বাঙালী চরিত্রে বদনাম-লেপা-কালি নিয়ে কবি সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবী দার্শনিক ঐতিহাসিক এমনকি পণ্ডিতদেরও মুখরোচক সমালোচনার অন্ত নেই৷ বাঙালী নিজের দোষের কাঁদুনি নিজেই গায়৷ আর মজা পায় অবাঙালীরা, বিদেশীরাও---মওকা বুঝে তারা তো দিন রাত বাঙালীর নিন্দে-অপবাদ-বাপান্ত করে চলেছে৷ আত্মসমালোচকরা বিশ্বাস করেন---আত্মসমালোচনায় মহত্ত্ব আছে, ক’জন পারে নিজের দোষ ধরতে? প্রবাদ বাক্য তো বলে--- মানুষ নিজের দোষ নিজে দেখতে পায়না৷ যেমন চোখের মাঝে কী আছে তা চোখ দেখতে পায়না৷ বাঙালী উদার, নিরপেক্ষ, নির্ভীক ও স্পষ্টবক্তা বলেই তাঁর সাদা কথায় কাদা নেই! কিন্তু এটা কোন দোষ নয়, বরং এটা বাঙালীর একটা মহৎ গুণ৷ কেননা আত্মসমালোচনা সঠিক ও পরিপূর্ণতার দিশা পেতে সাহায্য করে৷ পৃথিবীর কটা জাতি এমনটা নিজের দোষ ধরতে পেরেছে? নজীর নেই৷ সবাই নিজের ঢাক নিজেই পেটায়৷ ব্যতিক্রম হচ্ছে বাঙালী৷ এখন একটা প্রশ্ণ বাঙালী গায়ে যে বদনামের কাদা লেপা হয়েছে তা কতটা সত্যি? তা কতটা জিনগত? বা তা কতটা ফাঁসানো মিথ্যে বদনাম? বাঙালীর দায়ভারই বা কতটা? এক্ষেত্রে একটা ইংরেজী প্রবাদের কথা মনে পড়ছে--- কুকুরটাকে যদি মারতে চাও তবে একটা বদনাম দিয়ে দাও৷ তাহলে বাঙালীর সাড়ে সর্বনাশের পথ পাকা করতেই কী বাঙালীর ঘাড়ে বদনামের বোঝা চাপানো হয়েছে? নাকি এটা একটা সুদূর প্রসারী ষড়যন্ত্রের কল? এর উত্তর খোজার আগে কতগুলো বিষয়ের ওপর নজর দেয়া যাক---সমাজ বিজ্ঞানী ও মনোবিজ্ঞানীরা বলে থাকেন যে কোন ব্যষ্টি-মানুষের এমনকি তার এথ্নিক্ গ্রুপের স্বভাবধর্ম বা বৈশিষ্ট্য গড়ে ওঠার পিছনে কতগুলো শর্ত কাজ করে৷ যেমন প্রথমকথা---বাসভূমি বা ভূপ্রকৃতি বা পরিবেশের (ভৌগোলিক ও মানবিক) বিরাট ভূমিকা আছে৷ দার্শনিক শ্রেষ্ঠ শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার একেই স্বীকৃতি দিয়ে বলেন---’’ ভৌগোলিক পরিবেশ-পরিমণ্ডল স্থানীয় অধিবাসীদের পোশাক-পরিচ্ছদ, খাদ্যদ্রব্য, দৈনন্দিন ব্যবহার্য সামগ্রী, আচার-আচরণকে বিপুলভাবে নিয়ন্ত্রিত ও প্রভাবিত করে৷ এমনকি স্থানীয় জলবায়ু তার অধিবাসীর ভাবনা চিন্তা চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও স্বভাবকে নিয়ন্ত্রিত করে৷’’ যেমন---ক) নদীমাতৃক বাঙলার আদিগন্ত বিস্তৃত শ্যামল-সবুজ কান্ত-কোমল-পেলব রূপমাধুরী বাঙালীকে করেছে শান্ত স্বভাবের অন্তর্মুখী ও ভাবপ্রবণ৷
(খ) প্রকৃতি তাঁর সব ধরণের সম্পদের ডালাটা উজাড় করে ঢেলে দিয়েছে বাঙলাকে৷ তাই পেটের চিন্তায় বাঙালীকে হারিয়ে যেতে হয়নি৷ সহজলভ্য অফুরন্ত সম্পদের উত্তরাধিকারিত্ব তাকে দিয়েছে অতিরিক্ত অবসর কাল তাকে করেছে চিন্তাশীল, বিচারশীল, উদার ও অতিথি পরায়ণ৷
(গ) তা হলেও গ্রামে গাঁথা বাঙলার আপাত কৃষিনির্ভর নিঃস্তরঙ্গ জীবনধারায় অস্তিত্ব রক্ষার তীব্র সংগ্রামের খামতি ছিল না৷ বাঙলার নদী-নালা-খাল-বিল-বাওড়ের জলে কুমীর, আর ডাঙ্গায় বাঘের সঙ্গে মোকাবিলা করে টিকে থাকতে হয়েছে৷ তাই বাঙলার একটা বড় অংশের নামই ‘বাগড়ী (ব্যাঘ্রতটি বাগড়ি) অর্থাৎ যে অঞ্চল সব সময় বাঘের গর্জনে কেঁপে কেঁপে উঠত৷ এর থেকে একটা প্রবাদবাক্য ও তৈরী হয়ে গেল--- ‘‘ডাঙ্গায় বাঘ জলে কুমীর’’৷ মারী -মহামারী, ঘুর্ণীঝড় -প্রবল জলোচ্ছ্বাসে বারংবার বাঙালীর মাথা গোঁজার ঠাঁই, সৃষ্টি-কৃষ্টি-কীর্তি-এমনকি জনজীবনের চিহ্ণ পর্যন্ত ধবংস হয়ে গেছে৷ একাদশ-দ্বাদশ শতকে ‘ডবাক’ কুমিল্লা অঞ্চলে এমন ঘটনা ঘটেছে৷ আবার খুব বেশী দিনের কথা নয়---১৭৩৫ সালে ভাগীরথীর দক্ষিণ পাড়ের রাণাঘাট পর্যন্ত প্রবল ঘুর্ণীঝড়-জলচ্ছ্বাস সবকিছু একেবারে ধুয়ে-মুছে সাফ করে দিয়েছিল৷ ‘‘কই মাছের প্রাণ’’ বাঙালীর, দুর্জয় প্রাণশক্তিতে আবার নোতুন করে শুরু করে ঈর্ষনীয় উচ্চতায় পৌঁছিয়েছে৷ অর্থাৎ জীবন যুদ্ধে টিকে থাকতে প্রতিকূল পরিবেশ প্রকৃতিই বাঙালীকে আবার প্রতিস্পর্ধী, দুঃসাহসী, মরণপণ লড়াকু করেছে সংগ্রাম---আমৃত্যু লড়াই-এর বীজ তার রক্তে৷ প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াইটা বরফের দেশের মানুষের একরকম, মরুভূমির মানুষের আর এক রকম, বাঙলার মানুষের অন্যরকম৷ প্রকৃতিজাত কারণেই আর পাঁচটা রণনিপুণ জাতের মতই প্রতিস্পর্ধী রণকুশলী জাত৷ ইতিহাস তার অসংখ্য সাক্ষ্য বহন করছে৷ অতুল ঐশ্বর্য থাকায় বাইরের হানাদারীও কম ছিল না৷ সাম্রাজ্যবাদী হানাদার লুটেরা’রা বারবার বাঙলায় আক্রমণ শানিয়েছে দু’পথে--- স্থলপথে রাঢ়ের ওপর দিয়ে ও সমুদ্রপথে বঙ্গোপসাগর বেয়ে৷ তাই বাঙলাকে তার মোকাবিলা করতে দুর্ধর্ষ নৌবাহিনী গড়তে বাধ্য করেছিল৷ ইতিহাস তারও সাক্ষী৷ বাঙালী শৌর্যে বীর্যে গর্বিত মুগ্দ মধুকর বাঙালী কবির সুললিত ধবনিঝঙ্কারে তারই বর্ণময় উচ্ছ্বাস৷
‘আমরা বাঙালী বাস করি সেই বাঞ্ছিত ভূমি বঙ্গে
বাঘের সঙ্গে যুদ্ধ করিয়া আমরা বাঁচিয়া আছি,
আমরা হেলায় নাগেরে খেলাই, নাগেরি মাথায় নাচি৷
একহাতে মোরা মগেরে রুখেছি, মোগলেরে আর হাতে,
চাঁদ-প্রতাপের হুকুমে হঠিতে হয়েছে দিল্লীনাথে৷
মন্বন্তরে মরি নি আমরা মারী নিয়ে ঘর করি,
বাঁচিয়া গিয়াছি বিধির আশিসে অমৃতের টীকা পরি৷
- Log in to post comments