মানবজীবনে যদি আদর্শ না থাকে তাহলে জীবন সার্থক হতে পারে না৷ মানুষ মননশীল উন্নত প্রাণী বিশেষ৷ সাধারণ ভোগ লালসার শিকার হয়ে যদি মানুষ চলে তাহলে মনুষ্যত্ব বলতে আর আদর্শবান বলতে যা বোঝায় তার ত্রিসীমানায় থাকাটা সম্ভব নয়৷ তাই বলা হয় ‘হাই থিঙ্কিং প্লেইন লিভিং’ হ’ল সুষ্ঠুভাবে বেঁচে থাকার মহৎ উপায় বা পথ নির্দেশনা৷ ভারত তাই ঘোষণা করেছে সুপ্রাচীন কালে ‘ভূমৈব সুখং নাল্পং সুখমস্তি’৷ ‘ভূমাকে লাভ করাই সুখ, সেটা ব্যতীত সুখ লাভ সম্ভব নয়’৷ এই ভূমা কী? সেটা তো জানতে হবে৷ ভূমা হল সেই বিশ্বচরাচরে সৃষ্টির মূলকেন্দ্র৷ যা থেকে সকলের উৎপত্তি৷ এককথায় বলা হয় পরম ব্রহ্ম৷ যিনি বিরাট৷ যার মধ্যে সবই বিধৃত৷ তাঁকে জানতে গেলে মানুষকে আধ্যাত্মিক দর্শনের পথে এগোতে হবে৷ বেদে বলা হয়– ‘‘আত্মানাং বিদ্ধিং’’ আত্মাকে জান, আধ্যাত্মিক অনুশীলনের মধ্য দিয়ে৷ যম ও নিয়মের পথ ধরে চলতে পারলেই তাঁকে জানা যাবে৷ তাই বলা হয় নিজেকে জানাই যথার্থ জ্ঞান৷ আর এই নিজেকে জানতে পারলেই তবে জগতের সবই জানা যায়৷ কারণ সবকিছুতেই সেই ব্রহ্ম বিরাজ করছেন৷ সকলের সেবা করা, সকলের জন্যে শুভ চিন্তা, কল্যাণ কামনার মধ্যেই হূদয়ের বিস্তার হয়৷ এর ফলে স্বার্থপরতা নিছক ব্যষ্টিগত ভোগ লালসা দূর হয়৷ মানুষ উন্নত চিন্তা–ভাবনায় প্রেষিত হয়ে নিজে অতি সরল সাদামাটা জীবন যাপন করতে অভ্যস্ত হয়৷ এদেশে তাই দেখা যায় বিশ্ববরেণ্য ব্যষ্টিত্বের অধিকারী ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মত মানুষেরা অতি সরল জীবনযাপন করতেন ও বীরের ন্যায় অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে যেতেন৷ কিন্তু আজ সেই চরিত্রবান মানুষের বড়ই অভাব৷ দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের মধ্যেও এর দারুণ অভাব৷ তাই তো এত দুর্নীতি ও আর্থিক বিপর্যয়, আইন শৃঙখলার অবনতি৷ আদর্শচ্যুত মানুষ সমাজের বোঝা স্বরূপ ও মানব প্রগতির অভিশাপ৷ এই কথাটি মহান মার্গগুরু যিনি পরমারাধ্য বাবা শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী বার বার বলতেন৷ আর তিনি তাঁর প্রতিটি অনুগামীকে যম নিয়মে প্রতিষ্ঠিত হয়ে আধ্যাত্মিক সাধনায় যুক্ত হওয়ার নির্দেশ দিতেন৷ যম (অহিংসা, সত্য, অস্তেয়, অপরিগ্রহ, ব্রহ্মচর্য), নিয়ম (শৌচ, সন্তোষ, তপঃ, স্বাধ্যায়, ঈশ্বর প্রণিধান)–এই নীতিগুলি পালন করতে হয়৷ তবেই আধ্যাত্মিক উন্নতি সম্ভব ও মানুষ নিজেকে তৈরী করতে সক্ষম হয়৷ এদের হাতেই তিনি কথা বলেছেন শাসনভার, সেবার দায়িত্ব তুলে দেবার নির্দেশ দিতেন৷ তাই তো দেখা যায় কুচক্রীরা তাঁর আদর্শের বিরুদ্ধে তীব্র বিরোধিতা করে থাকে৷ আলোচনা প্রসঙ্গে বলি শত শহীদের রক্তে রাঙ্গা দেশের স্বাধীনতাকে নিয়ে দেশের শাসকবর্গ কীভাবে অপব্যবহার করছে৷ দীর্ঘ ৭১ বছর স্বাধীনতায় দেশের শাসকগণ ও বিরোধী দলগুলি শুধু ঝগড়া করেই কাটিয়ে দিল৷ সামাজিক ও অর্থনৈতিক অগ্রগতি অদ্যাবধি তেমনটা তো করেই নি বরং কিছু অর্থগৃধ্ণু লোভী ধনীর জন্ম দিয়েছে এদেশের শাসকবর্গ৷ ভারতীয় অর্থনীতির সংকট গভীরে৷ দেশের অধিকাংশ মানুষ ও শিশুরা অপুষ্টিতে ভুগছে৷ সংসদীয় গণতন্ত্রে সুষ্ঠু দেশ পরিচালনায় নেতাদের কোন সক্রিয় ভূমিকা নেই৷ আজ দেশের প্রকৃত নেতার দারুণ অভাব৷ দুর্নীতিগ্রস্তরা ভীড় করেছে রাজনীতির আঙ্গিনায়৷ দেশ দারুণ সংকটে৷ তাই দেশবাসীদের নেতৃত্বের উপর নির্ভর না করে যম–নিয়মে প্রতিষ্ঠিত হয়ে দেশকে বাঁচাতে হবে৷ এটা লেখা যতটা সহজ প্রকৃতপক্ষে তার বাস্তবায়ন ততটাই কঠিন কারণ ধনতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় সমাজ দাঁড়িয়ে আছে ‘শোষণের ওপর সমৃদ্ধির মানসিকতা’র ওপর৷ যে যা পার লুটেপুটে নাও, ভোগ করে যাও৷ আজ এটাই ভোগবাদী সমাজের লক্ষ্য৷ তাই তো প্রায় ১২৫ কোটি লোকের মধ্যে প্রায় ৮০ কোটি মানুষের জীবিকা নির্বাহের মান অতি নিম্নমুখী৷ অন্ন–বস্ত্র–শিক্ষা–চি ও বাসস্থানের কোনই গ্যারাণ্ঢি নেই৷ আজ স্বাধীনতার এতদিন পরে দারিদ্র্য সীমার নীচে বসবাসকারীদের খাদ্য সুরক্ষা আইন করে তাদের মুখে অন্ন তুলে দেবার আইন হচ্ছে৷ মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বাড়াবার ব্যবস্থা করতে হবে তবেই দেশের সুষ্ঠু নাগরিক গড়ে উঠবে৷ খাদ্য সুরক্ষা আইনের চেয়ে খাদ্য সু–বণ্ঢন নীতিকে মান্যতা দিতে হবে প্রথমে৷ সরকারের কি কেন্দ্র কি রাজ্য তো এতদিনে বাজার নিয়ন্ত্রণের দিকে নজরই দেয়নি৷ দেশের যে খাদ্য উৎপাদন হয় সেই উৎপাদিত খাদ্য যদি সুরক্ষা করা হয় আর যদি অত্যাবশকীয় খাদ্য অনাদরে, অবহেলায় খোলা স্থানে ফেলে রেখে নষ্ট না করা হয় , তাছাড়া এই খাদ্যদ্রব্য চোরাপথে পাশের রাষ্ট্রে যদি চালান না হয় তাহলে এদেশের মানুষের খাদ্যাভাব হয় না৷ তাছাড়া খাদ্যাভ্যাসকেও প্রয়োজনে পরিবর্ত্তন করার দরকার আছে যাতে শরীর ও মন দুইই সুস্থ ও নীরোগ থাকে৷ এই সব দিকে শাসকদের দৃষ্টি তেমন নেই৷
ভারতের মত বিরাট দেশে খোলা বাজারে সব কিছু ছেড়ে দেওয়াটাতে অসুবিধা আছে৷ অসাধু ব্যবসাদার, ফোড়েরা অত্যধিক মুনাফা লাভের আশায় খাদ্যের যোগান কম করে বাজারের কৃত্রিম চাহিদা বাড়িয়ে ক্রেতাদের শোষণ করে থাকে৷ তাই সরকারকে বাজার দর নিয়ন্ত্রণ করতে হবে৷ সকল নাগরিকের জন্যে রেশনিং ব্যবস্থায় অত্যাবশক জিনিসগুলির যোগান দিতে হবে৷
এই যোগানে খাদ্যের মান অনুযায়ী দামের তারতম্য থাকতে পারে৷ সেখানে সকলের কথা ভাবতে হবে, তবে ভরতুকি দিয়ে নাগরিকদের কৃপাপাত্র/পাত্রী না করে কিছুটা স্বল্প দামে খাদ্য যোগান দেওয়াটাই কাম্য৷ ২/৩/১ টাকায় গম চাল ডাল ইত্যাদি প্রতি কেজি দরে দিতে গিয়ে কেন্দ্র সরকারের দেশকে ঋণে জর্জরিত করার অনুমতি ভারতের নাগরিকগণ দিয়েছেন বলে মনে হয় না৷ প্রত্যেক নাগরিক যাতে কর্ম করার সুযোগ পায় সরকারী, বেসরকারী ক্ষেত্রে, সেদিকে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের ব্যাপকভাবে ব্যবস্থা গ্রহণের দায়িত্ব নিতে হবে৷ তবেই দেশের আর্থিক স্বচ্ছলতা আসবে, দেশ সামাজিক–র্থনৈতিক দিক হতে উন্নত হবে৷ যে গণতন্ত্রে শাসন ব্যবস্থায় ধনী আরও ধনী হয়, আর গরীব আরো গরীব হয়ে মাটিতে মিশে যায় তাকে কি সত্যিই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বলে? রাজনীতিকে দুর্বৃত্তদের বাড়–বাড়ন্তটা কী দেশের অগ্রগতির লক্ষণ না অধোগতির বাড়বাড়ন্ত?
তাই আজ নিছক স্বার্থপর, লোভী রাজনৈতিক নেতাদের দিকে তাকিয়ে থেকে কাল হরণ না করে শিক্ষিত, কর্মক্ষম তরুণ–তরুণীদের নিজেদের পায়ে দাঁড়িয়ে একদিকে যেমন আর্থিক উন্নতির কথা ভাবতে হবে ও সেটা বাস্তবায়ন করতে হবে ঠিক তেমনি দেশের সৎ নীতিবাদীদের একত্রিত হয়ে দেশ গড়ার দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে৷ দেশকে দুর্নীতিপরায়ণদের হাত থেকে রক্ষা করার দায়িত্ব নিতে হবে৷ দেশ আজ চরম সঙ্কট কালে নীতিবাদী তরুণ–তরুণীদের দিকে তাকিয়ে আছে৷ তাই বলি, ভারত তথা বিশ্বের মুক্তির জন্যে নীতিবাদীরা এক হও–এটাই মহাসম্ভূতি শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী নির্দেশ৷
- Log in to post comments