স্বাধীনতার ৭০ বছর পরেও সার্থক গণতন্ত্র অধরা

লেখক
আচার্য সত্যশিবানন্দ অবধূ্ত

মহাযুদ্ধ, গণতন্ত্রের উৎসব---কত ভাবে ভূষিত বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশের সাধারণ নির্বাচন৷ স্বাধীনতার ৭০ বছর পরেও সাবালক হয়নি গণতন্ত্র৷ দিল্লীর সিংহাসন কার দখলে যাবে, কোন দলের হাতে যাবে---তার লাগি কাড়াকাড়ি, হানাহানি৷ একটি নির্বাচনে বোট (ভোট) নিয়ে এত কাড়াকাড়ি, হানাহানি কেন? এত বিপুল সেনা আয়োজন---যেন গৃহযুদ্ধের মহড়া চলছে৷ স্বাধীনতার ৭০ বছর উত্তীর্ণ হলেও জনগণ কতটা স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের অধিকার পেয়েছে৷ স্বাধীনতার সব থেকে বড় লজ্জা দেশের এক বৃহত্তম অংশের মানুষের কোনও রকম রাজনৈতিক চেতনাই নেই৷ তাই রাজনৈতিক দলগুলি বড় বড় প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতা দখলের পর প্রতিশ্রুতি রক্ষার কোনও গরজ থাকে না৷ শুধু বাগাড়ম্বর করে পাঁচ বছর কাটিয়ে দেয়৷ তার পরেও জনগণের দ্বারে এসে বোট চাইতে কোনওরকম লজ্জাবোধ করে না৷ প্রধানমন্ত্রীর সভায় বিপুল জনসমাবেশ৷ কিন্তু কেউ এমন প্রশ্ণ করে না---‘পাঁচ বছর আগে দেওয়ার প্রতিশ্রুতির কি হ’ল?  নেতাজীর সব ফাইল, সুইস ব্যাঙ্কের কালো টাকা কোথায় গেল?’ এই ধরণের প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রতিশ্রুতি রক্ষা না করাটা জনগণের সঙ্গে কী একরকম প্রতারণা নয়?

আসলে স্বাধীনতা শুধু রাজনৈতিক ক্ষমতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ৷ সেখানেও নেতাদের মাতববরই শেষ কথা৷ গণতন্ত্র সম্পর্কে বলা হয়, জনগণের জন্য, জনগণের দ্বারা, জনগণের শাসন৷ কিন্তু দেশের সরকার যে জনগণের দ্বারা নির্বাচিত সেই জনগণ কতটা চেতনা সম্পন্ন? দেশের নেতা-মন্ত্রীরাই বা গণতন্ত্রকে সার্থক করতে কতটা সচেষ্ট? দুঃখের কথা, অনেক সময় নেতা-মন্ত্রীরা গণতন্ত্রকে প্রহসনে পরিণত করে ক্ষমতা দখল করে৷ দেশের শাসন ক্ষমতায় যারা নির্বাচিত প্রতিনিধি হয়ে বসবেন, নির্বাচনে তাদের শাসন করতেই বিশাল সেনাবাহিনী প্রয়োজন হচ্ছে৷ বে-শরম নেতামন্ত্রীরা এতে গর্বিত৷ যথেষ্ট জ্ঞান ও বোধশক্তিহীন জনগণ অনেক সময়ই ভ্রান্ত নেতৃত্বের দ্বারা প্ররোচিত হয়ে বোট দিয়ে থাকে৷ তাই প্রার্থীর ব্যষ্টিগত আচার-আচরণ, চরিত্র বিচার করে বোট দেওয়ার সুযোগ জনগণের থাকে না৷ কোথাও সুযোগ থাকলেও সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করার মত চেতনাই বা ক’জনের থাকে? যেখানে চোখ রাঙিয়ে বোট নেওয়া হয়, বোট কেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়া হয়, অর্থ দিয়ে বোট কেনা হয়, এসব অভিযোগ রাজনৈতিক দলের নেতা-নেত্রীরাই পরস্পরের বিরুদ্ধে করে থাকে৷ সেখানে গণতন্ত্র আজ প্রহসন মাত্র৷ অনৈকতাই নেতা-নেত্রীর যোগ্যতার মাপকাঠি৷ গণতন্ত্রকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে হলে প্রথম প্রয়োজন জনশিক্ষা৷ কিন্তু স্বাধীনতার ৭০ বছরে মন্দির-মসজিদের পেছনে যত অর্থ ব্যয় হয়েছে তার ১০ শতাংশও জনশিক্ষার জন্যে ব্যয় হয়নি৷ অনৈতিক নেতা-নেত্রীরা খুব চতুরভাবেই এটা করেছে৷ কারণ সাধারণ মানুষ যদি প্রকৃত জ্ঞান ও বোধ শক্তি অর্জন করে তবে অনৈতিক নেতাদের ছুঁড়ে ফেলতে বেশী দেরী করবে না৷ তাই গণতন্ত্রকে সার্থক করতে হলে চাই শিক্ষার বিস্তার ও যথার্থ জ্ঞানের প্রয়োজন৷ তবে শুধু জ্ঞান অর্জন করলেই চলবে না৷ নির্বাচিত প্রতিনিধি, নির্বাচকমণ্ডলী ও নির্বাচন পরিচালনা যারা করবেন সকলকেই কঠোর নীতিবাদের ওপর প্রতিষ্ঠিত হতে হবে৷ আজকের বিজ্ঞান ও নগর সভ্যতার যুগে যেখানে প্রতিনিয়ত ভোগ বিলাসের জীবন-যাপনের হাতছানি, সেখানে রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদের কঠোর নৈতিকতার অনুশীলন প্রয়োজন৷ সেই সঙ্গে ঢালাও বোট দানের অধিকার থাকলে হবে না৷ একমাত্র সামাজিক-অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক চেতনাসম্পন্ন মানুষেরই বোট দানের অধিকার থাকবে৷ গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা তখনই সার্থক রূপ পাবে৷