গম্ভীর শব্দের অর্থ হল জলের তলমাপক ভাব অর্থাৎ জলকে গম্ভীর বললে বুঝতে হবে সেটা অর্থই জল.... অনেকতলা পর্যন্ত সেই জল গেছে৷ যদিও শব্দটি আদিতে জলপরিমাপক হিসেবেই ব্যবহৃত হত কিন্তু পরবর্তীকালে বিভিন্ন ধরণের অলঙ্কারে বিভিন্ন বস্তুর তলমাপকতায় এর ব্যবহার হয়ে এসেছে৷ ভারী আবাজ, ভারী মনমেজাজ, ভারী চলন-বলন, যার মধ্যে অনেক নীচ অবধি বা অনেক ভিতর পর্যন্ত মাপবার প্রশ্ণ ওঠে তার জন্যে ‘গম্ভীর আবাজ হাসিবিহীন মুখকে লব গম্ভীর চলন৷ তবে মনে রাখতে হবে মুখ্যতঃ এটি জলেরই তলত্ব বা অতলত্বের পরিমাপ৷
‘গম্ভীর’ শব্দের কথা বলতে গিয়ে মনে পড়ে গেল একটি কম বয়সের ঘটনার কথা৷ আমার জানা এক ভদ্রলোকের স্ত্রী ছিলেন দারুণ দজ্জাল, উঠতে বসতে স্বামীকে খোঁটা দিয়ে কথা বলতেন৷ বচনের ঝালে তিনি অন্নপ্রাশনের ভাতকেও বমি করে বার করে দিতে লোককে বাধ্য করতেন৷ কিন্তু গোবেচারা*
(এখানে বেচারা মানে সাদাসিধে মানুষ..... সাত চড়েও যিনি রা-টি কাড়েন না৷ গোরু একটি শান্তশিষ্ট প্রাণী, মোষের মত)
একদিন ভোরে পশ্চিম দিকের পাহাড়টার দিকে বেড়াতে যাচ্ছি৷ দেখি, রাস্তার ধারে বটতলায় বসে রয়েছেন সৌরেন সরকার ৷ ভদ্রলোক আমার বাবার চেয়ে বয়সে এক বছরের বড় ছিলেন৷ তাই তাঁকে জ্যাঠামশায় বলতুম৷ তাঁকে ওইভাবে বসে থাকতে দেখে শুধোলুম--- কী জ্যাঠামশাই! এখন এখানে এভাবে বসে আছেন!
হ্যাঁ,প্রসঙ্গতঃ বলে রাখি, দেওয়ালে ঠেস দিয়ে থালা বাসন-পত্র যদি সেই বাড়ীর কাছ দিয়ে তীব্রগতিতে ছুটে আসা রেলগাড়ীর শব্দে থালা-বাসনপত্রের দেওয়ালের গা ছেড়ে যখন মাটিতে পড়ে যায় তখন একটা খন্ খন্ ঝনাৎ শব্দ নিশ্চয়ই শুণেছ৷ আবাজ কেমন বোঝাতে গিয়ে লোকে বলে খন্খন্ ঝন্-ঝন্ আবাজ ৷ এ আবাজ কেবল বাসনেরই হয়, মানুষ বা অন্য জীবের হয় না৷ তবুও এ আবাজটি অনেক সময় মুখর বা মুখরা মানুষের অভিব্যাক্তি বোঝানোর সময় ব্যবহৃত হয়৷
(মেজাজী নয়, হরিণের মত ছটপটেও নয়, বেস শান্তশিষ্ট স্বভাবের৷ যে বেচারী মানুষটি একেবারে গোরুর মত শান্তশিষ্ট তিনি হলেন গোবেচারী৷ গোরুকে বেশী মারলেও সে শিঙ নেড়ে তেড়ে আসে না৷ মার সয়েই যায়--- বেশী মারে শিঙ নেড়ে তেড়ে আসে না৷ মার সয়েই যায়--- বেশী মারে ক্কচিৎ কখনও কাঁদে৷ তাই কাউকে যদি গোরুকে মারার মত মারা হয় ও সে মার খেয়ে মরে যায়, সে ধরণের মারকে বলা হয় ‘গোবেড়ান্’--- কলকাতার কথ্য বাংলায় ‘গোবড়েন’৷ )
আমি সরকার জ্যাঠামশাইকে জিজ্ঞেস করলুম--- তা অত ভোরে এই বটতলায় বসে থাকার কারণটা কী? তিনি লর্েন--- বাবা, সবই তো জানো, বাড়িতে চর্র্িশ ঘন্টা খন্ খন্ ঝন্-ঝন্৷ তা তোমার জেঠীমার ভয়ে একটু গাছতলায় বসে শান্তি পাচ্ছি৷ খানিক বাদে আবার বাড়ী ফিরতে হবে, তারপর অফিস যেতে হবে, তবু আর দশটা মিনিট বসে থাকি.....যতটুকু সময় খন্ খন্, ঝন্-ঝনের হাত থেকে দূরে থাকা যায়৷
তাহলে ঝলে এই গম্ভীর শব্দ যদিও জলের পরিমাপের জন্যে প্রাচীনকালে ব্যবহৃত হত কিন্তু আজ গম্ভীর স্বভাবের মানুষ, গম্ভীর চালচলন, গম্ভীর চরণ-চারণা, গম্ভীর ধবনিবিন্যাস প্রভৃতি নানানভাবে নানান ব্যঞ্জনার বহ্বাম্ফোটে তরঙ্গের উত্তরণে সত্যিই মুড়ি-মুড়কির মতই ছড়িয়ে পড়েছে৷ শব্দটি তার সাবেকি গাম্ভীর্য আজ হারিয়ে ফেলেছে৷
(শঃচঃ ২০৷১৮)