প্রভাতী

দুরন্ত ছেলে

লেখক
প্রণবকান্তি দাশগুপ্ত

প্রথম দিন স্কুলে যাবে সুবি৷ সারদা ঝি সুবির হাত ধরে ঘোড়ার গাড়িতে তুলে দিতে যাচ্ছে৷ দুয়ারে গাড়ি দেখেই সুবি অতর্কিতে সারদার হাত ছাড়িয়ে দে ছুট৷ ছুটে গাড়িতে উঠতে গিয়ে পা পিছলে গেল পড়ে৷ অমনি চারদিক থেকে চিৎকার---যা! পড়ে গেল, পড়ে গেল৷ ধর ধর, তোল তোল৷ গাড়ির সামনে মানুষের জটলা৷ কে একজন বললো, আহারে, বাচ্চা ছেলে, মাথাটা গেছে ফেটে৷ রক্ত ঝরছে৷ ডাক্তার ডাকো, শিগগির ডাক্তার ডাকো৷

হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন সুবির মা প্রভাবতী৷ মুখে তাঁর উদ্বেগ৷ কী হলো ছেলের৷ সারদা ঝি কেঁদে কেঁদে বললো, সুবি পড়ে গিয়েছে মা৷

পড়ে গেছে? আতঙ্কিত হলেন প্রভাবতী৷ পাঁচ বছরের ছেলে৷ আজ প্রথম দিন স্কুলে যাচ্ছে৷ তুই ও কে ধরে রাখতে পারলি না?

ও যে হাত ছেড়ে পালিয়ে যাবে কি করে বুঝবো?

‘মাত্র পাঁচ বছরের ছেলে কে তুই ধরে রাখতে পারলি না? জানিস তো দুরন্ত ছেলে৷ হাত চেপে ধরে গাড়িতে তুলে দিতে পারলি না?

প্রতিবেশীরা চ্যাংদোলা করে ঘরে নিয়ে এলো সুবিকে৷ ডাক্তার এলেন৷ মাথা ফেঁটে গিয়েছে৷ রক্ত ঝরছে৷ ডাক্তার বললেন, তেমন কিছু নয়৷ ব্যাণ্ডেজ করে দিচ্ছি ওষুধ লাগিয়ে ঠিক হয়ে যাবে৷

বৈঠকখানায় বসে জানকীনাথ আদালতের কাগজপত্র গোছগাছ করছিলেন৷ এমন সময় সরকার এসে খবর দিল, সুবিবাবু পড়ে গেছেন৷ মাথা ফেটে গেছে৷

আদালতের নথিপত্র থেকে মাথা তুলে জানকীনাথ বললেন, ওর-না আজ প্রথম স্কুলের যাওয়ার দিন৷ পড়ে গেছে, মাথা ফেটে গেছে? মাথায় চোট৷ তার মানে তো কার্য-সিদ্ধি৷ তা সারদা কি করছিল?

প্রভাবতী বললেন, সারদা তো হাত ধরেই রেখেছিল, গাড়ি দেখে সারদার হাত ছিনিয়ে একা একাই গাড়িতে উঠতে গিয়েছিল৷ আর অমনি পা হড়কে পড়ে গেছে৷

জানকীনাথ ধ্যানস্থ হওয়ার মতন কিছুক্ষণ স্থির হয়ে রইলেন৷ তারপর আপন মনে বললেন, দুরন্ত ছেলে! ও কি কারো হাত ধরে চলার মতো ছেলে? ওর হাত ধরেই একদিন সারা দেশ জেগে উঠবে৷ ওর হাত ধরে চলবার জন্য একদিন সারা দেশ ওর দিকে হাত বাড়াবে৷

হ্যাঁ, সত্যিই তাই৷ জানকীনাথের এ-ভবিষ্যদ্বানী একদিন ঐতিহাসিক সত্যরূপে দেখা গিয়েছিল৷

এবার বলতো কে এই দুরন্ত সুবি? এই সুবিই হলেন সুভাষ৷ সুভাষচন্দ্র বসু৷ নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু৷ ১৯৪২ খ্রীষ্টাব্দে তিনি গোপনে ভারত ত্যাগ করেন৷ প্রথমে যান কাবুলে৷ সেখান থেকে মস্কোর পথে যান বার্লিন৷ পরে জাপানে গিয়ে আজাদ হিন্দ গভর্নমেন্টের প্রতিষ্ঠা করেন৷ তাঁর বাহিনী কোহিমা পর্যন্ত এসে ভারতের মাটিতে স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করেন৷

নিঃস্বার্থ দেশ প্রেমের জন্য শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তি, সুভাষচন্দ্র বসুকে বরাবর ভালবেসে এসেছিলেন৷ তাই তিনি তার ‘দেশ প্রেমিকের প্রতি’ পুস্তকটি আদরের সুভাষচন্দ্র বসুর নামে উৎসর্গ করেছেন৷

নেতাজী সুভাষ করে মনে বাস

লেখক
শিবরাম চক্রবর্তী

নেতাজী সুভাষ   তোমার সুবাস

ভারত তথা বিশ্ব,

পাওয়ার পরে    সবার ঘরে

পায় আনন্দের দৃশ্য৷

নেতাজী সুভাষ   তোমায় সাবাশ

দেশপ্রেমিকরা দেবে

বিশেষ ভাবে     বাঙালী সবে

তোমায় স্মরণ নেবে৷

নেতাজী সুভাষ   স্বামীজীর শ্বাস

তব ভাবনায় ভরা

থাকার ফলে     আত্মিক বলে

(তোমার) জীবন ছিল গড়া৷

নেতাজী সুভাষ   আই.সি.এস. পাশ

করেও ব্রিটিশের অধীন

চাকরী ছেড়ে     দেশের তরে

তুমি ছিলে স্বাধীন

নেতাজী সুভাষ   বিদেশীর গ্রাস

দেখেই হলে রাগী

বিদেশ গেলে    বন্ধু পেলে

লড়লে দেশের লাগি৷

নেতাজী সুভাষ   তেজেতে গ্রাস

করে তোমায় যখন

সৈনিক বেশে    খুব সাহসে

প্যারেড কর তখন৷

নেতাজী সুভাষ   তুমি কারো দাস

না হয়ে একেবারে,

শশাগড়া ইংরেজ ভরা

তাদের চাপলে ঘাড়ে৷

নেতাজী সুভাষ   নিয়ে ফুসফাস

করে’ যা তা বোলে

স্বার্থের কোলে   পড়ে ঢলে

আবার তোমারই কোলে!

নেতাজী সুভাষ (অলক্ষ্যে)         তোমার আশ্বাস

পেয়ে নূতন সমাজ

গড়ার তরে       ঈশ্বরের বরে

করে অনেক কাজ৷

নেতাজী সুভাষ   তোমার প্রয়াস

অনেকে না চায়,

স্বার্থান্বেষী        নয় বিদেশী

দেশের লোকই হয়৷

নেতাজী সুভাষ   মরণে বিশ্বাস

‘ওরা’ করতে পারে,

মুখার্জী কমিশন  বিমানে মরণ

তার মনে না ধরে৷

নেতাজী সুভাষ   চক্রান্তের ফাঁস

একদিন তো হবেই,

তখন তোমায়    পাগলের ন্যায়

তোমার আদর্শ নেবেই৷

সেয়ানে সেয়ানে

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

‘চাবি’ শব্দটি আমরা পোর্তুগীজদের কাছ থেকে পেয়েছি৷ এঁদের ভাষায় ‘ন্তুড়্ত্র’–এর উচ্চারণ কতকটা ‘শ’–এর মত৷ তাই ‘চাবি’–কে আমি স্পেন ও পোর্তুগাল দু’য়েতেই ‘শাবি’ উচ্চারণ করতে শুনেছি৷ আজ এই ‘চাবি’ শব্দটি বাঙলা তথা সমগ্র উত্তর ভারতে ব্যাপকভাবে প্রচলিত৷ অথচ আজ থেকে ৪৫০ বছর আগেও শব্দটির সঙ্গে এদেশের কারো পরিচয় ছিল না৷ উত্তর–ভারতে ‘চাবি’–কে বলা হত ‘কুঞ্জী’ আর বাঙলায় বলা হত ‘কাঠি’৷ তালা–চাবিকে রাঢ়ে এখনও কেউ কেউ ‘কুলুপ–কাঠি’ বলে থাকেন৷ এমনকি যাঁরা ‘চাবি’ বলেন তাঁরাও কেউ কেউ ‘চাবিকাঠি’ বলে থাকেন৷ বলেন–সিন্দুকটি তোমার চাবিকাঠিটি আমার৷ ‘কুঞ্জী’ শব্দটি এককালে উর্দু ভাষায় ব্যাপকভাবে চলত৷ আজ তার প্রভাব কমে এসেছে৷ সেই যে উর্দুতে একটা গল্প আছে না–

একজন পরীক্ষার্থী পড়াশুনা মোটেই করেনি কিন্তু সে ছিল ৰেশ সুরসিক৷ উত্তর পত্রের প্রতিটি পাতাতেই ও প্রতিটি প্রশ্ণের উত্তরেই সে কেবল লিখে গেছে–

‘‘হজারোঁ কী কিস্মৎ তেরে হাথোঁ মে হৈ

অগর পাস কর্ দেঁ তো ক্যা বাত হৈ৷’’

(হাজার হাজার লোকের ভাগ্য তোমার হাতে রয়েছে৷ যদি পাস করেই দিলে, তাতে ক্ষতিটা কী)

পরীক্ষক মশায় ছিলেন আরও ৰেশী রসিক ৷ পরীক্ষার্থী যেখানে যেখানে ওই পঙ্ক্তি ক’টি লিখেছিল তিনি ঠিক তার নীচেই প্রতিটি পাতায় লিখে দিলেন–

‘‘কিতাবোঁ কী কুঞ্জী তেরে হাথোঁ মে হৈ

অগর ইয়াদ কর্ লেঁ তো ক্যা বাত হৈ৷’’

(বইয়ের চাবি তোমার হাতেই রয়েছে৷ যদি মুখস্থই করে নিলে তাতে ক্ষতিটা কী)

ধরা আর সরা

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

দেশজ শব্দে ‘ট’ যথাযথভাবেই বজায় থাকে৷ আর ‘ড’ বা ‘ড়’ মৌলিক শব্দ হিসেবেই থেকে যায়৷ যেমন, আজ ভুলোর সঙ্গে ভোঁদার আড়ি হয়ে গেল৷ ওরা বলছে, ওরা আর একসঙ্গে মার্ৰেল খেলবে না, একটা পেয়ারাও আর কামড়াকামড়ি করে খাবে না৷ গোপনে কান পেতে শোনাকেও আড়িপাতা বলে৷ এটিও বাংলা দেশজ শব্দ৷

সেই যে একজন মহিলা আহ্লাদে আটখানা হয়ে তার এক ৰন্ধুকে বলেছিল–তোমার সঙ্গে দেখা হওয়ায় আমার যে কী আনন্দ হচ্ছে তা ভাষায় বলতে পারছি না৷ ৰন্ধু বলেছিল, তোমার যে কী আনন্দ হচ্ছে তার একটু আভাস আমায় দাও৷ মহিলাটি বলেছিল, আহ্লাদের আতিশয্যে আমার এখন ধরাকে সরা মনে হচ্ছে৷ সেই সময় হয়েছে কী, একজন চাষীর গোরু হারিয়ে গেছে৷ সে গোরু খুঁজে খুঁজে ক্লান্ত হয়ে যে বাড়ির বারান্দায় বসেছে সেই বাড়িরই ঘরের ভেতর ওই মহিলাটি বলছে– আমি আনন্দের আতিশয্যে ধরাকে সরা মনে করছি৷ চাষী আড়ি পেতে কথাটা শুনে নিলে৷ এবার সেও আনন্দের আতিশয্যে ধেই ধেই করে নাচতে নাচতে ঘরের বাইরে থেকে ওই মহিলাটিকে গড় করে বললে–মা লক্ষ্মী, এই বিরাট ধরাটা যখন তোমার কাছে সরা হয়ে গেছে তখন দয়া করে বলে দাও, ওই সরার কোন্খানটিতে আমার গোরুটা রয়েছে৷

কুবের চাকরী পেলেন

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

সংস্কৃতে ‘কোষাধ্যক্ষ’ শব্দের একটি অর্থ হল কুবের৷ পৌরাণিক কাহিনী অনুযায়ী দেবতাদের কাছে ছিল প্রচুর ধনরত্ন৷ এই ধনরত্ন তাঁরা ৰেশীর ভাগই সংগ্রহ করেছিলেন সমুদ্র মন্থনকালে সমুদ্রের তলদেশ থেকে৷ এছাড়া সংগ্রহ করেছিলেন সুমেরুশিখর (উত্তর মেরু) থেকে মূল্যবান ধাতু ও কুমেরুশিখর (দক্ষিণ মেরু) থেকে মূল্যবান মণি–মাণিক্য প্রস্তরাদি৷ এই বিপুল ধনরত্নের রক্ষণাবেক্ষণ হয়ে দাঁড়াল একটি সমস্যা৷ দেবতারা ছিলেন দারুণ ভোগলিপ্সু ও তৎসহ ক্ষমতালোভী৷ দেবতাদের দ্বারা যথাযথভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা সম্ভব ছিল না৷ তবে কি ওই বিপুল পরিমাণ ধনরাশির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব অসুরের হাতে তুলে দেৰেন! না, তাও সম্ভব নয়, কারণ অসুরদের মধ্যে ত্যাগের স্পৃহা ছিল অত্যন্ত কম৷ তাদের ধ্যেয় প্রেয় সৰকিছুই ছিল ধনসংগ্রহ৷ তারা খরচ করতে চাইত না৷ দেবতারা ভাবলে সৰ সম্পদ যদি অসুরদের হাতে তুলে দেওয়া হয় তবে দরকার পড়লে দেবতারা যদি অসুরদের কাছে চিৎহস্ত করে তবে অসুররা কিন্তু উপুড়–হস্ত করৰে না অর্থাৎ চিরকালের জন্যে সৰ সম্পদ অসুরদের কুক্ষিগত হয়ে থাকবে৷ তবে কি এই সৰ ধনরত্ন মানুষদের হাতে তুলে দেবে! না, তাও সম্ভব নয়, কারণ মানুষ অত্যন্ত নির্মম জীৰ৷ তারা বন্য পশুপক্ষী মৃগকুলকে হত্যা করে খায়৷ কিন্তু এখানেই কি শেষ! শুধু কি তাই! তারা তাদের নিরীহ পোষমানা পশুপক্ষীকে কেটে খেয়ে চরম নিষ্ঠুরতার পরিচয় দেয়৷ তারা সম্পদ সম্পত্তির জন্য নিরীহ লোককে হত্যা করে৷ তাদের দয়ামায়া ৰলে কোনো জিনিসই নেই৷ তারা মুখে দয়া–মানবিকতার কথা ৰলে কিন্তু কার্যক্ষেত্রে অত্যন্ত নির্দয়৷ তাদের জুলুমে অত্যাচারের কষাঘাতে ৰহু নিরীহ জীব ধরাপৃষ্ঠ থেকে অদৃশ্য হয়েছে, ৰহু শস্যশ্যামল ভূমি মরুভূমিতে রূপান্তরিত হয়েছে, ৰহু শস্যসম্পদ সীজ কণ্টকের রূপ ধারণ করেছে৷ মানুষের মত নিষ্ঠুর জীব আর দ্বিতীয় নেই৷ এরা রাজনীতির নামে মানুষকে হত্যা করে...দেশত্যাগ করতে বাধ্য করে...এরা ধর্মের নামে নারীহরণ করে......নিরীহ প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষকে তো বটেই, নিরীহ নারী–ৰৃদ্ধ–শিশুকেও হত্যা করতে পশ্চাদ্পদ হয় না...এরা মুখে হিউম্যানিজম বা মানবতার ৰুলি কপচায়, অথচ প্রতি পদ–বিক্ষেপে মানবতাকে কুঞ্চিকা ৰোধে পদদলিত করে পৈশাচিক আনন্দে উন্মত্ত হয়ে ওঠে৷ এই সেই মানুষ জাত যার কপটাচরণ তথা ভণ্ডামি দেবতা ও অসুর দুইকেই হার মানায়.... দুইকেই ভয়ে শিউরে তোলে৷ তাই মানুষকে যদি দেবতাদের সঞ্চিত বিত্তের রক্ষকের কাজে নিয়োগ করা হয় তাহলে মানুষ ওই সম্পদকে নিজের কুক্ষিগত রাখার জন্যে হয়তো বা দেবতাদের হত্যাও করবে৷ দেবতারা অমৃত খেয়ে অমর হয়েছেন ঠিকই, কিন্তু মানুষের অস্ত্রাঘাতে তাঁদের আহত তো হতে হৰে৷ তাই ধনসম্পদের রক্ষণাবেক্ষণের ভার মানুষের হাতে দেওয়া যায় না৷ অতঃ কিং করণীয়ম্৷

দেবতারা দেখলেন তাঁদের মধ্যে এমন একজন দেবতা রয়েছেন যাঁকে সব দেৰতাই তাঁদের দেবতা ৰলে শ্রদ্ধা করেন, তাঁকে প্রণাম করেন, তাঁকে সৰাই মেনে চলেন৷ তিনি হলেন মহাদেব৷ ‘‘দেবতানাং দেবঃ ইত্যর্থে মহাদেবঃ’’৷ দেবতারা তখন কৈলাসে গিয়ে মহাদেবের দ্বারস্থ হলেন৷ পার্বতী তাদের তড়া* (*যে আউশ তাড়াতাড়ি পাকে রাঢ়ের কোথাও কোথাও বিশেষ করে অজয় অববাহিকায় তাকে তড়া আউশ বলে৷ ‘তড়া’ শব্দটি আসছে ‘ত্বরা’ থেকে৷ এই তড়া আউশ সম্পূর্ণতই নিম্নবিত্তেরা খেয়ে থাকেন৷) আউশ ধানের ভাত ও কলমী শাকের ঝোল পেট ভরে খাইয়ে পরিতৃপ্ত করে দিলেন৷ অতঃপর পার্বতী দেবতাদের শুধোলেন–‘‘কী উদ্দেশ্যে তোমাদের শুভাগমন ৰলবে কি’’

দেবতারা ৰললেন–‘‘আমরা আমাদের ধনসম্পদ শিবের হিফাজতে রেখে দিতে চাই৷’’ পার্বতী ৰললেন–‘‘শিৰের জিম্মায় রাখা মানেই তো আমার জিম্মায় রাখা৷ আমার সারাদিনে সাতশ’ কাজ৷ ৰারৰার সিন্দুকের চাবি আমি খুলতে লাগাতে পারব না৷ তাছাড়া আঁচলে চাবিগাছাটা ৰেঁধে রাখা সম্ভব নয়৷ জানোই তো আমাকে কাজে ব্যস্ত থাকতে হয় তাই দেখছো তো কোমর ৰেঁধেই শাড়ী পরি...চাবি রাখব কোথায় তাই আমি শিবের পক্ষ থেকে ৰলছি তোমাদের প্রস্তাবে সম্মত নই৷’’ এমন সময় শিৰ ঘরে এলেন৷ দেবতারা নতজানু হয়ে তাঁর চরণ বন্দনা করলেন৷ শিৰ ৰললেন–কী চাস্ রে ব্যাটারা

দেবতারা ৰললেন–‘‘চাইবার তো কিছুই নেই৷ সবই তো দিয়েছেন আর না চাইতেই তো দিয়ে থাকেন৷ তাই চাইছি না কিছুই–একটা অনুরোধ আছে৷’’

শিৰ ৰললেন–‘‘ওসব আটঘাট–ৰাঁধা ভাষা আমি ৰুঝি না৷ আমার সঙ্গে সোজা ৰাংলায় কথা ৰল্৷’’

দেবতারা শিৰের চরণ চুম্বন করে ৰললেন–‘‘আমরা আকাশ থেকে, পাতাল থেকে, সুমেরু থেকে, কুমেরু থেকে সৎভাবে অসৎভাবে প্রচুর ধন সঞ্চয় করেছি..... ইনকাম ট্যাক্স ৰাঁচিয়ে, এক–নম্ৰরী, দু’–নম্ৰরী, তিন–নম্ৰরী খাতায় নানান ধরনের হিসেব লিখে কল্মষ–কলস উপচে ফেলেছি৷ এখন এই বিপুল ধনভাণ্ডার রাখি কোথায়! দেবতাদের কাছে রাখা যায় না কারণ দেবতারা লোভী৷ অসুরদের কাছে রাখা যায় না কারণ অসুররা অতিসঞ্চয়ী৷ মানুষের কাছে রাখা যায় না কারণ মানুষ নির্দয়৷ তাই আপনার শরণাপন্ন হয়েছি৷ তাই প্রভু, আপনি কিছু একটা করুন৷’’

শিৰ ৰললেন–‘‘কেন, অতীতে একটা ঘটনা হয়েছিল৷ জ্যোতির্ময় পরমপুরুষ সকল জীবের জন্যে ‘দ’ শব্দটি উচ্চারণ করেছিলেন৷ তোরা সে কথা কি ভুলে গেছিস!’’

দেবতারা ৰললে–‘‘শুনেছি মনে হয় তৰে এখন ঠিক ঠিক মনে পড়ছে না৷’’

শিৰ ৰললেন–পরমপুরুষ সর্বজীবের জন্যে একটি বাণী দিয়েছিলেন৷ সেটা ছিল ‘দ’৷ দেবতারা এই ‘দ’ শব্দের মানে নিয়েছিল ‘দমন করো’ অর্থে৷ সবাইকে যেন তেন প্রকারেণ দাবিয়ে রাখো৷ অস্ত্রশস্ত্রের সাহায্যে অ্যাটম বম্ব, মেগাটন বম্বের সাহায্যে, ভেটো ন্দ্বব্ধপ্সগ্গ প্রয়োগ করে নিজের তাঁবে রেখে দাও৷ বিশ্বকে কুক্ষিগত করে রেখে দাও ছলে ৰলে কৌশলে, সামে–দানে ভেদে–দণ্ডে দমন করে যাও৷ দমনকেই জীবনের মূলীভূত সত্য ৰলে মনে করো৷ অসুররা ছিল অতিসঞ্চয়ী৷ ওরা ভাবলে পরমপুরুষ ওদের ‘দ’ শব্দ দিয়েছেন দান করা অর্থে৷ সেই থেকে অসুররা সঞ্চয়বৃত্তি ছেড়ে দানবৃত্তি গ্রহণ করেছে৷ আর মানুষরা ‘দ’–এর মানে ধরে নিয়েছিল দয়া করো৷ মানুষ জাতটা ৰড় নির্দয় কিনা!

দেবতারা ৰললে–হে দেবাদিদেব, দেবতা–মানুষ–সুর সৰাই স্বধর্ম্মচ্যুত৷ এই অবস্থায় শুধু আপনিই আমাদের মুস্কিল আসান৷ আমাদের ধনসম্পদ আপনার জিম্মায় রেখে দিতে চাই৷

এমন সময় পার্বতী শিৰকে একটু আড়ালে ডেকে ৰললেন–‘‘ক্ষেপেছ গা! ওই ধনসম্পদ দেখাশোনা করবে কে! ধনসম্পদে আমাদের দরকার নেই৷ আমরা সুদ খাবও না, সুদে খাটাবও না৷ আর সরল সুদকষা, চক্রৰৃদ্ধি হারে সুদকষা কোনো অঙ্কই কষতে পারব না৷ তুমি সোজাসুজি দেবতাদের প্রস্তাব খারিজ করে দাও, নইলে আমি ভীষণ রেগে যাব কিন্তু......৷

তাছাড়া দেখছো তো কর্ত্তা, তুমি কতদিন আমাকে ৰলেছ–পার্বতী, আমি আমার উদ্ভাবিত তাণ্ডব নৃত্য নেচে চলেছি কিন্তু তুমি তোমার নিজস্ব ঘরানার ললিত্য নৃত্য নাচো না কেন মনে পড়ে, আমি প্রতিৰারই তোমাকে ৰলেছি–কর্ত্তা তুমি যখন নাচো তোমার গায়ের ঝাড়া খেয়ে সাপগুলো মাটিতে আছড়ে আছড়ে পড়ে৷ তখন কার্ত্তিকের ময়ূরটা ছুটে যায় সেগুলোকে গিলে খেতে৷ আমি থাকি ৰলেই তো ময়ূরটাকে দড়ি ৰেঁধে আটকে রাখি, আমিও যদি তোমার সঙ্গে ললিত নৃত্য জুড়ে দিতুম তাহলে কী তোমার একটা সাপও থাকত আমার হয়েছে কর্মফের, আমি দু’দণ্ড যে ললিত নৃত্য নাচব, পৃথিবীর দু’–চার জন মানুষকে প্রাণ–ভরে নাচ শেখাব তার জো নেই৷ এই অবস্থায় দেবতাদের ধনসম্পদ নিজের জিম্মায় নিই কী করে! তুমিই ৰলো! তুমি যখন দেবাদিদেব তখন তোমার আক্কেল তো মানুষ, অসুর, দেবতা তিনের চেয়ে অ...নে...ক গুণ ৰেশী৷’’

শিৰ ৰললেন–পার্বতী তুমি যা ৰলছ তা সবই ঠিক কথা... লাখ কথার এক কথা৷ আমি তো কোন ছার, একথা জজেও মানবে৷

শিৰ এসে সেই কথাটাই দেবতাদের বললেন৷ শুনে দেবতারা ৰললেন–‘‘মহারাজ, এই অর্থবিত্তের রক্ষণাবেক্ষণের জন্যে আমরা আপনাকে তিলমাত্র কষ্ট দোৰ না, মাতা পার্বতীকে তো দোৰই না৷ সম্পদ আপনার নামে থাকুক৷ আপনার পাণিমুদ্রা (হাতের ছাপ) বাদে কেউ একটা কানাকড়িও এদিক ওদিক করতে পারৰে না৷ আর আপনার নামে সমস্ত রক্ষণাবেক্ষণ তথা দেখাশোনা করে যাৰেন আপনারই একজন সহকারী৷ আমরাই দেবতাদের মধ্যে থেকে একজন অনুগত সহকারী দিচ্ছি৷’’ পার্বতী ৰললেন–‘‘ওগো শুনছ, দেবতাদের মুখের চাউনি দেখে আমার মনটা যেন কেমন করছে৷ ছেলেগুলো যেন চিন্তাভাবনায় ভেঙ্গে পড়েছে৷ ওরা আমাদেরই তো ছেলে! যখন তোমার এজন্যে ৰাড়তি খাটনি হৰে না তখন এদের প্রস্তাবে রাজী হয়েই যাও৷ আমিও যতটুকু পারি সামলে দোৰ৷’’ দেবতারা তখন তাঁদের মধ্যে থেকে একজন নিয়ম–মানা ঐকান্তিকতা তথা আন্তরিকতাপূর্ণ দেবতাকে শিবের সহকারী রূপে দিলেন৷ সেই অতীত যুগ থেকে আজ পর্যন্ত বিশ্বের সমস্ত ধনসম্পদ রাখা আছে কৈলাসশিখরের কাছাকাছি কোনো একটি জায়গায়, যে জায়গাটি দেবলোক–মর্ত্ত্যলোক দুইকেই ছুঁই–ছুঁই করছে৷ সেই শিবানুগত দেবতারই নাম কুবের৷ তাহলে তোমরা ৰুঝলে ‘কোষাধ্যক্ষ’ শব্দের আরেকটি অর্থ হ’ল ধনসম্পদের দেবতা কুবের৷

কৌশিক খাটুয়ার  কবিতা

 

(১)

ফুল বাগানে ব্যস্ত সভায়

চন্দ্রমল্লিকা ফুল,

গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে

হয় না তাদের ভুল৷

শীত-প্রতিনিধি ঢালে প্রেম-প্রীতি,

মনের কথাটি শুণিতে অতিথি

এসেছে কাননে না মানিয়া তিথি৷

চন্দ্রমল্লিকা বরণ ডালায়

অভ্যর্থনা ও স্বাগত জানায়,

জানায় ভক্তিপূর্ণ প্রণতি৷

 

(২)

কমল কলির সৌন্দর্যে মুগ্দ

উদ্ভাসিত দিবাকর,

নিয়মিত ভোরে দেখিবার তরে

আবির্ভূত ভাস্কর৷

যেথা অবগুণ্ঠিতা কুসুম কলি

ক্রমশঃ পাপড়ি মেলে,

সরোবরে তারা শতদল হয়ে

বিকশিত দলে দলে!

বিবেকানন্দ স্মরণে রাখি তাঁরে মননে

লেখক
শিবরাম চক্রবর্তী

বীর সন্ন্যাসী বিবেকানন্দের

          সারসত্তায় পাই,

ভারতআত্মার জাগরণেই

          মনে দিতেন ঠাঁই৷

আবার তিনি প্রগতিশীল

          মনেও ছিলেন ভারী,

তাই তো তিনি সত্যের ভাষণ

          করতেন সদাই জারি৷

খালি পেটে ধর্ম হয় না

          এই ছিল তার বাণী,

অন্ন-বস্ত্র-শিক্ষা-স্বাস্থ্য

          গৃহ চাই একখানি৷

পদব্রজে ভারত ভ্রমণ

          করে তিনি দেখেন,

কত কষ্টে দেশবাসীরা

          দিনযাপনে থাকেন৷

তারই মাঝে জাত-পাত আর

(ধর্মের) গোঁড়ামিও বেশ ছিল,

ইংরেজরা সেই সুযোগে

          ধর্মান্তরে মন দিল৷

ভারতবর্ষের একটাই দোষ

          অন্যের দেশ যখন,

ভারতীয়দের বাহবা দিত

          চিনত তাঁদের তখন৷

তাই মনে হয় বিবেকানন্দ

প্রথম বিদেশ (আমেরিকা) যায়

হিন্দুধর্ম নিয়ে বত্তৃণতায়

          খুব প্রশংসা পায়৷

তারপরে সে দেশে ফিরতেই

          সবাই জড়িয়ে ধরে,

এরই ফলে হিন্দু ধর্মের

          ভিত মজবুত করে

বিবেকানন্দের বত্তৃণতায়

          এমনই জাদু ছিল,

ফেরার পথে এক রমনী (মার্গারেট)

          তার সাথী হ’ল৷

পরে তিনি দীক্ষা নিয়ে

          ভগিনী নিবেদিতা,

হয়ে বাঙলা ও ভারতমাতার

          গ্রহণ করলেন ছাতা৷

‘‘গোলোক বৃন্দাবন’’

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

গ্রামে যাত্রাগান চলছে৷ গীতাভিনয়*(সেকালে ভাল ৰাঙলায় যাত্রাকে ‘গীতাভিনয়’ বলা হত৷) হচ্ছে জমিদার বাড়ীর সামনেকার প্রকাণ্ড মাঠে৷ যার যা পার্ট সে পার্ট তো সে করছেই উপরন্তু সবাইকার চেষ্টা কোনোক্রমে জমিদারৰাৰুকে কিছুটা সন্তুষ্ট করে দিয়ে কিছু বখ্শিস আদায় করা৷ এই ধরনের ব্যাপার সেকালকার ৰাঙলায় খুব চলত৷ যার এলেম*(*মূল শব্দটি ‘ইল্ম্’ যার থেকে ‘আলিম্’ শব্দটি এসেছে৷) তেমন নেই সেও জমিদারের খোশামোদ করে দিয়ে বখশিসের ব্যবস্থা করে নিত৷ সেই যে গল্পে আছে না–

জাড়া গ্রামের ভোলা ময়রার সঙ্গে জনৈক জগুঠাকুরের কবির লড়াই হচ্ছে জাড়া গ্রামের জমিদার মধুসূদন বাঁড়ুজ্জের বাড়ীতে৷ জগুঠাকুর দেখলে, ভোলা ময়রার সঙ্গে সে এঁটে উঠবে না৷ তাই সে ঠিক করলে জমিদারৰাৰুকে খোশামোদ করেই দু’পয়সার ব্যবস্থা করে নেবে৷ পালার বাইরে গিয়েই ধুন ধরলে–

‘‘এ এক বৃন্দাবন রে ভাই এ এক বৃন্দাবন৷

হেথায় বাঁশী বাজানো লীলা করেন শ্রীমধুসূদন৷৷’’

ভোলা ময়রার নাকি তা সহ্য হয়নি৷ সে সঙ্গে সঙ্গে উত্তরে বলেছিল–

‘‘কেমন করে’ বললি জগা জাড়া গোলোক বৃন্দাবন৷

হেথা তুলসীমঞ্চ কোথায় পেলি সবই দেখি বাঁশের বন৷

বংশীধবনি শুনলি কোথায় ওরে মশায় করে ভনভন৷

কবি গা’বি পয়সা পাবি অত খোশামোদের কী কারণ’’৷৷

আলোকের পথ ধরে

লেখক
কৌশিক খাটুয়া

জাগরণ আসে বিভাবরী শেষে

আলোকের শুভ সূচনা,

নববর্ষের নবারুণ হাসে

সবই পরমপিতার রচনা৷

 

উন্নয়নে জাগে জনপদ

নববর্ষের কঠোর শপথ------

নব্যমানবতাবাদের প্রতিষ্ঠা,

নির্মূল হোক কায়েমী স্বার্থের

বিধবংসী অপচেষ্টা৷

জীবের সেবায় হয়ে নিয়োজিত,

সবারে চাই করিতে প্রীত৷

 

সেই লক্ষ্যে অবিচল থেকে

কঠোর সাধনে ব্রতী,

নবযৌবন সুচি করে মন

জনস্বার্থে অগগতি৷

 

এই ধরনীর জল ও বাতাসে

ফলে ভরা মধু ফুলের সুবাসে,

সকলের রবে সম অধিকার

সংবৎসর করিব প্রচার৷

 

বুভুক্ষের হোক উদর পূর্তি,

অজ্ঞের হোক জ্ঞানের স্ফূর্তি,

কুসংস্কার ভুলে কুসংস্কারাচ্ছন্ন

নবারুণালোকে হোক পরিচ্ছন্ন৷

জ্ঞান-বিজ্ঞান হোক সার্বজনীন,

উন্মুক্ত সবার তরে,

প্রাকৃতিক সম্পদ নয় ব্যাষ্টি অধীন,

ন্যায় বন্টন ঘরে ঘরে৷

 

ধবংস হোক সমাজ শত্রু----পুঁজিবাদ,

কেটে যাক দূর্ভাগ্যের কালো রাত৷

ষড়যন্ত্রের হোক চিরস্থায়ী লয়,

ন্যায়, ধর্মের চিরন্তন জয়,

প্রেরণা যোগায় আলোর উত্তরণে,

উদ্ধত শির আকাশ ছুঁয়েছে,

প্রস্তুত মোরা রণে৷

শুভ কাজে আছে নৈতিক বল,

এক ছত্রতলে নির্ভীক সেনা দল৷

প্রভু নির্দেশ রূপায়ণে ব্রতী,

চারিদিকে তার বহিছে হাওয়া

মঙ্গলময় গতি৷

 

হোক তাঁর আদর্শের জয়---

শিরোপরে চিরস্থায়ী

পরমপিতার বরাভয়৷

আর নয় কালক্ষয়,

ঘুচাইয়া সংশয়,

শুরু হোল অবিরাম সংগাম,

ধবংসাত্মক শক্তির ভবিষ্যতের চরম পরিণাম৷

পারস্পরিক ভ্রাতৃপ্রীতি

থাকুক অক্ষয়৷

নিত্য প্রভাতে উদ্বুদ্ধ করুক

নব্যমানবতার নব অরুণোদয়৷

নববর্ষ কোথায় কখন কিভাবে

লেখক
প্রণবকান্তি দাশগুপ্ত

পয়লা জানুয়ারী আন্তর্জাতিক নববর্ষ৷ ইয়ূরোপে আজ নববর্ষ পালিত হয় পয়লা জানুয়ারী৷ কিন্তু এক সময় মার্চ মাসে নববর্ষ হতো৷

বাংলাতেও এখন যেমন বৈশাখ নববর্ষ অনুষ্ঠিত হয় প্রাচীনকালে হতো অগ্রহায়ণে৷

চীনা ও ইহুদীরা কোন নির্দিষ্ট দিনে নববর্ষ পালন করতো না৷ প্রাচীনকালে চান্দ্রবৎসর গণনার রীতি ছিল৷ সভ্যতার উন্মেষের সাথে সাথে সৌর আবর্ত্তনকে কেন্দ্র করে বছরের হিসেব শুরু হয়৷ সূর্যের হ্রাস বৃদ্ধি নেই৷ চন্দ্রকলার কিন্তু হ্রাসবৃদ্ধি আছে৷ আর এই সূর্য ও চন্দ্রের গতির তারতম্য হেতু কোন বছরে বারো, কোন বছরে তের মাস গোণা হয়৷ ফলে প্রাচীনকালে বিশেষতঃ চীনা ও ইহুদীরা নববর্ষ কোন নির্দিষ্ট দিনে পালন করতো না৷

আর্যরা উত্তরায়ন আরম্ভের দিনটিকে নববর্ষ মনে করতেন৷ উত্তরায়ন আরম্ভ হয় ২২শে ডিসেম্বর বা ৭ই পৌষ৷ তাই আর্যগণ ৭ই পৌষ নববর্ষ পালন করতেন৷ সেদিন তাঁরা সূর্যের পূজা ও যজ্ঞ করতেন৷

আজ থেকে ১৬০০ বছর আগে পৌষমাসের শেষ দিনে উত্তরায়ণ আরম্ভ হতো৷ অতএব ১লা মাঘ ছিল নববর্ষের দিন৷ সেদিনের পুণ্যতিথিটি সাগর সঙ্গমে স্নান অর্থাৎ মকর স্নানের মধ্য দিয়ে আজো পালিত হয়৷

‘হায়ণের অর্থ বৎসর’৷ অগ্র হচ্ছে প্রথম৷ অর্থাৎ বৎসরের প্রথম মাস৷ গীতায় অগ্রহায়ণকে বলা হয়েছে মার্গশীর্ষ৷ এককালে এই মার্গশীর্ষ বা অগ্রহায়ণ ছিল বছরের প্রথম মাস৷ মার্গ শীর্ষ নক্ষত্রে পূর্ণচন্দ্রের উদয় হলে সেই পূর্ণিমাকে বলে মার্গশীর্ষী পূর্ণিমা৷ এই মার্গশীর্ষী পূর্ণিমার জন্যেই মাসটির নাম মার্গশীর্ষ৷ অগ্রহায়ন মাসে সূর্যাস্তের পর এই নক্ষত্রে পূর্ণচন্দ্রের উদয় হয়৷ তাই এককালে অগ্রহায়ণই ছিল বছরের প্রথম মাস৷ ১লা অগ্রহায়ণ ছিল বছরের প্রথম দিন৷

১লা বৈশাখে ব্যবসায়ীদের হালখাতার উৎস খুঁজতে হলে যেতে হবে সেই মোগল আমলে৷ আকবরের আমল থেকে হিজরীসন অনুযায়ী বছরের প্রথম দিন রাজস্ব আদায় করা হতো৷ প্রজারা তখন রাজস্ব স্বরূপ ফসল দিত৷ তাই আজকের হালখাতার তখন নাম ছিল ‘ফসলী’৷ সংস্কৃত ভাষায় এর নাম ছিল ‘পুণ্যাহ’৷ অর্থাৎ পুণ্যের দিন৷ পুণ্যের লোভে যাতে প্রজারা রাজস্ব দিতে আগ্রহী হয় তাই কি এই নামকরণ? তামিলরা তাদের নববর্ষ (পোঙ্গল) পালন করে মাঘের শুরুতে৷

নেপালে নববর্ষ হয় কার্ত্তিক পূর্ণিমার পরের দিন৷ প্রাচীন কালে চীনে পুরনো বছরের প্রতীক হিসাবে একটি কাগজের ড্রাগন তৈরী করে তাকে পোড়ানো হতো৷ অর্থাৎ আবাহন হতো এইভাবে৷

পশ্চিম আফ্রিকায় কিছু কিছু উপজাতির মধ্যে নতুন বছরের মঙ্গল কামনায় শস্য ক্ষেত্রে অবাধ মেলামেশা হয়৷

জাপানে নববর্ষের দিন দুটো পিঠে তৈরী হয়৷ একটি পিঠেপুরুষ অপরটি নারীরূপে কল্পিত হয়৷ আর এদের উভয়ের মধ্যে মিল ঘটানো হয়৷

খ্রীষ্টপূর্ব ৪৬ সালে জুলিয়াস সিজার ১লা জানুয়ারী নববর্ষ প্রচলন করেন৷ সীজার ছিলেন সুপ্রসিদ্ধ রোমীয় মহাবীর৷

যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধির মতে ইয়ূরোপে যে ১লা জানুয়ারী নববর্ষ দিবস পালিত হয় তা ভুল, হওয়া উচিৎ ২৩শে ডিসেম্বর৷ কারণ ঐদিন থেকে উত্তরায়ন শুরু৷ উত্তরায়ণের আরম্ভকাল থেকেই নববর্ষের শুরু৷

উত্তর ভারতে বর্ষ আরম্ভ (বিক্রম সংবত) হয় চৈত্র মাসের শুক্লা প্রতিপদে৷ ওই দিন সেখানে ধবজা রোপণের প্রথা আছে৷ উড়িষ্যায় চালু ছিল আমলী ও বিলায়তী অব্দ৷ আমলী অব্দ শুরু হত ভাদ্রমাসের শুক্লা দ্বাদশী থেকে আর বিলায়তী আশ্বিন থেকে৷ দক্ষিণ ভারতে বার্হস্পত্য বর্ষশুরু হয় বৈশাখ মাসের কৃষ্ণা প্রতিপদ থেকে৷ কেরলে কোল্লামবর্ষ আরম্ভ হয় ভাদ্রমাসের কৃষ্ণা নবমী থেকে৷ গুজরাতিরা দেওয়ালীর দিন নববর্ষ পালন করে৷ সেদিন তারা জুয়া খেলে নতুন বছরের ভাগ্য পরীক্ষা করে নেয়৷