প্যাঁজ ফুলুড়ি

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

কারও পয়সা থাকলেই তার জেল্লা থাকে না, পয়সা থাকলেই তা’ সম্পত্তি পদবাচ্য হয় না৷ এই তো আমাদের চুঁচড়ো-চরকডাঙ্গার শ্রীযুক্ত ৰাৰু চাওয়া - চাটা চাটুজ্জেকে তোমরা অনেকেই  জানো! তার কত টাকা আছে কেউ জানে না৷ লোকে বলে, কুবের নাকি একবার তার টাকা গুণতে এসে অতি পরিশ্রমে অজ্ঞান হয়ে গেছলেন কিন্তু সেই চাওয়া-চাটা চাটুজ্জের  সম্পত্তি কি জেল্লাদার সম্পত্তি? তা কি ‘ভ’ পদবাচ্য? না, তা নয়৷ একটা ছোট্ট গল্প বলি, শোন ঃ

চাওয়া-চাটা-চাটুজ্জের বাড়ীই ছিল চউষট্টিটা--- চুঁচড়ো, চন্নগর আর চাতরায়৷ চাওয়া-চাটা বেশ মেপেজুকে কথা বলত৷ ভারী গলায় কথা বলে তার মনের ভেতরকার  ফাঁপা অবস্থাটা চাপা দেওয়ার চেষ্টা করত৷ ভারী গলায় কথা তো বলৰেই, কারণ যার আছে বাড়ী তার কথা ভারী ভারী, যার আছে ধান  তার কথা টান টান, আর যার আছে টাকা তার কথা ৰাঁকাৰাঁকা৷ ধান হাতে থাকে গ্রামের মানুষের৷ তাদের কথায় একটা টান থাকে৷ টাকা যার থাকে সে সোজা কথা বলে না--- ৰাঁকা কথা বলে৷

তা সে যাই হোক, আমাদের চাওয়া-চাটা চাটুজ্জে বাড়ীর পর বাড়ী কিনে গেছে৷ অথচ তাঁর সম্পত্তি ভোগ করবার দ্বিতীয় কোন উত্তরাধিকারী ছিল না৷ তার বংশে সে-ই ছিল একমাত্র বংশধর৷ সে ভাবারূঢ়ার্থেও অর্র্থৎ কিনা সব সময়ই তার হাতে একটা বাঁশের লাঠি থাকত৷ টাকা থাকলেই যে লোকে বাড়ী কিনবে এমন কথা নেই৷ তবে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীতে বিভিন্নধরনের রুচি থাকে বই কি৷ তাই না বলা হয়ে থাকে , হাতে কিছু টাকা এলে কে কী করে!

‘‘বাঙ্গালীর বাড়ী, সাহেবের গাড়ী’’

মিঞাসাহেবের হাঁড়ি, মেয়েমানুষের শাড়ী’’৷

বাঙ্গালীর হাতে দু’পয়সা এলেই একটা বাড়ী করে ফেলে৷ আর সাহেবরা দু’চার টাকার মুখ দেখলেই আলট্রামর্র্ডণ মডেলের নাই হোক, একটা হাত-ফেরতা (সেকেন্ড হ্যাণ্ড) গাড়ী কিনে ফেলে৷  আর মিঞাসাহেবের তকদির খুলে গেলে তিনি তখন কোর্র্ম- কাৰাৰ- কোপ্তা-শিক-কাৰাৰ-মিঠা পোলাউ-নমকিন পোলাউ-মুর্গমসল্লম্‌-ৰকরেকা পশীন্দা-বিরিয়ানী ইত্যাদি......ইত্যাদি খেয়ে কিছুদিন আনন্দ করে নেন অর্র্থৎ সৰ টাকা-পয়সা হাঁড়িতেই ঢালেন৷ আর মেয়েমানুষের শাড়ী সম্বন্ধে বেশী বলা অবাঞ্ছনীয় তো বটেই, বরং তাতে ঝুঁকিও(risk) রয়েছে....শাড়ী সম্বন্ধে বেশী কথা বললে ঘরে শান্তি ভঙ্গের সম্ভাবনা৷

তা সে যাই হোক, আমাদের চাওয়া- চাটাচাটুজ্জেরজীবনের্-জ্ঞান- আরাধনা- উপাসনা সৰ কিছুই ছিল ওই টাকা৷ সে বলত, অন্য চিন্তা করৰার সময় কোথায়! সুদের হিসাব মেলাতেই তো ২৪ ঘন্টা কেটে যায়৷ ভাল করে ঘুমোবার জন্যে একঘন্টা সময়ও হাতে পাই না৷

একদিন সৌরকরোজ্জ্বল সুপ্রভাতে চাওয়া-চাটা--চাটুজ্জের শ্মশান বৈরাগ্য এল৷ সে ভাবলে--- এতটাকা কিসের জন্যে? আজ অন্ততঃ ভালোমন্দ কিছু খাই৷ জন্মের শোধ খেয়ে নিই৷ সে তখন কম্বাইণ্ড হ্যাণ্ড ভোলাকে ডাকলো৷

চাওয়া--চাটা-চাটুজ্জে খেত পুঁইশাকের চ্চচড়ি আর ভাত৷ পুঁইশাক বাজার থেকে কিনতে যাবে কোন দুঃখে! বাড়ীর উঠোনেই ভোলাকে দিয়ে চাষ করাত৷ ভোলা বাসন মাজত, রান্না করত. ঘরদোর পরিষ্কার করত, বাজারে যেত শপিং করতে  আর পুঁইশাকের মার্কেটিং করতে কারণ তার বাড়ীর উঠোনে যে পরিমাণ পুঁইশাক হত, তা একজনের প্রয়োজনের তুলনায় কিছুটা বেশী৷ ভোলা যাতে বেশী দরে পুঁইশাক বাজারে ৰেচে আসে  তাই ভোলাকে ৰলেছিল---এই পুঁই ৰেচার টাকা থেকেই তোর মাইনে দেব৷

তা সে যাই হোক শ্মশান বৈরাগ্যের দিন  সে ভোলাকে ডেকে বললে---‘দেখ ভোলা, আজ একটু ভালমন্দ খাওয়ার স্বাদ হয়েছে৷  আজ নিয়ে আয় একসের ছানার পোলাও’ ৷

ভোলা আনন্দে আটখানা হয়ে বললে--- ‘এই আনছি কর্ত্তা, এক্ষুনি আনছি! এই গেলুম আর এলুম৷ টাকাটা দিন৷ ’

চাওয়া-চাটা  একটু থেমে বললে--- ‘আচ্ছা দেখ , ছানার পোলাও কেন, আজ ছানার পায়েস খাওয়া যাক৷ এখানে পাওয়া যাবে,  না চন্নগরে যেতে হবে’?

ভোলা বললে--- ‘হ্যাঁ কর্র্ত্ত, এখানেই পাওয়া যাবে৷  খড়োবাজারের একটা দোকানে পাওয়া যাবে’৷

চাওয়া-চাটা বললে--- ‘খড়োবাজার তো এখান থেকে অনেকটা ৷ তবে এক কাজ কর, আজ এক সের ক্ষীরের মালপো নিয়ে আয়৷’

ভোলা বললে---‘এই এক্ষুনি আনছি কর্ত্তা৷ টাকাটা দ্যান৷ আমি দৌড়ুতে দৌড়ুতে  গিয়ে দৌড়ুতে দৌড়ুতে এনে দিচ্ছি’৷

চাওয়া-চাটা বললে--- ‘দেখ সবই তো হ’ল৷ কাগজে বিজ্ঞাপন দেখছিলুম, একটা নোতুন ধরণের মিষ্টি উঠেছে---নাম ‘রসমাধুরী’৷ সে কি আমাদের  চুচড়োর  বাজারে পাওয়া যাবে? ভোলা বললে--- ‘খোঁজ নিয়ে দেখবো,  চুচড়োয় যদি না পাওয়া যায় চন্নগরে তো পাওয়া যাবেই’৷

চাওয়া-চাটা ডান-গালে হাত দিয়ে খানিকক্ষণ ভাবলে.....বাঁ গালে হাত দিতে খানিকক্ষণ কাশল৷ তারপর বললে--- ‘দেখ,  আজ ওসব থাক৷ আজ এক পয়সার প্যাঁজ-ফুলুড়ি নিয়ে আয়৷ পেঁয়াজী আর প্যাঁজ ফুলুড়ির  তফাৎ বুঝিস তো’৷

ভোলা বললে---‘আজ্ঞে না কর্ত্তা’৷

চাওয়া-চাটা বললে --- ‘পেঁয়াজের চেয়ে বেসন একটু বেশী থাকলে  তাকে বলা হয় প্যাঁজ ফুলুড়ি, আর তা ভাজা হয় ছাঁকা তেলে ছানচা দিয়ে৷ আর পেঁয়াজীতে বেশন থাকে নামে মাত্র ভাজা হয় চাটুতে তেল ছিটিয়ে৷ তেলেভাজাওলারা বেশী লাভ করতে গিয়ে অনেক সময় প্যাঁজ-ফুলুড়ির বদলে পেঁয়াজীকেই চালিয়ে দেয়৷  ঠিক দেখে শুনে  আনিস যেন প্রত্যেকটি প্যাঁজফুলুড়িই হয়৷

ভোলা বললে--- ‘আজ্ঞে কত্তা , আপনি লিশ্চিন্ত থাকুন৷ আমি সব দেখে শুনে আনবো’৷

চাওয়া-চাটা বললে--- ‘‘হ্যাঁ, দেখেশুণে আনবি৷ এক পয়সার প্যাঁজ-ফুলুড়িতে আমার                      দু দিনের চারবার জলখাবার হয়ে যায়৷

ভোলা বললে---‘এই যাই কত্তা৷ পয়সাটা দ্যান’৷

চাওয়া-চাটা বললে --- ‘পয়সা! পয়সা দিলে তো সবাই আনতে পারে!  একটা দিন বিনা পয়সায় আনতে পারিস না ?  সবাই চেনা জানা লোক৷ চেয়েচিন্তে এক পয়সার প্যাঁজ-ফুলুড়ি আনতে পারবি না৷’

খানিকবাদে একটা শালপাতা হাতে নিয়ে ভোলা সশরীরে চাওয়া-চাটার সামনে এসে দাড়াল৷ চাওয়া-চাটা শুধোলে---‘‘ কি ব্যাপার ! কি এনেছিস?--- পেঁয়াজী না প্যাঁজ-ফুলুড়ি’’?

ভোলা বললে ‘দোকানদার আমায় বললে, শালপাতায় পেঁয়াজী থাকলে সবাই খায়, কিন্তু পেঁয়াজীর এই শালপাতাটা তোর কত্তাকে খেতে দিগে যা’৷