ভারতীয় রাজনীতির কর্কট ব্যাধি

লেখক
একর্ষি

পূর্ব প্রকাশিতের পর

তাই তথাকথিত রাজনৈতিক নেতারা সৎ নীতিবান চেতনাসম্পন্ন মানুষের রাজনীতিতে আসাটা পছন্দ করেন না৷ পরীক্ষায় নকল করা ছেলে অভিভাবকের  কাছে চতুর ছেলের ক্রেডিট--- বোকা নয় ইত্যাদি৷ আধ্যাত্মবাদী ভাবাদর্শ রাজনীতির ভিত্তি না হওয়ায় দেশের এই হাল৷ স্মরণীয়, ধর্ম বা ধর্ম সাধনার কাল্ট--- আধাত্মবিজ্ঞানই নৈতিকতার উৎস মুখ৷

রাজনীতিতে নৈতিকতার প্রসঙ্গ উঠলেই অনিবার্যভাবে এসে যায় নির্বাচনের কথা৷ মানুষের অভিজ্ঞতা বড়ই বেদনাদায়ক--- অধিকাংশ দেশেই দুর্নীতিগ্রস্ত ও  কায়েমী স্বার্থবাদীরাই নির্বাচিত হয়৷ এমনকী কুখ্যাত খুনী,ডাকাত ও মাফিয়া নির্বাচনে জিতে সরকারে অংশ গ্রহণ করে৷ কার্যতঃ সৎ ও যোগ্য লোকেদের  এখানে কোন স্থান নেই৷ নীতিহীন লোকেরাই অর্থের জোরে নির্বাচন বিধিকে কলা দেখিয়ে, ভীতি প্রদর্শন করে এবং প্রয়োজনে পাশবিক শক্তিকে কাজে লাগিয়ে জয়কে ছিনিয়ে নেয়৷ তাই প্রায় সব ক্ষেত্রেই আর্থিক ক্ষমতাবান আর বাহুবলীদেরই নির্বাচিত হবার একচেটিয়া অধিকার৷

রাজনীতি থেকে ধর্ম বা আধ্যাত্মিকতা ছেড়ে যাওয়ার আর একটি বিষফল হল বোটব্যাঙ্ক রাজনীতি৷ ধর্মমত ভিত্তিক সংখ্যা লঘু -গুরু তত্ত্ব, গোষ্ঠীতত্ত্ব বা বিচ্ছিন্নতাবাদের কাঁধে ভর করে এর উত্থান৷ বোট বড় বালাই, দলতন্ত্রের এমনই উগ্র নেশা যে দেশের স্বার্থ সাধারণ মানুষের স্বার্থ এমনকি নীতি ধর্ম জলাঞ্জলি দিয়েও বোটে জিততে হবে, দলকে জেতাতে হবে! বিচ্ছিন্নবাদী শক্তিগুলোও এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে ষোল আনা৷ এদের কৌশলটা কেমন? প্রাক্তন বিচারপতি---আচার্য ডঃ দুর্গাদাস বসুর বিচারপতির চোখে---’’ এইসব বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তির কার্যপ্রণালী হচ্ছে ধাপে ধাপে এগোনো প্রথমে তারা একটা দাবী বাতাসে ছেড়ে দেয়, তারপর যখন দাবীটা প্রচারিত হয় ও প্রথম ধাক্কাটা কেটে যায় তখন নরম দাবীটাকে শক্ত রূপ দেয় এবং আকারে বড় করে৷ তারা জানে বোটের জন্য ---দলগুলি তাদের দাবী অংশ বা পূর্ণতঃ মেনে নেবার জন্য পরস্পরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করবে৷’’ এদের বোট-বৈতরণী পারাপারের নির্ণায়ক (ফ্যাক্টর) হয়ে দাঁড়ায়৷ এদের বোট যে পক্ষে যায় সে পক্ষের জয় নিশ্চিত হয়ে যায়৷

গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন---‘‘যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত৷--- ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভাবামি যুগে যুগে৷’’

জগতে যখন ধর্মের অধোগতি হয় মানুষ তখন তার স্বধর্ম অর্থাৎ মানবধর্ম থেকে বিচ্যুত হয়ে অধর্মের পথে চলতে থাকে৷ অধার্মিকদের অন্যায়-অবিচার অত্যাচারে মানুষের জীবন অতীষ্ট হয়ে ওঠে, অস্তিত্ব বিপন্ন হয়৷ এমন সংকটময় মুহূর্তে দুষ্টের দমন শিষ্টের পালনের জন্য তিনি মর্ত্যলোকে অবতীর্ণ হন৷ গীতার এই শ্লোকটি সেই ধ্রুব সত্যের ওপরই সীলমোহর দেয় যে সমাজ ও জীবন থেকে ধর্ম ছেড়ে গেলে সমাজ ও জীবনের শৃঙ্খলা নষ্ট হয়ে যায়, দুর্র্যেগ-দুর্বিপাক অনিবার্য হয়ে ওঠে, শোষণ-অপশাসন- অত্যাচার-অবিচার-বঞ্চনা যেন মানুষের ললাটলিখন হয়ে দাঁড়ায়৷ ধর্মকে অস্বীকার করাতেই আজকের বাঙলা তথা ভারতবর্ষের বর্তমান উদ্বেগজনক দুরবস্থা৷ এখানে একটা ব্যাপার লক্ষণীয়, জগতে প্রতিটি মানুষের স্থান-কাল-পাত্র অনুযায়ী এক একটা বিশেষ বিশেষ পরিচয় বা অবস্থান (আইডেন্‌টিটি) আছে, আর প্রতিটি অবস্থানের বা পরিচয়ের বিশেষ বিশেষ স্বভাব বৈশিষ্ট্য বা ‘ধর্ম’ আছে--- যার মধ্যে নিহিত আছে আরোপিত ও প্রত্যাশিত ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া, দায়িত্ব-কর্তব্য, সেবা ও সংবেদ৷ যার থেকে আভিধানিক-প্রয়োগগত-বুৎপত্তি অর্থে এসেছে রাজধর্ম, প্রজাধর্ম, ,সন্ন্যাসধর্ম, স্ত্রীধর্ম, পতিধর্ম, পিতার ধর্ম, পুত্রের ধর্ম, কর্ষকধর্ম, শ্রমিকধর্ম, ব্যবসায়ীর ধর্ম, নেতার ধর্ম, নারীধর্ম, পুরুষধর্ম, সৈনিকধর্ম, বীরধর্ম ইত্যাদি৷

এগুলোর সামগ্রিক ধর্ম পালনের ওপরই নির্ভর করে সমাজ-সভ্যতার ভাল-মন্দ, কল্যাণ-অগ্রগতি-প্রগতি৷ কাজেই মানুষের স্বধর্ম কেবল মানুষ প্রজাতির (স্পিশীজ্‌) মানবধর্মে (প্রপার্টি-ইটারনাল আর্জ) সীমাবদ্ধ নয়, মানুষের প্রতিটি পরিচয়ের (আইডেনটিটির) স্বধর্ম ধর্মের পরিধিভুক্ত৷ গীতায় শ্রীকৃষ্ণ ধর্মকে এই ব্যাপকার্থেই ব্যবহার করেছেন৷ ভাষাচার্য ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় কোন একপ্রসঙ্গে তাঁর ছাত্রদের উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন--- কোন পুকুরের জল যদি পচে যায় তাহলে সেই পুকুরের জল যেখান থেকেই তোলা হোক না কেন পচা জলই মিলবে৷ ধর্মহীন ভারতীয়  রাজনীতির ফসল---জীবনের সর্বস্তরে ধর্মহীন ভারতীয় সমাজ৷ ভারতবর্ষের সিংহভাগ জনগণই মানুষের প্রজাতিগতস্বধর্ম ও পরিচয় গত স্বধর্ম খুঁইয়ে বসেছে৷ কিন্তু সেই ধর্মস্নগস্থাপনের কোন উদ্যোগ ও ব্যবস্থা নেই৷ এখানেই যত বিপত্তি৷ (ক্রমশঃ)