স্বাধ্যায়  ও এর গুরুত্ব

লেখক
শ্রীসমরেন্দ্রনাথ ভৌমিক

পরমারাধ্য ‘ৰাৰা’ চরম নির্দেশে বলেছেন---‘‘যম-নিয়ম’ ব্যতিরেকে সাধনা হয় না, তাই যম-নিয়ম মানাও পরমপুরুষেরই নির্দেশ৷’’ ‘যম’-এর আছে পাঁচটি অঙ্গ (অহিংসা, সত্য অস্তেয়, ব্রহ্মচর্য ও অপরিগ্রহ), নিয়মেরও পাঁচটি অঙ্গ শৌচ, সন্তোস, তপঃ, স্বাধ্যায় ও ঈশ্বর প্রণিধান৷

এখন,‘ৰাৰা’ আমাদের জন্য এই চরম নির্দেশ পাঠের পরে সব শেষে ‘স্বাধ্যায়’-এর বিধিবদ্ধ নিয়ম করে দিয়েছেন দশটি অঙ্গের মধ্যে কেবলমাত্র কিন্তু প্রশ্ণ হল যম-নিয়মের মোট দশটি অঙ্গের ওপর বিশেষ গুরত্ব দিয়েছেন, তিনি বলেছেন যম নিয়ম ব্যতিরেকে সাধনা হয় না৷ আমি বর্তমান নিবন্ধে স্বাধ্যায়ের গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করব ---এই স্বাধ্যায়ের ওপর বিশেষ গুরুত্বকে নিয়েই৷ ‘ৰাৰা’ নিশ্চয়ই খুব সাধারণভাবে ব’লে যাননি৷ এই স্বাধ্যায়ের মধ্যে  অবশ্যই বিশেষ  কোন মহৎ গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষারউদ্দেশ্য লুকিয়ে আছে৷

এখন, স্বাধ্যায় কাকে বলে? কোন জটিল আধ্যাত্মিক তত্ত্বকে সম্যকভাবে বুঝে নেওয়ার নামই হ’ল স্বাধ্যায়৷ ঠিকমত অর্থ না বুঝে বা না শোনা হ’লে তাকে স্বাধ্যায় বলা যাবে না৷ কিন্তু স্বাধ্যায় ক’রে সম্যকভাবে কোন তত্ত্ব বা বিষয়কে বুঝে নিলে এতে মানুষের অথবা মানব সমাজের কল্যাণ হবে

জাগতিক জগতের অর্থাৎ বাহ্যিক জগতের মধ্যে থেকেই অন্তরজগতে বা ভাবজগতের দিকে এগিয়ে যেতে হবে  ও অন্তরের মধ্যে যে ভক্তি আছে, সেই ভক্তির অভিস্ফূরনের সুযোগ দিতে হবে৷ তাই ‘ৰাৰা’ বলেছেন---Subjective approch through objective adjustment- এর ভিতর দিয়ে মানুষকে ভক্তির পূর্ণত্বে পৌঁছাতে হয়৷

মানসিক অভিব্যক্তি বা অভিস্ফূরণের মাধ্যমে ভক্তির বিকাশ ঘটে৷ জাগতিক জগতে যা কিছু ঘটে তা এই অন্তর বা ভাবলোকের যে ছন্দ সেই ছন্দের সঙ্গে ছন্দায়িত হ’য়ে চলেছে৷ এখন,এই ছন্দ যেখানে সন্তুলিত Balanced) হ’য়ে যায় সেখানে আমাদের মনে প্রশান্তি আসে অর্থাৎ ভাল লাগে, আর এই ছন্দ যেখানে সন্তুলিত হচ্ছে না, সেক্ষেত্রে আমরা অস্বস্তি অনুভব করি, আমাদের ভাল লাগে না৷

মানুষের ভাবলোকে রয়েছে স্নেহ, মমতা, বিবেক, ভক্তি, ঈশ্বর নিষ্ঠা প্রভৃতি মূল্যবান সম্পদ, আর এই সমস্ত সম্পদগুলির মধ্যে সব চাইতে মূল্যবান সম্পদ্‌ হ’ল ভক্তিতত্ত্ব ও ঈশ্বর নিষ্ঠা৷ ভাবলোকের এই ভক্তি মানুষকে পূর্ণত্বের পথে চলতে শেখায় ও অবশেষে মানুষকে দেবত্বে পৌঁছে দেয়৷ ভক্তি জিনিষটা সকল মানুষের সবচেয়ে বড় সম্পদ৷ কিন্তু আজ জগতের মানুষের ভাব লোকের এই মূল্যবান সম্পদ ভক্তি ও ঈশ্বরনিষ্ঠাকে বাইরের জগতে  সৃষ্ট বিভিন্ন ধরণের ভাবজড়তা বা ভাবাবেগ sentiment)  প্রতিনিয়ত আঘাত ক’রে চলেছে৷ আর এই সমস্ত ভাবাবেগের তীব্র কষাঘাতে ভাবলোকের এই মূল্যবান সম্পদগুলির অভিপ্রকাশ ঘটতে দিচ্ছে না৷ তাই ‘ৰাৰা’ আমাদের  সতর্ক ক’রে দিয়ে বলেছেন--- ‘‘এই ভক্তি ও ঈশ্বরনিষ্ঠাকে  সযত্নে রক্ষা করতে হবে৷ ভাবলোকের সম্পদকে রক্ষা করতে গেলে জড়লোকে তার চারপাশে একটা বেড়া দিতে হবে, গার্ডার দিতে হবে৷ ছোট বৃক্ষকে, ক্ষুদ্র তরুকে বাঁচাতে গেলে যেমন একটা বেড়া বা গার্ডার দিতে হয়, তেমনি করতে হবে৷ এই গার্ডার হচ্ছে---লৌকিক জগতের একটা দার্শনিক তত্ত্ব যা মানুষকে  ঊধর্বলোকের সঙ্গে জড়লোককে সুন্দরভাবে প্রতিষ্ঠিত ক’রে রাখবে ও এগিয়ে চলার সম্প্রেষনা জুগিয়ে চলবে অনন্তকাল ধরে৷’’ পরমারাধ্য ‘ৰাৰা’ ভাবপ্রবণতা নিয়ে বলেছেন--- ‘‘ভাবপ্রবণতা মূলতঃ তিনপ্রকারের হয়৷ এরা হ’ল (১) ভৌমভাবপ্রবণতা Geo-sentiment), (২) সামাজিক ভাবপ্রবণতা Scio-sentiment) ও (৩) মানবিক ভাবপ্রবণতা Human-sentiment)৷’’

যে ভাবাবেগে কেবল মাটিকে অর্থাৎ ভূখণ্ডকে কেন্দ্র ক’রে গড়ে ওঠে তাকে ভৌম ভাবাবেগ বলে, আর এই ভৌম ভাবাবেগের ভিত্তিতেই গড়ে ওঠে আরও নানান ধরণের ভাবপ্রবণতা৷ যেমন---ভৌম দেশাত্মবোধ Geo-Patriotism), ভৌম ধর্মমত religion), ভৌম অর্থনীতি Geo-Economics), সামাজিক ভাবাবেগ Socio-sentiment) ইত্যাদি আরও অনেক কিছু ভাবাবেগ গড়ে উঠতে পারে৷ এখন, এই সমস্ত ভাবাবেগগুলি মানুষের বিচারপ্রবণ বুদ্ধি বা মানসিকতা, বিবেককে প্রেষিত করে চলেছে৷ এরফলে মানুষ তার বিবেক, বুদ্ধিকে বিসর্জন দিয়ে এই ক্ষুদ্রভাব ধারায় প্ররোচিত হ’য়ে চলেছে৷ এর ফলে ব্যষ্টি জীবন ও সমাজ জীবনে ডেকে  এনেছে নানা ধরণের বিপর্যয়৷ এই ভাবধারা হ’তেই জন্ম নিয়েছে নানান ধরণের ইজম্‌ ism), এই সব ভাবাবেগই পৃথিবীতে ডেকে এনেছে বহু রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ-বিগ্রহ, লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণহাণি হয়েছে৷

‘ৰাৰা’ বলেছেন---সব চাইতে  বড় ভাবাবেগ হ’ল সামাজিক ভাবাবেগ Socio-sentiment) এই ভাবাবেগ মাটিতে-আটকে নেই, একটা বিশেষ জনগোষ্ঠীতে আটকে  রয়েছে, এই সামাজিক ভাবপ্রবণতা পৃথিবীতে অনেক রক্তপাত ঘাটিয়েছে৷ এরপরও আর সেন্টিমেন্ট আছে, সেটি হ’ল তথাকন্ঠিত মানবিক ভাবপ্রবণতা So called Human sentiment)৷

এখন, মানুষকে এই বিভিন্ন ভাবাবেগ থেকে সতর্ক থাকতে হবে, যাতে করে  অন্তরের এই দামী সম্পদ inner assets) গুলি নষ্ট না হয়৷ কিন্তু কিভাবে এই Geo-sentiment-এরবিরুদ্ধে আমরা লড়বো? এইGeo-sentiment-তথা আরও বিভিন্ন sentiment-এরবিরুদ্ধে লড়বো তা ‘ৰাৰা’ বলেছেন---‘‘এর বিরুদ্ধে লড়তে হ’লে সবচাইতে বড় অস্ত্র হ’ল---বিচারপ্রবণ মানসিকতা rationalistic mentality)-Geo-sentiment -এর বিরুদ্ধে আমাদের গড়ে তুলতে হবে এই বিচার প্রবণ মানসিকতা৷ এখন, এই বিচারপ্রবণ মানসিকতা গড়ে তুলতে হয় দু’ভাবে৷ নানান ধরণের ‘ষ্টাডিজ’-এর মাধ্যমে যাকে বলে ‘পাঠ’ বা ‘স্বাধ্যায়’, আর যারা পড়তে জানে না৷ তারা অন্যের মুখ হ’তে শুণে অর্থাৎ স্বাধ্যায় শুণে আরও বিশজনকে বোঝাবে৷ সুতরাং এইভাবে স্বাধ্যায়ের মাধ্যমে সবাই বিচার প্রবণ মানসিকতা গড়ে তুলতে পারবে ও জিও-সেন্টিমেন্টের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারবে৷

প্রাচীন কালে মুনি ঋষির আশ্রমে থেকে শিক্ষার্থীরা এইভাবেই দৈনিক স্বাধ্যায় করত৷ প্রাচীনকালে গুরুর কাছ হ’তে স্বাধ্যায় করার পর জটিল জিনিষ সম্বন্ধে সম্যক জ্ঞান অর্জন করত৷ এই সময় লিপি আবিষ্কার না হওয়ায় শিক্ষার্থীরা স্বাধ্যায়ের মাধ্যমেই পরাজ্ঞান অর্জনের পথে এগিয়ে চলত৷ শুনে শুনে যারা জ্ঞান অর্জন করত, তাদের তাই বলা হ’তো শ্রুতিধর৷

তাই ‘ৰাৰা’ বলেছেন--- এই সেন্টিমেন্টগুলিকে কাটিয়ে উঠতে হ’লে আমাদের  স্বাধ্যায়ের মাধ্যমে বুদ্ধির মুক্তি ঘটাতে হবে, তবেই আমরা শেষ আশ্রয় ‘নব্যমানবতা’বাদ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হব৷

‘ৰাৰা’ এই কারণে ‘স্বাধ্যায়ের উপর এত গুরুত্ব দিয়েছেন ও সাধনা শেষে অর্থাৎ ডি.ধর্মচক্র শেষে ‘স্বাধ্যায়’-কে বিধিবদ্ধ নিয়ম ক’রে দিয়েছেন৷