পূজো আসছে

লেখক
আশীষ দত্ত রায়

-এই যে গাইড৷

-কী ব্যাপার সন্ধ্যে রাতে...৷ মনটন খারাপ নাকি?

- আরে শুধু কি মনখারাপ, সঙ্গে বুকের ভিতরটা হু...হু৷

- ও’টা বোধ হয় বাঙলার বাইরে থাকার এফেক্ট৷

- সে’টা ডিনাই করছি না, তবে এ মনখারাপ সে জন্যে  নয় গো৷

-নতুন করে স্মৃতিবেদনা চক্করে পড়োনি তো? শেষ বয়সে এসে অমন একটু আধটু হতেই পারে৷

- তাইই মনে হচ্ছে৷ এ বয়সে নতুন ঐটাই তো অবলম্বন৷ কিছু ওই গৃহপালিত এক্সার সাইজগুলো এন্টারটেনিং হয় বটে৷ এই যেমন ধরো গিন্নী প্রাতরাশের ফল ছুলে দিতে বললে৷ তা দিলাম৷ প্রভাতী চা টা তো করেই থাকি৷ মশারির খোলা ও ভাজ করা৷ পার্ফেক্ট রিদমে৷ সব ক’টা কাজ আমার দৃষ্টিতে নিখুঁত, কিন্তু তার দৃষ্টিতে গোলমেলে৷ কাজের কোনও ছিরি ছাদ নেই৷ তবে নতুন প্রেমের ‘ওগো-হ্যাঁগো-তোমায় ছাড়া দুনিয়া অন্ধকার -গো...ও সব আর এই বয়সে সইবে কেন বলো৷

- তা হলে শাগরেদ, কেন তব এ দুর্মতী?

- জীবনের হাহাকারটা স্পষ্ট হয়ে উঠছে গাইড৷ সে জন্যেই এই কান্দণ

-কী রকম?

- এই যে ধরো পূজো আসছে৷ ছেলেবেলার এক্সাইটমেন্টটা ভাবতে চাইছি কিন্তু কিছুতেই হচ্ছে না৷  ভাবছি এন্তার ঘোরাফেরা, খাওয়াদাওয়া করব৷ লুচি তে সাঁতার কাটব, চপ-ঘুগনিতে বুঁদ হয়ে যাব৷ আর গ্রামে গিয়ে মায়ের হাতের খিচুড়ি লাবড়া.....

ভেবে যেমন আনন্দ হচ্ছে, তেমনি বুক শুকিয়ে যাচ্ছে রিয়েলিটির কথা ভেবে আজকাল সল্টেড বাদাম চিবুলেও বুকজ্বালা৷ কোথায় লুচি ঘুগনি, কীসের চপ? সেই ট্যালট্যালে ডাল আর মিক্সড ভেজিটেবেলই স্বস্তি৷ বড় জোর শেষ পাতে  চাটনি৷ তারপর  ধরো কলকাতার প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে ঘুরে রাতকাবার করাটা একসময় মনে হত মার দিয়া কেল্লা৷ এখন ভীড় ভাবলেই বুক কেঁপে উঠছে৷ পুজো সংখ্যা হাতে আর পাইনা তাই স্যোশাল মিডিয়াই ভরসা৷ আচ্ছা গাইড, সবই কি ক্লিশে? ও সব কি আর কোনওদিনই ফিরে পাবো না?  আর ভয়ের কথা বুড়িয়ে গেলাম নাকি?

- ক্লিশে উড়িয়ে দেবে বিদগ্দ মানুষজন৷ তোমার আমার সে দায় নেই হে৷ চেনা পরিচিত ভালোলাগাগুলোকে জড়িয়ে ধরব, বুক বাজিয়ে ডিফেণ্ড করব৷ মনের সুখে সে সব ভাবনাগুলোকে আগলে রাখব৷ অতভেবে অফিসের ডেটাবেস সাজিও, বৃষ্টি নামলে মুড়ি আর ভাজাভুজি খোঁজ করাতেই আমাদের মুক্তি৷

তবে ‘পুজো আসছে পুজো আসছে’ করে লাফিয়ে উঠতে পারছি না কেন? কেউ কানের কাছে পুজো-পুজো ঘ্যানঘ্যান করলেই রাগ হচ্ছে কেন? তার ঝুঁটিটা ধরে নাড়িয়ে দিতেই বা ইচ্ছে যাচ্ছে কেন?

- সে’টা ক্লিশে নয় হে৷ বড়জোর আক্ষেপ বলতে পারো৷

- ব্যাখ্যা ? কিন্তু বাংলায়৷

- কিশোর বেলায় পুজোটা তুমি গ্রামের বাড়িতে কাটাতে, তাই না?

-প্রতি বছর৷ উইদাউট ফেল৷ যখন থেকে একা যাতায়াত করতে শিখেছি৷ আহা,  সে কথা মনে পড়ায় ‘পেটে, বুকে  হুহু, চোখে জল সিচুয়েশন হয়ে গেল৷ আর ৰাৰা৷ আর মা ৷ আর খোলা মাঠ মিষ্টি হাওয়া, কুয়োর জল, পাড়ার সে আটপৌরে পুজো৷ আর সেই মানুষগুলো৷ আর সে খিচুড়ি খাওয়া৷ আর ৰাৰা৷ আর মা৷ আর সে দূর থেকে পূজোর অঞ্জলি শুরু ঘোষণা৷ সন্ধ্যের থিয়েটারের আওয়াজ৷ আর কচিকাঁচাদের  মাইকে গিয়ে নিজের কন্ঠস্বর শোনার....৷ আর ইয়ে, দশমীর নারকেলের নাড়ু আর ঘুগনি৷ আর ৰাৰা৷ আর মা৷

-ওয়াটার ওয়াটার এভ্রিহোয়্যার নট আ ড্রপ টু ড্রিঙ্ক৷ চারিদিকে পুজো পুজো ভাব শাগরেদ, অথচ তুমি তোমার পুজোয় ফিরতে পারছ না৷

- ৰাৰা, মা সে পুজো বগলদাবা করে চলে গেল যে৷

- একটা কথা বলি শাগরেদ?

- নিশ্চয়ই গাইড৷

- তোমার ৰাৰা, মা তোমার ভালোবাসার পুজোর স্মৃতি তৈরি করে গেছেন, যে স্মৃতি নেড়েচেড়ে আজও তুমি চাঙ্গা হয়ে ওঠে৷ তাই না? তেমনই, নিজের বুড়োটেপনায় আটকে  না থেকে, অন্য কচিকাঁচাদের হয়ে ভালোবাসার পুজো তৈরির দায়ও তো তোমার ওপর খানিকটা বর্তায়, তাই নয় কি?

- দায়? আছে, তাই না?

- আলবাত৷ আর সে’ টা দায়ভার নয়৷ আমার ধারণা সে’ টাও বেশ তৃপ্তির৷

- গাইড, পুজো সত্যিই চলে এলো৷ তাই না?

- একদম্‌ একদম্‌!