প্রভাতী

যা ভাবছ তা নয়

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

‘মৃগী’ শব্দের একটি অর্থ হচ্ছে একটি স্নায়ু–সংক্রান্ত মানসিক ব্যাধি, ইংরেজীতে (epilepsy)৷ যদি কোনো কম বয়সের ছেলে বা মেয়ে হঠাৎ কোনো অভাবনীয় কিছু দেখে বা শোনে তাহলে অনেক সময় তার স্নায়ুর ওপর বা মনের ওপর হঠাৎ একটা ৰড় রকমের চাপ এসে পড়ে৷ সেই চাপ সে যদি সহ্য করতে না পারে তখন তার এই মৃগী রোগ দেখা দেয়৷ যেমন ধরো, একটি ১২/১৪ বছরের ছেলের ধারণা ছিল, অমুক লোকটি কোনো নেশার ধারেকাছে যান না৷ হঠাৎ সে দেখলে সেই সংশ্লিষ্ট লোকটি বোতলের পর বোতল মদ খাচ্ছে৷ ফলে তার আগেকার ধারণার ওপর বিরাট একটা হাতুড়ির আঘাত লাগল৷ এর ফলে তার মৃগী রোগ দেখা দিতে পারে৷ কোনো একটি ছেলের ধারণা ছিল যে সে সদ্বংশজাত কিন্তু হঠাৎ সে শুনতে পেলে তার বংশ পরিচয় নেই৷ এই অবস্থায় তার মৃগী রোগ দেখা দিতে পারে৷ মৃগী রোগীর জীবনে স্নায়ুতন্তুর ওপর হঠাৎ কোনো আরামদায়ক পরিস্থিতি এলেই রোগ ফুটে ওঠে৷ কোনো মৃগী রোগীর অনেকক্ষণ ধরে মূত্র ত্যাগের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে৷ কিন্তু উপযুক্ত স্থান না পাওয়ায় মূত্র ত্যাগের সুযোগ পায়নি৷ এখন সে যখন মূত্র ত্যাগের সুযোগ পায় তখন তার স্নায়ুতে একটা আরামের অবস্থা আসে৷ এমন সময় মৃগী রোগী মূত্র ত্যাগ করতে করতে রোগগ্রস্ত হয়ে পড়ে যায়৷ কোনো মৃগী রোগী হয়তো দারুণ গরমে কষ্ট পাচ্ছে, এমন সময়ে সেই কষ্ট থেকে বাঁচার জন্যে সে পুকুরে বা নদীতে স্নান করতে গেল৷ জলের সংস্পর্শে এসে তার আরাম ৰোধ হল৷ এমন অবস্থায় রোগগ্রস্ত হয়ে সে জলে পড়ে মৃত্যুমুখে পতিত হতে পারে৷ এই কারণে কোনো মৃগী রোগীকে একলা কখনই কোনো জলাশয়ে স্নান করতে যেতে দিতে নেই৷

‘মৃগী’ প্রসঙ্গে একটা গল্প মনে পড়ল৷ একবার কৃষ্ণনগরের এক পাঁড় মাতাল ৰেশী মদ খেয়ে বেসামাল হয়ে রাত্তিরটা নালীতে শুয়ে কাটালে৷ শেষ রাতের মিষ্টি মিষ্টি ফুরফুরে হাওয়া ও ঠান্ডা নালীর জলের মধুর স্পর্শে তার নেশার ঘোর যখন কিছুটা কেটে গেল সে চোখ মেলে চেয়ে দেখলে তাকে ঘিরে লোকের ভীড় জমেছে৷ তার তখন একটু একটু লজ্জা করতে লাগল৷ সে আবার চোখ বুজে ফেললে৷ খানিক বাদে আবার সে চোখ খুলে চাইল৷ চেয়ে দেখলে ভীড়ের লোকেদের ভেতর তার বেয়াই মশায়ও (বৈবাহিক) রয়েছেন৷

এবার তার লজ্জার মাত্রা গেল আরও ৰেড়ে৷ বেয়াই তাহলে আসল ব্যাপারটা জেনেই ফেলেছে৷ এবার কী হবে! সে তখন বেয়াইয়ের দিকে চেয়ে বললে–বেয়াই, ও বেয়াই, বেয়াই গো, শুনছ, তুমি যা ভাবছ এটি তা নয়–এ আমার মৃগী রোগ৷

                                       (শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকারের ‘গল্প সঞ্চয়ন’ থেকে)

পরোপকারী

লেখক
প্রণবকান্তি দাশগুপ্ত

কোলকাতার বউবাজারের পথে দাঁড়িয়ে এক সবজিওয়ালা চেঁচাতে লাগলো---বাবু, আমার ঝাঁকাটা একটু মাথায় তুলে দিন না..? ও বাবু, একবারটি ধরুন-না ঝাঁকাটা?...

সবজিওয়ালা যাচ্ছিল বাজারে৷ পথে এক ক্রেতার কথামতো ঝাঁকাটা নামিয়েছিল৷ ক্রেতা জিনিস কিনে চলে যাবার পর আর সে পারলো না ঝাঁকাটা তুলতে৷ ঝাঁকাটা বেশ ভারি ছিল কিনা৷

সামনে দিয়ে যেই যায় তাকেই সবজিওয়ালা অনুরোধ করে, বাবু, ঝাঁকাটা একটু তুলে দিন-না?

কিন্তু কেউই তার কথায় কান দিল না৷ সকলেই ব্যস্ত৷ বিশেষত একটা মুখ্যু গেঁয়ো চাষীর ঝাঁকা তুলে মান হারাতে এগিয়ে এলোনা কেউই, পরোপকারের চাইতে আত্মসম্মানটা এতোই বড়!

অগত্যা কি আর করা যায়৷ দেরি হলে বাজারে জায়গা মিলবে না আনাজও বিক্রি হবে না৷ সবজিওয়ালা তাই হতাশ মনে নিজেই ঝাঁকাটা তুলতে লাগলো৷ কিন্তু বারবারই সে বিফল হলো৷

এমন সময় চোগা চাপ কান-পরা এক ফিটফাট ভদ্রলোক এগিয়ে এলেন বললেন, নাও তোলো আমি ধরছি৷

সবজিওয়ালা তো অবাক! এমন ঝকঝকে তকতকে বাবু কিনা তার ময়লা ঝুড়িতে হাত লাগালো৷

ঝাঁকাটা মাথায় তুলে সবজিওয়ালা বাবুকে সশ্রদ্ধ প্রণাম জানালো৷

জানো, কে এই বাবুটি? ইনিই হলেন রাজা রামমোহন রায়৷ মানুষের সেবা, মানুষের উপকারে তিনি কখনো পরাঙ্মুখ হতেন না৷ মানুষ যখন অসহায় তখন তাকে সাহায্য করাই তিনি পবিত্র কর্তব্য মনে করতেন---সেক্ষেত্রে ঠুনকো আত্মমর্যাদা বা বাবুয়ানাতে তিনি মোটেই প্রশ্রয় দিতেন না৷ এটাই যথার্থ শিক্ষা৷ আশা করি, এই শিক্ষাই রাজা রামমোহনের জীবন থেকে তোমরা গ্রহণ করবে৷

মধুময় প্রীতি

লেখক
সুকুমার রায়

রাতের কালোয় খুঁজি আলো

আর সহে না, প্রদীপ জ্বালো

মন মানে না চলব দুলে,

অনিত্য ধরার, দোয়ার খুলে

নবিন আশায়, নবিন দেশে

নন্দনলোকের ছন্দে মিশে৷

তুমি হে, প্রিয়তম মোর এসেছ ধরায়

প্রীতিতে বেঁধেছ সবারে স্নেহচ্ছায়,

জানিনা কত আনন্দ ওগো, তোমার তরে

দাও সে নয়ন জোরে দেখি প্রাণভরে,

সুখে-দুঃখে তুমি সবার চিরসাথী

যুগে যুগে এসেছ নিয়ে মধুময় প্রীতি৷

 

জাগাও মানবতা

লেখক
কৌশিক খাটুয়া

তিরিশে এপ্রিল আসে--------

ভারাক্রান্ত মনে স্মরণ বেলায় অশ্রুতে আঁখি ভাসে৷

অসহায় প্রাণ জর্জরিত হল

নির্মম আঘাতে,

মর্ত্যভূমির বীর পুঙ্গবেরা ছিল নাতো রাজপথে!

পরমাত্মা ও মহাত্মার মাঝে পাপাত্মা করে খেলা,

অহংকারের মিথ্যা দম্ভে অপকর্ম সারা বেলা৷

জড়বাদী মন থাকে সর্বক্ষণ

পাপাচারে আবদ্ধ,

কোনো বিরোধিতা মানিতে নারাজ

শুনিলেই হয় ক্ষুব্ধ!

পরের স্বার্থে দধীচির দান

দেবাত্মারই ধর্ম,

ধরনীতে তাঁরা আসা যাওয়া করেন

সারিতে আপন কর্ম৷

প্রাতঃস্মরণীয় চির বরনীয়

মহারণে জয়ী বীর,

মহাপ্রেরণায় তাঁহাদের ন্যায়

উন্নত হোক শির৷

তিরিশে এপ্রিল আসে বারেবারে --

ডাক দিয়ে যায় মানবতার দ্বারে

জাগ্রত হোক সুপ্ত মানবতার,

আসুরিক শক্তি বিলোপ সাধনে

জীবন উৎসর্গ হোক বারংবার৷

ব্যথিত হৃদয়ে মানুষের আজ শপথ নেওয়ার দিন,

সময় হয়েছে শুধিতে হবে অতীতের রক্ত ঋণ৷

গাওয়াও আমায় গান

লেখক
প্রণবকান্তি দাশগুপ্ত

গাওয়াও আমায় জীবন ভরে গাওয়াও আমায় গান--       

যেই গানেতে প্রাণে প্রাণে জাগবে মহাপ্রাণ--

যেই গানেতে ফুটবে আশা

মধুর হবে ভালবাসা---

যেই গানেতে আমার তো নয় তোমারি সম্মান৷

গাওয়াও আমায় জীবন ভরে গাওয়াও আমায় গান৷৷

আড়াল হতে বাজিয়ে বাঁশী

জীবনে মোর দাঁড়াও আসি,

সংঘাতে সংঘাতে তোলো এগিয়ে চলার তান৷

গাওয়াও আমায় জীবন ভরে গাওয়াও আমায় গান৷৷

প্রশ্ণ হানে মানবতা

লেখক
জ্যোতিবিকাশ সিন্‌হা

সেদিনও এসেছিল অন্ধ নিশা অবসানে শুভ্র প্রভাত

নব রবির আলোক নির্ঝর-স্নিগ্দ প্রকৃতিবক্ষে বিহগের কলগুঞ্জন

একে একে জেগেছে মানুষ, নবশক্তি সম্পাতে কেটেছে অবসাদ

নব চেতনায় সমৃদ্ধ সবে উন্মুখ, আরব্ধ করিতে সম্পাদন৷

মহাজীবনের আহ্বানে তাপস-তাপসী অগণিত দলে দলে

ত্যাগব্রতে বলীয়ান, সেবাব্রতে মহীয়ান, সঁপেছে অমূল্য জীবন

নিঃস্বহায় আর্তত্রাণে, বিশ্বমানবতার বেদীমূলে

সত্য-ধর্মের মহামন্ত্রে ধবনিত বিশ্বের মহাজাগরণ৷

প্রমাদ গণেছে নিকষ অন্ধকারের জীব, নররূপী হায়নার দল

পাশবিক শক্তি মদমত্ত, মানবতার শত্রু, পাতক, মিথ্যাচারী

অনাথ-আশ্রয়হীন শিশুকল্যাণে যারা বিছায়েছে মমতার কোল

দুরভিসন্ধি সাধনে কুচক্রী তাহাদের ‘ছেলেধরা’ অপবাদে বিষায়েছে নগরী৷

বিরাশির তিরিশে এপ্রিল, সুন্দর সকাল, তিলোত্তমা কলকাতা ক্রমশ কর্মব্যস্ত

সহসা ধাবমান ঘোর বন্য আঁধার, আদিম পৈশাচিক বর্বরতা

অসভ্যের হিংস্র হুঙ্কারে বিজন সেতু, বণ্ডেল গেটে নিরীহ মানুষ ভীত-সন্ত্রস্ত

উন্মত্ত পাষণ্ডের নির্লজ্জ তাণ্ডবে কলঙ্কিত হ’ল মানব সভ্যতা৷

নিরস্ত্র সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী-সন্ন্যাসিনী, পীড়িত সেবায় সদা তৎপর

ঘাতকের অস্ত্রাঘাতে ক্ষত-বিক্ষত, রক্তাক্ত রাজপথে সপ্তদশ মানবদেহ ভূলুন্ঠিত

যন্ত্রণা কাতর দেহে পেট্রোল ঢালি, জ্বালিল অগ্ণি শয়তান-প্রবর

শ্বাপদকুলের জঘন্য উল্লাসে বিজন সেতু-বণ্ডেল গেট হ’ল প্রকম্পিত৷

সপ্তদশ দধীচির জ্বলন্ত দেহ, আকুল আর্তনাদ, অসহায় হাহাকার

প্রতি বৎসর তিরিশে এপ্রিল আসি মানুষের দরবারে মাগে বিচার

অজস্র ধিক্কারে প্রশ্ণ হানে মানবতা, সভ্যতার কি আজ সত্যিই দুঃসময়

নাকি ন্যায়ধর্ম প্রতিষ্ঠায় বিচারের অমোঘ নির্ঘোষ ধবনিবে নিশ্চয়ই?

ৰেফাঁস কথার ফ্যাসাদ 

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

‘খরগ্রহ’ শব্দের ভাবারূঢ়ার্থ হল যেখানে  অনেক গাধা রয়েছে৷ যোগারূঢ়ার্থে এক-একটি মানে হল গাধার আস্তাবল৷  দ্বিতীয় মানে হচ্ছে প্রাচীনকালে যখন দ্রুতগামী যানবাহনের ব্যবস্থা ছিল না তখন রাজপথ ধরে দূর দূরান্তে মানুষ চলত পদব্রজে৷ অবস্থাবান মানুষেরা ও নারীরা চলতেন শিবিকায় (দোলায়)৷ পাল্কী জিনিসটা তখনও আমাদের দেশে আসেনি৷ ওটি  এনেছিলেন ইয়ুরোপীয়রা৷ Palanquin’ শব্দ  থেকে ‘পাল্কী’ শব্দটি এসেছে৷ এই শিবিকা বা দোলার ব্যবহার  নারীদের জন্যে  তো করতে হতই, অবস্থাপন্ন মানুষেরাও বেশী দূর যেতে হলে শিবিকায় বা দোলায় যেতেন৷ ছোটখাট দোলা (দ্বিদোলা) দু’জন লোক কাঁধে বহন  করত৷ আর বড় দোলা বহন করত চারজন  লোকে (চতুর্র্দেলা)৷ দূর পাল্লার পথে গো-শকট, গর্দভ-শকট, ঘোটক শকটের ব্যবস্থা তো ছিলই৷ তবে  সাধারণতঃ মালবাহী শকটের জন্যে  গর্দভ শকট অধিক ব্যবহৃত হত৷  এই ‘শকট’ শব্দ থেকে ওড়িয়ায় ‘শগর’ শব্দটি  এসেছে৷

 যাইহোক, সরকারী ডাক ও কিছুটা বে-সরকারী ডাক বহনের  জন্যেও ঘোটক-শকট অথবা অশ্বারোহী মানুষ কাজ করে দিত৷ দূরগামী মানুষ ও শকটের  জন্যে প্রতি যোজন অন্তর (আন্দাজ ছ’ক্রোশ বা ৰার মাইল) একটি করে চটি (প্রাচীন তামিলে চউলট্রি ও সংস্কৃতে ‘চউট্রি’, বাংলায় ‘চটি’ শব্দ এসেছে) বা সরাই থাকত৷ হিমালয়ের পার্বত্য অঞ্চলে তীর্থযাত্রীদের জন্যে আজও এই ধরনের চটি রয়েছে৷ আমাদের আসানসোলের কাছে রয়েছে নিরসাচটি, বর্ধমানের কাছে নঈসরায়, মুঙ্গেরের কাছে রয়েছে পূরসরায় ও সোফিয়াসরায়, কাশীর কাছে রয়েছে মোগল সরায়৷  তা সেই  সরকারী সরক ধরে যে যোজনান্তর চটি বা সরায় থাকত সেখানে যাত্রীদের জন্যে জ্বালানী কাঠ, জল ও কাঁচা খাদ্যের ব্যবস্থা থাকত৷  লোকেরা নিজে রেঁধে খেতেন৷ যাঁরা রাঁধতে পারতেন না তাঁদের জন্যে রেঁধে দেবার লোকও থাকত৷  এই চটি বা সরায়ের  কাছাকাছি জায়গায় থাকত খরগৃহ, যেখানে  পরিশ্রমে ক্লান্ত পশুরা বিশ্রাম নিত,তাদের  দানা-পানী পেত৷ যাঁরা ডাক বহন করতেন (ডাকহরকরা) তাঁরা ওখানে এসে অনেক সময় বিশ্রাম নিতেন! আবার  অনেক সময়  কর্মচারী-বদলও ওই স্থানে  করে দেওয়া হত৷  কর্মচারী বদলের সঙ্গে সঙ্গে  অনেক সময় বাহক  পশু বা শকটের  পরিবর্তনও করে দেওয়া হত৷ এখন তোমরা উত্তর ভারতের  দিকে  যাবার সময় বিহার ও উত্তর প্রদেশের পথপার্শ্বে কিছু কিছু এই ধরণের  গুমটি হয়তো দেখে  থাকবে৷ তা’ পশুদের জন্যে নির্দিষ্ট সেই গুমটিতে গোরু, গাধা, ঘোড়া, যাই থাকুক না কেন তাদের সাধারণ শব্দ ছিল ‘খরগ্রহ’৷

খরগ্রহের  কথা বলতে গিয়ে একটি গল্পের কথা মনে পড়ল৷ একবার এক স্কুল-ইন্সপেক্টর সাহেব বেশ পণ্ডিত মানুষ তো ছিলেনই, সংস্কৃতে ছিল তাঁর অসামান্য দখল৷ যে বিদ্যালয় পরির্দশনে গেছলেন সেখানকার সংস্কৃতের পণ্ডিত মশায়ও ছিলেন ধুরন্ধর পণ্ডিত৷ মানুষটি বেশ ভাল, তবে একটু স্পষ্টবাদী৷ ইন্সপেক্টর সাহেবের বিদ্যালয়টির কোন কিছুই পছন্দ হল না৷ সংস্কৃতের ক্লাশে  গিয়ে তিনি তো রেগেই টং৷ পণ্ডিতজীর দিকে তাকিয়ে রোষকোষায়িত নয়নে বললেন--- এটি কি বিদ্যালয়, না  ‘খরগ্রহ’ (গাধার ঘর) ?

পণ্ডিত মশায় তাঁর কথাটা গায়ে না মেখে হাসতে হাসতে  ৰললেন--- একটা অনুরোধ রাখবেন স্যর?

ইন্সপেক্টার সাহেব বললেন--- কী অনুরোধ! কিসের অনুরোধ! কেন অনুরোধ!

পণ্ডিতজী ৰললেন--- আপনি  দয়া করে দরজার চউকাঠের  বাইরে দাঁড়ান স্যার, নইলে আমি মনে অত্যন্ত ব্যথা পাব৷

ইন্সপেক্টর সাহেব বললেন--- আমি ঘরে থাকলে ব্যথা পাবেন, আর আমি চউকাঠের বাইরে দাঁড়ালে ব্যথা দূর হবে, এ কেমনতর কথা৷

পণ্ডিতজী বললেন--- ‘‘খরগ্রহ’’ মানে যে ঘরে গাধারা থাকে৷ আমরা তো গাধা আছিই...ছিলুম... থাকবও৷ কিন্তু আপনাকে আমরা একমূহুর্তের জন্যেও  গাধা বলে ভাবতে চাই না৷ তাই  আপনাকে  অনুরোধ করছি আপনি  ঘরের বাইরে থাকুন৷                    

‘খর’ সম্বন্ধে আরো একটি ছোট্ট গল্প মনে পড়ল৷ একবার নাকি পাটনা সচিবালয় থেকে কোন একজন বি.ডি.ও, সাহেবের কাছে একটি পত্রাঘাত গেছল যে তিনি যেন আগামী চবিবশ  ঘণ্টার মধ্যে জানিয়ে দেন তাঁর ব্লকে কতগুলি ‘খর’ অর্র্থৎ গাধা আছে৷

তোমরা সেই পটনা সচিবালয়ের গল্প জান তো? একবার আকল্‌মন্দ সিং বাঁকীপুর রেল ইষ্টিশান থেকে (এখন ইষ্টিশানটির নাম হয়েছে পটনা জংশন) সেক্রেটারিয়েট যাচ্ছিলেন৷ ইষ্টিশনে তিনি রিক্সাওলাকে বলেছিলেন--- ‘‘মুঝে সচিবালয় লে চলো’’৷

রিক্সাওলা তাঁর কথা ৰুঝতে না পেরে ৰলেছিল--- সা’ব,রাষ্ট্রভাষামে ৰোলিয়ে, সচিবালয় মুঝে মালুম নেহী হৈ৷ আকল্‌মন্দ সিং ৰলেছিলেন---  সচিবালয় তুমহে মালুম নহীঁ?  সচিবালয়! সচিবালয়! জিস্‌কো আংরেজীমেঁ সেক্রেটারীয়েট  কহতেঁ হৈ৷

রিক্সাওলা তাকে বলেছিল--- বহী ৰোলিয়ে সেক্রেটারীয়েট, আপ রাষ্ট্রভাষা মেঁ  কিঁউ নহী ৰোলতে হেঁ?  কিঁউ আপ আংরেজীমেঁ ‘সচিবালয়’ ‘সচিবালয়’ ৰোলতা হেঁ? আজকাল আংরেজী কা জমানা নহীঁ হৈ৷

তা’সে যাইহোক, সেই পটনা সচিবালয় থেকে পত্র দণ্ডটি পেয়ে বি.ডি.ও সাহেব তাঁর বি. এল ডব্লিউ Village  level worker)  বা গ্রামসেবককে বললেন---তিনি যেন চবিবশ ঘন্টার মধ্যে তথ্যটি পটনা সচিবালয়ে পাঠিয়ে দেন৷ বি.এল. ডব্লিউ. তো খবরটা শুণে ভয়ে চক্ষুস্থির ৷ চবিবশ ঘন্টার মধ্যে  সে কী করে তাদের বাহাত্তরটি গ্রামে গিয়ে গাধার সংখ্যা নিয়ে আসবে৷ যখন তেইশ ঘন্টা উর্ত্তীণ হয়ে গেল তখন বি.ডি. ও  সাহেবের  কাছে  গিয়ে কেঁদে  কেটে আছড়ে পড়ে বললে--- স্যার, আর চাকরি বাঁচানো গেল না৷  আমি মাত্র দশটি গ্রামে এযাবৎ ঘুরতে পেরেছি৷ এখন যেভাবে হো’ক আমার চাক্‌রিটা বাঁচিয়ে দিন স্যর!

বি.ডি.ও সাহেব বললেন---সে জন্যে ঘাবড়াচ্ছো কেন? তুমি শুধু জানিয়ে দাও, আমি কেবল তিনটি গাধার সন্ধান জানি৷

বি.এল.ডব্লিউ. বি.ডি.ওকে  শুধোলেন--- তিনটি গাধা কে  কে  স্যর !

বি.ডি. ও সাহেব ৰললেন--- এক গদ্‌হা তুম, দুসরা গদহা মঁৈ, অঔর তীস্‌রা গদ্‌হা সচিবালয় কা বহ আফুসার জিন্‌হোনে গদ্‌হাওলা রাপোর্ট মাংগা৷ (শব্দ চয়নিকা-১৩শ খণ্ড)

পাখী জানে

লেখক
প্রণবকান্তি দাশগুপ্ত

 

পাখী জানে ঘুম ভাঙানো গান,

খুশির স্রোতে ভাসিয়ে দিতে প্রাণ!

 

পাখী জানে নিরুদ্দেশের পানে

মেলতে ডানা অজানারই টানে৷

 

পাখী জানে হারিয়ে যেতে বনে,

নীড় বাঁধতে একান্তে নির্জনে৷

 

পাখী জানে মান-ভাঙানো শিষ

দোদুল ডালে দুলতে অহর্নিশ৷

 

পাখী জানে যেথায় খুশি যেতে

বাঁধন-হারা মুক্তির স্বাদ পেতে৷

 

পাখীর জানে সুদূর মেঘের আড়ে

উড়তে উড়তে হয়তো পাবে তাঁরে৷

‘তুমি নিজে এলে’

লেখক
কৌশিক খাটুয়া

তুমি নিজে এলে আমার ঘরে

সেকি আমার তরে শুধু আমার তরে!

নাই আবাহন নাই আমন্ত্রণ

তবুও তোমার শুভ পদার্পণ,

সূর্যোদয়ের রাঙা ঊষায়

মনোবীণায় সুর ভেসে যায়!

 

দিবস রজনী আলোকে আঁধারে

আশা-হতাশায় ‘এ’ জীবন ভরে,

কত কাল যুগ কতনা জীবন

অজান্তে কভুকি করেছি স্মরণ!

তাতো জানা নাই মনে নাই ঠাঁই

তবু ভোরের আঙ্গিনায়

তোমা দেখা পাই৷

 

কেন আমায় করলে স্মরণ,

তুমি জানো এর গোপন কারণ৷

আলো হাতে দিলে পথের দিশা,

কাটিল গহন অমানিশা৷

বুঝিনি তো আগে স্নেহ-অনুরাগে

গড়েছ প্রীতির বন্ধন,

ভাব-জড়তা দূর করে দিলে

পেয়েছি প্রেমের স্পন্দন৷

 

মানব জীবনে শঙ্কা হরণে

যোগাও দুর্জয় সাহস,

হতাশার যবনিকা টেনে 

প্রাণচঞ্চলতা নিরলস৷

অন্তঃবিহীন পথের পুঁজি

 অনন্ত আলোর প্রেরণা৷

তাই স্বাগত জানাই প্রাণ মন ভরে

কাটিল বিড়ম্বনা৷

গদ্দী মেঁ কৌন্ হ্যায়

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

মানুষ আরামের অন্বেষণ করে৷ তাই এই অর্থে ‘ঢুণ্ঢ’ড করে যে ‘ঢ’ শব্দ পাই  তার একটা অর্থ হ’ল আরামের উপকরণ (ভাবারূঢ়ার্থ), যোগারূঢ়ার্থে ‘গদি’৷ গদি বলতে ৰোঝায় যা শয়নকে বা উপবেশনকে আরামদায়ক করে দেয়৷ খাটের তোষকের নীচে যে গদি ব্যবহার করি ৰা চেয়ারের ওপর যে গদি ব্যবহার করি তার জন্যে ‘ঢ’ ব্যবহার করা যেতে পারে৷

উত্তর ভারতে সাধারণতঃ ‘গদ্দা’ ব্যবহূত হয়৷ তবে ‘গদ্দী’ শব্দে ব্যবহার যে নেই এমন নয়৷ তবে উত্তর ও পশ্চিম ভারতে ‘গদ্দী’ বলতে ৰোঝায় দোকানদার যেখানে বসে তার কাগজপত্র দেখে বা হিসেব–নিকেশ করে সেই  স্থানটি অর্থাৎ অফিস৷ ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের অফিসকেও গদ্দী বলা হয়৷ গদ্দীর কথায় শেঠজীর সেই গপ্পটাও মনে পড়ে গেল৷

শেঠজীর বাড়াবাড়ি অসুখ........মৃত্যুশয্যায়৷ বাড়ীতে কান্নার রোল উঠেছে৷ খবর পেয়ে শেঠজীর পাওনাদারেরা উদ্বিগ্ণ৷  শেঠজীর অধমর্ণদের মুখে আনন্দের পাতলা ঝিলিক, যেন জল মেশানো ভেজাল দুধের পাতলা সরটি৷ শেঠজীর পুত্রেরা শশব্যস্ত হয়ে বিক্রয়কর, আয়কর ও আৰগারী বিভাগের খাতাপত্র সামলাতে ব্যস্ত৷

শেঠজী মরণাসন্ন৷ সেদিনকার মত গদ্দী ৰন্ধ করে তাঁর সাত ছেলে করজোড়ে শয্যাপার্শ্বে  এসে দাঁড়াল৷ শেঠজী নাম করে করে তাদের খবর নিতে লাগলেন৷ প্রথমে খোঁজ করলেন প্রথম পু–ের৷ শেঠজী বললেন– রামনজ র  হাজির রামনজ র হাত জোড় করে বললে–জী পিতাজী, হাজির৷ এবার দ্বিতীয় পু–ের খোঁজ করে বললেন–রামপরীক্ষণ হাজির৷ রামপরীক্ষণ বললে–জী পিতাজী, ম্যাঁয় উপস্থিত হুঁ৷ এবার তৃতীয় পু–ের খোঁজ নিয়ে শেঠজী বললেন–রামসুরথ হাজির রামসুরথ বললে–জী পিতাজী, ম্যাঁয় আপকা চরণ–কমলোঁ মেঁ হুঁ৷ এবার চতুর্থ পু–ের খোঁজ নিয়ে শেঠজী বললেন–রামসিংহাসন হাজির রামসিংহাসন বললে–জী পিতাজী, আপকা দাস হাজির৷ এবার পঞ্চম পু–ের খোঁজ নিয়ে বললেন–রামইক্ৰাল হাজির রাম ইক্ৰাল বললে–জী পিতাজী, ম্যাঁ আপকা চরণোঁ মেঁ হুঁ৷ এবার ষষ্ঠ পু–ের খোঁজ নিয়ে বললেন–রামবেশন  হাজির রামবেশন বললে–জী পিতাজী, দাস উপস্থিত হ্যায়৷ এবার সপ্তম পু–ের খোঁজ করে শেঠজী বললেন–রামনুঠা হাজির রামনুঠা বললে–দাস আপকে সেবা মেঁ হাজির হ্যায়৷ এবার শেঠজী ক্রোধে অগ্ণিশর্মা হয়ে বললেন–তুমলোগ  সাতোঁ ভাই  ইহাঁ পর হাজির হো তো গদ্দী মেঁ কৌন হ্যায় শেঠজী রাগে গর্জন করতে থাকায় হূদপিণ্ডের  ক্রিয়া ৰন্ধ হয়ে গিয়ে শেঠজীর মৃত্যু হ’ল৷

হ্যাঁ, তাহলে ৰুঝলে বাংলা ‘গদি’ ও উত্তর ভারতের ‘গদ্দী’ এক জিনিস নয়৷ একটার সঙ্গে অপরটা তোমরা গুলিয়ে ফেলো না৷