প্রথমেই বলে রাখি এই রচনার উদ্দেশ্য এটা নয় যে রেফারি বা আম্পায়ারদের বিচারকে ত্রুটিযুক্ত বলে খাড়া করে তাঁদের সিদ্ধান্তগুলোকে অবমাননা করা৷ উদ্দেশ্য এটাই খেলার ফলাফলের সিদ্ধান্তগুলোকে আরও নির্ভুল করা৷ সেই কারণে খেলাধূলাকে ভালবাসার তাগিদেই সাধারণ মস্তিষ্ক থেকে উঠে আসা কয়েকটি বাক্যাবলী উৎসাহী পাঠকদের ও খেলাধূলার নিয়ম রচনাকারীদের সামনে তুলে ধরছি৷
আরব দেশে আয়োজিত এশিয়া কাপের ক্রীড়া প্রতিযোগিতা চলছে৷ এশিয়ার সেরা দলগুলি এখানে পরস্পর প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে৷ গত ২৪শে সেপ্টেম্বর আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের খেলায় সেই ম্যাচের ভারত অধিনায়ক ধোনি ব্যাট করছিলেন৷ আফগানিস্তানের এক স্পিন বোলারের একটি বল তাঁর প্যাডে লাগল৷ এল.বি.ডব্লিউ-এর আবেদন উঠল৷ আম্পায়ার আউট দিলেন৷ ওই ম্যাচে ভারতের আর এক ব্যাটসম্যান দীনেশ কার্ত্তিকও লেগ বিফোর হন৷ ম্যাচ শেষে ধোনী, কার্ত্তিক দু’জনই আম্পায়েরর সমালোচনায় মুখর৷ কিন্তু প্রকাশ্যে ক্ষোভ প্রকাশ করলেই জরিমানার খাড়া৷ তাই খেলোয়াড়দের মুখে বিরক্তির ভাষায় প্রকাশ পেল এটাই যে তারা আউট না হয়েও প্যাভেলিয়ানে ফেরত গেলেন৷ টিভি রিপ্লেতে দেখা গেল ব্যাটসম্যানেরা আউট ছিলেন না৷
সম্প্রতি টেনিস খেলার একটি গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক ম্যাচে আম্পায়ারিং নিয়ে ক্ষুব্ধ আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্না টেনিস খেলোয়াড় সেরেনা উইলিয়ামস্৷
শেষ ফুটবল বিশ্বকাপেও কয়েকটি সিদ্ধান্ত বিতর্কিত হয়েছে৷ রেফারীর সমালোচনায় মুখর হয়েছে সংশ্লিষ্ট খেলোয়াড়রা৷
আসলে আম্পয়ার বা রেফারীরা খেলা চলাকালীন যে সিদ্ধান্তগুলি নেন তার সূক্ষ্মতার মাপকাঠিতে বিচার করার সময় তাঁদের হাতে থাকেই না৷ কয়েক সেকেণ্ডের ব্যবধানে তাঁদের চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিতে হয়৷ সেই কারণে রেফারিং বা আম্পায়ারিং নিয়ে প্রশ্ণ তোলাটা অখেলোয়াড়চিত বলেই গণ্য হবে৷ অবশ্য খেলার নিয়মকানুন যাঁরা তৈরী করেন তাঁরা বিচারকের কাজটিকে আরও নিখুঁত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন প্রতিনিয়ত৷ সেই কারণেই এসেছে উইকেটের মধ্যে ক্যামেরা, স্পিকার, মাঠের বিভিন্ন জায়গায় শক্তিশালী ক্যামেরা, জলের নীচে ক্যামেরা, স্পিকার ইত্যাদি আরও কয়েক ধরণের কম্পিউটার পরিচালিত যন্ত্র৷ উদ্দেশ্য একটাই সংশ্লিষ্ট খেলোয়াড়দের নৈপুণ্যের মাপকাটি যেন ১০০ শতাংশ নির্ভুল হয়৷
দেখা যাচ্ছে রেফারিং নিয়ে, আম্পায়ারিং নিয়ে নানা প্রশ্ণ উঠছে কিন্তু যে সকল যন্ত্রাদির কার্যকারিতা তথা যন্ত্রের সিদ্ধান্ত জানানোর সূক্ষ্মতা নিয়ে প্রশ্ণ উঠছে না৷ কারণ যন্ত্রের সবক’টি নির্ণয়ই নির্ভুল ও সঠিক৷ একটি দৌড় প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে ‘এণ্ড পয়েণ্টে’ কোন দৌড়বিদ আগে পৌঁছেছেন তার বিচার করে যন্ত্র---একটি সেকেণ্ডকে কয়েকশো ভাগে বিভক্ত করে৷ উত্তর আসে একজন ৯.০৭ সেকেণ্ড সময় নিয়ে দ্বিতীয় হয়েছেন আর যিনি প্রথম হয়েছেন একই দূরত্ব অতিক্রম করতে তাঁর সময় লেগেছে ৯.০৬ সেকেণ্ড৷ সংশ্লিষ্ট খেলোয়াড়রা এই বিচার ব্যবস্থাকে স্বাগত জানিয়েছেন, মেনে নিয়েছেন৷ যদি এ্যাথলেটিক্সের ক্ষেত্রে, সাঁতারের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণভাবেই যান্ত্রিক ব্যবস্থাকে প্রশ্ণাতীত ভাবে মেনে নিয়ে সূক্ষ্মতার মাপকাঠি রাখা হয় তবে ফুটবল, ক্রিকেট, হকি ইত্যাদি খেলার ক্ষেত্রে সম্পূর্ণভাবেই তা করা হচ্ছে না কেন? এখানে কোনওভাবেই আম্পায়ার বা রেফারি- লাইন্সম্যানদের ছোট করে দেখা হচ্ছে না কারণ মানুষের মগজই সেখান কাজ করছে মানুষেরই তৈরী যান্ত্রিক ব্যবস্থার মাধ্যমে৷ প্রশ্ণ এসে যায় বার বার রিপ্লে হলে খেলার গতি-ছন্দ নষ্ট হয়---অথচ সেই খেলায় গতির ব্যাপারটা সেখানে যথেষ্টই গুরুত্বপূর্ণ, যন্ত্রের দ্বারা গতি-ছন্দ-লয়কে ব্যাঘাত ঘটালে খেলা আর প্রকৃতর্থে খেলা থাকে না৷ তাহলে উপায়? নিয়ম এটাই হোক না যে সাবলীলভাবে খেলা চলুক৷ কিছুক্ষণ পর রিপ্লেতে যদি পূর্বের সিদ্ধান্ত ভুল প্রমাণিত হয় তাহলে থ্রো-ইন, গোল কিক, ওভারের শেষ বলের পরে পূর্বের ভুল সিদ্ধান্তকে পাল্টে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হোক, তাতে সংশ্লিষ্ট খেলাটির সর্বশেষ সিদ্ধান্তটি আরও নিখুঁত হবে৷ যদি ভুল সিদ্ধান্তের ফলে একজন খেলোয়াড় আউট হয়ে প্যাভেলিয়নে ফেরত যান তবে দুটি বা তিনটি বল পরে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে তাঁকে ক্রিজে ফিরিয়ে আনা হোক---আর ওই ভুল সিদ্ধান্তের পরের দু’টি বা তিনটি বল বাতিল বলে গণ্য করে আবার ওই বলগুলি করা হোক নতুন করে, ভুল সিদ্ধান্তের ফলে যদি একটি ফ্রি-কিক পেয়ে যায় একটি দল, আর তাতে যদি ওই ফ্রি-কিকে গোলও হয় তাহলে গোলও বাতিল হোক কারণ ফ্রি-কিক পাওয়াটাই ভুল সিদ্ধান্তের ফসল৷ বিচারের সূক্ষ্মতাকে সম্পূর্ণভাবে কার্যকরী রূপ দিতে চাইলে প্রাত্যহীক জীবনের অনেক কিছুই উদাহরণ হিসেবে মনের মাঝে উকি দিতে পারে৷ যেমন একজন গাড়ির চালক সিগনালে কোন ট্রাফিক পুলিশকে না দেখে ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন করলেন৷ দশ বা পনেরো মিনিট পরে একটি পুলিশের জিপ এসে গাড়ীটিকে সিস দাঁড় করিয়ে যন্ত্রের সাহায্য নিয়ে প্রমাণ করল যে তিনি তাঁকে ওই সময়ে গাড়ী চালানোর অনুমতি দেওয়া হয়নি অথচ তিনি তা লঙ্ঘন করেছেন তাই তাঁকে পানিশমেণ্ট করা হচ্ছে---সংশ্লিষ্ট ড্রাইভার নিজের ভুল মেনে নিয়ে পানিশমেণ্ট মাথা পেতে নিচ্ছেন---কারণ এটাই নিয়ম৷ এইভাবে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে নির্ভুলতা বজায় রাখার প্রয়াস যদি রাখতে চাই তাহলে মাঠে-ময়দানে প্রতিভার সূক্ষ্মতার বিচারের ক্ষেত্রে প্রতিটি মুহূর্ত্তের বিচারই হোক নির্ভুল---সংশ্লিষ্ট নিয়ামকদের প্রতি এই ক্ষুদ্র ভাবনার নির্ভুল ময়না তদন্ত আশা করে এই রচনার ইতি টানছি৷