ভারতের মাটিতে কোন বাঙালী বিদেশী নয়

লেখক
তপোময় বিশ্বাস

২০২১ সালটি বাঙালীর কাছে একটি পরীক্ষা বছর৷ বাঙালীদের ভারতবর্ষে বিদেশী হয়ে ডিটেনশন ক্যাম্পে থাকতে হবে নাকি স্বদেশী হয়ে মাথা উঁচু করে থাকবে---এটাই ছিল পরীক্ষার বিষয়৷ পশ্চিমবঙ্গের বাঙালীরা এ পরীক্ষায় দারুণ সাফল্যের সাথে উত্তীর্ণ হয়ে নাগরিকত্ব হারানোর ভয় কে জয় করেছে৷ মমতা ব্যানার্জির নেতৃত্বে তৃণমূল কংগ্রেস তৃতীয়বারের জন্য ক্ষমতায় এসেছে৷ কিন্তু অসমের বাঙালীদের নাগরিকত্ব হারানো/ ডিটেনশন ক্যাম্প ইত্যাদির ভয় গেল না৷ ২০২১-র অসম বিধানসভা নির্বাচনে পুনরায় ক্ষমতায় বসেছে বিজেপি৷

আমরা জানি এন.আর.সি প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছিল কংগ্রেস আমলে৷ কংগ্রেস আমলের মোটামুটি সব প্রকল্পই বন্ধ নচেৎ পরিবর্তন করা হয়েছে বর্তমান বিজেপি আমলে৷ জহরলাল নেহেরু যে হাফকোটটি পরতেন সেটি জহর কোট বলেই পরিচিত ছিল, বর্তমান প্রধানমন্ত্রীও হাফ কোট পরেন, শুধুমাত্র সামান্য ডিজাইন পরিবর্তন করে প্রচার করা হল নতুন করে মোদী কোট...৷ এমনকি কংগ্রেস আমলের তৈরী সংসদ ভবন ও প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন পরিবর্তন করে এই কোভিড অতিমারীর সময় প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা খরচ করে নতুন করে সংসদ ভবন ও প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন তৈরীর জন্য সেন্ট্রাল  ভিস্তা প্রকল্প গৃহীত হয়েছে৷ তাহলে দেখা যাচ্ছে কংগ্রেস আমলের সমস্ত নীতি-নির্ধারণ-প্রকল্প সবকিছুই মুছে ফেলছে অথবা বাতিল করেছে বিজেপি৷ একমাত্র বাতিল করছে না এন.আর.সি প্রক্রিয়ার৷ সব বাতিল হওয়া সত্ত্বেও কেন এন আর সি থেকে যাচ্ছে?

এই ‘কেন’ র মধ্যেই একটি পরিষ্কার নির্মম সত্য লুক্কায়িত৷ কোন সত্য? উত্তরে বলব বাঙালী নিধনের পরিষ্কার নির্মম সত্য৷ অসমের বাঙালীদের এই বিষয়ে সচেতন হতে হবে৷ এবছরের অসম বিধানসভা নির্বাচন ইস্তাহারে-এন.আর সি তালিকার ২০ শতাংশ নাম পুনর্যাচাই’র কথা ছিল৷ অসমে নতুন করে বিজেপি ক্ষমতায় আসায় গোটা রাজ্যে ১০ শতাংশ এবং সীমান্তবর্তী এলাকায় ২০ শতাংশ নাম ফের যাচাইয়ের আর্জি সুপ্রিম কোর্টে এন.আর.সি সমন্বয়কের তরফে জানানো হয়েছে৷ অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিয়েই এন.আর.সি ভুক্তদের তথ্য যাচাইয়ের কথা ঘোষণা করেছিলেন হিমন্ত বিশ্বশর্র্ম৷ এই ঘোষণার পর থেকে অসমের শিলচর, করিমগঞ্জ, ধুবড়ি সহ রাজ্যের বাঙালীরা পুনরায় আতঙ্কিত৷ দেশে কোভিড অতিমারিতে মৃত্যু মিছিল চলছে, অসমেও ব্যতিক্রম নয়৷ সেখানের বাঙালীদের বর্তমানে মৃত্যু ভয় এবং এন.আরসির পুনর্যাচাইয়ের ঘোষণার চরম আতঙ্ক দুয়েই মিলে অসমের বাঙালীদের জীবন্ত লাশে পরিণত করবে৷ সুপ্রিম কোর্টের তত্ত্বাবধানে অতীতে নাগরিক পঞ্জীর তালিকা বের করতে খরচ হয়েছে ১৬০০ কোটি টাকা, আতঙ্কে প্রাণ হারিয়েছেন ৭০ জন নির্র্দেষ বাঙালী৷  তাহলে স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ণ আসে ১৬০০ কোটি টাকা খরচ করে, ৭০ জনের মৃত্যুর পরেও আবার কেন পুনর্যাচাই?? পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে মমতা ব্যানার্জির দায়িত্বের পর তিনি প্রথম ঘোষণা করেন কোভিড অতিমারি থেকে রাজ্যবাসীকে রক্ষা করার, অন্য দিকে অসমের ক্ষেত্রে হিমন্ত বিশ্বশর্র্মর প্রথম ঘোষণা এন.আর.সির তথ্য যাচাই!!! এই বিষয় থেকে স্পষ্টভাবে প্রমাণ হয়ে যায় অসমের মুখ্যমন্ত্রী পরিবর্তন হলেও বাঙালী বিদ্বেসী কার্যকলাপের কোন পরিবর্তন হয়নি৷

পাঠকবর মনে করতে পারেন সিএএর মাধম্যে হিন্দু বাঙালীদের নাগরিকত্ব প্রদান করা হবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বিজেপি৷ এখানে পাঠকবর কে বলি, সি এ এ তে নাগরিকত্ব প্রদানের ব্যাপারে যে বিষয়ে সবচেয়ে লক্ষণীয় তা হল-‘‘ধর্মীয় অত্যাচারের কারণে দেশত্যাগের প্রমাণ’’৷ অত্যাচারিত হয়ে জীবন রক্ষার চিন্তাই প্রাধান্য পায়, প্রমাণ সংগ্রহের নয়৷ তাছাড়া ৭২-৭৪ বছর পরে প্রমাণ সংগ্রহ করা সম্ভব নয়৷ আসলে এই সিএএ নিয়ে বাঙালীদের পুতুল নাচ নাচাচ্ছে বাঙালী বিদ্বেষী বিজেপি৷ অসমের বাঙালীরা দেখেছে নেলির বাঙালী গণহত্যা, দেখেছে নাগরিকত্বহীনের আতঙ্কে শত বাঙালীদের মৃত্যু৷ এসবের পরেও ঐক্যবদ্ধ হয়নি, তাই আজও অসমীয়াদের কাছে বাঙালীমাত্রই বিদেশী, আর অসমীয়াদের এই চিন্তাধারাকে আরো উস্কে দিচ্ছে শাসক দল বিজেপি৷ আজ সময় এসেছে অসমের বাঙালীদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার৷ ধর্মমত-বর্ণগত-রাজনৈতিক বিভেদ ভূলে অসমের বাঙালীদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে নাগরিকত্বের ভয় কে জয় করতেই হবে, করতেই হবে, করতেই হবে, করতেই হবে৷ সরব উঠুক-বাঙালীর রক্তে স্বাধীন ভারতবর্ষের মাটিতে একটি বাঙালীকেও বিদেশী বানানো যাবে না, যাবে না, যাবে না৷