রবীন্দ্র–আদর্শের প্রতি আণুগত্য চাই

লেখক
সৌম্যসুন্দর দেব

বাঙালীর রবীন্দ্র প্রেমে আজও ভাটা পড়েনি৷ যদিও করোনার  করাল গ্রাস রবীন্দ্র জয়ন্তীর সব আড়ম্বর এ বছর ম্লান করে দিয়েছে৷ ঘটা করে রবীন্দ্র জয়ন্তী পালন না করলেও অনলাইনে অনুষ্ঠানের খামতি ছিল না৷ রবীন্দ্র সঙ্গীত, কবিতা, আবৃত্তি কোন কিছুরই অভাব ছিল না৷ তবে বাঙালীর রবীন্দ্রনাথের কাব্য সাহিত্যের প্রতি যতটা আকর্ষণ ওই কাব্য সাহিত্যের আদর্শগত ভাবধারা সম্পর্কে ততটাই অনিহা৷ বরং রবীন্দ্রসঙ্গীতগুলোর্ যেগুলি সুস্পষ্টভাবে ঈশ্বরপ্রেম সম্বন্ধীয় সেগুলিকে বেমালুম স্ত্রী–পুরুষের প্রেমের সঙ্গীত হিসেবে টিভি–সিরিয়্যালে ব্যাপক ভাবে ব্যবহার করে কথায় কথায় রবীন্দ্র প্রীতির নিদর্শন দেওয়া হচ্ছে৷ পাড়ায় পাড়ায় রবীন্দ্রসঙ্গীতের বন্যা বইছে৷ কিন্তু ওই সঙ্গীতগুলির অন্তর্নিহিত ভাব যে অনুভব করার চেষ্টা প্রায় কেউই করেন না এটা বলাই বাহুল্য৷ এই ভাবে রবীন্দ্র–ভাব, রবীন্দ্র–আদর্শকে ভুলেই আমরা রবীন্দ্রপ্রীতির উচ্ছ্বাস দেখাই৷

মনে পড়ে কবি যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের একটা কবিতা ছেলেবেলায় আবৃত্তি করেছিলুম৷ কবিতাটি হাতের কাছে না থাকলেও মনের মণিকোঠায় গাঁথা আছে৷ (দু’একটা শব্দের হেরফের হয়তো বা হয়ে থাকতে পারে৷) বর্তমানে এই কবিতাটা খুবই প্রাসঙ্গিক মনে করছি৷ কবিতাটা হ’ল ঃ

ঘরের দেওয়ালে টাঙ্গানো কবির ছবিখানি,

পঁচিশে বোশেখে বাইশে শ্রাবণে টানাটানি৷

সাবধানে উঠি নড়বড়ে টুলে

গিঁটপড়া দড়ি হুক হতে খুলে

মাকসার জাল ঝেড়ে ঝুড়ে তারে পেড়ে আনি৷

.......

ফুলে ফলে দীপে ধূপে চন্দনে

ইষ্টবন্ধু ডাকি কয় জনে

গীত উৎসবে অতি প্রীতি মনে পূঁজি বিশ্বের কবি

দ্যাখে টেবিলের ছবি৷

.......

শেষ হলে পূজা উঠি সাবধানে ভাঙ্গা টুলে

পুরোনো দড়িতে নয়া গিট বাঁধি হুকে তুলে

দেওয়ালের ছবি ফিরে সে দেওয়ালে

মোরা খাই দাই আপন খেয়ালে

শুকনো ফুলের মালা খুলে নিতে যাই ভুলে৷

.......

আশ্রয় হারা চকিত লুতারা ফিরে এসে জাল বোনে

পাশে টিকটিকি দ্যালে বুক রাখি চেয়ে দ্যাখে এক মনে৷

.......

এরই তরে কবি সারাটি জীবন করে গেলে বুঝি স্বপ্ণ সিবন

এরই তরে বরে বাইশে শ্রাবণ পঁচিশে বোশেখি রবি?

ভাবে দেওয়ালের ছবি৷’’

–এই কবিতার মাধ্যমে কবি যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত এই গভীর প্রশ্ণটুকুই আমাদের দিকে ছুঁড়ে দিয়েছেন৷

আজকের বিপন্ন সমাজের পরিপ্রেক্ষিতে রবীন্দ্র–ভাবনার প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে আজকের রবীন্দ্রপ্রেমীরা কি আন্তরিকভাবে চিন্তা করছেন? নিশ্চয়ই না৷ রবীন্দ্রনাথ কেবল কাব্যবিলাসী ছিলেন না৷ তিনি সমাজের দুঃখ, ব্যথা, বেদনা, অত্যাচার, শোষণ এসব সম্পর্কে খুবই সচেতন ছিলেন৷ তাঁর ‘এবার ফিরাও মোরে’ কবিতাতে তিনি তাই সুস্পষ্টভাবে বলেছেন ঃ

‘‘ওরে তুই ওঠ আজি৷

            আগুন লেগেছে কোথা কার শঙ্খ উঠিয়াছে বাজি

জাগাতে জগজ্জনে৷ কোথা হতে ধ্বনিছে ক্রন্দনে

শূন্যতল কোন্ অন্ধ কারা মাঝে জর্জর বন্ধনে

অনাথিনী মাগিছে সহায়৷ স্ফীতকায় অপমান

অক্ষমের বক্ষ হতে রক্ত শুষি করিতেছে পান

লক্ষ মুখ দিয়া৷’’

এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর ডাক দিয়েছিলেন তিনি তাঁর কবিতায়–

‘‘মুহূর্ত তুলিয়া শির একত্র দাঁড়াও দেখি সবে

আর ভয়ে ভীত তুমি সে অন্যায় ভীরু তোমা চেয়ে

যখনি জাগিবে তুমি তখনি সে পলাইবে ধেয়ে,

যখনি দাঁড়াবে তুমি সম্মুখে তোমার তখনই সে

পথ কুক্কুরের মত সংকোচে সত্রাসে যাবে মিশে৷’’

কবি হৃদয়ের গভীরতম প্রদেশ থেকে উপলব্ধি করেছিলেন ঃ

‘‘বড়ো দুঃখ বড়ো ব্যথা–সম্মুখেতে কষ্টের সংসার

বড়ই দরিদ্র, শূন্য, বড়ো ক্ষুদ্র, বদ্ধ, অন্ধকার৷

অন্ন চাই, প্রাণ চাই, আলো চাই, চাই মুক্ত বায়ু,

চাই বল, চাই স্বাস্থ্য, আনন্দ উজ্জ্বল পরমায়ু,

সাহস বিস্তৃত বক্ষপট৷’’

কিন্তু সমাজের এই গভীর সমস্যার সমাধান কোন্ পথে? কবি এই কবিতায় তাঁর নিজের অন্তরাত্মাকেই এই প্রশ্ণ করেছেন৷ আর তার উত্তরেই সত্যদ্রষ্টা কবির অন্তর থেকে বলিষ্ঠ সত্যের বাণী ফুটে বেরিয়ে এসেছে–যে বাণী শাশ্বত সত্যের বাণী৷ এটাই বিশ্বজনের উদ্দেশ্যে সত্যদ্রষ্টা কবির অন্তরের গভীর উপলব্ধি–প্রসূত বাণী৷

‘‘বলো, মিথ্যা আপনার সুখ,

মিথ্যা আপনার দুঃখ৷ স্বার্থমগ্ণ যেজন বিমুখ

বৃহৎ জগৎ হতে, সে কখনো শেখেনি বাঁচিতে৷’’

এতটা বললেই বোঝা যায় এ এক বলিষ্ঠ মানবতাবাদীর কথা৷ আজকে বিশ্বের কেউই কবির এই মানবতাবাদের দিকটা অস্বীকার করেননি৷ কিন্তু আসল সত্যটা হচ্ছে, কবি এখানেই থেমে থাকেন নি৷ এই সুগভীর মানবতাবোধের উৎসটা কী? তা না জানলে তো  ‘মানবতাবাদ’ কেবল বাগাড়ম্বর পূর্ণ বত্তৃণতার ফুলঝুরি হয়ে থাকবে৷ পৃথিবীর রুক্ষ নিষ্করুণ মৃত্তিকায় তা কোনো ফসল ফলতে পারবে না৷

কবি তাঁর আন্তর উপলব্ধির গভীরতা থেকে এই মানবতাবোধের উৎসের সন্ধান পেয়েছেন–যে উৎসকে বাদ দিলে মানবতাবাদ কেবল ফাঁকা বুলিই থেকে থাকবে৷ রবীন্দ্রনাথের উপলব্ধির এই গভীরতাকেই বুঝতে হবে৷ রবীন্দ্রনাথ যখনই বলছেন ‘‘স্বার্থমগ্ণ যে জন বিমুখ / বৃহৎ জগৎ হতে, সে কখনো শেখেনি বাঁচিতে৷’’ ঠিক এর পরের লাইনেই বলছেন–

‘‘মহাবিশ্বজীবনের তরঙ্গেতে নাচিতে নাচিতে

নির্ভয়ে ছুটিতে হবে, সত্যেরে করিয়া ধ্রুবতারা৷

মৃত্যুরে না করি শঙ্কা৷ দুর্দিনের অশ্রুজলধারা

মস্তকে পড়িবে ঝরি, তারি মাঝে যাব অভিসারে

তার কাছে–জীবনসর্বস্বধন অর্পিয়াছি যারে

জন্ম জন্ম ধরি৷’’

রবীন্দ্রনাথের এই যে গভীর অধ্যাত্ম–প্রত্যয় এটাই রবীন্দ্র আদর্শের মূল কথা৷ তিনি তাঁর বিভিন্ন কবিতায় ঘুরে ফিরে এ–কথাই বলেছেন৷ সমাজের নৈতিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক সমস্ত প্রকার সমস্যার চাবিকাঠিই রয়েছে এই সর্বসঙ্কীর্ণতাহীন উদার আধ্যাত্মিকতার মধ্যে–ভূমা আদর্শের মধ্যে৷ ‘নৈবেদ্য’তে একটি কবিতায় এই আধ্যাত্মিক আদর্শ সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি  সুস্পষ্ট ভাবে বলেছেন ঃ

‘‘রে মৃত ভারত

শুধু সেই এক আছে, নাহি অন্যপথ৷’’

রাষ্ট্র-শাসন ও মানব হিত

হরিগোপাল দেবনাথ

মানবজাতির সমাজ-সংরচনার পরবর্তী উল্লেখযোগ্য কৃতিত্ব হচ্ছে রাষ্ট্র-ঘটনা তথা রাষ্ট্র-পরিচালনার জন্যে সরকার-ঘটন ও সংবিধান রচনা৷ সুদূর অতীতের গুহা-মানব যুগ, প্রস্তুর যুগ্‌ পেরিয়ে মানুষ ধাতুর যুগে চলে আসে৷ এরই সঙ্গে তাল মিলিয়ে যুগপৎভাবেই মানুষের জীবনেও ধারাবাহিক ক্রমবিকাশ চলতে থাকে৷ একদিন মানুষ আরণ্যক জীবন ও পশু-স্তর থেকে উত্তীর্ণ হয়ে বুদ্ধি ও বিবেক-চেতনার সাহায্যেই সমাজজীবনে প্রবেশ করে৷ জনপদ গড়ে তোলে৷ সে সমাজবদ্ধ জীব হয়ে ওঠে৷ আবার, সমাজ-সুপরিচালনার উদ্দেশ্যে গড়ে তুলতে সচেষ্ট হয়েছিল সামাজিক বিধি-নিষেধ অর্থাৎ সমাজ শাস্ত্র রচনা করতে ও সেই সমাজ-শাস্ত্র অনুসারে সমাজের শাসনদণ্ড হাতে নিতে গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিল---মুকুরি বা সর্দারের প্রথার৷ সেই সর্দার প্রথাই যুগের পর যুগ পরিক্রমা করে, একদার রাজন্যযুগ বা সুলতানী, বাদশাহী বা নবাবী আমল ইত্যাদির অবসান ঘটিয়ে চলে এসেছিল বর্তমান সময়ের গণতান্ত্রিক যুগে৷ কিন্তু, গণতন্ত্রকে প্রকৃতভাবে রূপায়িত করতে যে-সমস্ত প্রাথমিক শর্তগুলো প্রয়োজন, আমাদের ভারতরাষ্ট্র সেসবের তোয়াক্কা করে না বলেই, ভারতের দুর্দশা ঘোচে না--- ভারতবাসীর জীবনেও সুদিনের সূর্র্যেদয়ের শুভ-মূহূর্তের আগমন ঘটছে না৷ কার্যতঃ, আত্মনির্ভর ভারত গড়ার ঢাক পেটানো শুধুই মিথ্যা---হিপোক্র্যাটদের মস্ত বড় রকমের প্রতারণা---অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদীদের মিথ্যার প্রচারণা--- পলিটিক্যাল মার্কেন্টাইলের কেমো ফ্লেজ্‌ড ফ্রড৷ এই জুমলাবাজির বাস্তব-রূপায়ণই হচ্ছে পুঁজিবাদের রমরমা তথা পুঁজিপতিদের একাধিপত্য৷

বর্তমান সময়টাতে বৌদ্ধিক জড়তা মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁচেছে৷ ধনলোলুপ  বৈশ্যরা মানুষের এই বৌদ্ধিক স্থবিরতার সুযোগ নিয়ে সুক্ষ্মতম উপায়ে লুতাতন্তু বিচার করে সমাজজীবনের প্রাণ-শক্তিটুকু নিংড়ে নিচ্ছে ও তাদের শোষণের বিজয়রথ নক্কারজনকভাবে নির্বিবাদেই চালিয়ে যেতে পারছে৷ ১৮০০ শতাব্দীতে স্যার অ্যাডাম স্মিথ  ‘‘ক্যাপিটালিজমের জনক’’বলে আখ্যপ্রাপ্ত হয়েছেন,সেই ক্যাপিটালিজম তথা বৈশ্যতন্ত্রের বিরুদ্ধে জনগণ দীর্ঘকাল ধরেই প্রতিবাদ-মুখর৷ বিভিন্নক্ষেত্রে এই পুঁজিবাদী শোষণের বিরুদ্ধে মানুষ বিক্ষোভ-আন্দোলনও চালিয়ে যাচ্ছে৷ আর এদিকে পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে জনগণের এই যে চাপা অসন্তোষ ও বিক্ষোভ দানা বাঁধা সত্ত্বেও সামগ্রিকভাবে সংঘটিত ঐক্যবদ্ধ রূপ না পাওয়াতে, বৈশ্য-শোষকের সে বিষয়ে সতর্ক থেকে শোষণেরই ধরণটা কেবলই বদলাতে শুরু করেছে৷ আর, এভাবে পরিবর্ত্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে পুঁজিবাদী গোষ্ঠীরা সর্বদাই খাপ খাইয়ে নিতে শুরু করেছে৷

ভারতের ক্ষেত্রেও তাই ঘটছে৷ যেমন, বিদেশী ঔপনিবেশিক ও সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠী ব্রিটিশদের শোষণের অবসান না ঘটতেই, ভারতের স্বাধীনতার নামে ‘‘রাজনৈতিক ক্ষমতা’’ হস্তান্তরের মাধ্যমে দেশীয় পুঁজিবাদী শোষক তথা হিন্দী-সাম্রাজ্যবাদীরা দেশবাসীকে ছলনায় প্রলুদ্ধ  করে রাষ্ট্রের শাসনভার লুফে নিয়েছে৷ এর অনিবার্য পরিণতি যা হবার তা তো বিগত সাড়ে সাতদশক ধরে অব্যাহত হয়ে চলেছে৷ ভারতে মোদী-শাহের জমানায় বর্তমানের কৃষি-আইন যাঁরাই কম-বেশী বিশ্লেষণ করতে পারছেন, তাঁদের দৃষ্টিতে বিষয়টি নিশ্চয়ই এড়িয়ে যায় নি৷ অথচ, শাসকেরগোষ্ঠী কিন্তু এখনও তাদেরই ঢোল পেটাচ্ছেন আর  গর্দান ফুলিয়ে শিঙ্গাও ফুঁকছেন৷ কেননা, তাদের এই দুর্বৃত্তায়ণ ও দৌরাত্ম্যের যোগ্য জবাব দিতে এখনও সামগ্রিক ভারতবাসী তাঁদের মোহনিদ্রার ঘোর কাটিয়ে শোষণের বিরুদ্ধে ও পুঁজিবাদ উচ্ছেদের সপক্ষে ঐক্যবদ্ধ হবার সংগ্রামের শপথগ্রহণে সক্রিয় হয়ে উঠেন নি৷

উল্লেখ থাকে যে, যে কম্যুনিজম তথা মার্কসবাদ এককালে পুঁজিবাদী শোষণের বিরুদ্ধে এক মারাত্মক ও অব্যর্থ পাশুপাত অস্ত্রবলে মনে করা হ’ত---সেটি আজ ভোঁতা ও সেকেলে অস্ত্রে পরিণত হয়ে গেছে৷ কারণ, মাকর্সবাদ থিয়োরী হিসেবে এক অসম্পূর্ণ দর্শন ও প্রয়োগভৌমিক তত্ত্ব নয় বলেই কখনও সফল হতে পারবে না৷ কম্যুনিজমে রয়েছে ব্যাপকভাবে আর গভীর পরিমাণে অন্তর্নিহিত স্থাণুত্ব৷ তাই, মাকর্সবাদ তথা কম্যুনিজম কোনদিনই প্রকৃত-বিপ্লব তথা শোষণমুক্তি ঘটাতে পারবে না৷ কেননা, এই থিয়োরী-রচনা করতে গিয়ে কার্লমার্কস সাহেব শোষণমুক্তি ঘটাতে চেয়েছেন ও মানব দরদেরও যথেষ্ট অনুভূতি তাঁর  চিন্তাধারায় প্রকাশ করেছেন বলেই তিনি চিরদিন মানবজাতির স্মরণীয় হয়ে থাকবেন৷ তবে তিনি মানুষের মনস্তত্ব-বিচারে যথেষ্ট ভুল করেছেন নতুবা সঠিকভাবে বুঝতে পারেননি বলে তাঁর থিয়োরিতে অসম্পূর্ণতা রয়ে গেছে৷ দ্বিতীয়তঃ ‘কো’ আর ‘মিউন’ এ দু’টো ল্যাটিন শব্দের মিশ্রণে যে ‘কমিউন’ কথাটি -সেটিও বুৎপত্তিগত-বিচারে ও মনস্তত্বের খাতিরে প্রকৃত রূপায়ণের পথ কার্লমার্কস দেখাতে ব্যর্থ হয়েছেন৷ তৃতীয়তঃ, সাম্যবাদ বলতে তিনি যা ভেবেছেন তাও বাস্তক্ষেত্রে কার্যকারণবশতঃই সম্ভব নয়৷ এ সম্পর্কে বিস্তৃত আলোচনার অবকাশ এখানে নেই বলেই আর ব্যাখ্যা বাড়ালুম না৷ পাঠকবর্গ নিশ্চয়ই উপলদ্ধি করছেন যে রাশিয়া মার্কসবাদের তথা কম্যুনিজমের পিতৃভূমি,যে চীনও সেই থিওরির পীঠভূমি সেই দু’টো দেশীই কিন্তু আজ মার্কসবাদ, লেলিনবাদ, মাওবাদ কোনটাতেই দাঁড়িয়ে নেই---ওরা এখন পুঁজিবাদী তথা সাম্রাজ্যবাদীই ঘরাণারাই রূপকার, একথা বলাটা কি ভুল বা অবান্তর হবে৷ কালমার্কসের দেশ জার্র্মনে মার্কসবাদ কদর পায়নি৷ ইংল্যাণ্ড মাকর্সকে আশ্রয় দিলেও মার্কসবাদকে বরণ করেনি৷ পোল্যাণ্ড, কোরিয়া, রুমানিয়া, বিয়েতনাম কোথাও কিন্তু মার্কসবাদের  বাস্তবরূপ দেখা যাচ্ছে না৷

এবার আমি মার্কসবাদের কথা নিয়ে ভারতে৷ রাশিয়ার মাটিতে গিয়ে মার্কসবাদ গলে গিয়ে লেলিনবাদের বা ষ্ট্যালিনবাদের দ্রবণ তৈরী করেছে বলা যাচ্ছে না৷ আবার চীনেও সেই কোন ‘বাদ’ অর্থাৎ ইজ্‌ম-এর বালাই না রেখে ‘মাওবাদ’ পূর্র্বেক্ত সব ইজমকেই গলা টিপে মেরে ফেলেছে, এরপরে ভারতে সেইসব ‘বাদাবাদি’-র ভূত-প্রেতাদি এসে বা কঙ্কালরা এসে ‘‘সংসদীয় গণতন্ত্রের খাতায় নাম লিখিয়ে তিন-চার দশক ক্ষমতার ভোগবিলাস আস্বাদন করেছে বৈ জনগণের সত্যিকারের কল্যাণসাধন বা দেশবাসীর  পুঁজিবাদী শোষণমুক্তির কোনও পথ দেখাতে পেরেছেন বলে কেউ যথার্থ অভিমত ব্যক্ত করতে পারেন কি? ‘নকশালবাদ’ বা ‘মাওবাদ’ নিয়ে ভারতে অযথা ধনজনের ক্ষয়ক্ষতি  ছাড়া আর কিছু উপকারজনক হতে পেরেছে কি? বরং, বলতে হবে ভারতে তথাকথিত মাকর্সবাদের ঝাণ্ডা ধারীরা পুঁজিবাদীদেরই সতর্ক করে দিয়ে তাদের শোষণের পথটা মসৃণ করে তুলেছেন৷ যেমন, মার্কসবাদীরাই এদেশে মালয়ালম্‌, ভাষায় শ্লোগান দিয়েছিলেন---‘‘টাটা তাগারেডুম’’ বলে৷ তাগারেডুম কথাটার  বাঙলা মানে হয় ‘নিপাতযাক’৷ আর কার্যক্ষেত্রে দেখা গেছে বার বার কংগ্রেস তথা দক্ষিণপন্থীদের সঙ্গে জোট বেঁধে ওরা দেশের হিন্দী সাম্রাজ্যবাদীদেরই দালালি করেছেন বা পুতুল সেজেছেন, যেমনটা দালালি করেছিলেন অতীতে নেতাজীর বিরুদ্ধে আর ব্রিটিশ-শাসকদের পক্ষে৷ মার্কসবাদীরাই এককালে ভারতে সরব ছিলেন---‘‘টাটা-বিড়লার কোলে---কংগ্রেসীরা দোলে’’ বলে৷ আর আজ তারা কংগ্রেসের সঙ্গে আঁতাত তথা পুরনো প্রেমকে রিনিউ করে নিয়ে আদানি-আম্বানী-চোকসি-মালিয়া-মোদী প্রমুখদের শোষণ-প্যাটনট্যাংকের ইঞ্জিনে জ্বালানী যোগাচ্ছেন বললে কী ভুলটা হবে? মূলতঃই কম্যুনিষ্ট তথা মার্কসবাদীরা কোন বিচারেই প্রকৃত বিপ্লবী নয়,কোনকালেই তেমনটা ছিলেন না আর আজও নয়৷ বরং ওদের ‘‘ভোকাল রিভুলুশনারি’’ বলাটাই অধিকতর সমীচীন বলে মনে করি৷ আর সেজন্যেই মার্কসবাদ পুঁজিবাদীদের কাছে নতজানু হয়েও রক্ষা পায়নি--- বলতে হচ্ছে মার্কসবাদের অকাল অপমৃত্যু ঘটেছে৷ পৃথিবীতে মার্কসবাদ আজ বিলুপ্ত৷ (ক্রমশঃ)