মানব সমাজের অন্তিম লক্ষ্য

লেখক
খগেন চন্দ্র দাস

অধ্যাপক অভ্র ঘোষ ২০২০ সনে কলকাতার আনন্দ পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত গ্রন্থ গান্ধী, দৃষ্টির বিচিত্রতায়-এর ১৫৮ পৃষ্ঠায় একটি  অত্যন্ত গভীর তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য করেছেন৷ তিনি লিখেছেন---‘‘মানব সমাজ কোন আদর্শ বা নীতি অবলম্বন করে মুক্তির স্বর্গে পৌঁছাতে পারবে আমরা কেউ তা জানি না৷’’ আমরা যে শুধুমাত্র মুক্তির স্বর্গে পৌঁছাবার রাস্তাটা জানি না তাই নয়, আমাদের অনেকেই এটাও জানি না যে সেই স্বর্গের যথার্থ স্বরূপটি কেমন! বিষয়টি অধ্যাত্মবাদী, জড়বাদী ও বিজ্ঞানী এই তিনজনের দৃষ্টিকোণ থেকেই বিচার করে দেখা যাক৷

জড়বাদী দর্শনের প্রবক্তা কার্ল মার্ক্স মানবসমাজের অন্তিম লক্ষ্যের কথা বলতে গিয়ে মানবসমাজকে ছয়টি পর্যায়ে ভাগ করেছেন৷ ক্রমবিকাশগুলি যথাক্রমে---(১Primitive Communism  আদিম কমিউনিজম্‌৷ (২) Slave Society (দাস প্রথার সমাজ) (৩Feudalism (সামন্তবাদী সমাজ) (৪)Capitalism ধনতান্ত্রিক সমাজ৷ (৫)Socialism (সমাজবাদ)৷ (৬)Global Stateless Communism আন্তর্জাতিক সীমানাবিহীন কমিউনিজম্‌৷) এই চূড়ান্ত পর্যায়ে সমাজে মানুষের  মধ্যে অর্থনৈতিক বা অন্য কোনরকম শ্রেণী বিভাজন থাকবে না, অর্থের কোনরকম ব্যবহার থাকবে না৷ অর্থাৎ টাকা পয়সার প্রয়োজন থাকবে না৷ আজকের মত বিভিন্ন দেশের মধ্যেকার সীমানা ইত্যাদি কোনকিছুরই প্রয়োজন থাকবে না৷ পুলিশ, মিলিটারীর আবশ্যকতা থাকবে না৷ সমাজে মানুষের মধ্যে অনাবিল সুখ-শান্তি, সৌহার্দ্য, সৌভ্রাতৃত্ব বিরাজ করবে৷ যাকে  এক কথায় বলা হয়েছে ফাইনাল সিনথেসিস্‌, চূড়ান্ত সংশ্লেষণ বা সমন্বয় ৷ আপাতদৃষ্টিতে মানবসমাজের  স্বপ্ণীল  কল্পনার  দৃশ্যটি নিতান্ত নিরীহ, শ্রুতিমধুর  অবশ্যই আশাব্যঞ্জক৷ সব চাইতে বড় কথা হতদরিদ্র মানুষকে আকর্ষণ করার এক অমোঘ আকর্ষণী ক্ষমতা রয়েছে এই চরম ভাববাদী বক্তব্যের মধ্যে৷ যে দর্শনে তথাকথিত ধর্মীয় মতবাদগুলিকে অবাস্তব বলে আফিমের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছিল অথচ ভাগ্যের কী পরিহাস, সেই মার্ক্সবাদ নিজের মধ্যেই জন্ম দিয়েছে আর ভয়ঙ্কর এক নেশার বস্তুকে৷ মার্ক্স মানবসমাজের উৎপত্তি সম্পর্কে সাফ জানিয়ে দিলেন---‘The philosophers have only interpreted the world in various ways;the point however is to change it. " (Marxists internet Archives.)’’ দার্শনিকগণ এযাবৎ শুধু নানাভাবে পৃথিবীর ব্যাখ্যা করেছেন এখন পৃথিবীটাকে বদলানোর প্রয়োজন৷ অবশ্যই বদলানোর প্রয়োজন৷ কিন্তু বদলাবার আগে এর সামগ্রিক ইতিহাস, ত্রুটিবিচ্যুতিতে মানুষের মনস্তত্বের জটিল খুঁটিনাটি বিষয়, সবই জানতে হবে৷ আর এসব না জেনেই শুধু কল্পনার স্বর্গে বসে শিব গড়তে চাইলে কেবলই বাঁদর গড়া হবে৷ মার্ক্সবাদীরা পৃথিবীজুড়ে এযাবৎ যা যা করেছেন ও এখনও করে চলেছেন৷

মানুস ও তার সমাজের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ সম্পর্কে বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু তাঁর ‘‘ভাগীরথীর উৎস সন্ধানে’’ শীর্ষক প্রবন্ধে নদীর উৎপত্তি থেকে সমুদ্র যাত্রা বাতাসের সাহায্যে মেঘ হয়ে বৃষ্টির আকারে নদীর উৎসে আবারও ঝরে পড়া---জলচক্রের এই নিরন্তর প্রবাহের সঙ্গে মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু---এর এক সুন্দর গ্রহণযোগ্য ছবি এঁকেছেন, যেখানে তিনি বলছেন---‘‘মৃত্যুতেই কি জীবনের পরিসমাপ্তি! সে কোথা যায়? আমার প্রিয়জন আজ কোথায়? তখন নদীর কলধবনির মধ্যে  শুণিতে পাইলাম, ‘‘মহাদেবের পদতলে৷’’

চতুর্দিকে অন্ধকার হইয়া আসিয়াছিল, কুলু কুলু শব্দের মধ্যে  শুণিতে পাইলাম, ‘‘আমরা যথা হইতে আসি, আবার তথায় ফিরিয়া যাই৷ দীর্ঘ প্রবাসের পর উৎসে মিলিত হইতে যাইতেছি৷’’ একটি অত্যন্ত গভীর ও জটিল বিষয়কে সাধারণ মানুষের বোঝার মত এর চেয়ে সহজ করে বলা কি সম্ভব? জগদীশচন্দ্র বসুর এই দার্শনিক চিন্তার মধ্যে মানুষের জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একটি পূর্ণ চিত্র আছে৷ যা মার্ক্সীয় দর্শনে অনুপস্থিত৷

আসুন দেখে নেওয়া যাক এই বিষয়ে ঋষি অরবিন্দ কী বলছেন৷ ‘‘....অগণিত বিবিক্ত প্রাতিভাসিক ধর্মের একটা অন্ধ অসহায় লক্ষ্যহীন স্বয়ম্ভূ-পিণ্ড অনন্তকালের কক্ষপথে ছুটে চলেছে সংঘাত ও সংঘর্ষের বিক্ষুব্ধ মত্ততায়... এ কখনও জগতের সত্যরূপ হতে পারে না৷ (অর্থাৎ সমস্ত গ্রহ-ণক্ষত্র নিয়ে এই যে তথাকথিত জড় মহাবিশ্বের অবিশ্রান্ত দুর্বার ছুটে চলা) অথবা এমনও বলতে পারি না, এ শুধু একটা তামসী শক্তির অপ্রমেয় স্বতঃস্ফূর্ত বিসৃষ্টি ও উচ্ছাস, এর অন্তরালে কোনও নিগৃঢ় বিজ্ঞানের প্রবর্তনা নাই, যা যাত্রার শুরু হতে শেষ পর্যন্ত সজাগ থেকে তার গতি ও পরিণামকে নিয়ন্ত্রিত করবে৷ বরং এই প্রত্যয়ই সত্য ও যুক্তিসহ স্বয়ংপ্রজ্ঞ অতএব অকুন্ঠ স্বাতন্ত্রে৷ স্বরাট এক অখণ্ড সত্তাই আবিষ্ট ও অন্তর্গূঢ় হয়ে আছে প্রাতিভাসিক সত্তাতে৷ বিশ্বের ব্যাকৃতিতে সেই আপনাকে রূপায়িত করছে, জীবব্যক্তির প্রচেতনায় মেলছে তার কমলদল৷’’ (দিব্য-জীবন, শ্রী অরবিন্দ, পৃষ্ট)

অন্যত্র তিনি তাঁর এই প্রত্যয়কে আরও দৃঢ়তার সঙ্গে তুলে ধরেছেন৷ (যেহেতু মানবজাতি সাধারণভাবে জীবনের মধ্যে  ভগবানের কোন না কোন রূপের ক্রমশই নিকটবর্তী হচ্ছে ও ক্রমবর্ধমান সংখ্যায় মানুষ সেই উপলব্ধি লাভ করছে...৷’’ (মানব যুগচক্র, শ্রীরবিন্দ, পৃঃ৬৯)

সারকথা এই যে, উদ্দেশ্যহীন চলা সম্ভব নয়, উচিতও নয়৷ বিশ্বসৃষ্টির আড়ালে স্রষ্টার একটি মহৎ উদ্দেশ্য রয়েছে তা জগদীশ চন্দ্র বসুর ভাষায় সৃষ্টির সমস্ত কিছু যে উৎস থেকে উৎসারিত সেই উৎসেই ফিরে যাওয়া ‘‘আমরা যথা হইতে আসি তথায় ফিরিয়া যাই৷’’ এই ফিরে যাওয়ার সীমাহীন প্রচেষ্টার মধ্যেই নিহিত রয়েছে আমাদের সার্বিক কল্যাণ৷

আর তাই শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী কাগজে কলমে আনন্দমার্গ প্রচারক সংঘ প্রতিষ্ঠার শুরুর দিনটিতেই৯ জানুয়ারি ১৯৫৫ তুর্যকন্ঠে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করলেন---‘‘মানুষ তুমি ওঁঙ্কারের পথ ধরে সুক্ষত্বের দিকে এগিয়ে চালো৷ ছুটো না তুমি আপাতমধুর তমোগুণী মরীচিকার দিকে৷ সত্ত্বগুণে প্রতিষ্ঠিত হয়ে তারপর ব্রহ্মত্বে লীন হও৷ ওঁঙ্কার যেখান থেকে এসেছে সেখানে গিয়ে পৌঁছাও৷ সাধনায়, নিষ্ঠায় জাগিয়ে তোলো নিজের সুপ্ত মনুষ্যত্বকে---উদ্বোধন কর দেবত্বের মনীষাকে, আর সেই সাধনালব্ধ শুচীশুভ্র দেবত্বকে বিলিয়ে দাও ব্রাহ্মী মহিমার অখণ্ড স্রোতে৷ অর্জন করো সেই পরমা স্থিতি যার জন্যে অনাদিকাল থেকে তুমি অনেক কষ্টে এগিয়ে এসে আজ নিজেকে মানুষ বলে পরিচয় দেবার সুযোগ পেয়েছ৷’’ (সুভাষিত সংগ্রহ, প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় খণ্ড একত্রে শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী, পৃঃ১৯)

এই সর্র্বেচ্চ ব্রাহ্মী ভাবনায় ভাবিত না হয়ে যে কাজই মানুষ করুক না কেন সফল হওয়া সম্ভব নয়৷ সে কাজ ব্যষ্টিগত, রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, সাংঘটনিক অথবা মার্ক্সের সেই গ্লোবাল স্টেটলেস কমিউনিজম হোক বা ‘‘আনন্দ পরিবার’’ ঘটন বা অন্য যা-ই হোক না কেন৷ লক্ষ্য শুধুমাত্র দর্শন পুস্তকের পাতায় থাকাই যথেষ্ট নয়৷ লক্ষ্যটি যতক্ষণ নিরন্তর আমার, আপনার, মানবসমাজের সামনে ধ্রুবতারা মত জ্বলজ্বল করবে ততক্ষণ সব চলাই সফল ও স্বার্থক৷ আর চলার পথে যখনই লক্ষ্য বিচ্যুতি ঘটছে তখন কেবলই হতাশা ও নৈরাশ্য ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না৷ যা মার্ক্সবাদের ক্ষেত্রে ঘটেছে৷