ৰেফাঁস কথার ফ্যাসাদ 

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

‘খরগ্রহ’ শব্দের ভাবারূঢ়ার্থ হল যেখানে  অনেক গাধা রয়েছে৷ যোগারূঢ়ার্থে এক-একটি মানে হল গাধার আস্তাবল৷  দ্বিতীয় মানে হচ্ছে প্রাচীনকালে যখন দ্রুতগামী যানবাহনের ব্যবস্থা ছিল না তখন রাজপথ ধরে দূর দূরান্তে মানুষ চলত পদব্রজে৷ অবস্থাবান মানুষেরা ও নারীরা চলতেন শিবিকায় (দোলায়)৷ পাল্কী জিনিসটা তখনও আমাদের দেশে আসেনি৷ ওটি  এনেছিলেন ইয়ুরোপীয়রা৷ Palanquin’ শব্দ  থেকে ‘পাল্কী’ শব্দটি এসেছে৷ এই শিবিকা বা দোলার ব্যবহার  নারীদের জন্যে  তো করতে হতই, অবস্থাপন্ন মানুষেরাও বেশী দূর যেতে হলে শিবিকায় বা দোলায় যেতেন৷ ছোটখাট দোলা (দ্বিদোলা) দু’জন লোক কাঁধে বহন  করত৷ আর বড় দোলা বহন করত চারজন  লোকে (চতুর্র্দেলা)৷ দূর পাল্লার পথে গো-শকট, গর্দভ-শকট, ঘোটক শকটের ব্যবস্থা তো ছিলই৷ তবে  সাধারণতঃ মালবাহী শকটের জন্যে  গর্দভ শকট অধিক ব্যবহৃত হত৷  এই ‘শকট’ শব্দ থেকে ওড়িয়ায় ‘শগর’ শব্দটি  এসেছে৷

 যাইহোক, সরকারী ডাক ও কিছুটা বে-সরকারী ডাক বহনের  জন্যেও ঘোটক-শকট অথবা অশ্বারোহী মানুষ কাজ করে দিত৷ দূরগামী মানুষ ও শকটের  জন্যে প্রতি যোজন অন্তর (আন্দাজ ছ’ক্রোশ বা ৰার মাইল) একটি করে চটি (প্রাচীন তামিলে চউলট্রি ও সংস্কৃতে ‘চউট্রি’, বাংলায় ‘চটি’ শব্দ এসেছে) বা সরাই থাকত৷ হিমালয়ের পার্বত্য অঞ্চলে তীর্থযাত্রীদের জন্যে আজও এই ধরনের চটি রয়েছে৷ আমাদের আসানসোলের কাছে রয়েছে নিরসাচটি, বর্ধমানের কাছে নঈসরায়, মুঙ্গেরের কাছে রয়েছে পূরসরায় ও সোফিয়াসরায়, কাশীর কাছে রয়েছে মোগল সরায়৷  তা সেই  সরকারী সরক ধরে যে যোজনান্তর চটি বা সরায় থাকত সেখানে যাত্রীদের জন্যে জ্বালানী কাঠ, জল ও কাঁচা খাদ্যের ব্যবস্থা থাকত৷  লোকেরা নিজে রেঁধে খেতেন৷ যাঁরা রাঁধতে পারতেন না তাঁদের জন্যে রেঁধে দেবার লোকও থাকত৷  এই চটি বা সরায়ের  কাছাকাছি জায়গায় থাকত খরগৃহ, যেখানে  পরিশ্রমে ক্লান্ত পশুরা বিশ্রাম নিত,তাদের  দানা-পানী পেত৷ যাঁরা ডাক বহন করতেন (ডাকহরকরা) তাঁরা ওখানে এসে অনেক সময় বিশ্রাম নিতেন! আবার  অনেক সময়  কর্মচারী-বদলও ওই স্থানে  করে দেওয়া হত৷  কর্মচারী বদলের সঙ্গে সঙ্গে  অনেক সময় বাহক  পশু বা শকটের  পরিবর্তনও করে দেওয়া হত৷ এখন তোমরা উত্তর ভারতের  দিকে  যাবার সময় বিহার ও উত্তর প্রদেশের পথপার্শ্বে কিছু কিছু এই ধরণের  গুমটি হয়তো দেখে  থাকবে৷ তা’ পশুদের জন্যে নির্দিষ্ট সেই গুমটিতে গোরু, গাধা, ঘোড়া, যাই থাকুক না কেন তাদের সাধারণ শব্দ ছিল ‘খরগ্রহ’৷

খরগ্রহের  কথা বলতে গিয়ে একটি গল্পের কথা মনে পড়ল৷ একবার এক স্কুল-ইন্সপেক্টর সাহেব বেশ পণ্ডিত মানুষ তো ছিলেনই, সংস্কৃতে ছিল তাঁর অসামান্য দখল৷ যে বিদ্যালয় পরির্দশনে গেছলেন সেখানকার সংস্কৃতের পণ্ডিত মশায়ও ছিলেন ধুরন্ধর পণ্ডিত৷ মানুষটি বেশ ভাল, তবে একটু স্পষ্টবাদী৷ ইন্সপেক্টর সাহেবের বিদ্যালয়টির কোন কিছুই পছন্দ হল না৷ সংস্কৃতের ক্লাশে  গিয়ে তিনি তো রেগেই টং৷ পণ্ডিতজীর দিকে তাকিয়ে রোষকোষায়িত নয়নে বললেন--- এটি কি বিদ্যালয়, না  ‘খরগ্রহ’ (গাধার ঘর) ?

পণ্ডিত মশায় তাঁর কথাটা গায়ে না মেখে হাসতে হাসতে  ৰললেন--- একটা অনুরোধ রাখবেন স্যর?

ইন্সপেক্টার সাহেব বললেন--- কী অনুরোধ! কিসের অনুরোধ! কেন অনুরোধ!

পণ্ডিতজী ৰললেন--- আপনি  দয়া করে দরজার চউকাঠের  বাইরে দাঁড়ান স্যার, নইলে আমি মনে অত্যন্ত ব্যথা পাব৷

ইন্সপেক্টর সাহেব বললেন--- আমি ঘরে থাকলে ব্যথা পাবেন, আর আমি চউকাঠের বাইরে দাঁড়ালে ব্যথা দূর হবে, এ কেমনতর কথা৷

পণ্ডিতজী বললেন--- ‘‘খরগ্রহ’’ মানে যে ঘরে গাধারা থাকে৷ আমরা তো গাধা আছিই...ছিলুম... থাকবও৷ কিন্তু আপনাকে আমরা একমূহুর্তের জন্যেও  গাধা বলে ভাবতে চাই না৷ তাই  আপনাকে  অনুরোধ করছি আপনি  ঘরের বাইরে থাকুন৷                    

‘খর’ সম্বন্ধে আরো একটি ছোট্ট গল্প মনে পড়ল৷ একবার নাকি পাটনা সচিবালয় থেকে কোন একজন বি.ডি.ও, সাহেবের কাছে একটি পত্রাঘাত গেছল যে তিনি যেন আগামী চবিবশ  ঘণ্টার মধ্যে জানিয়ে দেন তাঁর ব্লকে কতগুলি ‘খর’ অর্র্থৎ গাধা আছে৷

তোমরা সেই পটনা সচিবালয়ের গল্প জান তো? একবার আকল্‌মন্দ সিং বাঁকীপুর রেল ইষ্টিশান থেকে (এখন ইষ্টিশানটির নাম হয়েছে পটনা জংশন) সেক্রেটারিয়েট যাচ্ছিলেন৷ ইষ্টিশনে তিনি রিক্সাওলাকে বলেছিলেন--- ‘‘মুঝে সচিবালয় লে চলো’’৷

রিক্সাওলা তাঁর কথা ৰুঝতে না পেরে ৰলেছিল--- সা’ব,রাষ্ট্রভাষামে ৰোলিয়ে, সচিবালয় মুঝে মালুম নেহী হৈ৷ আকল্‌মন্দ সিং ৰলেছিলেন---  সচিবালয় তুমহে মালুম নহীঁ?  সচিবালয়! সচিবালয়! জিস্‌কো আংরেজীমেঁ সেক্রেটারীয়েট  কহতেঁ হৈ৷

রিক্সাওলা তাকে বলেছিল--- বহী ৰোলিয়ে সেক্রেটারীয়েট, আপ রাষ্ট্রভাষা মেঁ  কিঁউ নহী ৰোলতে হেঁ?  কিঁউ আপ আংরেজীমেঁ ‘সচিবালয়’ ‘সচিবালয়’ ৰোলতা হেঁ? আজকাল আংরেজী কা জমানা নহীঁ হৈ৷

তা’সে যাইহোক, সেই পটনা সচিবালয় থেকে পত্র দণ্ডটি পেয়ে বি.ডি.ও সাহেব তাঁর বি. এল ডব্লিউ Village  level worker)  বা গ্রামসেবককে বললেন---তিনি যেন চবিবশ ঘন্টার মধ্যে তথ্যটি পটনা সচিবালয়ে পাঠিয়ে দেন৷ বি.এল. ডব্লিউ. তো খবরটা শুণে ভয়ে চক্ষুস্থির ৷ চবিবশ ঘন্টার মধ্যে  সে কী করে তাদের বাহাত্তরটি গ্রামে গিয়ে গাধার সংখ্যা নিয়ে আসবে৷ যখন তেইশ ঘন্টা উর্ত্তীণ হয়ে গেল তখন বি.ডি. ও  সাহেবের  কাছে  গিয়ে কেঁদে  কেটে আছড়ে পড়ে বললে--- স্যার, আর চাকরি বাঁচানো গেল না৷  আমি মাত্র দশটি গ্রামে এযাবৎ ঘুরতে পেরেছি৷ এখন যেভাবে হো’ক আমার চাক্‌রিটা বাঁচিয়ে দিন স্যর!

বি.ডি.ও সাহেব বললেন---সে জন্যে ঘাবড়াচ্ছো কেন? তুমি শুধু জানিয়ে দাও, আমি কেবল তিনটি গাধার সন্ধান জানি৷

বি.এল.ডব্লিউ. বি.ডি.ওকে  শুধোলেন--- তিনটি গাধা কে  কে  স্যর !

বি.ডি. ও সাহেব ৰললেন--- এক গদ্‌হা তুম, দুসরা গদহা মঁৈ, অঔর তীস্‌রা গদ্‌হা সচিবালয় কা বহ আফুসার জিন্‌হোনে গদ্‌হাওলা রাপোর্ট মাংগা৷ (শব্দ চয়নিকা-১৩শ খণ্ড)