ঈশ্বরচন্দ্রের ঈশ্বর-চিন্তা

লেখক
প্রণবকান্তি দাশগুপ্ত

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ঈশ্বরে বিশ্বাসী ছিলেন---তার কোন স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় না৷ তাঁকে আস্তিকও বলা যায় আবার নাস্তিকও বলা যায়৷ অনেকে যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করেছেন ঈশ্বরের  অস্তিত্বে ঈশ্বরচন্দ্রের আদৌ প্রত্যয় ছিল না৷ এ ব্যাপারে ঈশ্বরচন্দ্রের অনুজ শম্ভূচন্দ্রের মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য---‘‘এক দিবস দাদা সুখাসীন হইয়া কথাবার্র্ত কহিতেছেন, এমন সময় দুইজন ধর্ম প্রচারক ও কয়েকজন কৃতবিদ্য ভদ্রলোক আসিয়া উপবেশন পূর্বক জিজ্ঞাসা করিলেন ‘বিদ্যাসাগর মহাশয়! ধর্ম লইয়া বঙ্গদেশে বড় হুলুস্থূলু পড়িয়াছে, যাহার যা ইচ্ছা সে তাহাই  বলিতেছে, এ বিষয়ের কিছুই ঠিকানা নাই৷’ এককথায় দাদা বলিলেন, ‘ধর্ম যে কি, তাহা মানুষের  বর্তমান অবস্থায় জ্ঞানের  অতীত ও ইহা জানিবারও কোন প্রয়োজন নাই৷’’

অনেকের মতে ঈশ্বরচন্দ্র ছিলেন রামমোহনের উত্তরসূরী৷ কিন্তু এ ধারণা অভ্রান্ত নয়৷ ঈশ্বরচন্দ্র কি রামমোহনের ধর্ম সংস্কারের বাহক ছিলেন? তিনি বরং ধর্মকে এড়িয়ে সমাজ সংস্কারে ব্রতী হয়েছিলেন৷ রামমোহনের মত ঈশ্বরচন্দ্র বেদান্তকে অভ্রান্ত দর্শন মনে করেননি৷ বরং  সেই ভ্রান্ত দর্শনের প্রভাব যাতে দেশবাসীর ওপর না পড়ে তাতে বিশেষ যত্নবান হয়েছিলেন৷ তাঁর সমাজ সংস্কার  কখনোই  ধর্মের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়নি৷

‘নোটস অন দ্য সংস্কৃত কলেজ’--- এই শিরোনামে ঈশ্বরচন্দ্র  ১৮৫২ সালের ১২ এপ্রিল বিশেষ করে সংস্কৃত কলেজের শিক্ষা ব্যবস্থার  সংস্কারকল্পে ২৬ প্যারা সম্বলিত একটি খসড়া তৈরি করেন৷ উক্ত খসড়াতে তাঁর শিক্ষা-চিন্তার  স্বরূপটি বিধৃত৷ সেখানে ১৬ নং প্যারাতে তিনি ভারতীয় ও  পাশ্চাত্য--- উভয় দর্শনই অধ্যায়ন করতে পরামর্শ দিয়েছেন যাতে ভারতীয় দর্শনের  ভ্রান্তি ও অসারতা বুঝতে  সুবিধা হয়৷ শিক্ষা সংসদের কাছে প্রেরিত অপর একটি রিপোর্টে তিনি তৎকালীন শাস্ত্রসর্বস্ব পণ্ডিতদের কটাক্ষ করে বলেছেন, তাঁরা শাস্ত্রে নিহিত বৈজ্ঞানিক সত্যের সন্ধান পেলে সেটাকে শাস্ত্রেরই জয় ভেবে বসেন ও বিজ্ঞানকে পরাজিত ভেবে তাকে দূরে সরিয়ে রেখে শাস্ত্রীয় কুসংস্কারকে আরও বেশি করে আঁকড়ে ধরেন৷

ঈশ্বরচন্দ্র একাধারে যেমন হিন্দু শাস্ত্র ও শাস্ত্রীয় কুসংস্কারের কবল থেকে ‘ছাত্রদের উদ্ধার করতে সচেষ্ট ছিলেন  তেমনি ভাববাদী চিন্তাধারা থেকেও  তাদের দূরে রাখতে উদ্যোগী ছিলেন৷ সংস্কৃত কলেজে বেদান্ত ও সাংখ্য পড়ানো হ’ত৷ কিন্তু উক্ত দুই দর্শন যে ভ্রান্ত তাতে তাঁর কোন দ্বিধা ছিল না৷ তাই তিনি এমন একটি পাশ্চাত্য দর্শন পড়াতে চেয়েছিলেন যাতে ছাত্রদের বেদান্ত ও সাংখ্য পাঠজনিত ভ্রান্তির অবসান ঘটে৷ তাঁর মতে সাংখ্য ও বেদান্ত দুই-ই ভ্রান্ত দর্শন৷ শিক্ষা-সংস্কার তাঁর কাছে ছিল জীবনের ‘প্রিয়তম উদ্দেশ্য’ বা ডারলিং অবজেক্ট ও  তাঁর ‘সর্বপ্রধান সৎকর্ম’ ছিল বিধবা বিবাহ প্রচলন৷ লক্ষ্যনীয় বিষয়, এই দুটো ব্যাপারের কোনটাতেই তিনি ধর্মকে টানেননি৷ তিনি ‘বিদ্যা দদাতি বিনয়ং’ বলছেন, বলেননি ‘সাবিদ্যা যা বিমুক্তয়ে৷’ বিধবা বিবাহ প্রথা প্রচলন করতে গিয়ে অবশ্য তাঁকে  শাস্ত্রের দ্বারস্থ হতে হয়েছিল৷ তাঁর কারণ, ‘এদেশে শাস্ত্রই সর্বপ্রধান প্রমাণ এবং শাস্ত্রসম্মত কর্মই সর্বতোভাবে কর্তব্যকর্ম বলিয়া পরিগৃহীত হইয়া থাকে৷ অতএব বিধবা বিবাহ শাস্ত্রবিরুদ্ধ কর্ম  ইহার মীমাংসা করাই সর্বাগ্রে আবশ্যক৷’ বিধবা বিবাহ প্রচলন করতে গিয়ে তিনি যে শাস্ত্রের দোহাই দিয়েছিলেন তাঁর কারণ ভক্তি নয়---বাস্তব কৌশল৷

সাধক শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস ঈশ্বরচন্দ্রের সাথে একাধিকবার সাক্ষাৎ করেছিলেন৷ নিছক নাস্তিক হলে রামকৃষ্ণের মত অন্তর্দৃষ্টি সম্পন্ন সাধক ঈশ্বরচন্দ্রের কাছে বার বার ছুটে আসতেন কি? হাস্য পরিহাসের মধ্য দিয়ে রামকৃষ্ণ ঈশ্বরচন্দ্রের স্বরূপটি কী সহজভাবে উদ্‌ঘাটন করেছেন৷ ‘কথামৃতে উভয়ের বাক্যালাপ এখানে উল্লেখযোগ্য,

‘‘তোমার কর্ম সাত্ত্বিক কর্ম৷ সত্ত্বের রজঃ৷ সত্ত্বগুণ থেকে দয়া হয়৷... আর সিদ্ধ তো তুমি আছই৷’’

বিদ্যাসাগর---(সহাস্যে)---মহাশয়, কেমন করে? শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে)---আলু পটল সিদ্ধ হলে তো নরম হয়, তুমি তো খুব নরম৷ তোমার অত দয়া (হাস্য)

নাস্তিক হলে ঈশ্বরচন্দ্র কখনোই রামকৃষ্ণ দেবের কাছে ধর্মকথা শুনতে আগ্রহী হতেন না৷ ঈশ্বরতত্ত্ব নিয়ে কোন আলোচনাও করতেন না৷ তিনি কোন ঘরোয়া বৈঠকেও ঈশ্বর সম্পর্কে আলোচনা করেননি--- শ্রীবিনয় ঘোষের এ বক্তব্য সঠিক নয়৷ কথামৃতে ধর্ম সম্পর্কে তাঁর যথেষ্ট আগ্রহ দেখতে পাই৷

‘ব্রহ্মা যে কি, মুখে বলা যায় না৷ সব জিনিস উচ্ছিষ্ট হয়ে গেছে৷ বেদ, পুরাণ, তন্ত্র, ষড়দর্শন, সব এঁটো হয়ে গেছে৷ মুখে পড়া হয়েছে, মুখে উচ্চারণ হয়েছে--- তাই এঁটো হয়েছে৷ কিন্তু একটি জিনিস কেবল উচ্ছিষ্ট হয় নাই, সেই জিনিসটি ব্রহ্মা৷ ব্রহ্মা যে কি , আজ পর্যন্ত কেহ মুখে বলতে পারে নাই৷’’

বিদ্যাসাগর (বন্ধুদের প্রতি)---বা এটি তো বেশ কথা৷ আজ একটি নূতন কথা শিখলাম৷ ব্রহ্মা উচ্ছিষ্ট হন নাই৷

বিদ্যাসাগর--- তিনি কারুকে বেশি শক্তি, কারুকে কম শক্তি দিয়েছেন?

শ্রীরামকৃষ্ণ---তিনি বিভূরূপে সর্বভূতে আছেন৷

ধর্মবিষয়ে  বিদ্যাসাগর কাহাকেও শিক্ষা দিতেন না৷’ ঠিক  কথা৷ কিন্তু ধর্মশিক্ষায় তাঁর অনীহাও ছিল না৷

ঠাকুর একদিন বিদ্যাসাগরকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘আচ্ছা তোমার কি ভাব?’’

বিদ্যাসাগর--- ‘আচ্ছা সে কথা আপনাকে একলা বলব৷’

অর্থাৎ বিদ্যাসাগরের সাধন পদ্ধতি কিছু একটা ছিল৷ ঠাকুর তাঁর কাছে বার বার ছুটে এসেছেন কি শুধু পাণ্ডিত্যের টানে?  শুষ্ক পাণ্ডিত্যের প্রতি  ঠাকুরের কোন মোহ ছিল না৷ আবার নিছক আড্ডা মেরে কালক্ষয় করার মত মানুষও তিনি ছিলেন না৷ ঠাকুরের প্রতি ঈশ্বরচন্দ্রের অকৃত্রিম ভক্তি লক্ষ্যণীয়৷ ঠাকুরের চাইতে ১৬/১৭ বছরের বড় হয়েও তিনি ঠাকুরকে ভক্তি ভরে প্রণাম করতেন৷

শ্রীসিত বন্দোপ্যাধ্যায় ঈশ্বরচন্দ্রকে আগুয়েস্ত কোঁৎ, মিল, বেন্‌হাম প্রভৃতি মানববাদী পাশ্চাত্য দার্শনিকদের সাথে এক সারিতে বসিয়েছেন৷ ঈশ্বরচন্দ্রের ঈশ্বরচিন্তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি যথার্থই বলেছেন, ‘‘কাহারও কাহারও মতে বিদ্যাসাগর নিরীশ্বরবাদী ছিলেন, কাহারও মতে তিনি ছিলেন ঘোর সংসারবাদী৷ তিনি ঈশ্বর-অস্তিত্বে সন্দিহান হউন আর নাই হউন, ফরাসি দার্শনিক কোঁতের মতো, মানুষ ব্যতীত অন্য কোন দেবতার জন্য বিশেষ ব্যস্ত হন নাই৷ গ্রীক হেডনইজম দর্শন ও ঊনবিংশ শতাব্দীর পসিটিভিজম-এর সঙ্গেই তাঁহার মানসিক সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যাইবে৷ নিছক জ্ঞানচর্চা, দর্শন আলোচনা ও  শাস্ত্র সংহিতাকে ত্যাগ করিয়া তিনি উপযোগিতার দিক দিয়াই সমস্ত কিছুকে বিচার করিয়েছেন৷ হিন্দুধর্ম-কর্মের প্রতি স্বভাবতই তাঁহার বিশ্বাস কিছু শিথিল হইয়া গিয়াছিল৷... বৈষ্ণব সাহিত্যে যেরূপ কৃষ্ণের নরলীলার প্রতি শ্রেষ্ঠত্ব আরোপিত হইয়াছে, সেই মানুষের ইহজীবন ও ভৌমচেতনাই ছিল বিদ্যাসাগরের ধ্যান, ধর্ম ও সাধনার বস্তু৷ তাঁহাকে ঊনবিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ মানববাদী সাধক বলিয়া শ্রদ্ধা করা উচিত৷’’