প্রভাতী

ন্যাজ সর্বস্ব

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

দ্যোতমানা শক্তির বৈবহারিক অভিব্যক্তি তোমরা ব্যষ্টিগত জীবনে হয়তো অনেক বারই দেখে থাকবে৷ এ সম্বন্ধে দু’একটা ছোট ছোট গল্প শোনাচ্ছি, মিলিয়ে দেখ৷

একজন জাঁদরেল কর্ষক ছিল৷ তার নাম শ্রীমান দন্তবিকাশ ন্যাজসর্বস্ব৷ (এটি পদবী)৷ শ্রীমান দন্তবিকাশ শ্বশুরালয়ে গেছেন৷ সেখানে যত্ন–আত্তির (‘আত্তি’ শব্দটা আত্মীয়তা থেকে এসেছে) কোন কসুর ছিল না৷ দন্তবিকাশের শ্বশ্রূ–ঠাকুরাণী৩ তাঁর জন্যে ষোড়শ উপাচারে জামাইভোগের ব্যবস্থা করেছেন৷ তারই সঙ্গে পাতের একটি কোণে রেখে দিয়েছেন ছাঁকা তেলে ভাজা দু’একটি গরমাগরম গুড়া পিঠে–বলা যেতে পারে একেবারে খোলা থেকে নোলা৷ জামাই বাবাজী অর্থাৎ শ্রীমান দন্তবিকাশ একটি গুড়পিঠে খেয়েই একেবারে তুরীয় স্তরে পৌঁছে গেল৷ দ্বিতীয়টির সময় তার আর বাক্যস্ফূর্তি হচ্ছে না৷ আমতা আমতা করে সে শুধোলে–মা ঠাকরুণ, আর দু’একটা এই জিনিসটা হবে মা ঠাকরুণ বললেন–দু’একটা কেন বাবা, এক্ষুনি তোমার জন্যে দু’চার ডজন এনে দিচ্ছি৷ দন্তবিকাশ সেগুলি গলাধঃকরণ করে যথাবিহিত সম্মানপুরসর শ্বাশুড়ীকে শুধোলে–‘মা ঠাকরুণ, এর নাম কী শ্বশ্রূ ঠাকুরাণী বললেন–সংস্কৃতে একে বলি ‘মধুপিষ্টকী’, বাংলায় গুড়পিঠে৷

শ্রীদন্তবিকাশ স্ব–গ্রাম অভিমুখে রওনা হল৷ শ্রীদন্তবিকাশের তেমন অক্ষরজ্ঞান ছিল না৷ তাই ‘গুড়পিঠে’ শব্দটা লিখে রাখা সম্ভব ছিল না৷ সে পথ চলছে মার্চিং–এর রীতিতে৷ তবে লেফ্ট রাইট না বলে বলছে গুড়–পিঠে...গুড়–পিঠে...গুড়–পিঠে.....গুড়–পিঠে৷

শ্রীমান দন্তবিকাশের কথা বলতে গিয়ে আমার একটা পুরোনো দিনের ছবি মনে পড়ছে৷ সেটা ১৯৪৩ সাল .... ইংরেজ আমল...... আমি তখন একজন সামরিক শিক্ষার্থী৷ আমাদের যাঁরা প্যারেড শেখাতেন তাঁরা ছিলেন স্কটিশ্ হাইল্যাণ্ডার.... খুবই দক্ষ সৈনিক৷ তাঁদের সব কিছুই ভাল ছিল৷ তবে তাঁদের উচ্চারণ ভারতবাসীর কাছে কিছুটা দুর্বোধ্য ছিল৷ আমরাও তাঁদের দেখাদেখি (অর্থাৎ শোনাশুনি) কম্যাণ্ড করবার সময় বলতুম, ‘ইল্লেফৎ–আইৎ, ‘ইল্লেফ্ৎ–আইৎ’৷ সামরিক শিক্ষার্থীদের মধ্যে এমনও কিছু ছিলেন যাঁরা লেখাপড়া কিছুই জানতেন না৷ ‘ইল্লেফৎ আইৎ’ তাঁদের কাছে ছিল একেবারেই দুর্বোধ্য৷ তাঁদের জন্যে বিশেষ ধরণের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছিল৷ তাঁদের বাঁ পায়ে বেঁধে দেওয়া হ’ত কিছুটা খড় ও ডান পায়ে বেঁধে দেওয়া হ’ত কিছুটা বিচালিও (ঘাস জাতীয় বৃহদাকার উদ্ভিদ যা মুখ্যতঃ পশুখাদ্য হিসেবে ব্যবহূত হয়৷ বিচালির দড়িও হয়)৷ তাঁদের ‘ইল্লেফৎ–আইৎ’–এর পরিবর্ত্তে বলানো হ’ত খড়–বিচালি....খড়–বিচালি....খড়–বিচালি৷ তাঁরা যখন ‘‘খড়–বিচালি’’–তে অভ্যস্ত হয়ে যেতেন তখন খড়–বিচালির–আইৎ পরিবর্ত্তে তাঁদের শেখানো হ’ত ‘ইল্লেফ্ৎ–ইল্লেফ্ৎ–আইৎ’৷

শ্রীমান দন্তবিকাশ স্ব–গ্রামের দিকে এগিয়ে চলছে ছন্দের তালে তালে–গুড়পিঠে....গুড়পিঠে....গুড়পিঠে....গুড়পিঠে৷

সামনে একটা প্রকাণ্ড নালা৷

দন্তবিকাশ বাবাজীবন তখন মারে–জোয়ান–হেঁইয়ো বলে এক লাফে নালার ওপারে পৌঁছালো৷ কিন্তু একি! গুড়পিঠে যে তার স্মৃতিপট থেকে অন্তর্হিত হয়ে গেছে৷ তখনও দন্তবিকাশ মার্চিং–এর রীতিতে এগিয়ে চলেছে৷ নোতুন বোল হয়েছে–কী যে খেলুম....কী যে খেলুম....কী যে খেলুম....কী যে খেলুম৷

বাড়ীতে পৌঁছে দন্তবিকাশ তার মাকে বললে–সেই যে শ্বশুর বাড়ীতে ‘কী যে খেয়ে এলুম’ তা–ই তৈরী করে দাও৷ তার মা বললে–কী খেয়ে এলি বল্, তবে না তৈরী করে দোব৷ দন্তবিকাশ বার বার বলে চলল–সেই যে কী যে খেলুম.....সেই যে কী যে খেলুম.....সেই যে কী যে খেলুম৷

তার মা কিছুতেই তার বক্তব্য বুঝতে পারে না৷ তখন দন্তবিকাশ তার মায়ের ওপর জোর হম্বিতম্বি শুরু করে দিলে৷ পাড়াপড়শীরা ছুটে এল৷ দন্তবিকাশের মা উপস্থিত জনতাকে সম্বোধন করে বললেন–পণ্ডিতেরা ঠিকই বলেন৷ মূর্খের অশেষ জ্বালা মূর্খ ছেলে থাকার চেয়ে না থাকাই ভাল৷ জ্ঞানীরা সেইজন্যে বলে থাকেন–

‘‘অজাত–মৃত–মূর্খাণাং বরমাদৌ না চান্তিমঃ৷

সকৃত দুঃখকরাবাদ্যাবন্তিম্ পদে পদে৷৷’’

পাড়ার লোকে দন্তবিকাশের মাকে শুধোলে–‘‘এটা কী শোলোক বল্লে গা, ওর মানে কী’’ দন্তবিকাশের মা বললে, ওতে বলা হয়েছে যার ছেলে জন্মায়নি তার একটাই দুঃখ৷ সে লোকের কাছে কেঁদে বলে, আমার ছেলে–পিলে নেই গো৷ যার ছেলে হয়ে মরে গেছে, তারও একটাই দুঃখ৷ সেও শিরে করাঘাত করে বলে, ছেলেটা ম’রে গেল গো, মা বলে ডাকতে কেউ রইল না৷ কিন্তু যার ছেলে আছে অথচ সে ছেলে মূর্খ–তার প্রতি পদে মূর্খ ছেলেকে নিয়ে নিজের তো জ্বালা–যন্ত্রণা আছেই, পাড়া–পড়শীরাও এব্লা এ বলে তোমার ছেলে এই করেছে, ওব্লা ও বলে তোমার ছেলে ওই করেছে৷ শুনে শুনে কান ঝালাপালা, প্রাণ পালাপালা৷ তাই জ্ঞানীরা বলেন–ছেলে না থাকা অথবা ছেলে মরে যাওয়া বরং ভাল কারণ ওই দু’টো ক্ষেত্রে দুঃখ থাকে একটাই কিন্তু মূর্খ ছেলের বেঁচে থাকা একেবারে ভাল নয়৷ কারণ সেক্ষেত্রে প্রতি পদেই দুঃখ ভোগ করতে হয়৷ তা আমার এই দাঁত বের করা দন্তবিকাশ মূর্খ বলেই আমার কী দুর্গতি হচ্ছে তোমরা তো দেখছো৷ আমার দুঃখ দেখে বনের শেয়ালও কাঁদে, ডোবার মশাও ডুকরে কেঁদে ওঠে৷ দেখ দেখি তোমরা –পিঠটা আমার কীরকম ফুলিয়ে দিয়েছে–পিঠটা ফুলে গুড়পিঠের মত হয়ে গেছে৷ দন্তবিকাশ সোল্লাসে বলে উঠল–ওই জিনিস.....ওই জিনিস.......ওই জিনিস৷ আগে বললেই তো হত৷

বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে

লেখক
প্রণবকান্তি দাশগুপ্ত

                   সেদিন বিজন সেতুর বুকে প্রকাশ্য দিবালোকে

                   অকস্মাৎ নেমে এসেছিল সূর্যহারা অরণ্যের অন্ধকার

                   শাসককুলের যত কুলাঙ্গার

                   ষড়যন্ত্রের নিশ্চিদ্র জাল করেছিল বিস্তার৷

                   মানব সেবায় নিবেদিত প্রাণ

                   সপ্তদশ অবধূত অবধূতিকা---

                   মিথ্যা গুজবের অপবাদ তাঁদের জীবন

                   গ্রাস করেছিল আগুনের লেলিহান শিখা৷

                   কী যন্ত্রনা, কী নিষ্ঠুরতা, সাহায্যার্থে

                   চউত্রিশ হাতের আকুল আবেদন হল নিষ্ফল৷

                   পিশাচের অট্টহাসি, নরঘাতকের দল---

                   তখন জড়বাদীদের জমানা,

                   ওরা ‘ধর্মেন হীনা’ তাই ‘পশুভিসমানা’৷

                   মনে পড়ে মহাভারতের সেই কলঙ্কিত অধ্যায়?

                   দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ

                   নারী নির্যাতন?

                   সভায় উপস্থিত রথী মহারথী বীর পুঙ্গব

                   বড় বড় যোদ্ধারা

                   দ্রৌপদীর কাতর কান্নায় কারো বিবেক কাঁপেনি৷

                   দুর্র্যেধনের পৈশাচিক অট্টহাসি

                   ত্রস্ত বিহঙ্গরা শুধু ডানা ঝাঁপটেছিল

                   যন্ত্রণায় লজ্জায়

                   আর বীর যোদ্ধারা ভয়ে মূক৷

                   রাষ্ট্র মাঝে মাঝে দেশকে এমনিভাবে দমিয়ে রাখে৷

                   শুভবুদ্ধিকে পাঠায় কবরে৷

                   কী দরকার ছিল জরুরী অবস্থার?

                   আসলে দরকার ছিল একমাত্র স্বৈরতন্ত্র কায়েম,

                   নিরঙ্কুশ ক্ষমতা ভোগ৷

                   সেদিনও দেশের গণমান্য দেশ বরেণ্যরা

                   রাষ্ট্রের ভয়ে বাক্যহারা৷

                   দেশের চারিদিকে পাহাড়,

                   সমুদ্র মরুভূমি

                   যেন লুপ্ত,

                   শুধু কারাগার, বিচারহীন অন্ধকার আর হাহাকার৷

                   সেই ধারাবাহিকতারই চিত্ররূপ বিজন সেতু,

                   ছিল না কোন যুক্তিগ্রাহ্য হেতু

                   তথাপি আধিভৌতিক, আধিদৈবিক আধ্যাত্মিক

                   সমস্যা-সমাধানকল্পে সরল মনের চলমান

                   সপ্তদশ সন্ন্যাসী সন্ন্যাসিনীর

                   অগ্ণিদহনে হল অসময়ে মর্মান্তিক মৃত্যু৷

                   সাহায্যার্থে সেদিনও কেউ আসেনি এগিয়ে

                   ভীতচিত্ত সুশীল সমাজ আতঙ্কে নিশ্চুপ৷

                   মুখে কুলুপ,

                   নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান, জানলা দরজা বন্ধ৷

                   শাসকের রক্ত চক্ষুর তির্যক দৃষ্টিতে ত্রাস

                   তাই প্রতিবাদ করেছিল শুধু রাস্তার কয়েকটি কুকুর,

                   প্রহারের ভয় না পেয়ে পশু হয়ে ও

                   পাশবিকতার বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিল---ঘেউ ঘেউ

                   তথাপি অন্ততঃ তাদের দেখেও এগিয়ে আসেনি কেউ৷

                   আর মুখ্য প্রশাসক ও

                   রাজ দণ্ড ধূলায় লুন্ঠিত, রাজ ধর্মচ্যুত দলদাস৷

                   অমানবিকতার চূড়ান্ত দৃষ্টান্ত৷

                   ভালমানুষের নকল ভাবমূর্ত্তির ঘেরাটোপে

                   চর্ব-চোষ্য-লেহ্য-পেয় সহযোগে আরামে দিনযাপন

                   উনি না হাসেন, না কাঁদেন---নির্বিকার৷

                   শোণরে ভণ্ড যত পাষণ্ড তোদের দণ্ড অনিবার্য৷

                   সন্ন্যাসী হত্যাকারীর বংশে কেউ থাকবে না বাতি দিতে

                   এ নয় আমার নিদান

                   এ শাস্ত্রের বিধান৷

গল্পের গল্পকথা

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

অনেকে ভাবে ‘গল্পষৰ’ বুঝি একটি সংস্কৃত শব্দ৷ না, এটি একটি গৃহীত সংস্কৃত শব্দ অর্থাৎ যে শব্দ মূলতঃ সংস্কৃত নয়, অন্য ভাষা থেকে নেওয়া হয়েছে যেমন ‘গুবাক’, ‘রজ্জু’, পান অর্থে ‘পর্ণ’, মাছ অর্থে ‘মীন’, গ্রাম অর্থে ‘পল্লী’---এরা সবাই গৃহীত সংস্কৃত৷ ‘গল্প’ শব্দটি তাই-ই৷ গল্প / গল্পিকা দুটোই গৃহীত শব্দ৷ সংস্কৃতে এরকম গৃহীত শব্দগুলির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হ’ল এদের ব্যুৎপত্তি পাওয়া যায় না৷

গল্পের সংস্কৃত হচ্ছে ‘কথা’ আর ছোট গল্পের সংস্কৃত হয় ‘কথানিকা’ (কথানিকা< কহানিয়া< কহানি< কাহিনী)৷ হ্যাঁ, ‘গল্প’, ‘গল্পিকা’ শব্দগুলি সংস্কৃতে আদিমকালে ছিল না, গৃহীত হয়েছিল সম্ভবতঃ বাংলা বা মৈথিলী থেকে কারণ ওই দুটি ভাষাতেই ‘গল্প’ বা ‘গপ্প’ শব্দ চলে যার উর্দু হচ্ছে ‘কিস্‌সা’৷ বাঙলায় কেউ কেউ ওই ‘কিস্‌সা’ থেকে ‘কেচ্ছা’ শব্দ তৈরী করে নিয়েছেন৷ ‘কেচ্ছা’ শব্দের আর একটি অর্থ হ’ল নিন্দা বা ‘কুৎসা’৷ এখানে ‘কেচ্ছা’ শব্দটি সংস্কৃত কুৎসা শব্দ থেকে আসছে না....আসছে উর্দূ ‘কিস্‌সা’ শব্দ থেকে৷ উর্দুতে যদি বলি ‘মতিবিবি কি কিস্‌সা’৷ তার বাংলা হবে ‘মতিবিবির কেচ্ছা’৷ এই কিস্‌সা শব্দের হিন্দী ভাষার তদ্ভব রূপ হচ্ছে ‘কহানী’, বাংলায় তদ্ভব রূপ ‘কাহিনী’ অর্থাৎ হিন্দীতে হবে ‘মতিবিবি কী কহানী’, বাংলায় হবে ‘মতিবিবির কাহিনী’৷ শোনা যায় একবার নাকি মিথিলার কমতৌলে বা সৌরাষ্ট্রের সভাগাছিতে অর্থাৎ নবদ্বীপের পোড়ামাতলায় অথবা ভাটপাড়ায় গঙ্গার ধারে কিংবা কোটালীপাড়ার বটতলায় অথবা কাঁথির কাছে জুনপুটের সমুদ্রতীরে কিংবা কোচবিহারের রাসময়দানে অথবা হাসিশহরের (পণ্ডিতী নাম ‘কুমারহট্ট’) ইট-বেরিয়ে যাওয়া গঙ্গার ঘাটে পণ্ডিতেরা সবাই জড় হয়েছিলেন৷ ‘গল্প’ শব্দটির ইতিহাস আবিষ্কার করতে৷ তাঁদেরজন্যে রাজারাজড়াদের এমন কিছু খরচ করতে হয়নি---আনতে হয়েছিল এক শ’ মণ চা আর পাঁচ শ’ মণ নস্যি৷ পণ্ডিতেরা তিন দিন তিন রাত এই নিয়ে তর্ক করেছিলেন, চর্চা করেছিলেন, শুরু হয়েছিল সেই তৈলাধার পাত্র বা পাত্রাধার তৈল নিয়ে গবেষণা৷ তারপর এল ‘তাল্‌ পড়িয়া চ ঢপ্‌ শব্দ হইল, না ঢপ্‌ শব্দ হইয়া তরু হইতে তাল্‌ পড়িল’! অবশেষে এল তামাকের গুণাগুণ৷ পণ্ডিতেরা এ সম্বন্ধে সিদ্ধান্তে পৌঁছে গেলেন ধোঁয়ারূপেই হোক অথবা চূর্ণ রূপেই হোক (দোক্তা বা জর্দা বা নস্যি) তামাক সেবন মহা ফলদায়ী৷ সংস্কৃতে তামাকের নাম ছিল না৷ পণ্ডিতেরা গবেষণা করে নাম দিলেন ‘তাম্রকূট’৷ কিন্তু কিছু পণ্ডিত বলেছিলেন নাম রাখা হোক ‘স্বর্ণকূট’৷ কিন্তু অন্যরা বললেন, হৈমবতী উমা অর্থাৎ পার্বতীর সঙ্গে নামটি যুক্ত৷ তাই এটি চলবে না৷ কেউ কেউ নাম রাখতে চাইলেন ‘রজতকূট’ অন্যে আপত্তি করে বললেন---না, তাও চলবে না কারণ শিবের ধ্যান মন্ত্রে আছে---‘ধ্যায়েন্নিত্যং রজতগিরিনিভম্‌ সুতরাং সে নামও চলবে না৷ তা নিয়ে দেবতাদের মধ্যে মতভেদ নেই৷ তাই নাম রাখা হ’ল ‘তাম্রকূট’৷ কথ্য ভাষায় লোকে নাম রাখতে পারে টোবাকু, তাম্বাকু, তামাকু, তাংকু, তাতে ব্যকরণ সমর্থন করুক বা না করুক৷ ‘যার সঙ্গে যার মজে মন / কিবা হাঁড়ি কিবা ডোম৷ তাঁরা সিদ্ধান্তে পৌঁছুলেন---

‘‘তাম্রকূটং মহদদ্রব্যং শ্রদ্ধয়া দীয়তে যদি৷

অশ্বমেধসমপুণ্যং টানে টানে ভবিষ্যতি৷’’

অর্থাৎ তামাকু একটি মহৎদ্রব্য৷ কেউ যদি শ্রদ্ধার সঙ্গে কাউকে তামাক অফার করে তাহলে প্রাপক যেমন এক-একটা টান দেবেন দাতা তেমনি এক-একটি করে অশ্বমেধ যজ্ঞের সমান ফল পেতে থাকবেন৷

সবই তো হয়ে গেল৷ এবার পণ্ডিতেরা এলেন আসল বিষয়ে৷ অনেক গবেষণার পর ওঁরা বললেন ঃ তিন বন্ধু ছিল---গণেশ, ললিত, পরেশ৷ ওরা একবার বক্সীর হাট থেকে বেড়িয়ে তোর্সা নদী পার হয়ে যাচ্ছিল মাথাভাঙ্গা গণেশ লম্বা চেলে সে গরমকালে তোর্সা নদীর কোমড় জল পার হয়ে গেল৷ পরেশ আরো লম্বা৷ গরমকালে তোর্সা নদী তারকাছে হাঁটু জলের সামিল৷ কিন্তু ললিত বেঁটেখাটো৷ তাকে বলা হ’ল তুই নদী পার হতে পারবি?

ও বললে---মুই পরিম না৷

তখন পরেশ ওকে নিজের কাঁধের ওপর বসিয়ে নিল৷ এখন পণ্ডিতেরা মানস দৃষ্টিতে ওই ছবিটা দেখে নিলেন ঃ তোর্সা নদীর মাঝ বরাবর দাঁড়িয়ে আছে গণেশ আর নামের প্রথম অক্ষর ‘গ’৷ আর একটু পেছনে দাঁড়িয়ে আছে পরেশ যার নামের অক্ষর ‘প’৷ আর পরেশের কাঁধে রয়েছে ললিত যার নামের প্রথম অক্ষর ‘ল’৷ সবার আগে ‘গ’, পেছনে ‘প’ অক্ষর তার মাথার ওপরে ‘ল’৷ এই হ’ল ‘গল্প’ এর ইতিহাস....নবতর পুরাণ৷     (শব্দচয়নিকা ২১/১০৭)

‘‘চক্রং ভ্রমতি মস্তকে’’

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

মনে পড়ে গেল একটা ইতিহাসপ্রসিদ্ধ আখ্যায়িকা৷ গ্রামের নাম কুড়িয়ে–খাওয়া৷ সেখানকার সুপ্রসিদ্ধ মানুষ ছিলেন শ্রীযুক্ত ৰাৰু কিপ্ঢেকঞ্জুস কর৷ কিপ্ঢেকঞ্জুস বৈধ অবৈধ নানান ভাবে টাকা রোজগার করত৷ সে ভেবে দেখলে, হঠাৎ–ৰড়লোক হতে গেলে শিব ঠাকুরের কাছ থেকে ৰরদান নিতে হবে৷ অন্য দেবতাদের সন্তুষ্টির জন্যে কঠোর তপস্যার প্রয়োজন৷ কিন্তু শিব তো ভোলানাথ .....আশুতোষ৷ একটা আকন্দ ফুল আর কয়েকটা ৰেলপাতা দিলেই সন্তুষ্ট হয়ে যান৷ তাই তাঁকেই ডাকি৷

কিপ্ঢেকঞ্জুসের জানা ছিল শিবের দয়ার শরীর৷ দানব–রাক্ষসেরা শিবের কাছ থেকে ৰর দান পেত৷ কিপ্ঢেকঞ্জুস শিবের তপস্যায় বসে গেল৷ অল্প দিনের তপস্যায় শিব সন্তুষ্ট হয়ে তার সামনে এসে দাঁড়ালেন৷ বললেন–‘‘চোখ খুলে চা ৰেটা, আমি এসেছি৷’’

কিপ্ঢেকঞ্জুস বললে–‘‘এসেছো যখন ঠাকুর, আমার মনস্কামনা পূর্ণ করো৷’’

শিব বললেন–‘‘কী তোর মনস্কামনা তুই আমাকে চাস, না আমার কাছ থেকে আর কিছু চাস’’

তখন কিপ্ঢেকঞ্জুস বললে–‘‘তুমি তো ছাইমাখা ভিখিরি৷ তোমাকে নিয়ে আমার লাভ কী! তুমি আমার ৰোঝা হয়ে দাঁড়াবে৷ তুমি বরং আমাকে ৰর দান করো যাতে দু’পয়সার মুখ দেখতে পাই৷’’

শিব বললেন–‘‘এই মাত্র বললি, আমি ছাইমাখা ভিখিরি৷ আবার আমার কাছ থেকে টাকা পয়সা চাইছিস কোন যুক্তিতে’’

কিপ্ঢেকঞ্জুস বললে–‘‘তুমি যে ছাইমাখা ভিখিরি একথা তো ঠিকই ৷ কিন্তু দুপুরৰেলায় হৰিষ্যি করার পর ধনৈশ্বর্যের দেবতা কুবের এসে তোমাকে ম্যাসাজ (হাত–পা টিপে দেওয়া) করে দিয়ে যায়৷ ম্যাসাজ করতে করতে কুবের যখন তোমাকে বলবে–‘ঠাকুর, এবার ডানপাশ ফিরে শোও, সেই ফাঁকতালে তুমি বলে দিও, কুবের কিপ্ঢেকঞ্জুসের দিকে মুখ তুলে চা৷ ওকে কিছু পাইয়ে দে৷’’

শিবঠাকুর বললেন–কুবের যদি আমার কথা না রাখে......

কিপ্ঢেকঞ্জুস বললে–‘‘ত্রিভুবনে কার ঘাড়ে ক’টা মাথা আছে যে তোমার কথা ঠেলতে পারে৷ কুবের তোমার কথা শুনৰেই শুনৰে৷’’

শিব বললেন–‘‘আমি কুবেরকে বলে দোৰ৷ আর কুবের যা বলৰে তোকে জানাৰ৷’’

কিপ্ঢেকঞ্জুস বললে–‘‘ঠাকুর ৰেশ কিছুদিন ধরে তপস্যা করে আজ তোমার ইন্টারভিউ পেয়েছি৷ আবার দ্বিতীয়বার ইন্টারভিউ পেতে গেলে অনেকদিন তপস্যা করতে হবে৷ এদিকে আমাদের দোকানের কেনাৰেচা লাটে উঠতে বসেছে৷ কুবেরের কী উত্তর হবে তা অনুমান করে নিয়ে তুমি আগাম বলে দাও আমাকে কী করতে হবে৷’’

শিব বললেন–‘‘আহাহা! ৰেচারা ৰারবার কেনই বা আমার জন্যে তপস্যা করবে! আহাহা বেচারা ......... মোহগ্রস্ত ৰেচারা!’’

শিব কিপ্ঢেকঞ্জুসকে বললেন–‘‘ওই যে দিগন্তবিস্তৃত অরণ্যানী*১ তুই নাকের সোজা ওর ভেতর দিয়ে এগিয়ে চলতে থাক৷ কথাটা আমি কুবেরকে জানাব৷ সে দরকারমত ব্যবস্থা করবে৷’’

কিপ্ঢেকঞ্জুস এগিয়ে চলল..........এগিয়ে চলল তার অশেষ গতিতে৷ গাছপালা সে দেখছে না...........গাছপালা নিয়ে গবেষণা করতে সে আসেনি৷ পশুপক্ষীর জীবন–চর্যার দিকেও সে তাকাচ্ছে না কারণ তাদের নিয়ে মাথা ঘামাবার সময় তার নেই৷ সে কি শিবঠাকুরের কথা ভাবছে না না না! শিবঠাকুর তখন তার কাছে পর্দার আড়ালে সরে যাওয়া জিনিস৷ সেকি কুবেরের কথা ভাৰছে–না, তাও নয়৷ সে ভাবছে কুবেরের ধন–সম্পদের কথা৷

কিপ্ঢেকঞ্জুস এগিয়ে চলেছে৷ তার বাঘের ভয় নেই......সাপের ভয় নেই........জল থেকে উঠে–আসা কুমীরের ভয় নেই৷ ধনসম্পদের মোহে সে আচ্ছন্ন৷ মোহের চশমায় তার দৃষ্টি অস্পষ্ট হয়ে গেছে৷ কে কী বলবে, কে কী ভাববে, তা ভাবার অবসর তার নেই৷ সে চলেছে......সে চলেছে.........অর্থগৃধ্ণুতার চরমত্বের দিকে৷ হঠাৎ কী যেন একটা দেখে কিপ্ঢেকঞ্জুস থমকে দাঁড়াল৷

সে তার চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না.....সামনে কড়ির*২ পাহাড়..........ডাইনে কড়ির পর্বত........ বাঁয়ে কড়ির টিলা........পেছনে কড়ির ঢ়িবি৷ সে জয় ঘোষণা করলে কিন্তু কার জয় শিবের জয় নয়......কুবেরের জয় নয়......কড়ির জয়! পরক্ষণেই সে ভাবলে–কড়ির আর দাম কতটুকু! সঙ্গে তো তার রয়েছে ছটা পকেট–কোটের চারটে পকেট আর প্যান্টের দুটো পকেট, ছটা পকেট–ভরতি কড়ি নিলেও তার দাম এমন কিছু হবে না৷কিপ্ঢেকঞ্জুস কড়িকে খারিজ করে এগিয়ে চলল৷

*১      ৰৃহৎ অরণ্য এই অর্থে অরণ্যানী৷ ৰৃহৎ হিম অর্থাৎ অনেকদূর পর্যন্ত বিস্তৃত হিম এই অর্থে হিমানী৷ কিন্তু ৰৃহৎ যবন এই অর্থে ‘যবনানী’ নয়, ‘যবনানী’ মানে যবনের লিপি বা লেখা৷ ‘অরণ্যানী’ শব্দ শুদ্ধ হলেও ‘বনানী’ শব্দ শুদ্ধ নয়৷

*২      কড়ির জন্যে সংস্কৃতে অনেকগুলি শব্দ থাকলেও কটিকা ও ক্কথিকা–এই দুটো শব্দই ৰেশী প্রচলিত৷ প্রাচীনকালে হাটেৰাজারে লেনদেনে কড়িই ৰেশী চলত৷ তাম্রমূদ্রা অচল ছিল না৷ তবে ৰাজার–চালু তাম্রমুদ্রার সংখ্যা বা পরিমাণ ছিল কম৷ কড়ি তৈরীর জন্য টংকশালার (টাঁকশালার) দরকার পড়ে না৷ তাই লেনদেনে ছিল তারই অৰাধ ব্যবহার৷ খুব ৰেশী দামী জিনিসের লেনদেনে টংকক (টাকা) বা রৌপ্যকম্ (রূপেয়া) ব্যবহার করা হত৷ এই টংকক বা রৌপ্যকমের সঙ্গে সাধারণ মানুষের বিশেষ যোগাযোগ ছিল না৷ এমনকি সাধারণ মানুষ অনেক সময় কড়ির ব্যবহার না করে অদলবদল প্রথায় কাজ চালাত৷ এই ‘অদলবদল’ শব্দটি আমাদের ছোটৰেলায় রাঢ়ে ব্যাপকভাবে ব্যবহূত হত৷ ছোটৰেলাতে তাই দেখেছি এক কুনকে চালের বিনিময়ে শাক–মাছ–তরীতরকা নানান জিনিস কেনা চলত৷ বীরভূমের খয়রাসোল থানায় দেখেছি ছুতোর কাঠের পিলশুজ তৈরী করে হাটে বসে চালের বিনিময়ে তা ৰেচছে৷ আধুনিক যুগের ৰার্টার ব্যবসায় প্রথাও কতকটা এই ধরনের৷

তা যাই হোক রূপোর টাকার ব্যবহার খুবই অল্পই ছিল৷ মুদ্রা মানে সোনাই চলত৷ কিন্তু ৰাজারে সাধারণ লেনদেনে সোণা বা স্বর্ণমুদ্রার (সীনক) ব্যবহার ছিল না৷ সাধারণ মানুষের জীবনের সঙ্গে তাই কড়ি অচ্ছেদ্যভাবে জড়িত থাকত৷ আগেকার দিনে মেয়েরা যে লক্ষ্মীপুজো করতেন তাতে লক্ষ্মীর ঝাঁপিতে অবশ্যই কড়ি থাকত৷ আমাদের ছোটৰেলায় কোলকাতায় দেখতুম বিয়েতে ৰরণের সময় ৰরকে বলা হত ঃ

‘‘কড়ি দিয়ে কিনলুম, দড়ি দিয়ে ৰাঁধলুম,

হাতে দিলুম মাকু একবার ভ্যা কর তো ৰাপু৷’’

জানি না কোনো কোনো ৰোকা ৰর সত্যিসত্যিই ভ্যা করত কিনা৷ এখনও আমরা ব্যবহারের ভাষায় টাকাকড়ি, পয়সাকড়ি, মাইনেকড়ি বলে থাকি, যদিও কড়ি ৰড় একটা চোখে দেখি না৷

যেসব মায়েদের মৃতবৎসা রোগ ছিল তারা সন্তান যাতে না মরে সেইজন্যে ভূমিষ্ঠ হৰার সঙ্গে সঙ্গে সন্তানকে ধাইকে (দাই–প্পন্স্তুভ্রন্ন্দ্রন্দ্ব, সংস্কৃতে ‘ধাত্রী’) দান করত৷ তারপর যেন অন্যের ছেলেকে কিনছে এই রকম ভান করে সেই ধাইয়ের কাছ থেকে একটা কড়ি, তিনটে কড়ি, পাঁচটা কড়ি, সাতটা কড়ি বা ন’টা কড়ি দিয়ে কিনে নিত৷ আর সন্তানেরও নাম ঠিক তেমনি রাখা হত৷ সেকালে কড়ি নিয়ে বেচাকেনা চলত বলেই ছাত্রদের অঙ্ক শিখবার সময় কড়াক্রান্তি শিখতে হত৷

নববর্ষের শপথ

লেখক
কৌশিক খাটুয়া

শুধু আত্ম মোক্ষ নয়কো কাম্য

ভেদাভেদ হীন সমাজে সাম্য

 গড়িতে এসেছি আজ,

জগদহিতার্থে যাহা করণীয়

মরন সেথায় হোক বরণীয়

 রণং দেহি সাজ!

আর ঘুম নয়, হোক জাগরণ

স্থিতিশীল হয় যেন আমরন

পূব দিগন্তে নবীন সূর্যোদয়,

 সুষ্ঠু সমাজ গড়িবার দায়

 সৎ মানুষের পর বর্তায়

মাথার উপর স্রষ্টার বরাভয়৷

শোষন মূক্ত মানব সমাজ

ভ্রাতৃপ্রীতির স্থায়ী বিরাজ

 অনুশাসনের ধারাগুলি

 পায় যেন মান্যতা,

কোমলে কঠোরে হৃদয়ে সুপ্ত

 মানবিক উদারতা!

বুদ্ধির জগতে বোধির জগতে

 মানুষ শ্রেষ্ঠ জীব,

দুঃসাহসের ইতিহাস বলে

 ছিল না মানুষ ক্লীব৷

নিঠুর মরন চোখ রাঙিয়ে

 মোর পানে যদি ধায়,

তবু কৃতজ্ঞ চিত্তে বীরত্ব স্মরণ

 বিনম্র শ্রদ্ধায়!

শত শহীদের উত্তর শাখায়

 ভরে আছে এ ভূবন,

তুমি কি জাননা তব শোণিত

ধারায় সুপ্ত সংগামী মন!

নিজ পৌরুষ জাগরণে হোক

 বিপ্লবের শুভ বোধন,

নিজ অধিকার বুঝে নিতে

 হতে হবে সচেতন৷

কায়েমী স্বার্থ সিদ্ধির তরে

 পুঁজিবাদী চক্রান্ত,

ভেদবুদ্ধির প্রাচীর ভাঙ্গিয়া

 হও সমুখে অতিক্রান্ত৷

পরমপিতার আশীষ মাথায়

 নববর্ষের শপথ,

সার্বজনীন কল্যান কাজে

 নিয়োজিত জনপদ৷

নব্যমানবতাবাদকে স্বাগত জানায়

 নববর্ষের নবারুণ,

বিশ্বসমাজ দেখিবার লাগি

 নিশীথে তারার নাই ঘুম৷

মানব সমাজ, তরুলতা,

 প্রাণীদের প্রতি দায়,

নব্যমানবতা রূপায়ণ

 মানুষের পর বর্তায়৷

নব অভিযান

লেখক
প্রণবকান্তি দাশগুপ্ত

বিষাক্ত কন্টকপথে পণ করে’ প্রাণ

শুরু হলো আমাদের নব অভিযান৷

মান নেই, খ্যাতি নেই,

নেই সমর্থন---আছে জ্বালা,

আছে ব্যঙ্গ ---সহস্র বন্ধন৷

শুভ কাজে যত শুনি তিক্ত অপবাদ

অট্ট হেসে তত পাই রোমাঞ্চের স্বাদ!

ড্রাগনেরা ঘিরে আছে প্রগতির পথ

সংগ্রামে প্রস্তুত আছি---নিলাম শপথ৷

জীবন-সংকটে কভু হটবোনা পিছে,

পেয়েছি অভ্রান্ত পথ মৃত্যুভয় মিছে!

মাঝপথে যদি নামে দুর্র্যেগের রাতি,

যদি ওঠে ক্ষুব্ধ ঝঞ্ঝা নাহি রয় সাথী

আমাদের অভিযান থামবে না তবু---

তিলে তিলে দেবো প্রাণ

দমবো না কভু৷৷

বাঙলা ভালো নাই

লেখক
সাক্ষীগোপাল দেব

ওপার বাংলা কেমন আছো?

এপার ভালো নাই,

ভায়ে ভায়ে বেশতো ছিলাম

(আজ) ভিন্ন ভিন্ন ঠাঁয়৷

বাংলা মায়ের কোল ছাড়া আজ

থাকি দূরে দূরে

কেন হলাম ছন্নছাড়া---

কেন গো ভবঘুরে৷

নদী, পাহাড় সবই ছিল

ছিল সাগর ঝর্ণা,

শস্য শ্যামলীমায় ভরা

মা ছিল সম্পূর্ণা৷

কোথায় গেল সে সব সুদিন

গোলাভরা ধান,

পুকুরভরা মাছের খেলা

বরজভরা পান৷

হায়রে কারা করল এমন

দেশের সর্বনাশ,

ঘর থাকতেও ঘর হারিয়ে

দেশান্তরে বাস৷

আর কতকাল রইবে ঘুমে

বাংলার সন্তান,

আমরা বাঙালী হোক পরিচয়

নই হিন্দু-মুসলমান৷

গাজনের গপ্পো

লেখক
প্রণবকান্তি দাশগুপ্ত

শিব নাকি শ্রাবণ মাসে জন্মেছিলেন৷ আর বিয়ে করেছিলেন চৈত্র মাসের শেষের দিকে৷ বিয়ে হয়েছিল নীল চণ্ডিকার সঙ্গে৷ তাই চৈত্রমাসের শেষে হিন্দু নারীরা নীলের উপোস করে৷ আর তার সঙ্গে গাজন উৎসব শুরু হয়৷ শিবের বিয়ে উপলক্ষে সন্ন্যাসীরা ছিলেন বরযাত্রী৷ বরযাত্রীরা মাঝে মাঝে গর্জন করতেন৷ সেই গর্জন থেকে ‘গাজন’ শব্দের উৎপত্তি৷

না, শিবের বিয়ে নীল চণ্ডিকার সঙ্গে হয়নি৷ শিবের বিয়ে প্রসঙ্গে শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তি বলেছেন---‘সেকালে বহু বিবাহের প্রচলন ছিল৷ শিবেরও তিন স্ত্রী ছিলেন৷ আর্যকন্যা পার্বতী, অনার্য কন্যা কালী, আর মঙ্গোলীয় কন্যা গঙ্গা৷’ (তন্ত্রই সাধনা সাধনাই তন্ত্র)

কেউ কেউ বলেন, গাজনের শেষ দিনে হয় চড়ক৷ মাটিতে চড়কের গাছ পুঁতে তার মাথায় আড়ভাবে একটা বাঁশ এমনভাবে বাঁধা হয় যাতে পাক খাওয়া যায়৷ আগে সন্ন্যাসীরা পিঠে লোহার বড় বড়শি বিঁধিয়ে বাঁশের শেষ অংশ থেকে ঝুলে পাক খেতো৷ এই নৃশংস প্রথাটিকে ইংরেজ সরকার ১৮৬৫ সালের ১৫ই মার্চ আইন করে বন্ধ করে দেন৷ তখন থেকে সন্ন্যাসীরা বুকে গামছা বা কাপড় বেঁধে চড়ক গাছে ঘুরপাক খেতে আরম্ভ করেন৷ চড়ক গাছটি হওয়া চাই শক্ত৷ নচেৎ ভেঙে পড়তে পারে৷ তাই শাল বা গজারি ব গর্জন গাছের একটি খুঁটি বছর খানেক পুকুরের জলে ডুবিয়ে রাখা হয়৷ গাজনের আগের দিন ভক্তরা সেই খুঁটি জল থেকে তুলে বেশ করে তেল মাখিয়ে মাটিতে পোঁতে৷ একে বলে গাছ জাগানো৷ এই গর্জন গাছের সাহায্যে অনুষ্ঠান হয় বলেই হয়তো উৎসবের নাম গাজন৷

আবার বর্তমানকালের পণ্ডিতগণ বলেন, সার্বজনীন ভাবনা থেকে গাজন শব্দের উৎপত্তি৷ গ্রামের সকলে মিলে এই উৎসবে অংশগ্রহণ করতো বলে এই উৎসবের নাম গাজন৷ গ্রাম+ জন= গা+ জন= গাজন৷

এ প্রসঙ্গে শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তি বলেছেন ---‘অন্ততঃ একদিন প্রাণভরে চীৎকার করে শিবের নামে গর্জন করি, ‘শিব হে’ বলে মানুষকে আহ্বান করি৷ গর্জন> প্রাকৃতে গজ্জন> বর্তমান বাংলায় ‘গাজন’৷             (নমঃ শিবায় শান্তায়)৷

ফুল ফোটে তোমার তরে

লেখক
কৌশিক খাটুয়া

কত শত কুঁড়ি ফুল হয়ে ফুটে

 কত ফুল যায় ঝরে,

ফুল ফুটে শুধু ঝরিবার তরে

 যা’ ছিল উজাড় করে৷

সৃষ্টিকর্তার অপরূপ সৃষ্টি

 সৃষ্ট সকল ফুল,

রূপে গুনে তার মুগ্দ জগত

 নাই তার সমতুল৷

কল্যাণকর কাজে নিয়োজিত

তোমার সেবায় হাসে দুর্গত,

তুষ্ট তারা, যারা নিপীড়িত

বিশ্ববিধাতা তাই এত প্রীত!

 যা’’ কিছু তোমার আছে বৈভব

 বিধির চরণে দিলে অকাতরে

এক শুভদিনে মাহেন্দ্রক্ষণে

ঠাঁই পরমপিতার স্নেহময় ক্রোরে,

 মানব জনম সার্থক করে!

সাজানো পৃথিবী মিলন মেলা

সবাই প্রিয়জন নয় অবহেলা,

 তাদের নিত্য গমনাগমন

জানিনা কখন কেঁদে ওঠে মন!

যাওয়া-আসা সেতো তাঁর অভিপ্রায়

 আছে স্নেহভরা প্রীতি,

কাছের মানুষ দূরে চলে যায়

 রেখে যায় শুধু স্মৃতি৷

 প্রতিদিন কত জনম মরন

 অশ্রু হাসি সকলই স্বাগত,

 যেটুকু সময় আছি এ জগতে

তাঁর সেবা কাজে যেন থাকি রত৷

প্রিয়তম তুমি মোর

লেখক
কৌশিক খাটুয়া

থাকো অবিকার নয় নিরাকার

উপলব্ধিতে তোমাকে চাই,

পঞ্চেন্দ্রিয়র ঊর্দ্ধলোকেতে

কৃপা করে লহ হৃদয়ে ঠাঁই৷

 

নিত্য নূতন তুমি সনাতন

অপরিণামদর্শী তোমাকে মানি,

অনু থেকে ধরা পরিচালনায়

অলক্ষ্যে রত তাহাও জানি৷

 

সব কাজে আছো ধরায় বিরাজো

সে’ কথা কাহারো অজানা নয়,

ছাড়িতে চাহিলে ছেড়ে নাহি যাও

 তবে কেন পাই অযথা ভয়!

 

রয়েছো আমার আবেগ উদ্বেগে

 শত ভাবনার মধ্য মনি,

হাসি-ক্রন্দনে প্রেম-বন্ধনে

অন্ধ বিবরে হীরকের খনি!

 

শত সমস্যা যবে বোঝা হয়

পাহাড়-প্রমাণ অচলায়তন,

তব কৃপা কণা অপার করুণা

সহজ সমাধানে করিয়া যতন৷

 

না বলে এসেছো অচেনা অতিথি

ভাবে-অভাবে ঢালো প্রেম-প্রীতি,

বিশুষ্ক মনে ঢেলে দিলে গীতি

 কোন জনমের পূণ্য ফলে!

এসেছো যখন থাকো কিছুক্ষণ

পথের নিশানা যাওগো বলে৷

 

এত ভাব দিলে এত ভাষা দিলে

 এত সুর এত গান

যে গান শ্রবণে ভরে মন-প্রাণ

 আলোড়িত ধরাধাম!

 

ছিনু নিদ্রামগ্ণ তন্দ্রাচ্ছন্ন

 জড়তা জড়ানো সুপ্তিতে,

ভরিল এমন আলোর প্লাবন

 ভাবালোকের দীপ্তিতে৷

 

অলোক ভূলোক গোলক জানিনা

 প্রতি পলে পলে তোমাকে চাই,

আলো ঢেলে দাও আঁধার ঘুঁচাও

 তোমার চরণে লইব ঠাঁই৷