স্বাধীনোত্তর ভারতের অর্থনীতির গতিধারা

লেখক
অসিত দত্ত

বিট্রিশ সরকার ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগষ্ট ভারতবাসীর  হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে৷ কেন ক্ষমতা হস্তান্তর করল?  চাপে পড়ে বা অন্যকোন  কারণে সে কথা স্বতন্ত্র এবং  এখানে আলোচ্য নয়৷ যা হোক ভারত বলতে তখন তিন টুকরো ভারতের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে৷ এক টুকরো ভারতের পশ্চিমে পশ্চিম পাকিস্তান, আর এক টুকরো পূর্বে পূর্ব পাকিস্তান ও অবশিষ্ট বড় অংশটি ভারত নামেই পরিচিত হোক৷ কয়েকটি বাক্যতে এই বিরাট বিভক্ত ভারতের  কথা বলা যায়৷ ছোট দুটো টুকরো অর্থাৎ দুই পাকিস্তানের ক্ষমতা মুসলীম লীগের  হাতে গেল এবং বড় টুকরোর ক্ষমতা তখনকার  কংগ্রেসের হাতে গেল৷ কিন্তু এই যে ক্ষমতা হস্তান্তর হল, এর পেছনে কোটি কোটি ভারতবাসীর স্বাধীনতা সংগ্রামের অবদান দুদিকের নতুন শাসকদল ভাববার অবকাশ পেল না৷ তখন শাসকগণের নিয়ন্ত্রণের  রাশ পূঁজিপতি শ্রেণীর হাতে চলে গেছে৷ দুই পাকিস্তানে শাসকদের নিয়ন্ত্রণ যে পুঁজিপতিদের হাতে গিয়েছিল সেটা খোলাখুলি প্রকাশিত৷ এতে ওদের শাসকদের লজ্জা বোধ নেই৷ কারণ ওরা ওদের জনগণকে ধর্মমতে রেখেছে৷ উপরন্তু ভারত বিদ্বেষের আগুন জ্বালাতে পেরেছে৷ যে আগুনের জন্য ভারতের  সঙ্গে ধারাবাহিক যুদ্ধ ও বিভিন্ন ধরণের সংঘর্ষ বাধিয়ে রেখেছে৷ ফলে জনগণকে  বোকা বানিয়ে তারা ক্ষমতা ভোগ করতে লাগলো৷ জনগণ চরম দারিদ্র্য, অভাব অনটনের মধ্যে  কালাতিপাত  করলেও ঐ নেশাগ্রস্ত হবার প্রতিবার করতে পারলো না যার রেশ এখনও বর্তমান৷ জনগণ ভুলে গেল স্বাধীনতা সংগ্রাম করতে কত মায়ের কোল খালি হয়েছে কত স্ত্রী স্বামীহারা হয়েছে, কত রক্ত অশ্রু ঘাম ঝরেছে৷ সকলের একটাই প্রত্যাশা ছিল যে দেশ বিদেশী শাসকের শোষণমুক্ত হবে, স্বাধীন হবে, সবাই খেয়ে পরে সুখে শান্তিতে দিন অতিবাহিত করতে পারবে৷ কিন্তু তা আর হল কোথায়? জনগণ সে তিমিরে ছিল সেই তিমিরে এখনও রয়ে গেল ৷ এটা হল পাকিস্তানের অবস্থা৷

ভারতবর্ষের যার শাসনভার তখনকার দিনের জাতীয়  কংগ্রেসের হাতে এসেছিল সেই জাতীয় কংগ্রেসের  অভ্যন্তরে বহু মানুষ ছিল যারা দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের অবদান ভুলতে পারেনি৷ তারা ভুলতে পারেনি দেশের মানুষ যারা স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নিয়েছিল তাদেরও  আশা ছিল দেশের আপামর জনসাধারণ সুখে শান্তিতে থেকে স্বাধীনতার সুফল ভোগ করুক৷ ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগষ্ট ভারতবর্ষ স্বাধীন হল৷ বিধিবদ্ধ সংবিধান পেল ২৬শে নভেম্বর ১৯৪৯ সালে ও ২৬শে জানুয়ারী৷ ১৯৫০ সালে সাধারনতন্ত্র দিবস পালন করে তা গ্রহণ করলো৷ এই সংবিধানের প্রস্তাবনাতে সার্বভৌম, গণতান্ত্রিক, প্রজাতান্ত্রিকদেশ হিসাবে  ঘোষণা করা হল ও সেখানে বিচার, স্বাধীনতা, সাম্য সৌভ্রাতৃত্বকে অগ্রাধিকার দেওয়া হল, কিন্তু এতে জনগণের চাপ থেকেই গেল৷ ফলে সংবিধান সংশোধন করে ১৯৭৬ সালে সমাজতান্ত্রিক ধর্ম নিরপেক্ষ শব্দদুটি প্রস্তাবনাতে বসানো হল৷ তবে প্রথমে স্বাধীনতা অর্জন করার পর পুঁজিপতিদের নিয়ন্ত্রণ যাতে জনসাধারণ বুঝতে না  পারে তার জন্য দেশে মিশ্র অর্থনীতি নামক এক ধরণের নীতি চালু করলো৷ একই সঙ্গে পূঁজিপতিদের গায়ে হাত না দিয়ে তাদের পরিচালিত কলকারখানা ব্যবসা বাণিজ্য তাদের হাতেই ব্যষ্টিগত মালিকানায় চলতে লাগলো ও পাশাপাশি জনগণকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য কলকারখানা ব্যবসা বাণিজ্য সরকারী মালিকানা বা রাষ্ট্রীয় মালিকানা জনগণকে বোঝানো হল ধীরে ধীরে ব্যষ্টিমালিকানায় চলতে আরম্ভ করল৷ চলতে লাগলো পরিচালিত সংস্থাগুলি জাতীয়করণ করা হবে৷ প্রথম প্রথম রেল, ব্যাঙ্ক, ইন্সুরেন্স এমনকী রাজা জমিদারদের হাতে থাকা বিপুল পরিমাণ জমিও দখল করা হতে থাকলো৷ যদিও রাজন্যভাতা ও ক্ষতিপূরণও দেওয়া হয়েছিল৷ কিন্তু ব্যষ্টি মালিকানায় থাকা কলকারখানা ও ব্যবসা-বাণিজ্য জাতীয়করণের চাপ থাকলো৷ একসময় আমরা দেখতে পেলাম জনতাপার্টী ক্ষমতায় থাকার সময় কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সমাজতন্ত্রী জর্জ ফার্ণাণ্ডেজ ইত্যাদিরা জাতীয়করণের পক্ষে ছিল৷ সমাজতন্ত্রী জর্জ ফার্ণাণ্ডেজ পুঁজিপতিদের ক্ষমতা সম্ভবত বুঝে উঠতে পারেননি৷ তিনি আবেগের বশে বলে ফেলেছিলেন টাটা কোম্পানীর কারখানা জাতীয়করণ করতে হবে৷ তারপর সকলে দেখলো পুঁজিপতিদের ক্ষমতা৷ টাটা কোম্পানী একটি প্রদর্শনী করেছিলে যেখানে আলোর মাধ্যমে দেখানো হল বিরাট এক দৈত্যের জাতীয়করণ হা করে আছে ও ব্যষ্টি মালিকানার কলকারখানাগুলি সেই দানব গিলছে৷ অর্থাৎ জাতীয়করণ বিরোধী প্রদর্শনী৷ তারপর বড় বড় পত্রিকার সাংবাদিকরা টাটা কোম্পানী পরিদর্শন করে সেখানকার শ্রমিক ও অন্যান্য মানুষের মুখ দিয়ে বললেন ‘টাটা কোম্পানীর পরিচালন ব্যবস্থা খুব সুন্দর সবাই সুখে শান্তিতে আছে৷ যদি সরকার এটা অধিগ্রহণ করে তবে এর অবস্থা বিপর্যস্ত হবে৷ এরপর আবার টাটা কোম্পানীর শ্রমিকরা একটি প্রতিবাদ সভা করলো৷ সেখানে ত্রিশ হাজারের জমায়েতে তারা দাবী করলো টাটা কোম্পানীকে জাতীয়করণ করা চলবে না৷ এরপর আরো মজার ঘটনা তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জর্জ ফার্ণাণ্ডেজকে ধমক দিয়ে বললেন ‘নিজের চরকায় তেল দাও৷’’ অর্থাৎ জাতীয় করণের চিন্তা বাদ দাও৷ প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা যায় রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কলকারখানাগুলি প্রকৃতপক্ষে লোকসানে চলেছে৷ তারজন্য সরকারী তহবিল থেকে ভত্তুর্কী দেয়া হয় যেটা আবার জনসাধারণের টাকা খুব স্বাভাবিকভাবেই নতুন করে রাষ্ট্রীয়করণের বিরোধিতা করার মতো পরিবেশ তৈরী হয়েছে৷ আসলে সরকারী উদ্যোগগুলিতে দক্ষতাহীন পরিচালক, অঢেল চুরি ও দুর্নীতি, তা দক্ষ নিষ্ঠাবান কর্মচারীর অভাব ও পুঁজিপতিদের প্রতিযোগিতামূলক আচরণ যাতে সরকারী উৎপাদিত পণ্য বাজারে মার খায় ইত্যাদি বিভিন্ন কারণে সরকারী নিয়ন্ত্রিত উদ্যোগগুলির অধিকাংশই খায়৷ সামান্য উদাহরণ দিলে বিষয়টা আর পরিস্কার হবে৷ সরকারী নিয়ন্ত্রিত পরিবহনের  ও একটি বাস চললে লাভের মুখ তেমন দেখা যায় না৷ কিন্তু  ব্যষ্টিমালিকানায় সেই একই বাস চালিয়ে মালিকরা প্রচুর লাভের মুখ দেখেন ও  বছর বছর আরো বাস নামান৷ সরকারী উদ্যোগে তেমনভাবে লাভ হচ্ছে না বা লোকসান হচ্ছে এটা পুঁজিপতিদের কৌশল৷ এই কৌশল জনগণ বুঝতে পারে না৷ ফলে সরকারী উদ্যোগগুলি ব্যষ্টিমালিকানার হাতে তুলে দেবার সরকারী চক্রান্ত হয় ও এভাবেই ব্যাঙ্ক, রেল, ইনস্যুরেন্স ইত্যাদি বহু সংস্থা ব্যষ্টিমালিকানার হাতে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে৷ যদিও এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ কিন্তু হচ্ছে৷ তবে কে শোণে কার কথা৷ পূঁজিপতিদের অসীম ক্ষমতা৷ তারা যে সরকারকে পরোক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে৷ সুতরাং সরকারী সংস্থা বেসরকারীকরণ উদ্যোগ চলবেই৷ অর্থাৎ ধীরে ধীরে দেশে পুঁজিবাদ কায়েম হবে৷ সেখানে মুষ্টিমেয় লোক দেশের সম্পদ অধিক থেকে অধিক পরিমাণে আয়ত্ত করবে, মুষ্টিমেয় লোক ভোগ বিলাসের সুখের সাগরে জীবন অতিবাহিত করবে, আর অধিকাংশ মানুষ দুঃখ দারিদ্র্য অনাহারে থাকবে, চিকিৎসার সুযোগ পাবে না, শিক্ষার অভাবে অজ্ঞতার অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে৷ পুঁজিবাদের আর একটি লক্ষণ হল সেখানে বড় পুঁজিপতি ছোট ছোট পুঁজিপতিদের শোষণ করে যেমন বড় মাছ ছোটমাছকে গিলে খায়৷ বেশ কিছুদিন এই লক্ষণ কিন্তু দেখা যাচ্ছে৷ যেমন বড় বড় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান তাদের অঢেল অর্থ দিয়ে অনলাইন ব্যবসা শুরু করেছে৷ আমাজন, ফ্লিপকার্ট, মেসো, মিন্ত্রা, জিও মার্ট এই ধরণের প্রতিষ্ঠানগুলি এই ব্যবসা শুরু করেছে৷ তারা অনলাইনে খরিদ্দারের কাছ থেকে অর্ডার নেয় এবং  ঘরে ঘরে খরিদ্দারের কাছে সেই অর্ডারীমাল পৌঁছে দেয়৷ অর্ডার নেবার সময় খরিদ্দারদের নানারকম অফার, সাময়িকভাবে কমশূন্যে কেনার লোভ দেখায়৷ সেই লোভের বশবর্তী হয়ে এবং ঘরে বসে জিনিষ পাবে এই জন্য তাদের অর্ডার দেয়৷ এর ফলে কী হয় না ঐ খরিদ্দার পাড়ার, গ্রামের বা শহরের দোকানগুলির থেকে  যে মাল নেয় তা আর তারা নেয় না৷ ফলে পাড়ার, গ্রামের বা শহরের দোকানদার মার খায়, তাদের বিক্রী কমে যায়৷ এর ফলে এমন দিন আসতেই পারে যেখানে ছোট ছোট দোকানদার আর তাদের ব্যবসা চালাতে পারবে না বা তারা ব্যবসা  বন্ধ করতে বাধ্য হবে৷ আবার ‘মল’ নামক এক ধরণের বৃহদায়তন দোকান ছোট শহর থেকে মহানগরীতে ছেয়ে গেছে৷  যারা নিত্যপ্রয়োজনীয় সমস্ত রকম জিনিষ সাজিয়ে নিয়ে বসে আছে৷  যা চকচকে শীততাপ নিয়ন্ত্রিত এই সকল দোকানে খরিদ্দার একবার ঢুকে এক জায়গাতেই তার প্রয়োজনীয় সমস্ত  জিনিষ পেয়ে যায়৷ যে রকমারী প্রয়োজনীয় জিনিষ সে কিনলো তা বাইরে কিনতে গেলে তাকে অনেক দোকানে কষ্ট করে ঘুরে ঘুরে কিনতে হতো৷ কিন্তু  এই ‘মলে’ ঢুকলে একজায়গা থেকেই  সব মাল পেয়ে যায়৷ সময় বাঁচে ঘোরাঘুরির কষ্ট বাঁচে ও খানিকটা দামেও কম নেয়৷ আবার অফার ও দেয় যেমন একটা কিনলে দুটো পাবে এইরকম আর কী৷ তাহলে ছোট ছোট দোকানদারদের বিক্রীও কমে যায়৷ ঐ  আগের কথায় আসছি এরা একসময় ব্যবসা চালাতে পারবে না বা ব্যবসা বন্ধ করে দেবে৷ এই অনলাইন ব্যবসা বা ‘মল’-এর ব্যবসা বড় পুঁজিপতিদের হাতে৷ এরা সরাসরি ছোট পুঁজির ব্যবসাদারদের গিলে খাবে৷ এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে একসময় এফ.ডি.আই অর্থাৎ ফরেন ডাইরেক্ট ইনভেষ্টমেন্ট করা চলবে না৷ এই মর্মে দেশে খুব জোরদার আন্দোলন হয়েছিল৷ এখন সে ধরনের আন্দোলনের কথা শোণা যায় না৷ এফ.ডি.আই চালু হলে দেশের অভ্যন্তরে ছোট পুঁজির ব্যবসা এমন কী কৃষিক্ষেত্রেও এই ইনভেস্টমেন্ট চালু হলে ব্যবসা বাণিজ্য ও কৃষি উৎপাদন সব মার খাবে বা ক্ষতিগ্রস্ত হবে৷ এদের সকলের  পেটে কিল মেরে লভ্যাংশ ফরেনে বা বিদেশে চলে যাবে৷ এইজন্য এর প্রতিবাদ হয়েছিল৷ কিন্তু এখন নূতন করে  দেশীয় পুঁজি ঐ সকল সংস্থার মাধ্যমে খাটছে, কৃষিক্ষেত্রেও এই ধরণের বিনিয়োগ হচ্ছে৷ ফলে ছোট পুঁজির ব্যবসাদার ও কর্ষক ক্ষতিগ্রস্ত হবেই৷ এটা একটা খুব বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিতে যাচ্ছে৷ এ ব্যাপারে সকলের চিন্তা ভাবনা করা দরকার৷