চাই ‘আমরা বাঙালী’ ভাবাবেগ

লেখক
আনন্দমোহন দেব

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

বিশেষ বিশেষ ভৌগোলিক পরিবেশ বা পরিস্থিতির প্রাকৃতিক পরিবেশ যে রীতি-নীতি, আচার-আচরণাদি ভাষা সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও সভ্যতা গড়ে ওঠে তা ওই স্থানের মানুষের  অস্থি-মজ্জায় -অনুপ্রবিষ্ট হয়ে থাকে৷ তবে কিছু উন্নত ভাবনা বা মত প্রচলিত সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে  পুষ্ট করতে সাহায্য করে তেমনি নিম্নমানের ও ত্রুটিপূর্ণ মতবাদ, সভ্যতা ও সংস্কৃতির অধঃপতন ঘটিয়ে থাকে৷ হরিমুখী মনোভাব বাংলার সভ্যতা ও সংস্কৃতির  বিকাশ সাধন করেছে আর জড়মুখী ও ভোগবাদী মনোভাব বাঙলার অধঃপতন  ঘটিয়েছে৷  আবার অন্য এক পরিবেশের  মানুষ অপর কোন পরিবেশে বংশ পরম্পরাগতভাবে স্থায়ীভাবে বসবাস করলে তার যে ভাবাবেগ মজ্জাগত হয়েছিল তা ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হয়ে ওই স্থানের রীতি-নীতি আচার-অনুষ্ঠানের স্বভাবের হয়ে ওঠে৷ যেমন ভারতের  শক, হূণ, পাঠান, মোগলেরা  যারা  ভারতে এসে স্থায়ী  বসবাস  করেছে সবাই তারা ভারতের-সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যতে লীন হয়ে গেছে৷ তেমনি বাঙলার  ক্ষেত্রেও যারা বাঙলায় এসে, স্থায়ীভাবে বসবাস করে বাঙলার ভাষা,  সংস্কৃতি, রীতিনীতি , আচারকে আপন  করে নিয়েছে, বাঙলার পরিবেশের  প্রভাবে বাঙালী সংস্কৃতির মানুষ হয়ে গেছে তারাও বাঙালী হয়ে গেছে৷  যেমন অনেকদিন ধরে সাঁওতালরা বাঙলায় থাকতে থাকতে  তারা বাঙালী সংস্কৃতি টও ভাষাভাষী হয়ে গেছে৷ তেমনি অনেক বিহারী, গুজরাটীও৷ মাটির গুণে , ভৌগোলিক  পরিবেশের ফলে  মানুষ একই সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের-মানুষ হয়ে  যায় এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য যা, প্রাকৃতিক নিয়ম৷ রীতি-নীতি, আচার-আচরণ, সৌজন্য আদর্শ, প্রেম-প্রীতি ইত্যাদির  সমাহারকে বলা হয়  সভ্যতা৷ সমগ্র মানবজাতির সংস্কৃতি  একটাই, কিন্তু সভ্যতা সমাজের পৃথক পৃথক হয়ে থাকে’’ আর ‘‘সমাজের মানুষদের পারস্পরিক সম্পর্ক, নারী পুরুষের সম্পর্ক, মানুষের সামুহিক প্রয়োজন বৈয়ষ্টিক ও সামুহিক দায়দায়িত্ব, ব্যষ্টিগত ও সমষ্টিগত অগ্রগতির ধারা---এসব কিছু নিয়ে সভ্যতা’’ (নদী ও সভ্যতা---শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার) নদী ও সভ্যতার ধারা অনুযায়ী সারা ভারতে ৪৪ (চুয়াল্লিশ)টি সমাজ অর্থাৎ সভ্যতা ও সারাবিশ্বে ২৫৬ (দুইশত ছাপান্নটি) টি সমাজ বা সভ্যতা৷ এই সারাবিশ্বের ২৫৬টি সভ্যতার  ঐক্যসূত্র হলো মহান দার্শনিক শ্রী প্রভাত রঞ্জন সরকার প্রবর্তিত অধ্যাত্মভিত্তিক সামাজিক, অর্থনৈতিক তত্ত্ব ‘প্রাউট’ দর্শন৷  এই ‘প্রাউট’ দর্শনের ভিত্তিতে সমাজ  বা সভ্যতাগুলির  সীমা নির্ধারিত হবে ও ঐ সব স্থানগুলির মানুষের অস্তিত্বে গ্যারান্টি অর্থাৎ অন্ন,বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার ব্যবস্থা সুনির্দিষ্ট করা হবে, আর সকল মানুষের  সর্বাঙ্গীণ বিকাশ সাধিত করা হবে৷ ফলে সারা বিশ্বের  ঐক্য সাধিত হবে, আর মানুষ মানুষের  মধ্যে কোন ভেদ বিভেদ  আর থাকবে না৷ বিশ্বভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা হবে৷

কোনস্থানের ভূমিগত সংস্থান বা ভৌগোলিক পরিবেশের সৃষ্টির পেছনে  রয়েছে নদীগুলির ধারা প্রবাহ বা নদীর গতিধারা৷ ‘‘মানব সভ্যতার উন্মেষ ও প্রসার নদীউপতক্যা ধরেই ঘটে থাকে৷ নদীর মত মানুষের সভ্যতার তিনটি স্তর--- পার্বত্যস্তর (হিল স্টেজ) সমভূমিস্তর (প্লেন স্টেজ)  ও ব-দ্বীপীয় স্তর (ডেল্টা স্টেজ)৷ কোন সভ্যতার  সূত্রপাত পার্বত্যস্তরে, আর তার পরিণতি ‘ব-দ্বীপীয়’ স্তরে৷ স্বভাবগতই  ‘বদ্বীপীয়’ স্তর হচ্ছে সভ্যতার চরম ও সর্বোচ্চ স্তর’’৷ ‘‘বাঙলায় তিনটে  ব-দ্বীপীয় সভ্যতার বিমিশ্রন ঘটেছে--- গাঙ্গেয় সভ্যতা, ব্রহ্মপুত্র সভ্যতা ও রাঢ় সভ্যতা৷’’ বাঙলার সভ্যতা হ’ল রাঢ়ের গণ্ডোয়ানা সভ্যতা, এর সঙ্গে উত্তর ভারতের  গাঙ্গেয় সভ্যতা ও তিববত চীনের মঙ্গোলিয়ান সভ্যতার  বিমিশ্ররূপ৷ ‘‘নদী যেমন যেমন এগিয়ে যায় ও অন্য নদীতে মিশে বিশেষ বিশেষ সভ্যতার  তেমন তেমন পরিবর্ত্তন হয়ে থাকে৷ আর এইভাবেই জন্ম নেয় খণ্ড খণ্ড সভ্যতা (সাব্‌-সিভিলাইজেশন) সভ্যতাকে মুখ্যতঃ  দুই ভাগে ভাগ করা যায়--- মৌলিক সভ্যতা ও বিমিশ্র সভ্যতা৷’’ বাংলায়  যে রাঢ় সভ্যতা---‘‘এই সভ্যতা পার্বত্য স্তর সমভূমি স্তর ও বদ্বীপীয় স্তর এই তিনটে স্তর রয়েছে বাঙলাতে৷ রাঢ়ের সব ক’টি নদী  বাঙলার নিম্নাঞ্চলে এসে মিলিত হয়ে নূতন নূতন  বিমিশ্র উপসভ্যতার  জন্ম দিয়েছে৷ এই জন্যেই  দেখতে পাই বাঙলায়  তিনটি ব-দ্বীপীয়  সভ্যতার বিমিশ্রণ ঘটেছে---গাঙ্গেয় সভ্যতা, ব্রহ্মপুত্র সভ্যতা ও রাঢ় সভ্যতা৷ জগতের সভ্যতার  ইতিহাসে এটাই সর্র্বেত্তম বিমিশ্র সভ্যতার উৎকৃষ্ট উদাহরণ৷ বাঙলার মানুষের বৌদ্ধিক বিকাশের ব্যাপারে প্রকৃতির সাহায্য অবারিত৷ কারণ পৃথিবীর আর কোথাও গঙ্গা ও ব্রহ্ম পুত্রের মত  বড় বড় দু’টো নদী একত্র মিলিত হয়নি৷

মৌলিক সভ্যতায় মানুষের দৈহিক সামর্থ অধিক হয়৷ বিমিশ্র সভ্যতায়  মানুষের বৌদ্ধিক সামর্থ অধিক হয় ও সেই সঙ্গে  গোটা সভ্যতাটা হয়ে থাকে জটিল ও দৃঢ়ভিত্তিক৷---বদ্বীপীয় স্তরে  মানুষ হয়  জটিল, দৈহিক সামর্থ অপেক্ষাকৃত কম৷ কিন্তু বৌদ্ধিক সামর্থ, অনেক বেশী৷ বাঙলার মানুষেরা বৌদ্ধিক দিক থেকে খুবই উন্নত, কারণ--- বাঙলার সভ্যতা হচ্ছে তিনটি ব-দ্বীপীয়  সভ্যতার বিমিশ্রণ৷’’ (নদী ও সভ্যতা-শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার)৷ বাঙলার প্রাকৃতিক পরিবেশের জন্য বাঙালী চরিত্রে এসেছে যেমন বিশ্বৈকতাবাদী বোধ, অসীম সহ্যগুণ৷ তেমনি-অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার হিম্মতও তখন কোন শক্তি-ই বাঙালীকে রোধ করতেই পারে না৷ বাঙালী এমন একটি জনগোষ্ঠী যা বিশ্বে বিরল৷ বাঙলার গৌরবময় সংগ্রামী ঐতিহ্য বিপ্লবীচেতনা লড়াকু মনোভাব রয়েছে৷ এই বাঙালী জনগোষ্ঠীর  শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, কাব্য সঙ্গীত, (গান, বাজনা, নৃত্য নিয়ে সঙ্গীত), অঙ্কন, দর্শন, বিজ্ঞান, নৃতত্ত্ব, প্রত্নতত্ত্ব, জ্যোতিষ বিজ্ঞান, দেশাত্মবোধ, আধ্যাত্মিকতা প্রভৃতি ক্ষেত্রে মানুষের  জীবনের যতগুলো দিক রয়েছে সব দিক দিয়ে  বাঙলার প্রাকৃতিক পরিবেশ বাঙালীকে স্বয়ং সম্পূর্ণ করেছে৷ তাই মহামতি গোখলে বলেছিলেন ---‘‘বাঙলা আজ যা চিন্তা করে, ভারতবর্ষ-তা করে আগামীকাল৷’’

যে বাঙলা ছিল ‘সভ্যতার-আদি বিন্দু সেই বাঙলা ও বাঙালীর ঐতিহ্য আজ অবলুপ্তির ও ধবংসের পথে৷ বিহার, উড়িষ্যা, অসম ও বাঙলা নিয়ে যে সুবা বাঙলা ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা টুকরো টুকরো করে দিয়ে ভেদ-বিভেদের  (ডিভাইড-এ্যাণ্ড রুল) রাজনীতি করে  বাঙলাকে  শোষণ করে গেছে৷ আর বাঙলা ভাষাভাষী অঞ্চলের কিছু অংশ উড়িষ্যায়, কিছু অংশ বিহারে (বর্তমান ঝাড়খণ্ড), কিছু অংশ অসমে রেখে ঐ অঞ্চলের  বাংলা ভাষা ভাষীদের  মুখের ভাষা কেড়ে নিয়ে ভাষাগত শোষণ অব্যাহত রেখে গিয়েছে আর পশ্চিমবঙ্গ নামে ছোট একটি অংশ ভারতের অঙ্গরাজ্য থেকে গেছে৷ স্বাধীনতার পরে এই  ছোট পশ্চিমবঙ্গের  উপর দিল্লী তথা হিন্দী সাম্রাজ্যবাদীদের আধিপত্যে  বাঙলা আর্থিক ও ভাষাগতভাবে শোষিত হয়ে চলেছে৷ সামাজিক রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক সকল স্তরে দুইশত বৎসর ধরে চলছে বাঙলা ও বাঙালীর  ওপর অবাধ শোষণ৷ বাঙালীর  মজ্জাগত যে গৌরবময় সংগ্রামী ও বিপ্লবী চেতনা প্রকৃতিগত ছিল যা ইংরেজ শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছে বাঙলা তথা ভারতের সকল জাতির মুক্তির জন্য৷ আজ অসংস্কৃতি তথা হিন্দী সংস্কৃতির প্রভাবে বাংলার বিশেষ করে যুবশক্তি  বিভিন্ন প্রকারের নেশাগ্রস্থ হয়ে সেই বিপ্লবী ও সংগ্রামী চেতনা হারিয়ে দাস সুলভ মানসিকতাগ্রস্থ হয়ে পড়েছে৷ আজ বাঙলার মানুষ মানসিক দিক দিয়ে দেউলিয়া অর্থাৎ পঙ্গু হয়ে পড়েছে---অনৈতিক , সমাজবিরোধী কাজে তারা লিপ্ত হচ্ছে৷