আগে রাজতন্ত্র ছিল৷ প্রজাদের শোষণ করে রাজাদের বিলাস ব্যাসন চলত৷ এই শোষণ বন্ধ করতে এল প্রজাতন্ত্র বা সাধারণতন্ত্র৷ আমাদের দেশে ১৯৫০ সালের ২৬শে জানুয়ারী থেকে প্রজাতন্ত্র ঘোষিত হয়েছে৷ প্রজাদের অর্থাৎ জনসাধারণের সেবার উদ্দেশ্যে সংবিধানসম্মতভাবে জন প্রতিনিধিরা দেশকে পরিচালনা করবেন৷ এটাই প্রজাতন্ত্রের সারকথা৷
ভারতের প্রজাতন্ত্রের ৬৮ বছর পূর্ণ হ’ল৷ অথচ, আজও কি বেনামীতে সেই রাজতন্ত্রই চলছে? এই প্রশ্ণ ওঠার কারণ হ’ল, বর্তমানে কেন্দ্রের ২০১৮-১৯ সালের জন্যে যে আয়-ব্যয়মাত্রিকা (বাজেট) পেশ করা হ’ল, তাতে জনপ্রতিনিধিদের বেতন অস্বাভাবিকভাবে ও দৃষ্টিকটুভাবে বৃদ্ধি করা হ’ল৷ বলা হয়েছে মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এই বেতন হার বাড়ানো ছাড়া নাকি গত্যন্তর ছিল না৷ রাষ্ট্রপতি যিনি পরোক্ষভাবে জনপ্রতিনিধিই, তাঁর বেতন বর্তমানে ১.৫০ লক্ষ টাকা, তা বাড়িয়ে করা হচ্ছে ৫ লক্ষ টাকা, অর্থাৎ তিন গুণের চেয়েও বেশী৷ দেড় লক্ষ টাকাতে রাষ্ট্রপতির চলছিল না? বড় কষ্ট হচ্ছিল? তাই তিন গুণের বেশী বাড়ানো হ’ল? মানে মাসে সাড়ে তিন লক্ষ টাকা বৃদ্ধি করতে হচ্ছে৷ তাহলে দেশের প্রজা বা জনসাধারণ, যাদের স্বার্থে, যাদের জন্যে এই শাসনব্যবস্থা বলে গালভরা বুলি আওড়ানো হচ্ছে---তাদের কী অবস্থা! তাদের দিনে ২০ টাকাতে (অর্জুন সেনগুপ্ত কমিশন তো তাই বলছে) চলবে কী করে? যখন তিনি এই রিপোর্ট প্রকাশ করেছিলেন, ধরে নিলাম, তাদের আয় দৈনিক ২০ টাকা থেকে এখন হয়ত তা বেড়ে দৈনিক ৩০ টাকা হয়েছে৷ মাত্র ৩০ বা ৪০ টাকায় দেশের ৭৪ শতাংশ জনসাধারণের চলছে! তাহলে কি এমন পরিস্থিতি এল যে রাষ্ট্রপতির মাসিক দেড় লক্ষ টাকাতেও চলছে না, তাকে বাড়িয়ে তিন গুণের বেশী করতে হচ্ছে!
উপরাষ্ট্রপতির বেতন বৃদ্ধি করে বর্তমানে ১.২৫ লক্ষ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩.৫০ লক্ষ টাকা করা হচ্ছে, রাজ্যপালদের বেতন ১.১০ লক্ষ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩.৫০ লক্ষ টাকা করা হচ্ছে৷ বলা বাহুল্য, এরই সঙ্গে মন্ত্রী, সাংসদদেরও বেতন বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে৷ কার্যত নিজেরাই নিজেদের বেতন বাড়িয়ে নিচ্ছেন৷ কেবল নিতান্ত দৃষ্টিকটু লাগছে বলে নাক ঘুরিয়ে এই বেতন বৃদ্ধির আইন পাশ করা হবে৷ বর্তমানে সংসদের দুই কক্ষের সদস্য নিয়ে তৈরী একটি সংসদীয় কমিটি সাংসদদের বেতন বৃদ্ধির প্রস্তাব দিয়েছে৷ সাংসদদের গৃহীত প্রস্তাবই তো আইনে রূপ নেয় ও কার্যকর হয়৷ তাই সরকার নির্ধারিত মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই যে মন্ত্রী ও অন্যান্য সাংসদদের বেতন বৃদ্ধি করবে---তাতে আর কোনও সন্দেহ নেই৷
হ্যাঁ, এটাও বলে রাখা প্রয়োজন, এই যে বেতন বৃদ্ধির প্রসঙ্গে আলোচনা হচ্ছে, এটা হচ্ছে মূল বেতন৷ এর পর তো ঘরভাড়া, টেলিফোন বিল, সমেত নানান ভাতা রয়েছে৷ এইসব তো বিনামূল্যে পাবেনই৷ সংসদ চলাকালীনও প্রতিদিনকার জন্যে মোটা টাকাও বরাদ্দ আছে, তা সংসদের কাজ হোক বা না হোক৷
এই বিপুল পরিমাণ অর্থ কোথা থেকে আসবে? জনপ্রতিনিধিরা কি সৃষ্টি করবেন? তা তো নয়৷ জনসাধারণেরই অর্থ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ট্যাক্স রূপে আদায় করে এই অর্থের যোগান ঘটানো হয় ও হবেও৷ তাহলে যে দেশের প্রায় ২৭ কোটি মানুষ দীর্ঘস্থায়ী ক্ষুধা জনিত রোগে মারা যায় বা এর বৃহৎ অংশ প্রত্যক্ষভাবে ক্ষুধার তাড়নায় মারা যায়, তাদেরই অর্থে জনপ্রতিনিধিদের এই বিপুল পরিমাণ বেতন বৃদ্ধি কি শোষণ নয়? এটা কি জনসাধারণের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা নয়? এটা কি আমাদের সংবিধানের প্রতি চরম পরিহাস নয়?