মানুষ মানুষ হারায়ে হুঁশ

লেখক
মনোজ দেব

মহান দার্শনিক ঋষি শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার তাঁর রচিত ৫০১৮টি প্রভাত সঙ্গীতের একটিতে লিখেছেন---

‘‘মানুষ মানুষ হারায়ে হুঁস কোথায় চলেছ তুমি

আকাশ বাতাস বিষিয়ে দিয়ে নরক করে’মর্ত্ত্যভূমি৷৷’’

সম্প্রতি মুম্বাইয়ের সাকিনাকায় দানবীয় বর্বরতার শিকার  ৩৪ বছরের এক মহিলা গত ১১ই সেপ্ঢেম্বর মারা যান৷  তাঁর প্রতি যে নারকীয় অত্যাচার মনুষ্য পরিচয় নিয়ে  দ্বিপদ জীব করেছে৷ --- তা সমগ্র মানব সমাজের লজ্জা৷ মানুষ যেন দিন দিন ভুলে যাচ্ছে সে মানুষ!

আজকের  সমাজের  সবচেয়ে  বড় সমস্যা মানুষ আজ দিশা  হারিয়েছে৷ মানুষ  ভুলে গেছে  তার লক্ষ্য  কী? শিক্ষিত থেকে সাধারণ  মানুষ  এই একই  ব্যাধিতে আক্রান্ত৷ কেবল সাময়িক আত্মসুখের পেছনে সবাই উন্মত্তের  মত ছুটে চলেছে৷ আর সীমাহীনভাবে এই আত্মসুখের উন্মত্ততায় মানুষ প্রকৃতপক্ষে সমাজের বৃহত্তর স্বার্থের বিরুদ্ধে ছুটে চলেছে, বৃহত্তর সমাজের চরম ক্ষতি ডেকে আনছে৷  মানুষের সঙ্গে মানুষের প্রকৃতপক্ষে পারস্পরিক সম্পর্ক কী সেটাই সে জানে না৷ তাই সমাজের প্রতি তার কর্তব্য, পরিবেশের সঙ্গে তার কর্তব্য সেটাই সে বিস্মৃত৷ আর নিজের  প্রকৃত কল্যাণটাই  বা কী  বা কোন পথে  এ সম্পর্কে ই মানুষ আজ সম্পূর্ণ অজ্ঞ৷ সমাজের সমস্ত  সমস্যার  মূল  কিন্তু এখানেই৷

এই  পরিস্থিতিতে আনন্দমার্গের প্রবর্তক শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী মানুষকে তার জীবনের সঠিক দিশা দেখিয়েছেন৷ মানুষের জীবনের পরমলক্ষ্য ও কর্তব্য চোখে  আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছেন৷ সমাজের সমস্ত সমস্যার  প্রকৃত সমাধানের পথ নির্দেশনা দিয়েছেন৷ এটাই মানবসমাজকে শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী সবচেয়ে বড় অবদান৷

মূলনীতি যদি ভুল হয়, তাহলে কর্মধারা যাই হোক না কেন তা শেষ পর্যন্ত ভুল হতে বাধ্য ও তা শেষ পর্যন্ত মানুষের কল্যাণ না করে অকল্যাণই সাধন করতে বাধ্য৷  জীবনের  তথা সমাজের এই মূল নীতিটাই শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তি সুস্পষ্টভাবেই ব্যাখ্যা করে দিয়েছেন৷

 মানুষের জীবনের লক্ষ্য সম্পর্কে পন্ডিত মহলে, দার্শনিক মহলেও মতভেদের  অন্ত নেই৷ যাঁরা জড়বাদী, তাঁরা ঈশ্বরকে স্বীকার করেন না, মনের স্বতন্ত্র অস্তিত্বকেও তাঁরা স্বীকার  করেন না৷ মনকে মস্তিষ্কের একটা গুণ বলেন৷ দৈহিক প্রয়োজনের  পূর্ত্তি হলেই মানুষের  সমস্ত সমস্যার অবসান হবে বলে তাঁরা  মনে করেন৷ তাঁদের কাছে  মানসিক ও আধ্যাত্মিক শিক্ষার কোনো প্রয়োজন নেই৷ তাঁরা মনে করেন, সমাজের সামাজিক -অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পরিবর্তনের  মাধ্যমেই সমাজের সমস্ত সমস্যার সমাধান সম্ভব ও মানুষের  সর্র্বত্মক কল্যাণ সম্ভব৷ এই ধারণার  বশবর্তী হয়ে মার্কসবাদীরা বিপ্লবের নামে সারা বিশ্বজুড়ে লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যা করে সমাজব্যবস্থা পাল্টাতে উদ্যোগী হলেন৷  অনেক দেশে তাঁরা ক্ষমতার আসনেও এলেন৷  শেষ পর্যন্ত সর্বত্র চরম নিষ্ঠুরতাপূর্ণ একনায়কতন্ত্রের শেষে  মার্কসবাদের অপমৃত্যু ঘটল৷

বর্তমান বিশ্বজুড়ে যে ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা, তার মূলে রয়েছে আত্মসুখতত্ত্ব৷  নিজেই সুখে থাক৷ সবাই সুখ চায়৷ আর এই সুখপ্রাপ্তির জন্যে যত পার ভোগ্যদ্রব্য করায়ত্ত কর৷ এই ভোগবাদের উন্মাদনায়, বলতে গেলে, সারা বিশ্ব আজ উন্মাদ হয়ে উঠেছে৷ মানুষ হয়ে উঠছে চরম স্বার্থপর৷  এই স্বার্থপরতার প্রকাশ আমরা দেখতে পাচ্ছি সমাজের নানান অমানবিক ঘটনায়৷ এরই ফলে চলছে সর্বত্র ব্যভিচার , নারী নির্র্যতন, অবাধ দুর্নীতি ও শোষণ৷ সমাজে অন্যের প্রতি দায়বদ্ধতা, পরিবেশ-চেতনা, সবকিছু ভুলে পৃথিবীটাকে আজ নরক বানিয়ে ফেলা হচ্ছে৷

তথাকথিত ধর্মের ক্ষেত্রেও আজ অজস্র কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস,  অযৌক্তিক ও অমানবিক লোকাচার মানব সভ্যতাকে  বদ্ধ জলাশয়ে পরিণত  করে ফেলেছে৷ আর সেই বদ্ধ জলাশয় মারাত্মক সব ব্যাধির ডিপো হয়ে উঠেছে৷  মানুষের   সমাজ  প্রগতির  রাস্তা ভুলে গেছে৷ বিভিন্ন ধর্মমতের  (রিলিজিয়ন) অনুগামীরা মানবসমাজের শান্তিকে  চরমভাবে বিঘ্নিত করছে৷ 

আধ্যাত্মিক জগতের বিভিন্ন দর্শন দ্বৈতবাদ, অদ্বৈতবাদ কোনোটাই নিপীড়িত মানবতার  মুক্তির যথার্থ পথ দেখাতে পারছে না৷  মানুষের সমাজ  অন্ধকারে  পথ হারিয়েছে৷

এই পরিপ্রেক্ষিতে যুগপুরুষ শ্রীশ্রীআনন্দমূত্তিজী মানুষকে  নোতুন পথের সন্ধান  দিয়ে  বলেছেন, দ্বৈতবাদ নয়, অদ্বৈতবাদও  নয়, মানুষের যথার্থ আদর্শ হ’ল ‘অদ্বৈত-দ্বৈতাদ্বৈতাবাদ’৷ অর্র্থৎ শুরুতে অদ্বৈত, তারপর দ্বৈত, অন্তিমে আবার অদ্বৈত৷ অর্র্থৎ এক পরমব্রহ্ম থেকে জগৎ তথা জগৎবাসীর সৃষ্টি৷ এই জগৎবাসীর জীবনের পরম লক্ষ্যও সেই এক পরমব্রহ্মে মিলে মিশে একাকার হয়ে যাওয়া৷

জীবনের  লক্ষ্য হবে ব্রহ্ম-পরমাত্মা৷  একই আত্মার  প্রবাহ সবার মধ্যে৷ একই আত্মিক সূত্রে সবাই বাঁধা রয়েছে৷ তাই পারস্পরিক ভালবাসা-বিশ্বপ্রেম এটাই স্বাভাবিক৷ সমস্ত  মানুষই  শুধু নয়,  জীবজন্তু, পশুপাখী, তরুলতা সবাইকে ভালবাসতে হবে৷ এই পৃথিবীর সবাইকে নিয়ে এগিয়ে চলতে হবে জীবনের চরিতার্থতার পথে৷  এটাই মানুষের জীবনের প্রকৃত আদর্শ৷  এটাই সমস্ত মানুষের প্রকৃত কল্যাণের পথ ৷ শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তি এরই নাম দিয়েছেন নব্যমানবতাবাদ৷ এই নব্যমানবতাবাদই  নিপীড়িত মানবতার একমাত্র আশ্রয়৷  আজকের সমস্ত সমস্যার  সমাধান এই নব্যমানবতার পথেই আসবে৷

এই নব্যমানবতাবাদে মানুষকে  প্রতিষ্ঠিত হতে হবে৷ তারজন্যে চাই উপযুক্ত নৈতিক ও আধ্যাত্মিক শিক্ষা৷ সঙ্গে সঙ্গে ধর্মের  নামে যে সমস্ত অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার, ডগ্‌মা তথা ভাবজড়তা রয়েছে--- এই সবকিছুর ঊর্ধে উঠতে হবে৷ এই যুক্তি ও বিজ্ঞানসম্মত আধ্যাত্মিক মানবতাবাদই মানুষের  হুঁশ ফিরিয়ে আনার একমাত্র পথ, আজকের সমাজের সমস্ত সমস্যার একমাত্র সমাধান৷