমি সহজেই পাল্টাতে পারো৷ তোমার ভেতরের সত্য গুণগুলি জাগিয়ে তুলতে আমি সাহায্য করতে পারি৷ তোমাকে একজন মহান মানুষ হতে সাহায্য করতে পারি৷ সস্নেহে বললেন ‘আমি তোমাকে দীক্ষা দেবো৷ কালীচরণের দুচোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়তে লাগলো৷ তৎক্ষণাৎ হাতের ধারালো অস্ত্র গঙ্গায় ছুড়ে ফেলে,  স্নান করে আসলো দীক্ষা নিতে৷ প্রভাতরঞ্জন কালীচরণকে দীক্ষা দান করলেন৷ জড়ের উপরে চেতনের সম্পাতে কালিচরণের মনোজগতে এক অনিবর্চনীয় আনন্দের অনুভূতি এলো! কালীচরণ ব্যানার্জী এক নতুন জীবনে প্রবেশ করলো৷ তার দেহ, মন, আত্মা গুরুর চরণে সমর্পণ করে দিল৷

প্রভাতরঞ্জন সেদিন থেকে আত্মপ্রকাশ করলেন গুরুরূপে৷ যিনি মহাকৌল, তিনি সদ্‌গুরু আর তিনিই ভগবান৷ ধরা দিলেন আনন্দস্বরূপ আনন্দমূর্তি রূপে৷

বিভিন্ন মতাবলম্বি মানুষের প্রচলিত ধ্যান-ধারণা অনুযায়ী একই সর্বশক্তিমানের ভিন্ন ভিন্ন রূপ হলো ঈশ্বর, আল্লা বা গড্‌৷ তবে ভগবান কথাটি সমার্থক নয়৷

সংস্কৃত শ্লোকে রয়েছে---‘‘ঐশ্বর্য্যনঞ্চ সমগ্রনঞ্চ, বীর্যনঞ্চ,জ্ঞান,বৈরাগ্যশ্চ,যশ সংশ্রীয় ‘ভগ’ ইতি উক্তম৷ রূপ থেকে যেমন রূপবান, গুণ থেকে গুণবান তেমনি ‘ভগ’ থেকে  হচ্ছে ভগবান৷  যে এক ব্যষ্ঠি-সত্তার মধ্যে সমগ্র ঐশ্বর্য্য তথা  অষ্ঠ বিভূতি রয়েছে যিনি অমিত বীর্যের অধিকারী , মহাজ্ঞানী অর্থাৎ তাঁর অজানা কোথাও কিছু নেই,বৈরাগ্য অর্র্থৎ বিষয়-আসক্তি রহিত, যশ অর্থাৎ খ্যাতি---যার যশ রয়েছে তাঁর অপযশ করার দুর্জনও রয়েছে, আর ‘শ্রী’ মানে সৌন্দর্যের আকর্ষণ,---ভাল লাগে, তাই আকৃষ্ট হয়ে তাঁর কাছে ছুটে যাই, কেন জানি না৷

পাঞ্চভৌতিক-দেহধারী যে একজন মানুষের মধ্যে উপরোক্ত গুণবলী প্রকাশ পায় তিনিই ভগবান পৃথিবীতে উন্নত সংস্কার যুক্ত অগণিত মানুষ যারা শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তির বিশ্বরূপ দর্শন করেছেন, তাঁকে একান্ত কাছে পেয়ে তাঁর স্বরূ উপলদ্ধি করেছেন তাঁরাই জানেন তিনি স্বয়ং ভগবান৷ আর এভাবেই বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়ে তাঁর অনুগামী ভক্তবৃন্দের দল৷

শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী ভক্ত-শিষ্যরা সব সময় ‘ৰাৰা’ বলে সম্বোধন করতেন৷ ৰাৰা কথাটি মূলতঃ সংস্কৃত ‘বপ্র’ শব্দ থেকে এসেছে, যার অর্থ যিনি সবচেয়ে বেশী প্রিয়৷ লৌকিক জীবনে প্রভাত রঞ্জনের নিকট আত্মীয়, বড়-ছোট সবাই তাঁকে ৰাৰা বলেই সম্বোধন করতেন৷ ১৯৭০ সালের অক্টোবর মাস৷ ৰাৰা তখন রাঁচী থেকে ৬০ কিমি. দূরে৷ ‘আমঝরিয়া’ নামক বনবিভাগের রেস্ট হাউসে গেলেন সপ্তাহদিনের অবসর কাটাতে৷ প্রকৃতির কোলে সবুজের  এক  উন্মুক্ত পরিবেশে ৰাৰার লৌকিক পরিবার ও অনুগামী ক’জন ভক্ত সঙ্গে ছিলেন৷ খবর পেয়ে ডালটনগঞ্জ, হাজারিবাগ ও রাঁচী থেকে কিছু কিছু ভক্তপ্রাণ শিষ্য চলে আসেন গুরুদর্শনে৷

ৰাৰা তখন প্রসন্ন মুদ্রায় কল্যাণ সুন্দরম রূপে সবাইকে আনন্দে বিহ্বল করে দিতেন৷ পরমারাধ্য ৰাৰাকে কল্পতরু রূপে পেয়ে মার্গীদের উল্লাসের অন্ত ছিল না৷

ঠিক তেমনি একদিন ৮ অক্টোবর রেস্ট হাউস সংলগ্ণ সমতল ভূখণ্ডের উপর ৰাৰা চেয়ারে উপবিষ্ট ছিলেন৷ সঙ্গে ভক্তবৃন্দেরা ঘিরে বসে আছে৷ নিঃসীম নিলীমায় সবুজ পাহাড় আর দূর-অরণ্যের এক স্বর্গীয় পরিবেশ৷ ৰাৰা চুপচাপ সম্মূখের বৃক্ষরাজি ছোট বড় সবুজ পাহাড়ের দিকে তাকিয়েছিলেন৷

একবার চোখ বন্ধ করে তারপর অর্ধনিমিলীত চক্ষে ৰাৰা বললেন, ---‘‘তোমরা মন দিয়ে শুণো কিছু শোণা যাচ্ছে কি?’’

উদ্‌গ্রীপ হয়ে নিবিষ্ট চিত্তে সবাই তখন অনুভব করলেন--- বহুদূর থেকে ভেসে আসছে এক অস্পষ্ট সুর তরঙ্গ৷ ৰাৰা আবার বললেন খুব মন দিয়ে শোণার চেষ্টা কর--- সাথে কিছু শব্দ রয়েছ কি না৷ সবাই মিলে ধ্যানস্থ হয়ে কান পেতে আবার শোণার চেষ্টা করলেন৷ কিছুক্ষণের  মধ্যে সকলে সমস্বরে বলে উঠলো---‘হ্যাঁ ৰাৰা! এর মধ্যে শব্দও রয়েছে---‘‘ৰাৰা নাম্‌ কেবলম্‌’’৷

তখন ৰাৰা নীরবতা ভেঙে বললেন, ‘‘দেখো এটা হচ্ছে কীর্তনের ধুন, আর এটা আসছে, অন্তরীক্ষ থেকে৷’’ এই হলো অষ্টাক্ষরী সিদ্ধমহামন্ত্র---‘‘ৰাৰা নাম কেবলম্‌’’ এর জন্ম কথা!

যাকে নিয়ে কিছু জানাতে গেলে মনের সমস্ত ভাব বাক্যপথের অতীত হয়ে যায়, ভাসা হারিয়ে যায় তাঁকে জানাব কি করে? তিনি যে অনন্ত! পাঞ্চভৌতিক আঁধারে যাকে আমরা দেখেছি সেই--- আনন্দমূর্ত্তিজী বাস্তবিকই এক দুর্জ্ঞেয় রহস্যময় পুরুষ ছিলেন৷ সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা বিশ্বব্যাপী শত সহস্র বড়মাপের সন্ন্যাসী ও সাধক সাধিকা, যাঁরা তাঁর ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে থাকতেন তাঁরাও তাঁর দুর্জ্ঞেয় রহস্যময় ব্যাষ্টিত্বের মাপ ঠিকানা করতে পারেননি৷ আর দেশে বিদেশে তাবড় পণ্ডিতবর্গ যাঁরা আনন্দমূর্ত্তিজীর দর্শন, ভাষাতত্ত্ব, সমাজতত্ত্ব সঙ্গীত ইত্যাদির  উপর বিভিন্ন ভাষায় দেওয়া গ্রন্থসমূহ পাঠ করেছেন, তাঁদেরও আনন্দমূর্ত্তিকে নিয়ে বিস্ময়ের ঘোর কাটে না৷ কাটবেই বা  কী করে ‘তিনি এক সময় বলেছেন ‘I was mystry, I am mystry and I shall remain mystry’’ উন্নত সংস্কারমুক্ত যেসব মানুষের মনে আত্মজিজ্ঞাসা বা পরিপ্রশ্ণ জেগেছে, যারা ভাবতে জানে আমি কে, জন্ম মৃত্যু,রহস্য কি? তারাই একমাত্র আনন্দসম্প্রাপ্তির পথকে খুঁজে বের করবে৷

রসায়ন বিজ্ঞানের পরীক্ষাগারে গিয়ে বিশ্লেসণ পদ্ধতিতে যেভাবে জানা যায় যে তরল বস্তু জলের আসল উপাদান হলো দুটি গ্যাসীয় পদার্থ হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন আর সেটা পরীক্ষাগত উপলদ্ধির জন্য ল্যাবে প্রবেশ করা যেভাবে প্রয়োজন, অধ্যাত্ম বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও ঠিক তাই৷  নিজের প্রকৃত সত্তাকে উপলদ্ধি করতে হলে ‘আনন্দমার্গ’ নামক ল্যাব এ প্রবেশ করতে হবে৷ প্রবেশ করার সদর্থক মানসিকতা অর্জন করতে হবে৷ নিছক বুদ্ধির জোরে সেটা হবার নয়৷ প্রয়োজন অগ্রাবুদ্ধির৷ ইনটেলেক্ট থেকে ইনটিউশন, আর চাই সদ্‌গুরুর অহৈতুকী কৃপা৷ নিজেকে উদ্‌ঘাটিত করতে হবে তারই নির্দেশিত ‘অষ্টাঙ্গিক যোগ’ সাধনার কষ্টি পাথরে৷ বুদ্ধি থেকে উন্মেষ হবে বোধিজ্ঞানের, জীবভাবের উত্তরণ ঘটবে শিবভাবে৷

শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী বলেছেন---ব্যষ্টিজীবনে যেমন প্রগতির জন্যে যোগসাধনা অপরিহার্য, তেমনি সমষ্টি-জীবনে সমাজের অস্তিত্ব ও প্রগতির জন্য ছয়টি তত্ত্ব অত্যাবশ্যক৷ সেগুলো হলো---আধ্যাত্মিক দর্শন, আধ্যাত্মিক অনুশীলন, সামাজিক ও অর্থনৈতিক তত্ত্ব, সামাজিক দৃষ্টিকোণ, শাস্ত্র ও গুরু৷

নীতিবাদের ভিত্তিভূমিতে নিজেকে তৈরি করা ও বিশ্বৈকতাবাদের চূড়ান্ত লক্ষে উপনীত হওয়া৷ বিশ্বের সকল মানুষের একটিই সমাজ যার নাম---‘মানব সমাজ’৷ জীবনের সর্বক্ষেত্রে,প্রতিটি পদক্ষেপে কাউকে পিছিয়ে পড়তে দেওয়া যাবে না৷ সবাইকে সঙ্গে নিয়ে চলার নামই তো সমাজ৷ এই সমাজে যত প্রকারের অনর্থ ঘটে থাকে তার মূল কারণ হলো  মানুষের প্রতি মানুষের সুবিচারের অভাব৷ যার পুঞ্জিভূত ফল হল সর্বপ্রকারের দুর্নীতি ও দুরাচার৷ সুতরাং সমাজের প্রতিটি সদস্যকে সম-সমাজতত্ত্ব তথা নব্যমানবতাবাদের  নিরিখে বিচার-প্রবণ মানসিকতাকে প্রয়োগ করে তবেই সর্বপ্রকারের কার্য্য সম্পাদন করতে হবে৷

আমাদের পরম সৌভাগ্য যে বরাক উপত্যকার করিমগঞ্জ ১৯৬৪ সালে ও শিলচর ১৯৭৯ সালে, মহাসম্ভূতি শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী পুণ্য চরণস্পর্শে ধন্য হয়েছে৷