প্রভাতী

শোল–ঘাপটি

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

গাত্রূসম্কুচূঘঞূণিনি‘গাত্রসংকোচিন্’৷ ভাবারূঢ়ার্থে গাত্রসংকোচিন্ মানে যে শরীরকে সংকুচিত করে, যোগারূঢ়ার্থে যে পরিবেশগত ও মানসিক কারণে শরীরকে ছোট করে দেয়, ঘাপ্পি বা ঘাপটি মেরে বসে পড়ে৷ এই ঘাপ্পি বা ঘাপটি মারা আবার তিন ধরনের হয়৷

১) শোয়া–ঘাপটি ঃ যেমন হাত–পা কুঁঁকড়ে হাঁটু দু’টো ৰুকের কাছাকাছি এনে চিৎ হয়ে ৰা পাশ ফিরে শুয়ে থাকা৷ এতে শীত একটু কম লাগে৷ শীতের দিনে বিড়াল, কুকুর ও অন্যান্য অনেক জীৰকে এই ভাবে শোয়া অবস্থায় দেখতে পাৰে৷

 তোমরা কখনো কখনো ঠান্ডায় অনেকক্ষণ থাকার পর শীতের রাতে যখন নেপের তলায় চলে যাও যদিও সে সময়টায় আমি তোমাদের নেপ সরিয়ে দেখিনি তবু অনুমান করি খানিকটা সময় শরীরকে কিছুটা তাতিয়ে না নেওয়া পর্যন্ত তোমরা ৰোধ হয় ঘাপটি মেরে শুয়ে থাক অর্থাৎ কুঁকড়ি হয়ে শুয়ে থাকো৷

২) বসা–ঘাপটি ঃ দ্বিতীয় ঘাপটি হল বসা–ঘাপটি বা তিন–মুণ্ডে ৰসা৷ দু’টো হাঁটু হল দু’মুণ্ড ও তোমার নাকের ডগা হল তিন মুণ্ড৷ দু’হাতে করে অনেক সময় পা দু’টোও জড়িয়ে ধরো৷ তোমরা অনেক ক্ষেত্রে দুঃখের সময়ে, শোকের সময়ে এইভাবে ৰসে থাকো৷ আবার অনেক সময় হাঁটাহাঁটি ভাল লাগছে না ৰলেও ওই ভাবে বসে থাকো৷ হুগলী জেলার কলাচাষীদের আমি সাধারণতঃ ওইভাবে উৰু হয়ে বসে কলার কাঁদির ছড়া গুণতে দেখেছি৷ তোমরা দেখোনি

৩) দাঁড়িয়েও ঘাপটি মেরে থাকা যায়৷ এক হাতের কনুইয়ের ওপর বা কনুইয়ের ফাঁকে আরেক হাতের কনুই ঢুকিয়ে দিয়ে শীতের রাতের কষ্ট দূর করার চেষ্টা তোমরা করো না কি! নিশ্চয় করো৷ এতে শীতের কষ্ট কিছুটা কমানো যায়৷

একটা মজার কথা ভেবে দেখ৷ পরচর্চা করবার সময় (কারো কারো মতে যা ডালমুট–চানাচুরের চেয়েও মুখরোচক) কেউ কিন্তু ঘাপটি মেরে ৰসে না, ভাল করে আসন পেতেই বসে৷ মেয়েরা যাঁতীতে সুপুরি কোচাবার সময় পা ছড়িয়ে দিয়ে বসেন.... ঘাপটি মেরে বসেন না, কতকটা যেমন বসেন পা দিয়ে সলতে তৈরী করার সময়৷ যাই হোক্, এই ঘাপটি মারা হল এক ধরনের গাত্র সংকোচন৷

অনেকদিন আগে তোমাদের একবার শোল–ঘাপটির গপ্প ৰলেছিলুম না! একজন ছিলেন জাঁদরেল হাকিম সাহেৰ তাঁদের ছিল পারিবারিক একটি হেয়ার–কাটিং সেলুন৷ আরেকজন ছিলেন জাঁদরেল মৎস্যজীবী তাঁর ছিল সাতখানা মাছ ধরার ডিঙ্গি৷ কেউ কারো চেয়ে কম নয়–ইজ্জতে, আভিজাত্যে, অর্থকৌলীন্যে৷

গোপেন্দ্রনাথ হাকিমের এজলাসে একটা খুনের মামলায় সাক্ষ্য দিতে এসেছেন সেই মৎস্যজীবী বৃন্দাবনচন্দ্র৷ গোপেন্দ্রনাথ হাকিম বৃন্দাবনচন্দ্রকে শুধোলেন–আচ্ছা, যখন লোকটাকে খুন করা হচ্ছিল লোকটা কোনো আবাজ করেনি

বৃন্দাবনচন্দ্র ৰললে–হ্যাঁ, লোকটা তখন কই–কাতরান কাতরাচ্ছিল৷

হাকিম শুধোলেন––ওই বীভৎস কাণ্ড দেখবার সময় তুই কী করছিলি

বৃন্দাবনচন্দ্র ৰললে–আমি তখন ভয়ে শোল–ঘাপটি মেরে ৰসেছিলুম৷

গোপেন্দ্রনাথ হাকিম বৃন্দাৰনচন্দ্রকে শুধোলেন–সময়টা তখন দিন না রাত্তির, আলো না অন্ধকার

বৃন্দাবনচন্দ্র ৰললে–দিনও নয়, রাতও নয়, আলোও নয়, অন্ধকারো নয়, কেমন একটা আলো–আঁধারি৷ এই পুকুর পাড় ঘেঁসে মাছেরা যে সময় গাঁদি মারে তেমন সময়৷

গোপেন্দ্রনাথ হাকিম শুধোলেন–তুই তারপর কী করলি

বৃন্দাবনচন্দ্র ৰললে–আমি জাল–কাটা বোয়ালের মত ঝপাঙ করে জলে লাফ দিয়ে পড়লুম, তারপর চ্যাঙ মাছের মত চোঁ চোঁ করে পুকুরের ওপারে পঁৌছে গেলুম...কাতলা মাছের মত কেৎরে গিয়ে একটা আঁৰ গাছের আড়ালে গিয়ে নুকোলুম৷

গোপেন্দ্রনাথ ৰললেন–তোর ভীমরতি হয়েছে, সবেতেই মাছের কথা, সবেতেই মাছ নিয়ে আদিখ্যেতা৷ যেন মাছ ছাড়া দুনিয়ায় আর কোনো কুলীন ৰামুণ নেই৷

কথাটা বৃন্দাবনচন্দ্রের গায়ে লাগল....লাগল না ৰলে ৰলতে হয় ৰিঁধল৷

গোপেন্দ্রনাথ বৃন্দাবনচন্দ্রকে শুধোলেন–আচ্ছা, ৰল তো এই যে খুনের ঘটনাটা ঘটল .... রক্তপাত হল এতে আন্দাজ কতখানি রক্ত বেরিয়েছিল ৰলতে পারিস

বৃন্দাবনচন্দ্রের মুখেচোখে, ঠোঁটের কোণে অল্প হাসির ঝিলিক নেৰে এল৷ সে ৰললে– তা ঠিক কী করে ৰলি ৰলুন হুজুর, তৰে আপনি যাতে আন্দাজ পেতে পারেন সেই ভাবে ৰলছি...অ এই নাপতে বাটির এক বাটি হৰে৷

যাই হোক্, এই ঘাপ্পি মারা বা ঘাপটি মারা কাকে ৰলে জেনে গেলে৷

হ্যাঁ, তবে মটকা মারা কিন্তু আলাদা জিনিস আর এই মটকা মারার সঙ্গে গরদ–মটকা–তসরে কোনো সম্পর্ক নেই৷ ৰাঙলা ভাষায় ‘মটকা’ শব্দটি তিনটি অর্থে ব্যবহূত হয়৷ প্রথমতঃ যে পলু পোকার গুটি খেয়ে প্রজাপতি গুটি কেটে বেরিয়ে যায় সেই গুটির গরদ মোটা ও নিকৃষ্ট মানের হয়৷ সেই মোটা ও নিকৃষ্ট মানের গরদকে মটকা ৰলা হয়৷

পাকা ঘর বাদে খড়, টিন, টালি প্রভৃতি দিয়ে ঘর তৈরী করলে ঘরের যেটা সর্বোচ্চ অংশ তাকেও মটকা ৰলে–‘‘চেয়ে দেখ মটকার ওপর একটা মুরগী ৰসে রয়েছে’’৷

‘মটকা’র তৃতীয় অর্থ হল ভাণ বা অছিলা৷ ‘‘চেয়ে দেখ, মনে হচ্ছে ও ঘুমুচ্ছে, আসলে কিন্তু ঘুমুয়নি, মটকা মেরে পড়ে আছে৷ যে ঘুমায় তাকে ডেকে বা ধাক্কা দিয়ে তোলা যায় কিন্তু যে মটকা মেরে পড়ে থাকে তার ঘুম ভাঙ্গানো যায় না’’৷

হ্যাঁ, যদি কেউ কোনো জায়গায় ঢুকে নিজের পরিচয় গোপন রেখে বা নিজ উদ্দেশ্য চেপে রেখে চুপ করে একটা জায়গায় গিয়ে ৰসে থাকে তাকেও বলে ঘাপটি মারা–ভাল ৰাংলায় ‘গাত্রসংকোচী’, কথ্য ৰাঙলায় ‘ভিজে ৰেড়ালটি’৷

আয় চৈতালী ঝড়

লেখক
প্রণবকান্তি দাশগুপ্ত

আয় বসন্ত, আয় দুরন্ত, আয় চৈতালী ঝড়

আয়রে ভীষণ, আয়রে ভয়াল, আয়রে ভয়ংকর!

আনরে কাঁপন জীর্ণ শাখায়,

আনরে মরণ শুষ্ক পাতায়,

আনরে মাতন সবুজ পাতায়--- হানরে অসুন্দর!

আয় বসন্ত, আয় দুরন্ত, আয় চৈতালী ঝড়!

আয় ভাঙনের জয়গান গেয়ে, আয় মহা তাণ্ডবে,

এক ঘেয়েমির সুর-তাল কেটে আয় হত গৌরবে৷

আয় ধবংসের ডঙ্কা বাজিয়ে,

আয় সৃষ্টির অর্ঘ্য সাজিয়ে,

নবীন আশার পুলক জাগিয়ে আয় নতুনের চর!

আয় বসন্ত, আয় দুরন্ত, আয় চৈতালী ঝড়!!

ভুমাদর্শ

লেখক
আচার্য গুরুদত্তানন্দ অবধূত

একই পিতার পুত্র কন্যা

মানব মোদের এই পরিচয়

অন্য কিছু নাই৷

একই আকাশ একই বাতাস

যোগায় সবে বল

অভিন্ন এক হৃদিধারায়

আমরা উচ্ছ্বল৷

একই রণন---মাতিয়ে প্রাণে

টানছে একই পানে

সঞ্জীবীত আমরা সবাই

একের অভিধ্যানে৷

জীবন মরণ তুচ্ছ করি

গড়ি মোরা সমাজ

অসীম অপার ভালবাসায়

চাহি একের রাজ৷

বসন্ত-প্রকৃতি

লেখক
কৌশিক খাটুয়া

কাঁপন ধরা মাঘের শেষে

 বসন্তের আগমন,

চেয়ে নীহারিকা আকাশের রাকা

 মুখরিত উপবন৷

কৃষ্ণচূড়া রাধাচূড়া

 মেতেছে আজ রঙের খেলায়,

অজ্ঞাত কার কোমল ছোঁয়ায়

 সুপ্তি ভাঙ্গল দূর অবেলায়!

সম্ভাবনাময় কুঁড়ি গুলি চায়

 পূর্ণ প্রস্ফুটন,

বসন্তের একান্ত অভিপ্রায়

 হোক রূপায়ণ৷

 

করবী-কামিনী নয় অভিমানী

 বসন্তে তারা হাসে,

আজ মধুমাসে চৈতি হাওয়ায়

 ফুলের সুরভী ভাসে৷

অশোকে-পলাশে কি উচ্ছ্বাসে

 রঞ্জিত করে বন,

কাঞ্চন বনে কোকিলের গানে

 আবিষ্ট তনু মন৷

নব কিশলয় সবুজ ভূষণে

 উজ্জীবিত উদ্যান,

পাতা ঝরে যাওয়া শীতের তরু

 ভুলে গেছে অভিমান!

অলি-প্রজাপতি বাসন্তী অতিথি

 বকুলের আবাহনে,

সৌরভ তার মৃদু সমীরণে

 বয়ে আনে বাতায়নে৷

 

মাধবীলতার গোপন কথা

 শুনিতে আসে ভ্রমর,

শিমুল-পারুল স্বাগত জানাতে

 খুলিয়া রেখেছে দোর৷

রঙের খেলায় ফুলের মেলায়

 পূর্ণিমা চাঁদ হাসে,

মধুপ-গুঞ্জরণ পুলকিত মন

 মহুয়া ফুলের বাসে৷

আম্রমুকুলে ঢেকেছে রসাল

 জগৎ জোড়া সুনাম,

বৈভবে ভরা ঋতুরঙ্গে ধরা

 স্রষ্টাকে জানাই প্রনাম৷

বেগুণ গাছও বিরিক্ষি

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

‘‘যত্র বিদ্বজনো নাস্তি শ্লাঘ্যস্তত্রাল্পধীরপ্৷

নিরস্তে পাদপে দেশে এরণ্ডহপি দ্রুমায়তে৷৷’’

যেখানে সত্যিকারের বিদ্বান নেই সেখানে অল্পজ্ঞ ব্যষ্টিও শ্লাঘ্য অর্থাৎ বরণীয় রূপে গণ্য হন৷ যেমন যে দেশে বৃক্ষ নেই সে দেশে এরণ্ড (রেড়ির গাছ) বৃক্ষরূপে সম্বোধিত হয়ে থাকে৷ ওপরের কথাটির কী জুৎসই বাংলা হবে একদিন আমি তা ভাবছিলুম৷ ভাবতে ভাবতে চলেছি হুগলী জেলার বেলুন গ্রামের পাশ দিয়ে৷ সবে সন্ধ্যে হয়েছে৷ হঠাৎ দেখি দীর্ঘকায় দুই নারী নাকি সুরে চিৎকার করছে---একজনের হাতে আঁশবটি৷ অন্যের হাতে মুড়ো ঝাঁটা৷ তাদের নাকি সুরে বুঝলুম তারা মানবী নয়---পেত্নী৷ কথা শুণে মনে হ’ল তারা দুই জা৷

ছোট জা বলছে আমার সোঁয়ামীর মাস যেঁতে আয় তিন হাজার টাকা৷ আর ভাঁসুর ঠাঁকুরের মাত্তর দু হাজার টাকা৷ অথচ একবেঁলা আঁমাকে রান্না ঘরে বসে কাঁঠের উনুনে তাঁত সঁইতে হয়৷ তাঁ আঁমি কেঁন কঁরব? আঁমি আঁর হেঁসেল ঠেলতে পাঁরব না৷ ওঁই সঁময়টা হঁয় সিনেমা দেঁখতে যাঁব না হঁয় কোন শ্যাঁওড়া গাঁছে চঁড়ে খানিকটা হাঁওয়া খেয়ে আসব৷ তোঁর সোঁয়ামির আঁয় কঁম৷ তুই দু’বেলা হাঁড়ি ঠেঁলবি৷

বড় জা বলছে---‘কঁথায় বঁলে, যেঁখানে বড় গাঁছ নেই সেখানে বেঁগুণ গাঁছ ও বিরিক্ষি৷ (কথাটা আমি সঙ্গে সঙ্গে নোট বুকে টুকে নিলুম৷ বুঝলুম---এইটাই ‘এরণ্ডহপি দ্রুমায়তে’ কথাটার জুৎসই বাংলা)৷ তুঁই হাঁ-ঘরে হাঁ-ভাতে ছোঁট ঘঁরের মেঁয়ে---বাঁপের জঁন্মে এঁকসঙ্গে তিঁন হাঁজার টাঁকা দেঁখিসনি৷ এঁখানে এঁসে তাঁই দেঁখে ধঁরাকে সঁরা জ্ঞাঁন কঁরছিস৷ আঁজ থেঁকে আঁর পেঁত্নী বঁলে পঁরিচয় দিঁয়ে লোঁক হাঁসাসনি৷ তঁবুও যঁদি তিঁন হাঁজার টাঁকা সঁত্যিকারের আঁয় হোঁত! মাঁইনে তোঁ পাঁয় এঁক হাঁজার টাঁকা আঁর বাঁকীটা পাঁয় চোঁরাবাজারে হাঁসপাতালেঁর চাঁদর, তোঁয়ালে, ওঁষুধ, ফিঁনাইল বাঁইরে পাঁচার করে’৷ আঁজ তোঁর তিঁন হাঁজার টাঁকার শ্রাঁদ্ধ কঁরছি৷ এঁইসব চুঁরি আঁর পঁাঁচারের কঁথা টিঁকটিঁকি বাঁবুদের (ডিটেক্‌টিব্‌ মানে ইনটেলিজেন্স৷ ডিটেকটিব শব্দ থেকেই টিকটিকি শব্দ এসেছে) বঁলে দোঁবে৷ তাঁরা গঁলায় গাঁমছা বেঁধে তোঁর মুঁখপোড়া সোঁয়ামীকে জেঁলে ঠেঁলে দেঁবে’৷

পেত্নীর ছোট জা তখন বললে---‘তোঁর যাঁ ইঁচ্ছে কঁরগেঁ যাঁ৷ আঁমি আঁশ বঁটি দিঁয়ে টিকটিকির ন্যাঁজ কেঁটে দোঁব৷ আঁমার সোঁনার চাঁদ বাঁছাটা এঁকদিনও মাঁছের মুঁড়ো চোঁখে দেঁখতে পাঁয় নাঁ, আঁর তোঁর ভুঁতুম পেঁচা উনুন মুঁখোটা রোঁজ রোঁজ রুঁই মাঁছের মুঁড়ো চিঁবোচ্ছে৷ এঁ আঁর আঁমার সঁহ্য হঁয় নাঁ৷ নাঁরায়ণ! আঁজই এঁর এঁকটা হেঁস্তনেস্ত কঁরে দাঁও৷’

পেত্নী দু’জন এতক্ষণ দেখতে পায়নি৷ আমি আরও কাছে আসায় আমার জুতোর শব্দে তাদের হুঁশ হলো৷ তারা আমার দিকে তাকিয়ে দেখে তাদের দশ হাত লম্বা জিভ দাঁতে করে কেটে তাদের লজ্জানুভুতি জানাল৷ আমি বললুম---‘অত বেশী দাঁতে চাপ দিসনি৷ জিভ কেটে খসে যাবে৷ তখন ঝগড়া করা জন্মের মত বন্ধ হয়ে যাবে---বোবা হয়ে যাবি’৷ তখন তারা জিভ ভেতরে ঢুকিয়ে নিয়ে মাথায় প্রকাণ্ড ঘোমটা টেনে দিল৷ ঘোমটা এত লম্বা করে টানলে যে ঘোমটার জেরে পিঠ হয়ে গেল একেবারে ফাঁকা গড়ের মাঠ৷

আমি আবার বললুম---তোদের এত লজ্জার কি আছে রে! এত লম্বা ঘোমটা টানলে যে দেখতে পাবি না৷’

তারা তখন ঘোমটা সরিয়ে ফেললে আর বললে---‘পেত্নী হঁলেও আঁমরা তোঁ মাঁনুষ---আঁমরাও তোঁ তোঁমার মেঁয়ে৷ তাঁই ঘোঁমটা আঁর দিঁলুম নাঁ’৷

আমি বললুম---‘পিঠটা বরং ভালো করে ঢাক৷ শীত কম লাগবে৷

আমি বললুম---‘এই ভর সন্ধ্যেয় তোরা ঝগড়াঝাঁটি করছিস, তোদের বাড়ীর পুরুষ মানুষেরা গেল কোথায়’?

ওরা বললে---‘আঁমরা যঁখন ঝঁগড়াঝাঁটি কঁরি তঁখন ওঁরা এঁকটু তঁফাতে থাঁকে, ধাঁরে কাঁছে আঁসে না৷ লঁড়াই থেঁমে যাঁওয়ার পঁর তাঁরা লাঁঠিসোঁটা নিঁয়ে ইঁউনিফরম্‌ পঁড়ে আঁমাদের কাঁছে এঁসে হঁম্বিতঁম্বি কঁরে বঁলে---আঁগে খঁবর কাঁহে নেঁহি দিঁয়া হ্যাঁয়? ক্যাঁ হুঁয়া? সেঁই জঁন্যেই তুঁমি বাঁড়ির পুঁরুষদের কাঁউকেই দেঁখতেও পঁচ্ছো না’৷ আমি বললুম---‘অনেকক্ষর ধরে চিৎকার করে তোদের গলা শুকিয়ে গেছে৷ খানিকক্ষণ গাছে চড়ে একটু জিরিয়ে নে৷’

ওরা দুজনেই সামনে তালগাছটাতে তরতরিয়ে উঠতে গেল৷ আমি বললুম---‘‘দুজনেই একটা তালগাছে উঠিসনি৷ তাহলে গাছে উঠে ধস্তাধস্তি করে ধাক্কাধাক্কি করে দুজনেই নীচে পড়ে হাড়গোড় ভেঙ্গে প্রাণ হারাবি৷ মানুষ ছিলি---একবার ম’রে পেত্নী হয়েছিস আর একবার যদি মরিস তোদের কী গতি হবে আমি ভেবে কুল-কিনারা পাচ্ছি না৷

তাই শান্তিতে যদি জিরিয়ে নিতে চাস তবে তোরা দুজনেই দুটো আলাদা আলাদা গাছে উঠে বস’৷ ওরা তখন দুটো আলাদা গাছে উঠে বসল৷ আমার জরুরী কাজ ছিল৷ ট্রেন ধরবার জন্যে তাড়াতাড়ি পাণ্ডুয়া স্টেশনের দিকে চলে চলেছি৷ পথ চলতে চলতে অনেক দূর থেকে কাণে ভেসে আসছিল তালগাছের ওপর থেকে পেত্নী গাওয়া রাশব রাগীনিতে ‘ফিল্মী গানেঁ’

যাইহোক, শিখলুম নোতুন কথা ঃ যেখানে বড় গাছ নেই সেখানে বেগুণ গাছও বিরিক্ষি৷

রবীন্দ্রনাথের এপ্রিল ফুল

লেখক
প্রণবকান্তি দাশগুপ্ত

 অক্ষয় চৌধুরি ছিলেন একাধারে এম এ, বি এল, আ্যাটর্নি এবং কবি৷ তখনকার দিনে সে এক বিরাট ব্যাপার৷ তাঁর বিখ্যাত কাব্য--- ‘উদাসিনী’৷

কবি অক্ষয় চৌধুরির বাড়িতে বোম্বে থেকে বেড়াতে এলেন এক পারসী যুবক৷ সঙ্গে এলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর ৷ পারসী যুবকের মাথায় বিরাট পাগড়ী, গালে পেল্লাই দাড়ি৷ তবে যুবক অত্যন্ত কাব্যরসিক ৷

অক্ষয় চৌধুরি মনের মত লোক পেয়ে তাঁর সঙ্গে জুড়ে দিলেন কাব্যালোচনা৷ চুরুটে টান দিতে দিতে ডুবে গেলেন বায়রন শেলির মধ্যে৷ পারসী যুবক কোন কিছুতেই কমতি নন৷

এমন সময়, অতর্কিতে ঘরে এসে ঢুকলেন পালিত মশাই তারক পালিত৷ কাব্য-চর্চা গেল থেমে৷ পালিত মশাই ঘর ঢুকে পারসী যুবককে দেখেই অবাক৷ কিছুক্ষণ আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করার পর হঠাৎ সোল্লাসে তিনি চেঁচিয়ে উঠলেন--- ‘আরে, এযে আমাদের রবি’!

অক্ষয় চৌধুরি তো হতভম্ব! তারপর পালিত মশাই মাথায় একটা থাপ্পড় মারতেই পারসী যুবকের পাগড়ী গেলো খুলে৷ আলগা হয়ে গেলো গোঁফ-দাড়ি৷ তখন অক্ষয় চৌধুরি সবিস্ময়ে দেখলেন, পারসী যুবকের ছদ্মবেশ ভেদ করে যিনি আত্মপ্রকাশ করলেন তিনি আর কেউ নন--- স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর! তখন পালিত মশাই অক্ষয় চৌধুরির কানে কানে বললেন, ‘আজ পয়লা এপ্রিল’!

 

যুগের দাবী

লেখক
কেয়া সরকার

ব্যর্থ হবে না যুগের দাবী

এ দাবী চিরকালের---

গড়ব সমাজ নতুন আদর্শে

এ আশা প্রতি পলের---

ভাব জড়তার প্রাচীর ডিঙিয়ে

শত ভেদাভেদের গণ্ডি এড়িয়ে,

বিশ্ব সমাজ করব রচনা

এ আশা প্রতি জনের৷

 

সব বিদ্বেষ, গ্লানি দূর হয়ে,

ভালোবাসা কে পথ করে দেবে---

শুভ বুদ্ধিতে জাগ্রত জনে,

 

আদর্শকে হৃদে ধরে রবে---

ঐক্যের সুধা পান করে যবে,

মানুষ আবার এক হয়ে যাবে ---

প্রাউট স্থাপনে পৃথিবীতে আর,

মানুষের কোনো দ্বিধা নাহি রবে৷

 

নব্যমানবতার কোমল স্পর্শে,

মানুষের যবে চোখ খুলে যাবে---

হৃদয় নিংড়ানো প্রীতি-ভালোবাসায়

মানুষে মানুষে ভেদ ঘুচে যাবে---

বিশ্ব সংসারে মানুষ আবার

মানুষ বলে পরিচিতি পাবে,

সেই দিন এক নোতুন পৃথিবী

মানুষের তরে গড়ে নেওয়া হবে৷

বসন্তোৎসব

লেখক
আচার্য প্রবুদ্ধানন্দ অবধূত

আকাশে আজ রঙের মেলা

কে যেন সব রাঙিযে দিল,

বিশ্ব ভূবন মন মাতান হাসি

কৃষ্ণ মনে দোলা দিলো৷

দোদুল্যমান সৃষ্টির উল্লাসে

কেউ বা কাঁদে কেউ বা হাসে,

মনের কোণে কৃষ্ণ হাসে

সব লীলা খেলা তাঁরই সাজে৷

রাখো তাঁরে হৃদয় ভরে

সিংহাসন তো তাঁরই গড়া,

সকল হৃদয়ে তিনি আছেন

সমর্পিয়া হও আত্মহারা৷

ব্রাউনশোয়ায়েগ, জার্মানী৷

ধরা আর সরা

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

দেশজ শব্দে ‘ট’ যথাযথভাবেই বজায় থাকে৷ আর ‘ড’ বা ‘ড়’ মৌলিক শব্দ হিসেবেই থেকে যায়৷ যেমন, আজ ভুলোর সঙ্গে ভোঁদার আড়ি হয়ে গেল৷ ওরা বলছে, ওরা আর একসঙ্গে মার্ৰেল খেলবে না, একটা পেয়ারাও আর কামড়াকামড়ি করে খাবে না৷ গোপনে কান পেতে শোনাকেও আড়িপাতা বলে৷ এটিও বাংলা দেশজ শব্দ৷ সেই যে একজন মহিলা আহ্লাদে আটখানা হয়ে তার এক ৰন্ধুকে বলেছিল–তোমার সঙ্গে দেখা হওয়ায় আমার যে কী আনন্দ হচ্ছে তা ভাষায় বলতে পারছি না৷ ৰন্ধু বলেছিল, তোমার যে কী আনন্দ হচ্ছে তার একটু আভাস আমায় দাও৷ মহিলাটি বলেছিল, আহ্লাদের আতিশয্যে আমার এখন ধরাকে সরা মনে হচ্ছে৷ সেই সময়  হয়েছে কী, একজন চাষীর গোরু হারিয়ে গেছে৷ সে গোরু খুঁজে খুঁজে ক্লান্ত হয়ে যে বাড়ির বারান্দায় বসেছে সেই বাড়িরই ঘরের ভেতর ওই মহিলাটি বলছে– আমি আনন্দের আতিশয্যে ধরাকে সরা মনে করছি৷ চাষী আড়ি পেতে কথাটা শুনে নিলে৷ এবার সেও আনন্দের আতিশয্যে ধেই ধেই করে নাচতে নাচতে ঘরের বাইরে থেকে ওই মহিলাটিকে গড় করে বললে–মা লক্ষ্মী, এই বিরাট ধরাটা যখন তোমার কাছে সরা হয়ে গেছে তখন দয়া করে বলে দাও, ওই সরার কোন্খানটিতে আমার গোরুটা রয়েছে৷ বইয়ের নামেই বিপত্তি ঔষধ রোগকে হত্যা করে৷ তাই হত্যাকারী অর্থে ‘থুর্ব’ ধাতু ড করে যে ‘থ’ শব্দ পাই তার একটি যোগরূঢ়ার্থ হচ্ছে ঔষধ৷ এই ঔষধ যে কেবল শারীরিক রোগের ঔষধ তাই নয়, মানসিক রোগের ঔষধও৷ মানসিক রোগের যতরকম ঔষধ আছে তার একটা নাম হচ্ছে মানুষের মনে রসচেতনা জাগিয়ে তার মনকে হালকা করে দিয়ে ব্যথাভার সরিয়ে দেওয়া–চিন্তাক্লিষ্টতা অপনয়ন করা৷ এজন্যে প্রাচীনকালে এক ধরনের মানুষ থাকতেন যাঁরা মানুষের মনকে নানান ভাবে হাসিতে খুশীতে ভরিয়ে রাখতেন৷ মন ভাবে–ভাবনায় আনন্দোচ্ছল হয়ে উপচে পড়ত৷ এই ধরনের মানুষেরা শিক্ষিত বা পণ্ডিত থেকে থাকুন বা না থাকুন এঁরা মানব মনস্তত্ত্বে অবশ্যই পণ্ডিত হতেন৷ এঁদেরই বলা হত বিদুষক৷ বিদুষকের ভাববাচক বিশেষ্য ত্ব্ব্দব্ধব্জ্ত্রন্তুব্ধ প্সব্ভুগ্গ ‘বৈদুষ্য’ শব্দটির সঙ্গে নিশ্চয়ই তোমরা ভালভাবেই পরিচিত৷ ‘‘বাক্ বৈখরী শব্দঝরী শাস্ত্র ব্যাখ্যান কৌশলম্৷ বৈদুষ্যং বিদুষাং তদ্বৎ ভুক্তয়ে ন তু মুক্তয়ে’’৷ বিদুষকের বিদ্যেৰুদ্ধি থাক্ বা না থাক্ তাঁদের মনস্তত্ত্বের জ্ঞান থাকা দরকার, উপস্থিত ৰুদ্ধি ত্মন্দ্ব্ত্রস্তুম্ভ ভ্রন্ব্ধগ্গ থাকা তো চাই–ই৷ তোমরা অনেকেই নিশ্চয় মুর্শিদাবাদের শরৎচন্দ্র পণ্ডিত মহাশয়ের নাম শুনেছ৷ তাঁর মত উচ্চমানের বিদুষক খুব কমই জন্মেছেন৷ সাধারণের মধ্যে ‘দাদাঠাকুর’ নামে পরিচিত এই মানুষটি ‘বিদুষক’ নামে একটি পত্রিকাও ছাপাতেন৷ সেবার ৰহরমপুরে বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলন হচ্ছে৷ উপস্থিতদের মধ্যে শরৎচন্দ্রপণ্ডিত মহাশয় তো আছেনই, আর ছিলেন সুপ্রসিদ্ধ কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়৷ তিনি তখন প্রতিষ্ঠার তুঙ্গে৷ তাঁর লেখা ‘চরিত্রহীন’ পুস্তকটির তখন ‘খোলা থেকে নোলা’ গরমাগরম আলুর চপের মতই ৰাজারে ৰেজায়** কাটতি৷ শরৎ চাটুজ্জে নামকরা কথাশিল্পী ছিলেন ঠিকই, কিন্তু ভাষণ ভাল দিতে পারতেন না.....মজলিসী গল্পগুজবে ছিলেন ওস্তাদ৷ সবাই তাঁকে ধরে বসল–‘‘আপনাকে এখানে কিছু বলতেই হবে৷’’ শরৎ চাটুজ্জে দু’এক মিনিট দায়সারা গোছের কিছু বলে বসে পড়লেন৷ আর বসার আগে বললেন–‘‘আমি আর এখানে ৰেশী কিছু বলব না–বলবেন বিদুষক শরৎচন্দ্র৷’’ শরৎচন্দ্র পণ্ডিত (দাদাঠাকুর) উঠে খানিকক্ষণ বললেন আর বসার আগে বললেন–আমি আর কতটুকু জানি, আমার চেয়ে ঢ়ের ৰেশী জানেন ওই ‘চরিত্রহীন’ শরৎচন্দ্র৷ (* কুলোকর্ণী,কুলোর সংস্কৃত ‘শূর্প’৷ শূর্পঞ্ছশূপ্পঞ্ছশূপ৷ উত্তর ভারতীয় ভাষাগুলিতে কুলোকে ‘শূপ’ বলা হয়৷ যার নখ শূর্প অর্থাৎ কূলোর মত সে শূর্পণখা৷) (** এটি একটি খাঁটি ৰাঙলা শব্দ৷ ফার্সী ৰজহ্’–এর সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই৷ ফার্সী ‘ৰজায়’ শব্দের সঙ্গেও এর কোনো সম্পর্ক নেই৷ শব্দটির অবস্থা কতকটা ৰাঙলা শব্দ ‘পিদীম’–এর মত৷ অনেকে ভাবেন এটি ৰোধ হয় সংস্কৃত ‘প্রদীপ’ থেকে এসেছে৷ না, তা নয়৷ এটি একটি খাঁটি ৰাঙলা শব্দ৷ স্থান বিশেষে ‘পিদ্দিম’ ও ‘পিদ্দুম’ রূপেও উচ্চারিত হয়৷)

আজ বসন্ত

লেখক
প্রণবকান্তি দাশগুপ্ত

দখিন হাওয়ায় তালি বাজে

ডালে ডালে,

আকাশ সাজে পলাশফুলের

লালে লালে!

গুনগুনিয়ে গান শুনিয়ে

মৌমাছিরা

ফুলের বনে দলে দলে

দেয় হাজিরা৷

ডানার শিশির রৌদ্রে মোছে

শঙ্খ চিল

নেই কুয়াশা বিষণ্ণ্তার---

আকাশ নীল!

প্রজাপতি ফুল ফোটানোর

খেলায় মাতে

 

নানা রঙের রঙিন পাখার

আলপনাতে!

কুহুতানে মাতোয়ারা

দিগদিগন্ত---

কী আনন্দ কী আনন্দ

আজ বসন্ত!