পৃথিবী গ্রহে মানব-সভ্যতার অগ্রগতির ক্ষেত্রে পরিবার-ঘটন, সমাজ-সংরচনা, রাষ্ট্র-নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ, রাষ্ট্র পরিচালনের জন্যে সংবিধান-রচনা ও সরকার তথা রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রণ-ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা ইত্যাদি বিষয়সমূহ নিঃসন্দেহে অতি গুরুত্বপূর্ণ৷ আবার রাষ্ট্র তথা দেশ পরিচালনার জন্যে এ যাবৎ মানুষের উদ্ভাবিত বা আবিষৃকত যে-সব ব্যবস্থাপনা রয়েছে, সে সবের মধ্যে--- মোরবিব তথা সর্দার-প্রথা, সামন্তপ্রথা বা ফিউডালিজ্ম তথা জমিদারি প্রথা,রাজতন্ত্র (রাজা-বাদশাহ্-নবাব-সুলতানী শাসন ব্যবস্থা), আমলাতন্ত্র, সামরিকতন্ত্র, একনায়কতন্ত্র, অটোক্র্যাসী বা স্বৈরতন্ত্র ইত্যাদি ব্যবস্থাপনা সমূহের অভিজ্ঞতা মানুষ লাভ করে নিয়েছে---আস্বাদনও করে নিয়েছে৷ এসবের পরবর্তী ধাপে মানুষের উদ্ভাবিত শাসন ব্যবস্থাটি হচ্ছে---গণতন্ত্র তথা ডেমোক্র্যাসী৷ বলা হচ্ছে, গণতন্ত্রই হল এ যাবৎ মানুষের অভিজ্ঞতালব্ধ রাষ্ট্র পরিচালনা-সংক্রান্ত ব্যবস্থা সমূহের মধ্যে সর্র্বেত্তম পন্থা৷ কেননা, একমাত্র গণতন্ত্রে ভেতর দিয়ে মানবতার প্রকৃষ্ট মর্যাদা দানের উপায় সুরক্ষিত বলে জনমানসে দৃঢ় বিশ্বাস রয়েছে৷ জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্যে, জনগণের শাসন--- অর্থাৎ গণতান্ত্রিক বিধি অনুসারে জনগণই হচ্ছে শেষ কথা৷ এই পদ্ধতিতে সংখ্যাগরিষ্ঠের অর্থাৎ মেজরিটির মতামতকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়৷ জনগণ বলতে বোঝায় মানুষ আর সমাজ-রচনা থেকে রাষ্ট্র পরিচালনা অব্দি বৃত্ত-পরিধির মূল কেন্দ্র বিন্দুতে যেক্ষেত্রে রয়েছে জনগণ তাই সেই জনগণকে ভিত্তি করে যে শাসনতন্ত্র এর বিকল্প স্বরূপ তুলনামূলকভাবে শ্রেয়তর শাসনব্যবস্থা যতদিন মানবজাতির বোধগম্যতার ধরা পড়ছে না, তদবধি গণতন্ত্রকেই প্রাধান্য দেওয়া যুক্তিসঙ্গত তো বটেই আর সেই লক্ষ্য স্থির রেখেই, সাম্রাজ্যবাদী ও ঔপনিবেশিক শোষকগোষ্ঠী ব্রিটিশের শাসননিগূঢ় থেকে মুক্ত ভারতকে (যদিও ব্রিটিশ আর এতদ্দেশীয় উভয় শাসকগোষ্ঠীর ঘৃন্য ষড়যন্ত্রে আজকের খণ্ডিত ভারতবর্ষ, যাকে ব্রিটিশদেরই দেওয়া মুখরোচক নাম ‘‘ইন্ডিয়া’’ বলা হচ্ছে) পৃথিবীর বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বলে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে৷ কিন্তু, মনে হচ্ছে অতি সঙ্গত কারণেই আমাদের দেশটার জনগণকে আর বিশেষ করে যাঁরা শুভবুদ্ধি জাগ্রত শুভচিন্তা নিয়ে ও প্রকৃত সমাজচেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সমগ্র মানবজাতির কল্যাণমুখী ব্রতধারণ করে কর্ত্তব্যপালনে রত রয়েছেন, সেই সকল রাজনীতিক, শিক্ষাবিদ, রাষ্ট্রীয় বা প্রশাসনিক কর্মকর্ত্তৃ বৃন্দ, চিন্তানায়ক, দেশপ্রেমিক,মানবদরদী ও মানবহিতৈষী মাত্রেই আজ বিচার-বিশ্লেষণে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণে অবতীর্ণ হওয়াটা একান্ত জরুরী কর্ত্তব্য বিবেচিত হওয়া কালের প্রয়োজন হয়ে দাঁড়িয়েছে৷
আমার উপরিউক্ত এ ধারণাটি ব্যক্ত করার পেছনেও আমি মনে করি যথার্থ কারণ বিদ্যমান রয়েছে৷ কেননা, লোক সাধারণ্যে একটা প্রচলিত ধারণা থেকেই বিশ্বাস উদ্ভূত হয়েছে বলেই আমার ছোটবেলা থেকে শুণে এসেছি যে ‘এই তো সবে কলির সন্ধ্যে’৷ তবে, বর্ত্তমানে আমার জীবদ্দশার তিনকাল পেরিয়ে এসে, বেশ উপলব্ধি করতে পাচ্ছি যে, এখন সবে তো কলির সন্ধ্যেটাও উত্তীর্ণ হয়ে গেছে৷ আমার প্রবুদ্ধ চেতনা হয়ে গিয়ে প্রৌঢ়ত্বের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে৷ শুভানুধ্যায়ী পাঠকবর্গ কলিকাল নিয়ে আমার পৌরাণিক ধারণাকে অনুগ্রহ পূর্বক ‘‘হেয়’’ প্রতিপন্ন করে আমাকে যেন পাশ-মার্কস পাওয়া থেকে বঞ্চিত করে দেবেন না৷ ‘কলিকাল’ বলতে আমি এখানে সময়ের পরিমাপক হিসেবে কোন যুগকে চিহ্ণিত করতে আদৌ অভিলাষী নই কলি-র বিশ্লেষণ করতে চেয়েছি আমি সম্পূর্ণরূপেই মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে৷
মহাজনোক্তি রয়েছেঃ--- ‘‘শয়াণে কলিঃ ভবতি সন্ধিহানস্ত দ্বাপরঃ/উত্তিষ্ঠান ত্রেতা ভবতি ক্রতং সমূদ্যতে৷’’ একটি রূপকের সাহায্যে এর ব্যাখ্যা করা চলে৷ ধরা যাক, একটা ঘরে চারটে লোক পাশাপাশি ঘুমিয়ে রয়েছে৷ ইত্যবসার ঘরটিতে কোনভাবে আগুন ধরে গেল৷ সেই অগ্ণিশিখার তাপ যখন গায়ে এসে লাগছে তখন ওদের ভেঙ্গে গেছে ওরা পরস্পর বলাবলি করছে--- ‘‘চ, উঠে পড়ি৷’’ এদের মধ্য থেকেই অতি আলসে ও দায়িত্বহীন মানসিকতার লোকটা তার অলস-স্বভাবের কারণেই শ্রম বাঁচাবার স্বার্থে কায়ক্লেশে কোনরকমভাবে উচ্চারণ করল---‘‘পি-পু ফি-শো৷’’অর্থাৎ ওর বক্তব্যটির মানে বোঝাল---‘পিঠ পুড়ছে তো ফিরে শো৷’ বস্তুতঃ এই লোকটাই আচ্ছন্ন রয়েছে ঘোর কলিকালের তামসিকতার আচ্ছাদনে--- সে শুধু শারীরিকভাবেই অলস তা তো নয়, মানসিকভাবেও তামসিকতায় ও ক্লীবতায় অবসন্ন৷ দ্বিতীয় ব্যষ্টি ওর কথার মান্যতা না দিয়েই উঠে গেল, কিন্তু বসেই রইল দিশাহীনভাবে৷ তৃতীয় ব্যষ্টি কষ্টে-সষ্টে উঠে দাঁড়াল বটে তবে বুঝে উঠতে অপারগ যে কী করতে হবে৷ আর চতুর্থ ব্যষ্টি ঝট্পট উঠে পড়েই আর কারোর অপেক্ষা না করেই বিছানা ছেড়ে দৌড় তুলল কিছু একটা করতে হবে বলেই৷ এভাবেই, প্রথমোক্ত ব্যষ্টিটিকে কলিযুগের প্রতীক, আবার দ্বিতীয়,তৃতীয় ও চতুর্থ ব্যষ্টিত্রয়কে যথাক্রমে দ্বাপর,ত্রেতা ও সত্যযুগের প্রতীক বলে ব্যাখ্যাত করা হয়েছে৷
এখানে বলতে হচ্ছে যে, সমগ্র পৃথিবীব্যাপী গোটা মানবগোটা মানবসমাজেই তার ঘনায়মান অবস্থার নিরিখেই বলতে হচ্ছে যে, বর্ত্তমানে ঘোর কলিকালের তামসী অমানিশার নিশ্চিদ্র আঁধার সকল দিক ছেয়েফেলেছে বলেই---পৃথিবী জুড়ে মানবসমাজে নেমে এসেছে মহা বিপর্যয় মহামন্দা ও মহাদুর্র্যেগের ঘনঘটা৷ অশুভ শক্তিরা চারদিকে থেকে তাদের লোলুপ-রসনা বিস্তার করে মানব সভ্যতাকে গিলে ফেলতেই উদ্যত হয়েছে৷ মানুসের অসংযত ও অবিবেকী বাসনাই যেন মানুষকে ক্রম--- অধঃপতন তথা বিনষ্টির পথে প্লাবন-স্রোতরাশির বেগে নিয়ে চলেছে৷ এর পরিণতি স্বরূপ,সত্যিই মনুষ্যত্ব আজ ভূ-লুণ্ঠিত, মানব-অস্তিত্বও সংকটাপন্ন৷ আধুনিক সভ্যতা গর্বী মানুষ অন্ধ জড়ভোগের নেশায় মত্ত হয়ে মান-মর্যাদা, বিবেক-চেতনা তথা হুঁশ হারিয়েই যেন বিদিশা অদৃশ্য আকর্ষণে মনুষ্যত্ব-বোধ টুকুও জলাঞ্জলি মহাবিনষ্টি তথা জাহান্নামের সর্বগ্রাসী বহ্ণিশিখায় ঝাঁপ দিতে অত্যুগ্র-বেগে ছুটে চলেছে৷ অতীতের দু-দুটো বিশ্বযুদ্ধের মর্মান্তিক অভিজ্ঞতাসহ বিভীষিকাও মানুষের হৃদয়োপরি লালসার আস্তরণকে ধুয়ে মুছে নির্মল করে তুলতে পারেনি৷ তাইতো, বর্তমানের পৃথিবীর দুর্র্যেধন দুঃশাসনের বিবেক-শাসিত না হয়ে ভোগাতুর মোহান্ধ ধৃতরাষ্ট্রের চাপে জগৎজোড়া মানব সমাজকেও বিপন্ন করতে দ্বিধাবোধ করছে না৷ একদিকে ওদের প্রতারণামূলক শান্তির বাণী আওড়াচ্ছে আর অপরদিকে প্রতিমুহুর্তেই মারণাস্ত্রের শান দিয়ে চলেছে--- গোলাবারুদে তাপ সংযোজন করে চলেছে৷
- Log in to post comments