মানালী ভ্রমণ

লেখক
আশীষ দত্ত রায়

এই যে হিমালয় বাস৷ কি করব? কতকটা আমার স্বভাব দোষ, কতকটা অদৃষ্টলিপি! হিমালয়ের দুর্নিবার আকর্ষণ ও রাজধানীর দুর্ধর্ষ গ্রীষ্মের হাত থেকে পালিয়ে আত্মরক্ষার জৈব তাগিদ-এই দুয়ে মিলে আমায় ঘর ছাড়া করল৷ জুন মাসের অগ্ণুত্তপ্ত তেজা রাজধানীর তীব্র তাপমাত্রার আওতা ছাড়িয়ে রওনা হয়ে পড়লাম৷ ১৭ ঘন্টা লাগল বশিষ্ঠ (মানালীতে) পৌছাতে৷ আঃ, কী বিপুল বৈষম্য আবহাওয়ায়৷ কোথায় অগ্ণিতপ্ত গৃহবাস ও তার কুটিল ভয়াল কটাক্ষ, আর কোথায় এই সবুজ  পাহাড় ঘেরা এই মৃদু মন্থর সমীরণ! কিন্তু এই মধুন্ধি হিমানী--- সৌভাগ্য ভোগ করবার বরাত কি সহজ নাকি? পুত্র বদান্যতায় সারথি সহ রথের আয়োজন  ও তৎসহ তারই (পুত্রের) আরোপিত নানা নিয়মাবলী, সর্বোপরি দীর্ঘ বাসের নানা আয়োজনের পরিকল্পনা ও উপকরণ সংগ্রহ এতেই তো পারিবারিক  কলহের পক্ষে ঢের৷

যা হোক, সে সব শেষে যাত্রা শুরু৷ প্রথম বিঘ্ন সম্ভবতঃ সমকারণে অধিক সহযাত্রী ও মাত্রাতিরিক্ত নানা ধরনের গাড়ি৷ চওড়া রাজপথের  অনেকাংশে আন্দোলনরত কৃষক অবস্থানের জেরে সে পথ ক্ষীণকায়৷ অপরের চেয়ে আগেই বেরিয়ে যাবো মানসিকতায় তাতে অধিক অবরোধ৷ সে এক তামাশা বটে৷ তরুণ সারথির জেগে থাকার সাথী উচ্চ স্বরে সঙ্গীত পিছনে দুই প্রৌঢ়-প্রৌঢ়ার মুখ চাওয়া চাওয়ি৷

এক সময় গাড়ির ভিড় পাতলা হতে শুরু হলো৷ শরীরের একটু বিশ্রামের প্রয়োজন হয়ে পড়লো৷ তা ঘন্টাখানেক ওই সঙ্গীত গর্জনে কানের পরিশ্রম হওয়াতে বিশ্রাম উঠলো মাথায়৷

দেখতে দেখতে পঞ্জাবের রাস্তাও শেষ হলো শুরু হলো হিমাচল ভূমি৷ প্রৌঢ়ার  দীর্ঘ চর্চিত পারদর্শিতা পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে বমনদ্রেক ব্যস্ত করে তুললো শুধু প্রৌঢ়কে নয় সারথীকেও ৷ তবে সারথীর সম্ভবতঃ এ অবস্থার যথেষ্ট অনুভব থাকায় পুরোপুরি নির্বিকার না হলেও অনেকটা উদাসীনতা পথের সময়কে দীর্ঘায়িত করলো না৷

এই পথ চলায় খাদ্যহীন থাকার সুবিধা অনেক৷ সেই সুবিধা ভোগ (কিংবা দুর্র্ভেগ) করতে  করতে উপস্থিত হলো উন্নয়নের দুর্দশা৷ পথ কে পাহাড় সরিয়ে (কেটে) চওড়া করার উদ্যোগের ব্যবস্থা৷ নানা স্থানে দীর্ঘ অপেক্ষা৷ গ্রীষ্মের তীব্র দহন জ্বালা৷ সঙ্গতে শ্রীমতির বন্ধ গাড়িতে মন্দ শরীরের উপাখ্যান৷ অবসন্ন পরিশ্রান্ত শরীরে পৌঁছালাম বশিষ্ট কুণ্ডের ধারে নির্দিষ্ট গৃহে৷

বাহন থেকে একের এক থলে, থলি, ঝোলা, ঝুলি, বটুয়া যখন নামতে লাগলো তার পরিমান দেখে নন্দনের শ্মশ্রু গুম্ফর ফাঁকে মিচকি হাসি প্রৌঢ়ের চোখ এড়ালো না৷

গৃহিনী ততক্ষণে গৃহপ্রবেশ করেছেন৷ তার স্বস্তির শ্বাস পুত্রের উদ্বেগ দূরীকরণে সাহায্য করলো৷ যাক নিবাস মনোনয়নের শ্রম সার্থক৷

কিছু সময়ের মধ্যেই গৃহাধিকারির স্বপত্নী উপস্থিতি পাহাড়ি আন্তরিকতার ছোঁয়া দিয়ে গেল৷ গৃহিনী গৃহের সাজানো গোছানোর দিকে মনপ্রাণ ঢেলে ভুলিয়ে দিল মন্দ শরীরের ছন্দ পতনের উপাখ্যান৷

বেশ কিছু দিন পরে আত্মজ দর্শনে শ্রীমতির অপত্য স্নেহ উপচে  উঠতে লাগলো শারীরিক ও বাচিক অভিব্যক্তিতে৷ কিন্তু নন্দনের কাজের সময় হয়ে যাওয়ার তার ছেদ পড়লো৷ এটা জেনেই খুশি থাকতে হলো মাঝে বিরতির সময়ে আবার এসে দেখা করে যাবে৷

অলিন্দে বসে চা পানের সময় প্রথমেই যা মন কাড়লো তা হলো সবুজে ভরা ঊর্ধকায়  পর্বতের গায়ে মেঘের চালচিত্রে নানারূপ গ্রহণ ও বর্জন৷ দূরের শৈলশ্রেণীর গলায়  বরফের তৈরী রুপোলী নানা নরীর হার৷ পাইনের সারিভরা নানান মাপের গিরিচূড়া৷ সামনে বিয়াস (বাঙালীর বিপাশা-কৃতজ্ঞতা রবীন্দ্রনাথ) নানা মাপের নুড়ির সমারোহে জানিনা কত যুগ ধরে বয়ে চলা এ নদী এখন স্নিগ্দ রূপে  বিরাজমান৷  বর্ষায় নাকি প্রলয়ংকারী৷ কেবল অহোরাত্রি ধবনিশৃঙ্খলার  আয়োজনে জানান দিয়ে যাচ্ছে তার প্রবাহমানতা৷

পাইন ছাড়াও অনেক নাম না জানা বৃক্ষের সমারোহ৷

দেরি করে রাত নেমে আসা দেখার অভ্যেস আছে৷ শান্তিহরণ প্রকৃতির স্পর্শে আবাস সংলগ্ণ অলিন্দে বসে ভুলেই গেলাম গত ১৭ ঘন্টার যাত্রার পূর্ব উপলদ্ধি৷ বয়ে আনা আনাজপাতিতে রাতের আহার্যের আয়োজন তাড়াতাড়ি করা গেল গৃহকর্ত্রীর সুনিপুণ সঞ্চালনায়৷ ভোজন শেষে আবার অলিন্দে৷ এবার গায়ে হালকা চাদর৷ ২৪ ঘন্টা আগেও দাবদাহের কথা মনেই আসছিল না৷ মন তখন বর্তমানেসু বর্ত্ততে৷  (ক্রমশঃ)