প্রভাতী

জলটান

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

সংস্কৃত ‘মদ’ ধাতুর একটি অর্থ হল যা শুষে আরাম পাওয়া যায় (ভাবারূঢ়ার্থ), যোগারূঢ়ার্থে জল, সরবৎ, পানা, ফলের রস ও যে কোন তরল বস্তু যা পানীয় পর্র্যয়ভুক্ত৷ উপরি-উক্ত যে বস্তু খেলে জলটান হয় অর্র্থৎ যে আহার গ্রহণের পর বারৰার জলতেষ্টা পায় সেই বস্তুকে ম+ড= ‘ম’ নামে আখ্যাত করা হয়ে থাকে৷ যেমন কম জলে ছাতু গুলে খেলেও বার বার জলতেষ্টা পায়৷ এই ধরনের জলতেষ্টাকে ‘জলটান’ ৰলা হয়৷

তোমরা সেই ৰলাগড়ের ব্রজবল্লভ ৰসাকের জলটানের গল্প শুণেছ তো! যদি না শুণে থাক তো একবার ৰলি৷ ব্রজবল্লভ ৰসাক থাকতেন ৰলাগড়ে--- তাঁর পৈতৃক ভদ্রাসনে৷

কিন্তু ব্রজবল্লভ ৰসাকের অন্তরঙ্গ বন্ধুরা ৰেশ কিছুটা দূরে থাকতেন ৰন-হুগলীতে, অপর অন্তরঙ্গ বন্ধু বিজিত বসু থাকতেন ৰাজেশিবপুরে৷ বিজিত ৰাঁরুজ্জের ছেলেটি লেখাপড়া সমাপ্ত করে সদ্য সেই যে কী যে একটা সরকারী বিভাগ আছে যেখানে খাদ্যশস্য ওজন করে দাম দিয়ে গুদামজাত করা হয় সেই বিভাগটিতে অল্পদিন হল কাজ পেয়েছে৷ আর বিজিত বসুর ছেলেটি এম.এ. পাশ করেছে, হুগলীর কোন একটি কলেজে তার পেপেচুরির চাকরি হলো-হলো৷

একদিন প্রাতর্ভ্রমণ সেরে ব্রজবল্লভ বসাক বাড়ী ফিরে আসতেই তাঁর স্ত্রী সেয়ানাসুন্দরী বললেন, ‘‘ওগো শোন, তোমার বন্ধু বিজিতৰাৰু এইমাত্র খৰর পাঠিয়েছেন, আজ রাত্তিরে ওঁর ছেলের ৰউ-ভাত৷ তোমাকে নেমতন্ন রক্ষা করতে যেতেই হৰে৷ নইলে উনি মনে ভারী দুঃখু পাৰেন৷ কাজকর্মে অত্যধিক ব্যস্ত থাকায় নিজে আসতে পারলেন না৷ নইলে তিনি নিজেই এসে তোমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন’’৷

ব্রজবল্লভ বসাক সেয়ানা সুন্দরীকে শুধোলেন---‘‘কোন জায়গাটার নাম করেছে ৰল তো--- ৰনহুগলীর না ৰাজেশিবপুরের’’৷

সেয়ানাসুন্দরী ৰললেন---‘‘অত তো জিজ্ঞেস করিনি৷ কারণ যে লোকটি এসেছিল সে ৰললে বিজিতৰাৰু ব্রজৰাৰুর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ৷ নাম নিলেই ৰুঝতে পারৰেন’’৷

ব্রজবল্লভ বসাক বললে---‘‘তাও তো জিজ্ঞেস করিনি কারণ লোকটি বললে, নেমতন্নকারীর নাম শুণলেই ব্রজৰাবু বুঝতে পারবেন, বেশী বলার দরকার পড়বে না’’৷

ব্রজবল্লভ মহাফাঁপরে পড়লেন৷ তিনি এবার বাস্তব বুদ্ধি প্রয়োগ করলেন৷ বিজিত বাঁডুজ্জের ছেলেটি চাকরী করে৷ সুতরাং চাকরী পাওয়ার পরে নিশ্চয় তার বিয়ের ঘটকালি শুরু হয়েছিল৷ তাই তার বিয়েই বেশীই সম্ভব৷ বিজিত বসুর ছেলেটি পেপেচুরির কাজ পাৰে, তারপরে পাত্রীর সন্ধান হবে, তারপরে দেনাপাওনার কথা হবে, ঠিকুজী গোষ্ঠী বিচার করে তারপরে পাকা দেখা হবে৷ তারপরে না বিয়ে! শতকরা ৯৯.৯ ভাগ সম্ভাবনা বিজিত বাঁড়ুজ্জের ছেলের বিয়ে৷

বলাগড় থেকে ৰাজেশিবপুর যেতে গেলে সোজা ট্রেনে যাওয়া যাবে না৷ গঙ্গা পার হতে হবে৷ কিন্তু বনহুগলী যেতে গঙ্গা পার হতে হয় না৷ কিন্তু ৰনহগলী যেতে গঙ্গা পার হতে হয় না৷ ব্রজবল্লভ বসাক কী করৰেন! ঘনিষ্ঠ বন্ধু তো৷ আত্মীয়ের চেয়ে বন্ধুর টান বেশী৷ তাই তিনি যেভাবেই হোক বনহুগলীতে গিয়ে পৌঁছুলেন সন্ধ্যে একটু আগেই৷ বন্ধুর ছেলের বিয়ে...... একেবারে ৰাইরের লোকের মত এসেই হাতটি ধুয়ে পাতে ৰসে পড়া যায় না৷ দরকার পড়লে ময়দা মাখতে হৰে, নুচি ৰেলতে হৰে, এমনকি কোমরে গামছা জড়িয়ে নুচি ভাজতে হৰে কিংবা ৰাঁ হাতে ডালের ৰালতি, ডান হাতে হাতা নিয়ে পরিবেশন করতে হবে৷ ঘাম মোছবার জন্য কাঁধে একটি গামছাও রাখতে হবে৷ তাই একটু আগেই যাওয়া দরকার৷

বনহুগলীতে পৌঁছলেন ব্রজবল্লভ বসাক৷ কিন্তু এ কি! বিজিত বাঁড়ুজ্জের বাড়ী দেখে বিয়ে বাড়ী ৰলে তো মনেই হচ্ছে না৷ বাইরের দিকে একটা আলোও জ্বলছে না৷ সামনে বৈঠকখানায় একটা কম পাওয়ারের আলো টিমটিম করে জ্বলছে৷ কড়া নেড়ে দরজা খোলাতে হল৷

বিজিত বাঁড়ুজ্জে বললেন--- ‘‘এসো এসো, ব্রজ, তোমার যে আজকাল টিকিই দেখতে পাই না৷

ব্রজবল্লভ ঘরে ঢুকে যা দেখলেন তাতে তার মনে নেৰে এল সন্দেহের কালো ছায়া৷ এ ৰাড়ী তো বিয়ে-ৰাড়ী নয়৷ পরিস্থিতি সামলাবার জন্যে বিজিত বাঁড়ুজ্জের সঙ্গে তিনি দু’চারটি কুশল সংবাদের আদান প্রদান করলেন ৷ বিজিত বাঁড়ুজ্জের চোখ মুখ দেখে মনে হল তার ঘুম আসছে৷ তখন রাত্রি পৌনে ন’টা৷ বিজিত বাঁড়ুজ্জে হাঁই তুূলতে তুলতে ৰললেন, ‘‘একটু সকাল সকাল খাই কী না আর বোঝ তো বয়স হয়েছে--- বিশেষ কিছু সহ্য হয় না৷ রাত্তিরে খই দুধ খেয়ে শুয়ে পড়ি৷ ওটা একটু হাল্কা জিনিস তো৷’’

ব্রজবল্লভ বসাক ৰললেন, হ্যাঁ, আমিও অনেকক্ষণ ধরে উঠৰ উঠৰ করছিলাম৷ অনেকদিন পরে তোমাকে দেখে এত আনন্দ হচ্ছে যে কী ৰলৰ৷ ......আচ্ছা চলি৷ তা তোমার ছেলেটি এখন কী করছ? তার বিয়ে-থার কী হল?’’

বিজিত বাঁড়ুজ্জে বললেন,---‘‘পাত্রীর খোঁজ তো চলছে, তবে পাত্রী পছন্দ হচ্ছে তো দেনা-পাওনায় মিলছে না, আবার দেন-পাওনা মিলছে তো পাত্রী পছন্দ হচ্ছে না৷ তবে আশা করি সামনের মাঘ মাসে বিয়ের ব্যবস্থা হৰে৷ সে  খবর তো তুমি আগেই পেয়ে যাৰে’’৷

ব্রজবল্লভ বসাক বাড়ীতে ফিরে এলেন৷ কড়া নাড়তেই সেয়ানা-সুন্দরী দরজা খুলে দিলে৷ ঘরে ঢুকেই ব্রজবল্লভ স্ত্রীর দিকে একটু বিষণ্ণ্ মুখে তাকালেন৷

স্ত্রী জিজ্ঞেস করলেন---বিয়েবাড়ীতে কেমন খাওয়া-দাওয়া হ’ল?

ব্রজবল্লভ বসাক বললেন---‘‘আগে এক গেলাস ঠাণ্ডা জল দাও দিকি’’৷

ব্রজবল্লভ ধপাস্‌ করে চেয়ারে ৰসে হাতটা রাখলেন ডানগালের নীচে৷ জোরে একটা        দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন৷ মনে মনে বললেন, নুচি-পোলাও দুই-ই৷ সেয়ানাসুন্দরী জল নিয়ে এলো৷ ব্রজবল্লভ বসাককে বললে,---‘‘কী খেয়েছো তোমাকে আর বলতে হবে না, আমি ৰুঝে নিয়েছি’’৷

ব্রজবল্লভ বসাক ৰললেন---‘কী খেয়েছি ৰল দেখি’?

সেয়ানাসুন্দরী বললে,---‘নিশ্চয়ই পোলাও’৷

ব্রজবল্লভ শুধোলেন--- ‘কী করে ৰুঝলে’?

সেয়ানাসুন্দরী ৰললে---‘ওটুকু আমি জানি গো জানি, পোলাও খেলে দারুণ জলটান হয়’৷

একেলা পথে

লেখক
কৌশিক খাটুয়া

আমার ডাকে সাড়া দিতে

  ভুলেছো কি দয়াময়,

হাজার কাজে ব্যস্ত রয়েছো

  পাওনি বুঝি সময়!

ফুল ফোটানো ধরা জাগানো

   ভোরের সূর্যোদয় ,

শেফালীর সাথে কথোপকথনে

    সুষমা কি কথা কয়?

ঝর্ণাধারায় নদী বয়ে যায়

    সুমধুর কলতানে,

সুখ-দুঃখের কাহিনী শোনাতে

    ছুটে সাগরের পানে!

নিশা অবসানে রবির কিরণে

    প্রভাতী পাখির গানে,

কালবৈশাখীর অকাল বৃষ্টি

    চাতকের অভিমানে !

 

আজও হিমালয় স্বমহিমায়

      মহৎ অঙ্গীকারে,

বালুকাবেলায় মরু সাহারায়

     খর বায়ু বহিবারে৷

ঘটনা বহুল বসুন্ধরায়

   সুখ-দুঃখের সংসার,

নিত্য নিয়মে বেলা বয়ে যায়

  তোমারি কি দায়ভার!

তোমার আমার এত ব্যবধান

জমা অভিমান পাহাড় প্রমান,

কর্মব্যস্ততার অছিলা দেখাও

   শিশু ভুলানোর ছলে!

বেলা বয়ে যায় সন্ধ্যা ঘনায়

   তিলে তিলে পলে পলে,

বিষাদ-হৃদয় আর নাহি সয়

    কেন দূরে, যাও বলে৷

আমি কেন তবে এসেছি জগতে

কোথায় যাব এলেম কোথা হতে,

   অজ্ঞ, বিজ্ঞ, প্রাজ্ঞ সবাই

     ব্যর্থ জবাব দিতে,

কাউকে চিনিনা জানিনা মানিনা

    তোমা পেতে চাই সাথে৷

থেকো নাকো দূরে হাত দুটি ধরে

     নিয়ে চল তব পথে,

সৃষ্টি-শ্রষ্টা অটুট বাঁধন

     প্রলেপ হৃদয়-ক্ষতে৷

নব অভিযান

লেখক
প্রণবকান্তি দাশগুপ্ত

বিষাক্ত কন্টকপথে পণ করে’ প্রাণ

শুরু হলো আমাদের নব অভিযান৷

মান নেই, খ্যাতি নেই,

নেই সমর্থন---আছে জ্বালা,

আছে ব্যঙ্গ ---সহস্র বন্ধন৷

শুভ কাজে যত শুনি তিক্ত অপবাদ

অট্ট হেসে তত পাই রোমাঞ্চের স্বাদ!

ড্রাগনেরা ঘিরে আছে প্রগতির পথ

সংগ্রামে প্রস্তুত আছি---নিলাম শপথঃ

জীবন-সংকটে কভু হটবোনা পিছে,

পেয়েছি অভ্রান্ত পথ মৃত্যুভয় মিছে!

মাঝপথে যদি নামে দুর্র্যেগের রাতি,

যদি ওঠে ক্ষুব্ধ ঝঞ্ঝা নাহি রয় সাথী

আমাদের অভিযান থামবে না তবু---

তিলে তিলে দেবো প্রাণ

দমবো না কভু৷৷

অভ্রান্ত যাত্রা

লেখক
কৌশিক খাটুয়া

বিমুক্তির পথে ---

আমরা চলেছি তাঁর

 সুসজ্জিত রথে,

অনুজীব থেকে ক্রমে

 বহুকোষী প্রাণে,

অজস্র জনম ধরে

 ক্রম উত্তরণে,

 পরিশেষে মানব জীবন

পায় পথ চলার জীবন দর্শন!

 

কাঙ্খিত এ’ জীবন দূর্লভ

 কিন্তু দুষ্প্রাপ্য নয়,

 তাঁর কৃপায় ক্রমোন্নতি

কারণ জানেন লীলাময়!

 

কিন্তু এই অগগতি অভ্রান্ত,

তাই ক্লান্ত পান্থ হয় শান্ত,

 নয় বিভ্রান্ত৷

নেপথ্যে সৃষ্টিকর্তার প্রেম অনন্ত!

পথ পরিক্রমা এখানেই নয় অন্ত৷

 

কামনা বাসনা ভরা সংস্কার

যতদিন না ফুরায় ভাণ্ডার,

অশেষ অপার জীবনধারা----

মায়ার বাঁধনে গতি হারা৷

শেষের পরেও আছে শুরু

নিয়ন্ত্রণে কৃপাময় গুরু৷

আশা-যাওয়া অবিরাম যাত্রা

নাই যতি, কমা, ছেদ মাত্রা৷

 

তাই পরমপিতার কৃপাকণা

 অবিরাম শির পরে ঝরে,

যা’ কিছু সংস্কার শুভাশুভ

দাও শ্রীচরণে উজাড় করে৷

 

তাই ভূমার মহৎ আকর্ষণে

অনুমন নয় বদ্ধ কারাগারে,

 শরিতার একমুখী প্রবাহ

অতল অপার পারাবারে!

 

তপোবনে তপস্যা রত

 পবিত্র সাধনে ব্রতী যত

তাদেরও একাগতা

 স্থির অবিচল লক্ষ্যে,

নাই আসক্তি শুধু অনুরক্তি

 রাগাত্মিকা ভক্তির পক্ষে৷

 

সাধনে ভজনে উদ্বুদ্ধ মননে

 নন্দিত হই তোমারে বরণে,

তোমার দেখানো পথ অনুসরণে

 আজীবন গতি তোমারই পানে৷

রূপসী বাংলা

লেখক
সাক্ষীগোপাল দেব

ধন্য আমি জন্ম আমার

          শস্য শ্যামল বঙ্গে,

ছয়টি ঋতু খেলে হেথায়

          নানা মধুর রঙ্গে৷

গ্রীষ্ম আসে রুদ্র যেন

          পোড়ায় জরাজীর্ণ

যত আছে সব পুরাতন

          অর্দ্ধমৃত শীর্ণ৷

বর্ষা যেন মঙ্গল ঘট

          ছড়ায় শীতল বারি,

ধরায় নব সৃষ্টি শুরু

          বার্র্ত যেন তারি৷

শরৎ এলো মেঘের ভেলায়

          কাশফুলেদের সাথে,

নবীন ঘাসের গালচে পাতা

          জ্যোৎস্না হাসে রাতে৷

হেমন্তেরই স্নিগ্দ সকাল

          ঘাসে শিশির বিন্দু,

শিউলি ফুলের মিষ্টি সুবাস

          রাতের শোভা ইন্দু৷

শীতের সাথে হিমেল হাওয়া

          আনে নূতন স্বাদ,

নলেন গুড়ের পিঠে ছাড়া

          জীবনটাই বরবাদ৷

বসন্ত যে ঋতুর রাজা

          রং বে-রং এর হোলি,

বঙ্গমায়ের চরণে দেয়

          প্রাণের অঞ্জলি৷

মুঙ্গের ও রেঙ্গুন পাশাপাশি

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

‘খটক’ শব্দের আরেকটি অর্থ হচ্ছে যিনি দুই পক্ষের মধ্যে যোগাযোগ ঘটিয়ে কার্যসিদ্ধি করে দেন অর্থাৎ ‘ঘটক’৷ এঁরাও অনেক সময় কথা বেচে অনেক অনিচ্ছুক পাত্রপক্ষ ও অনিচ্ছুক পাত্রীপক্ষের ওপর অবাঞ্ছিত পাত্রী বা পাত্র গছিয়ে দেন৷ এই প্রসঙ্গে একটা ছোট্ট ঘটনা মনে পড়ল৷

সেটা ১৯৩৫ সালের কথা৷ আমরা তখন কলকাতায় থাকি, মামার বাড়ী শ্যামবাজারে৷ আমার দিদির বিয়ের সম্বন্ধ প্রায় পাকা হয়ে এসেছিল৷ কেবল পাকা দেখাটাই বাকী ছিল৷ পাত্র সব দিক দিয়েই ভাল–বার্মা গবর্ণমেন্টের উচ্চপদস্থ অফিসার৷ বাড়ী ২৪ পরগণা জেলার বসিরহাট৷ কোন তরফেই বিয়েতে কোন আপত্তি ছিল না৷ হঠাৎ আমার মা বেঁকে বসলেন......বললেন, মেয়েকে আমার নির্বাসনে পাঠাব না৷ হঠাৎ দরকার পড়লে মেয়েকে আনাতে পারব না৷ নিজেরা হঠাৎ ওখানে পৌঁছে যেতে পারব না৷ রেঙ্গুন অনেক দূর..... রেঙ্গুন অনেক দূর৷ অত দূরে মেয়ের বিয়ে দোব না৷ .... বিয়ে কলকাতার বাইরে দোবই না....তাও কেবল উত্তর কলকাতায়....বড় জোর ভবানীপুরে৷

আমার বাবা–মামা সবাই মা’র কথা মেনে নিলেন৷ প্রমাদ গুণলেন ঘটকী ঠাকরুণ৷ তাঁর মোটা একটা আয় গেল–গেল অবস্থায় গিয়ে পৌঁছোল৷ ঘটকী ঠাকরুণ একবার আমার বাবাকে ধরেন, একবার মামাকে ধরেন৷ ওঁরা বললে–মেয়ের মা যখন চাইছেন না তখন আমরা কিছুতেই বিয়েতে মত দিতে পারছি না৷

শেষ পর্যন্ত ঘটকী ঠাকরুণ আমার মা–কে বললেন–তুমি কেন রাজী হচ্ছ না মা বার্মা তো বাঙলার পাশেই ও তো আর দূর বিদেশ নয়৷ এ যেমন আমাদের শ্যামবাজার–কুমোরটু৷

মা তাতেও রাজী হলেন না৷

ঘটকী তখন শুধোলেন, ‘‘হ্যাঁ মা, তোমার যে জামালপুরে থাক সেটা কোন জেলায়

মা বললেন–মুঙ্গের জেলায়৷ তখন ফোকলা মুখে একগাল হেসে ঘটকী বললেন–তবে আর আপত্তি করছ কেন মা মুঙ্গের আর রেঙ্গুন তো পাশাপাশি৷

মা বললেন, ‘‘সে তো নিশ্চয়ই....দুয়েতেই যখন ‘ঙ্গ’ রয়েছে!’’ (শব্দ–চয়নিকা, ১২/১০৮)

ভালো-মন্দ যাহাই ঘটুক সত্যরে লও সহজে

লেখক
প্রণবকান্তি দাশগুপ্ত

সংস্কৃত কলেজের একটা ভাঙা সিড়ি নিয়ে একবার দুই ক্লাসের ছেলেদের মধ্যে ভীষণ মারামারি আর হৈচৈ হলো৷ দুপক্ষই চাইল ভাঙা সিঁড়িটি খেলার সামগ্রী হিসাবে দখল করতে৷ তাই উভয় দলের মধ্যে শুরু হলো শক্তি পরীক্ষা৷ প্রথমে কথা কাটাকাটি... তারপর ঠোকনা ঠাকানি.... তারপর ঠেলাঠেলি ব্যঙ্গ বিদ্রূপ...তারপর দুমদাম কিলচড় লাথিঘুষি৷

সংবাদটা পৌঁছে গেল অধ্যাপক মহলে৷ জনকয়েক অধ্যাপক ছুটে এসে ধমকানি দিতেই ছাত্ররা যে যার ক্লাসে পালিয়ে গেল৷

 কিন্তু ব্যাপারটা সেইখানেই শেষ হলো না৷ জল আরেকটু গড়ালো৷ অধ্যাপকদের কাছ থেকে সংবাদটা পৌঁছলো অধ্যক্ষের কাছে৷ ছাত্ররা ভীষণ বেপরোয়া হয়ে উঠেছে৷ শক্ত হাতে এদের শায়েস্তা করা দরকার৷

তাই নাকি! সংবাদ পেয়েই ছুটে এলেন অধ্যক্ষ ই.বি. কাউয়েল৷ কাউয়েল সাহেব একটি ক্লাসে ঢুকেই আদেশ করলেন, যে যে মারামারিতে যোগ দিয়েছিলে সে সে উঠে দাঁড়াও৷

কিন্তু কোন ছাত্রই উঠে দাঁড়ালো না৷ কিন্তু সব ছাত্রই যে মারামারিতে যোগ দিয়েছিল তার তো যথেষ্ট প্রমাণ আছে৷ অধ্যাপকরাই তো স্বচক্ষে তা দেখেছেন৷ কিন্তু তবুও ছাত্ররা উঠে দাঁড়িয়ে দোষ স্বীকার করলো না৷

তখন কাউয়েল সাহেব একটু বিরক্ত হয়ে বললেন তবে কি আমি বুঝবো কোন ছাত্রই মারামারিতে যাওনি?

না স্যার, আমি গিয়েছিলাম৷ মিথ্যাকে আর আঁকড়ে থাকতে পারলো না একটি ছেলে৷ সত্যকে স্বীকার করতে সে একটুও ভয় পেল না৷ উঠে দাঁড়িয়ে বললো, ‘মারামারিতে আমি ছিলাম, স্যার৷’

সমস্ত দোষী ছেলের মধ্যে মাত্র একটি ছেলে দোষ স্বীকার করলো৷

কাউয়েল সাহেব যৎপরোনাস্তি সন্তুষ্ট হলেন৷ সত্যবাদী ছেলেটির ওপর৷ বললেন, তোমার সততার জন্য তোমাকে মার্জনা করলাম৷ কিন্তু আর সকলকে দু টাকা করে জরিমানা দিতে হবে৷

জানো কে এই সত্যবাদী ছেলেটি? ইনিই হলেন আচার্য শিবনাথ শাস্ত্রী৷ ৩১শে জানুয়ারী তাঁর শুভ জন্মদিন৷ সেদিন তোমরা তাঁকে বিশেষভাবে জেনো দেখবে তিনি শুধু উপাধিধারী পণ্ডিতই ছিলেন না৷ তিনি ছিলেন একজন একনিষ্ঠ সমাজসেবক, আদর্শ শিক্ষক ও ধর্মপ্রচারক৷ ১৮৭২ খ্রীষ্টাব্দে সংস্কৃত কলেজ থেকে তিনি এম.এ.ও শাস্ত্রী উপাধি লাভ করেন৷

দিশাহীন উন্মত্ততা

লেখক
কৌশিক খাটুয়া

এদের *ক* লিখতে কলম ভাঙ্গে

 *খ* লিখতে ছেঁড়ে খাতা,

 এরা হলেন বাংলাদেশের

বি. এন. পি আর জামাত নেতা!

জাতির জনক মুজিবর

ভেঙেছে তাঁর দুয়ার-ঘর,

ইতিহাসকে লোপাট করে

বাড়ায় নিজের বাজার দর!

যাঁর ভূমিকায় স্বাধীনতা

সম্মানীয় জাতির পিতা,

স্বেচ্ছাচারী নেতা বলে

এসব নাকি আদিখ্যেতা!

ক্ষমতাচ্যুত নির্বাচিত সরকার

ক্ষমতায় উন্মত্ত জবরদখলদার,

উগ্র রক্ষণশীলতার আবরণে

‘ভারত-বিদ্বেষ’ একমাত্র হাতিয়ার৷

এরা মানব সমাজে বিরাজমান

 বিষাক্ত হুলে ভিমরুল,

কাজি হলেও হয়নাতো তারা

 বিদ্রোহী কবি নজরুল!

এদের হাওয়ায় ভাসে মুহুর্মুহু

 হুঙ্কার আর আস্ফালন,

হিংসায় আর দাঙ্গায় তার

 নিত্য ঘটে প্রতিফলন৷

হামলা মামলা কর্মসূচি

 বিধর্মীদের রক্ত চায়,

পদ্মা-যমুনা রঞ্জিত হয়

অপাপবিদ্ধ শোণিত ধারায়৷

মন্দির আজ দেবতা মুক্ত

জন-দেবতা ভাঙা কান্নায়,

লুন্ঠন আর অগ্ণিসংযোগ

 নারী সম্ভ্রম ধূলায় লুটায়৷

দেশ স্বাধীনে ভারতের স্থান

কে করে স্বীকার তার অবদান,

ধর্মের ভাই এক পাতে খাই

 কেমনে ভুলিবে পাকিস্তান!

শিক্ষার পথ ভুলে গেছে এরা

 স্কুল শেষ কোন অতীত কালে,

তুঘলকি রাজ করিছে বিরাজ

 মাছ ধরে এরা ঘোলা জলে!

যখনই দাবি ওঠে

 বুভুক্ষু জঠরে চাই খাদ্য,

তখনই দেখানো হয়

সীমান্তে বাজিছে রণবাদ্য৷

জল-স্থল-বায়ু পথে

 ভারত আক্রমনাত্মক,

শাসকের মন্তব্যে বুঝি

 প্রতারক আহাম্মক!

দেড় হাজার বছর প্রাচীন

 ধর্মীয় নীতি-নির্দেশিকা,

কালের গতিতে ত্যাজ্য

যুগের দাবিতে ব্রাত্য

 ঘোর বিভীষিকা৷

মৌলবাদ, ধর্মান্ধতাপুষ্ট

 রক্ষণশীলতা

হারায় মূল্যবোধ

 বাড়ায় সাম্প্রদায়িকতা!

ধর্ম যখন বর্ম হয়ে

 দেয় নিজ পরিচয়৷

সমাজ-সংস্কৃতি বিকৃত হয়,

 হয় সামাজিক অবক্ষয়!

নাই সম্প্রীতি, ভ্রাতৃ-প্রীতি

 কবে হবে এর ইতি,

কবে দায়িত্বশীল জনপ্রতিনিধি

 সমাজে আনিবে স্থিতি?

সেকালের সরস্বতী পুজো

লেখক
প্রণবকান্তি দাশগুপ্ত

সরস্বতীর মূর্ত্তি পুজো বেশিদিনের ঘটনা নয়৷ এমনিতেই অন্যান্য দেবদেবীর তুলনায় সরস্বতীর রূপকল্পনা হয়েছে অনেক পরে৷ ষষ্ঠ কিংবা সপ্তম শতাব্দী থেকে তার শুরু৷ এ প্রসঙ্গে শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তি বলেছেন---এই যে সর্বশুল্কা সরস্বতী পৌরাণিক দেবী, এঁর পুজোও কিন্তু ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল না৷ এমনকি পাঠান যুগেও ছিল না, এমনকি মোগলযুগেও ছিল না৷’’ (নমঃ শিবায় শান্তায়)৷

পশ্চিমবঙ্গে চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর আগে বই মাটির দোয়াত, শরের কলম, তালপাতার তাড়া, কাগজ ইত্যাদি পুজো হতো৷ পুজোর জন্য নিবেদিত হত বাংলা বা সংস্কৃত বই, ইংরেজি নয়৷ কারণ ইংরেজি ম্লেচ্ছভাষারূপে বিবেচিত হত৷ শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তি বলেছেন--- ‘মোগলযুগে, পাঠান যুগে লোকে এই সর্বশুক্লা সরস্বতীর পুজো করতে গেলে বইয়ের পুজো করত, পুস্তকের পুজো করত৷ (নমঃ শিবায় শান্তায়)৷

‘সরস’ শব্দের আদিম অর্থ জ্যোতি৷ ‘সরস’ থেকে সরস্বান (সূর্য), তেমনি সরস্বতী, সরস্বতী জ্যোতির্ময়ী৷ আনন্দমূর্ত্তিজী বলেছেন---‘সরস্‌’ শব্দের মানে সাদারঙের আলো,শুভ্র জ্যোতিঃ৷....সরস্বতী মানে যার মধ্যে শাদারঙের জ্যোতিঃ আছে...৷’

আর দেবীর পুজোতেও তাই দেওয়া হয় শাদা চন্দন, শাদা ধান, শাদা ফুল ইত্যাদি৷ সবই শ্বেত উপচার৷ প্রসাদ ও শাদা৷ দই, খৈ, তিলে খাজা,খোয়াক্ষীর মাখন,নারকেল কুল ইত্যাদি৷ এছাড়া দেবীর শ্বেতপদ্মে অধিষ্ঠান,শ্বেতবস্ত্র পরিধান৷

বইয়ের মাধ্যমে সরস্বতী পুজো প্রসঙ্গে আনন্দমূর্ত্তিজী আরো বলেছেন---‘‘এখন ইংরেজ আমলের গোড়ার দিকে সাহেবরা সাহেবরা বললে--- টোমাডের এ্যাটো ডেবডেবী আছে, আর তোমরা সরস্বতী পূজা বুক দিয়ে কেন করো? Why books why not a Devi, why not a goddess)? এখন ওই ইংরেজ আমলের সর্বশুভ্রা সরস্বতীর মূর্ত্তি গড়ে পূজো করবার রীবাজ শুরু হলো এই কলকাতা শহরেই৷ ...মূর্ত্তি গড়ে পূজো করছে লোকে এই ইংরেজ যুগে৷ তার আগে এ পূজোটা ছিল ও না৷’’          (নমঃ শিবায় শান্তায়)

নোতুন পৃথিবী

লেখক
সাক্ষীগোপাল দেব

বজ্রমুঠি গৈরিক বেশ

হাতে নিশান স্বস্তিক,

আসছে ওরা অযুত নিযুত

নাস্তিক নয় আস্তিক,

সুদর্শনে কাটছে ওরা

ধনতন্ত্র, জড়বাদ,

পাপীর ষড়যন্ত্র ওরা

করছে হেলায় বরবাদ!

আনল প্রাউট মুক্তি আলো

ব্যথীর বুকে আশ্বাস

ধার্মিকেরা নেবে আবার

দু’-বুক ভরে নিশ্বাস৷

হাসবে আবার গাছ গাছালি

হাসবে যত নিঃস্ব,

হাসবে আবার নোতুন করে

তোমার আমার বিশ্ব৷