প্রকৃত আত্মবিকাশের পথ আধ্যাত্মিকতা

লেখক
সত্যসন্ধ দেব

আজ একবিংশ শতাব্দীর ডিজিটাল ভারতেও অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারে আবদ্ধ মানুষ ভাবে গঙ্গাস্নানে পাপক্ষয়  ও পুণ্য সঞ্চয় হবে বা গোরুর লেজ ধরে ভববৈতরণী পার হওয়া যাবে  এখন দেখা যাক্, পাপ–পুণ্য কী? ব্যাসদেব বলেছেন, ‘‘অষ্টাদশ পুরাণেষু ব্যাসস্য বচনাদ্বয়ম্, পরোপকারায় পুণ্যায় পাপায় পরপীড়নম্৷’’ অষ্টাদশ পুরাণে ব্যাসদেবের শিক্ষা হ’ল পরোপকার পুণ্য ও পরপীড়ন পাপ৷

মুনীঋষিরা এও বলেছেন কর্মের ফল ভুগতেই হয়৷ সৎকর্মের সুফল ও অসৎকর্মের কুফল – দুইপ্রকার ফলেরই ভোগ হয়৷

তাই সুখ–দুঃখকে জীবনের অঙ্গ ভেবে নিয়েই সাধন–ভজন, সৎকর্ম করে যেতে হবে৷ সিদ্ধ–যোগী, মুনী–ঋষি – সবাই একথাই বলেছেন, গীতা, উপনিষদ, তন্ত্রও একথাই বলছে৷ অমুক নদীতে, অমুক তীর্থে স্নান করলে সব পাপ ধুয়ে মুছে যাবে আর রাশি রাশি পুণ্যার্জন হবে – এ সবের মধ্যে কোনো যৌক্তিকতা নেই৷

এটাও মনে রাখতে হবে, বিভিন্ন সময় লোকশিক্ষার জন্যে অনেকে অনেক পুরাণ, মঙ্গলকাব্য প্রভৃতি লিখেছেন৷ সেগুলিতে আসলে নানান্ কাল্পনিক কাহিনী কথিত হয়েছে – আর সেই কাহিনীর মাধ্যমে পুরাণকাররা কিছু সদুপদেশ দেওয়ার চেষ্টা করেছেন৷ ‘পুরাণ’ মানেই লোকশিক্ষার্থে রচিত কাহিনী৷ এই সমস্ত কাহিনীর মধ্যে অনেক স্ববিরোধী কথাও রয়েছে৷ অনেক ক্ষেত্রে অনেক অযৌক্তিক ও অবান্তর কথাও রয়েছে৷ সেই সব ক্ষেত্রে মুনী–ঋষিরা যুক্তি বিচার করে  সত্যাসত্য নিরূপণের নির্দেশ দিয়েছেন৷ তাই তাঁরা বলেছেন, –

                ‘‘কেবম্ শাস্ত্রমাশ্রিত্য ন কর্তব্যো বিনির্ণয়৷          যুক্তিহীন বিচারের তু ধর্মহানি প্রজায়তে৷৷

তাই কেবল শাস্ত্রের দোহাই দিয়ে কর্তব্য নির্ধারণ করা উচিত নয়, শাস্ত্রে বলা হলেও যদি যুক্তিহীন বিবেচিত হয় তাহলে তা করা উচিত নয়, তা করলে ধর্মহানি হয়৷ আবার শাস্ত্রেই বলা হয়েছে –

‘‘যুক্তি যুক্তমুপাদেয় বচনং বালকাদপি৷

অন্যং তৃণমিব ত্যজ্যমপ্যুক্ত পথ জন্মনা৷৷

একটি বালকও যদি যুক্তিযুক্ত কথা বলে তা মানা উচিত, স্বয়ং পদ্মযোনি ব্রহ্মাও যদি অযৌক্তিক কথা বলেন, তা তৃণবৎ পরিত্যাগ করবে৷

যাইহোক, গীতা, উপনিষদ, তন্ত্র সর্বত্রই অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার ত্যাগ করে ধর্মসাধনা ও পরোপকারে সৎকর্ম করে পুণ্য অর্জনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে৷ পাপক্ষয় ও পুণ্যার্জনের এই ‘সট কাট’ পদ্ধতির কথা কোথাও সিদ্ধযোগী, মুনী–ঋষিরা বলেননি৷

আসলে সমাজের এক শ্রেণীর সুবিধাবাদী মানুষ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পুস্তক লিখে বা বিভ্রান্তমূলক উপদেশ দিয়ে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করেছে৷ সরল, অজ্ঞ, সাধারণ মানুষ, এমনকি তথাকথিত অনেক শিক্ষিত মানুষও তাদের কুমৎলবের শিকার হয়েছে আর অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের জালে জড়িয়ে পড়ে ওই  সমস্ত সুযোগসন্ধানী মানুষদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ শোষণের শিকার হয়েছে৷

কালক্রমে ওই শোষণের জাল বৃদ্ধি পেতে পেতে সারা দেশকে ছেয়ে ফেলেছে৷ এতে  ওই  সমস্ত ধর্ম ব্যবসায়ীদের বংশানুক্রমিকভাবে বা শিষ্যানুক্রমিকভাবে সহজে অর্থ রোজগারের ব্যবস্থা পাকা হয়েছে৷

এমনিভাবেই সমাজে জাত–পাত–সম্প্রদায় ভেদ, বিশেষ বিশেষ তীর্থমাহাত্ম্য থেকে শুরু করে অজস্র ধরণের অযৌক্তিক আচার–নুষ্ঠান গোটা সমাজকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে৷ এর ফল স্বাভাবিকভাবে মানুষ স্বচ্ছবুদ্ধির স্রোত নানান্ ভাবজড়তার (ডগ্মার) আবর্জনাস্তুূপের মধ্যে রুদ্ধ হয়ে গেছে৷

অনেক তথাকথিত ধর্মকে, তাদেরও বলতে শোনা যায়, পূর্বপুরুষরা যা মেনে এসেছেন, তোমরা তা কেন মানবে না? তাহলে তো পিতা–পিতামহ তথা পূর্ব–পুরুষদের অপমান করা হয়৷ এতে ধর্ম বিনিষ্ট হয়৷ তাই কোনো যুক্তি না দেখিয়ে পূর্ব পুরুষদের অনুসৃত নীতি মেনে চল৷

তাই যদি হয়, তবে কি রাজা রামমোহন রায় সতীদাহ প্রথা বন্ধ করিয়ে, বিদ্যাসাগর মহাশয় বিধবা বিবাহ চালু করে, অনেক মহাপুরুষই অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে লড়াই করে অন্যায় করেছেন? পূর্বোল্লিখিত রক্ষণশীল ধর্মবেত্তারা কি সতীদাহ প্রথা সহ সমস্ত কুসংস্কারগুলিকে সমাজে চালু রাখার পক্ষপাতি? তা নিশ্চয়ই সমাজের পক্ষে কল্যাণকর নয়৷

মনে রাখতে হবে প্রকৃত ধর্ম তথা আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে কোনো প্রকার কুসংস্কার, অযৌক্তিক অন্ধবিশ্বাসের স্থান তো নেই, জাত–পাত–সম্প্রদায় ভেদেরও স্থান নেই৷ আধ্যাত্মিকতার পথ হ’ল প্রকৃত আত্মবিকাশের পথ৷ প্রকৃত আধ্যাত্মিকতা সম্পর্কে শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী বলেছেন–

‘‘আধ্যাত্মিকতা কোনো ভিত্তিহীন কল্পনা বিশ্বাস নয়৷