কমলা নেবু
পাহাড়ে কিছুটা ঠাণ্ডা আবহাওয়া থাকলে ও তৎসহ রক্ত–মৃত্তিকার সঙ্গে কৃষ্ণকার্পাস মৃত্তিকার মিশ্রণ থাকলে ও তাতে যদি ক্যালসিয়ামের প্রয়োজন মত মিশ্রণ থাকে তবে সেই মাটিতে উত্তম মানের পাহাড়ী কমলা হতে পারে বা হয়ে থাকে৷ তবে এই ধরনের মাটিতে যে কমলা [Citrus reticulata] হয় তা টক হয় না বটে, তবে তাতে মিষ্টত্বের চেয়ে কিছুটা জলসা বা পানসে ভাব বেশী থাকে (জল সহ > জলসহ>জলসা, পানী সহিত > পানীসহিত> পানীসই> পানীসাঞ্> পানসে)৷ এই নেবুর খোলা ও কোয়ার মাঝখানে থাকে একটুখানি ফাঁকা জায়গা৷ তাই খোলা ছাড়ানো খুব সোজা৷ সিলেটী কমলার কোয়ার গায়ে অতটা ফাঁপা ভাব থাকে না৷ অসমের কমলার মিষ্টত্ব যথেষ্ট, সিলেটী কমলারই মত, আকারে সিলেটী কমলার চেয়ে একটু বড় তবে (খোলাতে) তেলের পরিমাণ একটু কম৷ নাগপুরী কমলা আকারে খুবই ছোট৷ পশ্চিম ভারতে একে বলা হয় সান্তারা৷ এর খোলা কোয়ার গায়ে লেপটে থাকে বলে ছাড়াতে অল্প অসুবিধা হলেও ছাড়ানো যায়৷ স্বাদে মিষ্ট এই সান্তারা বা নাগপুরী কমলাকে কেউ কেউ খোকা–কমলাও বলে থাকেন৷ নামটি ভালই৷
অবশ্য বিশ্বের বাজারে স্পেন দেশের (আসল নাম এসপানো) ব্যালেন্সিয়ার (Valencia) কমলার আজ বিশ্বজোড়া খ্যাতি..... ডাকসাইটে নাম৷ পাহাড়ী কমলা বিদেশ থেকে আসেনি৷ পাহাড়ী কমলা একটু ফাঁপা ফাঁপা দেখতে৷ সহজেই কীটের দ্বারা আক্রান্ত হয়৷ ছোটবেলায় কালিম্পংয়ে এসে যে ছোট ধরনের কমলানেবু দেখতুম, আজ তা আর দেখি না, শুণতে পাই কোন কোন বাগানে অল্পস্বল্প পাওয়া যায়৷ কিন্তু তা আর শিলিগুড়ির বাজার গলে’ কলকাতার দিকে নেবে আসে না৷ উত্তর বাংলার গ্রামের হাটে এককালে হালির দরে পাওয়া যেত৷ ঙ্মকমলার খোলার ঔষধীয় গুণ যথেষ্ট যা যথাস্থানে বলা হবে ক্ষ৷
কমলার সাবেকী সংস্কৃত নাম ‘নাগরঙ্গ’৷ ‘নাগ’ শব্দের একটি অর্থ ঝর্ণা আরেকটি অর্থ হ’ল ক্ষৃহদাকার সর্প আরেকটি অর্থ হ’ল আরণ্য হাতী৷ বুনো হাতী কমলা নেবু পাকলে তার টুকটুকে রঙ দেখে ছুটে আসে, গাছের কাঁটাকে উপেক্ষা করে নেবুর সান্নিধ্য লাভ করতে৷ তাই যে নেবু আরণ্য হাতীর মনকে রাঙিয়ে দেয় তা হ’ল ‘নাগরঙ্গ’৷ এই ‘নাগরঙ্গ’ শব্দ থেকে উর্দূতে ‘নারঙ্গী’ শব্দ এসেছে৷
অরেঞ্জ বর্গ আর লীমন বর্গের মধ্যে পার্থক্য ঃ কমলার খোলা যদি ছাড়ানো না যায় তবে তাকে কমলা বা orange বলা হয় না, তাকে বলে •sweet) lemon বা মৌসম্বী বা সরক্ষতী নেবু৷ বাতাবী নেবুর (সংস্কৃত মহালঙ্গ বা জম্বীর) খোলা ছাড়ানো যায় না, পাতিনেবু ও কাগজী নেবুরও৷ তাই তারাও অরেঞ্জ বর্গে পড়ে না, তারা ‘লীমন’ বর্গে পড়ে৷
কাগজী নেবু
কাগজী নেবু আমাদের দেশীয় নেবু নয়৷ দেশী নেবু হলে তো পাতিনেবু নামই হত৷ ঈষৎ লম্বা, মোটা খোলার সুগন্ধযুক্ত অম্লরসাত্মক এই যে নেবুটি, এটি আমাদের দেশে ইংরেজ আমলের আগে ছিল না৷ বাংলার বিশেষ করে হুগলী জেলার কিছু সংখ্যক মুসলমান দেশীয় পদ্ধতিতে কাগজ তৈরী করতেন৷ একে তুলোট কাগজ বলা হত৷ তালপাতার পুঁথির যুগ শেষ হবার পর বাংলা সাহিত্যের অধিকাংশ রচনাই এই তুলোট কাগজের পাতাতেই বন্দী হয়ে রয়েছে৷ তারপরে ইংরেজ আমলে যখন কাগজের কল হ’ল (যতদূর মনে হয় এটি হয়েছিল কলিকাতার নিকটস্থ বালিতে), বাদামী রঙের কাগজ তৈরী হ’ল–লোকে বলত বালির কাগজ৷ তারপর শাদা কাগজ হ’ল (ফুলস্ক্যাপ* সাইজের) বর্দ্ধমানের রাণীগঞ্জে, ২৪ পরগণা জেলার টিটাগড়ে৷
যাই হোক, হুগলী জেলার যে সকল মুসলমান দেশীয় পদ্ধতিতে কাগজ তৈরী করতেন তাঁদের বলা হত কাগুজে মুসলমান বা কাগজী মুসলমান৷ যেমন বাঁকুড়া জেলার যে সব মুসলমান চাষ করে পলু পোকা পালন করতেন তাঁদের বলা হত তুঁতে মুসলমান৷ ইংরেজরা বালীতে কাগজ কল করার পরে কাগজী মুসলমানরা জীবিকাচ্যুত হয়ে পড়ল৷ বাংলার সুপ্রসিদ্ধ গরদের বাজার মন্দা হওয়ায় বিষ্ণুপুরে তুঁত চাষে মন্দা দেখা দিল৷ তখন এই কাগজী মুসলমানরা, তুঁতে মুসলমানরা সাগরপারের দিকে পাড়ি দিয়ে চলে এলেন দক্ষিণ আমেরিকায়৷ তখন সেখানে জীবিকা ছিল সহজ, জীবন ছিল অকণ্ঢক৷ সেই মুসলমানেরা তারপরে কখনো সখনো নিজেদের পূর্ব পুরুষের ভিটাতে আসতেন৷ এই কাগজী মুসলমানরা দক্ষিণ আমেরিকা থেকে লম্বাটে সুগন্ধী প্রজাতির নেবু নিয়ে এলেন যার স্থানীয় নাম হয়ে গেল কাগজী নেবু৷ তাহলে ক্ষুঝলে পাতিনেবু যেমন দেশী নেবু, কাগজী নেবু তেমনি দেশী নেবু নয়–এসেছিল দক্ষিণ আমেরিকা থেকে৷
তোমরা ভাল করেই জান, ‘লেবু’ শব্দটি একটি সাধারণ বিভ্রান্তি৷ সংস্কৃত ‘নিম্বুকম্’ শব্দ থেকে প্রাকৃতে ‘নিবম্বু’, প্রাচীন বাংলায় ‘নেবু’, বর্ত্তমান বাংলায়ও ‘নেবু’, বর্ত্তমান হিন্দীতেও ‘নীম্বু’, অঙ্গিকায় ‘নেমু’৷ মূল শব্দ যদি ‘নিম্বু’ হয় তবে ‘লেবু’ কোত্থেকে আসবে