শ্রবণ, মনন ও নিদিধ্যাসন
শাস্ত্রীয় নির্র্দেশ অনুযায়ী মানুষের উন্নতির জন্যে তিনটি তত্ত্ব আবশ্যক৷ তিনটি তত্ত্ব কী?–না, শ্রবণ, মনন ও নিদিধ্যাসন৷ প্রথমে দেখা যাক্–শাস্ত্র বলতে কী ক্ষোঝায়?
শাস্ত্রীয় নির্র্দেশ অনুযায়ী মানুষের উন্নতির জন্যে তিনটি তত্ত্ব আবশ্যক৷ তিনটি তত্ত্ব কী?–না, শ্রবণ, মনন ও নিদিধ্যাসন৷ প্রথমে দেখা যাক্–শাস্ত্র বলতে কী ক্ষোঝায়?
অনেক সময় দেখা যায়, মানুষ বর্তমান বা ভবিষ্যতের চেয়ে অতীত নিয়েই বেশী মাথা ঘামায়৷ অনেককেই অনেক সময় বলতে শোণা যায়, ‘হে ঈশ্বর, আমি পাপী, তুমি আমাকে ত্রাণ করো’ এই ধরনের চিন্তা তন্ত্রসম্মত নয় কারণ ‘যাদৃশী ভাবনা যস্য সিদ্বির্ভবতি তাদৃশী’৷ যে নিজেকে সর্বদা পাপী ভাবে, সে যদি পাপী নাও হয়, তবু যদি সে ভাবে, ‘আমি পাপী, আমি পাপী’---এই রকম ভাবতে ভাবতে সে পাপী হয়ে যাবে৷ সুতরাং এ ধরনের চিন্তা খুবই খারাপ৷ বরং এটাই ভাবা উচিত, আমি পাপী ছিলুম, আজ আর পাপী নই, কারণ আমি ঈশ্বরের শরণে এসেছি, আমার পাপ কোথায় থাকবে?
আজ একজন সাধক মনকে একাগ্র করার পদ্ধতি সম্বন্ধে জানতে চেয়েছিল৷ তার প্রশ্ণ ছিল কীভাবে মন একাগ্রতার চরমাবস্থায় পৌঁছতে পারবে এর উত্তর সব সাধকেরই জানা উচিত৷ ৰৌদ্ধিক বিচারে প্রতিটি জীবই তিন শ্রেণীভুক্ত–পশু, মানব ও দেবতা৷ আধ্যাত্মিক সাধনা হ’ল এক বিশেষ অভ্যাস যা পশুত্ব থেকে মানবত্বে ও মানবত্ব থেকে দেবত্বে প্রতিষ্ঠিত করে৷
অনেক সময় দেখা যায়, মানুষ বর্তমান বা ভবিষ্যতের চেয়ে অতীত নিয়েই বেশী মাথা ঘামায়৷ অনেককেই অনেক সময় বলতে শোণা যায়, ‘হে ঈশ্বর, আমি পাপী, তুমি আমাকে ত্রাণ করো’ এই ধরনের চিন্তা তন্ত্রসম্মত নয় কারণ ‘যাদৃশী ভাবনা যস্য সিদ্বির্ভবতি তাদৃশী’৷ যে নিজেকে সর্বদা পাপী ভাবে, সে যদি পাপী নাও হয়, তবু যদি সে ভাবে, ‘আমি পাপী, আমি পাপী’---এই রকম ভাবতে ভাবতে সে পাপী হয়ে যাবে৷ সুতরাং এ ধরনের চিন্তা খুবই খারাপ৷ বরং এটাই ভাবা উচিত, আমি পাপী ছিলুম, আজ আর পাপী নই, কারণ আমি ঈশ্বরের শরণে এসেছি, আমার পাপ কোথায় থাকবে?
মানুষের করণীয় কী জীবন একটা ব্রত৷ আমি বলেছি মানুষের জীবন একটা আদর্শের ধারাপ্রবাহ বিশেষ৷ অর্থাৎ মানব জীবন একটা ব্রত–জীবন মানেই ব্রত অস্তিত্ব মানেই ব্রত৷ ‘‘আত্মমোক্ষার্থং জগদ্ধিতায় চ’’–মানুষ যা–ই করুক না কেন, তা করা উচিত আত্মমোক্ষের জন্যে–তার নিজের মোক্ষের জন্যে, আর করা উচিত সমগ্র বিশ্বের উন্নতির জন্যে৷ মানুষের এই দু’টো কাজ করতে হবে অর্থাৎ মানুষের ব্রত হচ্ছে এই দু’টো কাজ৷
শ্রীমদ্ভাগবত গীতার একটি শ্লোক উদ্ধৃত করে ৰলেছিলুম,
‘‘যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত৷
অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্৷৷’’
এখানে ‘যদা যদা’ কথার মানে কী? এখানে ‘যদা’ শব্দের অর্থ হচ্ছে যথোপযুক্ত কালে, ঠিক সময়ে৷ তোমরা জান যে প্রত্যেকটি কাজের জন্যে, প্রত্যেক কর্তব্যের জন্যে সবচেয়ে উপযুক্ত সময় থাকে, মাহেন্দ্রক্ষণ থাকে৷ সেটাই সেই বিশেষ কর্তব্য সম্পাদনের জন্যে উপযুক্ত সময়৷ বিভিন্ন ধরণের ফল-ফসল লাগাবার জন্যে একটা বিশেষ সময় থাকে আবার পাকা ফসল ঘরে তোলবার জন্যেও একটা বিশেষ সময় থাকে৷ সেই বিশেষ সময়টাই বিশেষ ধরণের কাজের জন্যে সবচেয়ে বেশী উপযুক্ত সময় ৰলে গণ্য হয়৷
মানুষের অভীষ্ট পরমপুরুষকে লাভ করতে জ্ঞান, কর্ম, ভক্তি তিনেরই প্রয়োজন৷ জ্ঞান ও কর্মের মাধ্যমে ভক্তির জাগরণ হয়৷ আর এই ভক্তিই মানুষকে ভুমানন্দ প্রাপ্তির পানে নিয়ে চলে৷
ভক্তি ত্রুটি থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত কিন্তু জ্ঞান ও কর্ম তা নয়৷ জ্ঞানলাভ প্রায়শঃই মানুষকে অলস ও অহংকারী রূপে তৈরী করে৷ আর কর্মও মানুষের মধ্যে আনে আত্মম্ভরিতা৷ সাধক এই দু’য়ের ত্রুটি থেকে মুক্ত হতে না পারলে কেবলা ভক্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয় না যা পরমপুরুষকে পাবার জন্যে অতীব প্রয়োজন৷ তাই ৰুদ্ধিমান সাধক সেই উপায়ই অবলম্বন করবে যা তাকে জ্ঞান ও কর্মের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে মুক্ত রাখবে৷
মানুষের অভীষ্ট পরমপুরুষকে লাভ করতে জ্ঞান, কর্ম, ভক্তি তিনেরই প্রয়োজন৷ জ্ঞান ও কর্মের মাধ্যমে ভক্তির জাগরণ হয়৷ আর এই ভক্তিই মানুষকে ভুমানন্দ প্রাপ্তির পানে নিয়ে চলে৷
ভক্তি ত্রুটি থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত কিন্তু জ্ঞান ও কর্ম তা নয়৷ জ্ঞানলাভ প্রায়শঃই মানুষকে অলস ও অহংকারী রূপে তৈরী করে৷ আর কর্মও মানুষের মধ্যে আনে আত্মম্ভরিতা৷ সাধক এই দু’য়ের ত্রুটি থেকে মুক্ত হতে না পারলে কেবলা ভক্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয় না যা পরমপুরুষকে পাবার জন্যে অতীব প্রয়োজন৷ তাই ৰুদ্ধিমান সাধক সেই উপায়ই অবলম্বন করবে যা তাকে জ্ঞান ও কর্মের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে মুক্ত রাখবে৷
চিতিশক্তির মহাজাগতিক ৰন্ধনে সবাই ৰদ্ধ৷ যতক্ষণ সৃষ্টি আছে, পরমপুরষেরও প্রতিটি বস্তুর সঙ্গে ওতযোগ ও প্রোতযোগের ৰন্ধন রয়েছে৷ কেউ যদি বলে যে অন্য কারোর তার প্রয়োজন নেই, আমি একলাই থাকব, কারোর সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই– এটা বলা তার পক্ষে অনুচিত কাজ হবে৷ পৃথিবীতে কেউ একলা থাকতে পারে না৷ দেখ, তোমার জলের প্রয়োজন, তার জন্যে তুমি কি কোদাল নিয়ে মাটি খুঁড়ে একা একাই কুঁয়ো বানিয়ে দেবে তোমার জুতোর প্রয়োজন এরজন্যে নিজেই জুতো তৈরী করতে বসে যাবে বস্ত্রের প্রয়োজন, তাই নিজেই বস্ত্র তৈরীতে লেগে যাবে – না, এটা সম্ভব নয়৷ সকলেই সকলের ওপর নির্ভরশীল৷
...‘‘ঈশ্বর–প্রণিধান’’ জিনিসটা... দাঁড়াচ্ছে–মনকে সেই পরমাশ্রয়ে প্রতিষ্ঠিত করবার জন্যে তাঁর পানে ছুটিয়ে নিয়ে চলা৷ তাই ঈশ্বর–প্রণিধান জিনিসটা সম্পূর্ণ ভাবাশ্রয়ী–সম্পূর্ণতই একটা মানস ঙ্মআধ্যাত্মিকৰ প্রচেষ্টা৷ এতে চীৎকার করে লোক জড় করবার বা ঢ়াক–ঢ়োল পিটিয়ে ভক্তি দেখাবার অবকাশ নেই৷....
সহজ নৈতিকতায় যেখানে বিচারের সমর্থন এসে গেল, তখন সেটা হয়ে গেল আধ্যাত্মিক নৈতিকতা (spiritual morality)৷ যেখানে জ্ঞান–ৰুদ্ধির স্ফূরণ হতে থাকে, সেই অনুযায়ী আধ্যাত্মিক নৈতিকতা আর অনৈতিকতার মধ্যে পার্থক্য এসে যায়৷ এইজন্যে যদিও আধ্যাত্মিক নৈতিকতা সহজ নৈতিকতার মতই সাপেক্ষিক কিন্তু আধ্যাত্মিক নৈতিকতার মধ্যে বাহাদুরী আছে৷ এই বাহাদুরী বা বিশেষত্ব কী এটা স্থূল জগতের সঙ্গে পরমাত্মাকে সম্পর্কিত করে, সম্বন্ধিত করে৷ এটাই হচ্ছে এর বিশেষত্ব৷ যেরকম, মানসলোকে মনের ভাব আর পরমাত্মার ভাব, এই দুইয়ের মধ্যে সম্পর্ক নির্ণয় করার যে কলা তাকেই আমরা সাহিত্যের ভাষায় মিষ্টিসিজম্ বলি৷ হিন্দীতে একে বলা হয় রহস্যবাদ৷ রহস্যবাদ
ৰ্রহ্মাস্মি বিজ্ঞান যদি কেবল শাব্দিক স্তরে সীমিত থাকে, তাতেও কোন কাজ হবে না৷ এ জন্যে ‘সোহং’ মন্ত্রের পরিচ্ছেদহীন ভাবনা নিতে হবে৷ এই যে অ–পরিচ্ছিন্ন ভাবনা, এ ভাবনা বাচনিক জপে সম্ভব নয়৷ মানস তথা অধ্যাত্মসাধনার এই যে সূক্ষ্মবিজ্ঞান, এটা তন্ত্রেরই আবিষ্কার ঙ্মতন্ত্র ও যোগের মধ্যে মূলতঃ কোন পার্থক্য নেই৷ তন্ত্রেরই সূক্ষ্মতর সাধনার নাম যোগমার্গৰ৷ সাধনামার্গে জপক্রিয়া ও ধ্যানক্রিয়া মহাকৌলেরই ব্যবস্থা৷ কেবল জপেও কোন কাজ হবে না, যদি মন্ত্রের গতিধারার সঙ্গে মনের গতিধারা সমান তালে না চলে৷ মনে মনে জপও করছি, আবার তার সঙ্গে অন্যের ক্ষতির চিন্তাও করছি–এ ধরনের জপ নিষ্ফল৷ জপক্রিয়ায় সাফল্য লাভ করতে গেলে সমস্
পরমপুরুষের পরম রচনাত্মক শক্তি নিজ আন্তরিকতা তথা ভূমামনের চেতনাশক্তির সাহায্যে ভৌতিক জগতের জড় অথবা জীব সত্তার বিভিন্ন রূপ প্রদান করে থাকে৷ প্রত্যেক বস্তু তাঁরই রচনা, প্রত্যেক বস্তু তাঁরই দ্বারা সংরক্ষিত ও পালিত হয়ে থাকে৷ শেষ পর্যন্ত তাঁরই কারণে বিরাট ভূমামনে সমস্ত জাগতিক সত্তার অন্তিম পরিণতি ঘটে যায়৷ অর্থাৎ পরমসত্তার মানসিক আধার ভূমিতে সব কিছুর লয় হয়ে যায়৷ এই কারণে আমি বলি কোন বস্তুই ক্ষুদ্র নয়, কোন বস্তুই অনাবশ্যক নয়৷ যদি অগুন্তি প্রোটোপ্লাজম দ্বারা এই সামূহিক শরীর তৈরী হয়ে থাকে, তাহলে তোমার মনও একটি সামূহিক মন৷ এছাড়া প্রত্যেক প্রোটোপ্লাজম একটি
তোমরা জান যে প্রাচীনকাল থেকেই ‘কার্য ও কারণ’ তত্ত্ব প্রচলিত আছেঙ্গ এটা একটা নিশ্চিত সত্য যে যেখানেই কার্য আছে সেখানে তার কারণ অবশ্যই থাকবেঙ্গ মহর্ষি কণাদ্ এই তত্ত্বের প্রবক্তাঙ্গ তিনিই প্রথম বলেন যে কার্য থাকলে তার কারণ থাকবেইঙ্গ আমরা কারণ জানতেও পারি, নাও জানতে পারি কিন্তু কারণ আছেইঙ্গ তাহলে তোমরা ৰুঝলে প্রতিটি কার্যের পিছনে কারণ থাকবে কিন্তু যেখানে কারণ আছে সেখানে কার্য থাকতেও পারে আবার নাও পারেঙ্গ
...ব্রহ্মাস্মি বিজ্ঞান যদি কেবল শাব্দিক স্তরে সীমিত থাকে, তাতেও কোন কাজ হবে না৷ এ জন্যে ‘সোহং’ মন্ত্রের পরিচ্ছেদহীন ভাবনা নিতে হবে৷ এই যে অ–পরিচ্ছিন্ন ভাবনা, এ ভাবনা বাচনিক জপে সম্ভব নয়৷ মানস তথা অধ্যাত্মসাধনার এই যে সূক্ষ্মবিজ্ঞান, এটা তন্ত্রেরই আবিষ্কার (তন্ত্র ও যোগের মধ্যে মূলতঃ কোন পার্থক্য নেই৷ তন্ত্রেরই সূক্ষ্মতর সাধনার নাম যোগমার্গ)৷ সাধনামার্গে জপক্রিয়া ও ধ্যানক্রিয়া মহাকৌলেরই ব্যবস্থা৷ কেবল জপেও কোন কাজ হবে না, যদি মন্ত্রের গতিধারার সঙ্গে মনের গতিধারা সমান তালে না চলে৷ মনে মনে জপও করছি, আবার তার সঙ্গে অন্যের ক্ষতির চিন্তাও করছি–এ ধরনের জপ নিষ্ফল৷ জপক্রিয়ায় সাফল্য লাভ করতে গেলে সমস
বলা হয়েছে, পরমাত্মার কৃপা হলে ‘মূকং করোতি বাচালং পঙ্গুং লঙঘয়তে গিরিম্’৷ অর্থাৎ যে মূক–বোবা সেও বাচাল হয়ে যায়, খুব কথা বলতে থাকে, আর পঙ্গুও পর্বত লঙঘন করতে পারে৷ পরমপুরুষের কৃপাতেই যে তা সম্ভব, এটা খুব সহজেই ৰোঝা যায়৷ কিন্তু আমি বলতে চাই– যে কোনো কাজই, মনে কর, মূক হয়তো বাচাল হচ্ছে না, কিন্তু কিছুটা কথা বলছে, পঙ্গু পর্বত লঙঘন করছে না, কিন্তু ধীরে ধীরে পাহাড়ে উঠছে– এটা কি মানুষ তার নিজের শক্তির সাহায্যে করে পঙ্গুর গিরিলঙঘন যেমন তার নিজের শক্তির সাহায্যে সম্ভব নয়, তেমনি যে বৃদ্ধ মানুষটি ধীরে ধীরে হাঁটছে, সেও নিজের শক্তির সাহায্যে চলছে না৷ তার পায়ে যে সামান্য শক্তিও আছে, লাঠির সাহায্যে সে যে চলছ
মানুষের অভীষ্ট পরমপুরুষকে লাভ করতে জ্ঞান, কর্ম, ভক্তি তিনেরই প্রয়োজন৷ জ্ঞান ও কর্মের মাধ্যমে ভক্তির জাগরণ হয়৷ আর এই ভক্তিই মানুষকে ভুমানন্দ প্রাপ্তির পানে নিয়ে চলে৷
ভক্তি ত্রুটি থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত কিন্তু জ্ঞান ও কর্ম তা নয়৷ জ্ঞানলাভ প্রায়শঃই মানুষকে অলস ও অহংকারী রূপে তৈরী করে৷ আর কর্মও মানুষের মধ্যে আনে আত্মম্ভরিতা৷ সাধক এই দু’য়ের ত্রুটি থেকে মুক্ত হতে না পারলে কেবলা ভক্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয় না যা পরমপুরুষকে পাবার জন্যে অতীব প্রয়োজন৷ তাই ৰুদ্ধিমান সাধক সেই উপায়ই অবলম্বন করবে যা তাকে জ্ঞান ও কর্মের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে মুক্ত রাখবে৷
ধর্ম বৈবহারিক, সৈদ্ধান্তিক নয়৷ কে ধার্মিক, কে ধার্মিক নয়–তা তার বিদ্যা, ৰুদ্ধি বা পদমর্যাদা থেকে প্রমাণিত হয় না৷ কে ধার্মিক তা প্রমাণিত হয় তার আচরণ থেকে৷ কে অধার্মিক তাও প্রমাণিত হয় তার আচরণ থেকে৷ যে ধার্মিক হতে চায়, তাকে তার আচরণ ঠিক করতে হবে৷
মানুষের সামনে দুটি পথ–একটি শ্রেয়ের পথ, অন্যটি প্রেয়ের পথ৷ প্রেয়ের পথে মানুষ পায় ক্ষণিক সুখ, আর শেষে দুঃখ৷ আর শ্রেয়ের পথে চললে তাতে সাময়িক দূঃখ–ক্লেশ এলেও শেষপর্যন্ত সেই পথেই মানুষের ৰৃহত্তর কল্যাণ সাধিত হয়৷ মানুষ যখন প্রেয়ের পথ ধরে তখন সে যুক্তির দ্বারা পরিচালিত না হয়ে সেন্টিমেন্টের (ভাবপ্রবণতার) বশে চলে আর যখন শ্রেয়ের পথ নেয়,তখনও যুক্তির দ্বারা নয়, কল্যাণৰোধের ভাবনার দ্বারা প্রেষিত হয়ে চলে৷ ভাবে, এই যে পথে আমি চলেছি, কাজ করছি, এটা কল্যাণের পথ– মঙ্গলের পথ৷ এই পথেই জনসেবা–জনকল্যাণ সর্বাধিক হবে৷
জগতে যেসব বস্তুকে আমরা নিত্য বলে মানি তাদের নিত্যতাপ্রদানকারীও পরমপুরুষ৷ বস্তু হ’ল প্রতিফলিত সত্তা–রিফ্লেক্টেড এণ্টিটি৷ চেতন বস্তুর মনঃশক্তিও তাঁর থেকেই এসেছে৷ তিনি সকলের প্রয়োজনের পূর্তি ঘটান–পিঁপড়ে থেকে হাতী পর্যন্ত, ছোট ছোট জীব থেকে সমুদ্রের বড় বড় জানোয়ার পর্যন্ত সকলের৷ এতই উদার তিনি৷ সেইজন্যেই তিনি জগতের কর্তা, অধিকর্তা, প্রভু৷ এই রকম উদারতা লাভ করতে পারলে তুমিও তিনি হয়ে যাবে৷
যদিও পরমপুরুষ কালের পরিধির বাইরে তবুও তিনি যদি কালের গণ্ডিতে আবদ্ধ হন, তখন আমরা নোতুন কিছু পাই কি? পরমপুরুষ দেশ বা পাত্রেরও বাইরে কিন্তু এদের সংস্পর্শে তিনি যদি এসে গেলেন তাহলে কী হতে পারে?
তোমরা জান, যে ললিত-মার্মিক নৃত্যের সাহায্যে কীর্ত্তন করা হয় তা হ’ল বিশুদ্ধ আধ্যাত্মিক ভাবের নৃত্য, আর কৌশিকী হ’ল মানসাধ্যাত্মিক নৃত্য যার সূত্রপাত হয় মানসিক স্তরে ও শেষ পরিণতি আধ্যাত্মিক স্তরে৷ তাণ্ডব শারীরিক-মানসিক আধ্যাত্মিক নৃত্য৷
ললিত-মার্মিকে হাত দু’টিকে ৯০০-র বেশী কোণ তৈরী করে ওপরে রাখতে হয়৷ এতে বোঝা যায় যে এটি একটি মুদ্রা, যা সংস্কৃত শব্দ৷ এই মুদ্রার তাৎপর্য হচ্ছে ‘‘হে সৃষ্টিকর্তা, তুমি আমার৷ আমি তোমার, আমি একান্তভাবে তোমার৷’’
আমি অবশ্যই বর্তমান কালকে অস্বীকার বা অবহেলা করতে পারি না । এর অর্থ আমাকে অবশ্যই মনে রাখতে হবে আমি কোথায় আছি আর ঠিক বর্তমানে আমাকে কী করতে হবে । কিন্তু বর্তমান কাকে বলব?
আমরা জানি বর্তমান, অতীত আর ভবিষ্যতকে নিয়ে কাল তিনটি । এই তিন ধরনের কাল আসলে কী বস্তুতঃ বর্তমান কাল বলে ঠিক কোন কিছু নেই । আমি যখন কিছু বলি, তুমি ততক্ষণাৎ তা শুণতে পাও না । কিছুটা বিরতির পরে তুমি সেটা শুণতে পাও । তাহলে সেই বিরতিটা কী শব্দ বায়ুর দ্বারা বাহিত হয়ে কাণে পঁৌছতে যে সময় লাগে সেটাই বিরতি । আর যখন তা তুমি শোণ সেটা আমার কাছে কিন্তু অতীত, আর তোমার কাছে তা ভবিষ্যৎ কেননা অল্পক্ষণ পরে তুমি তা শুণতে পাচ্ছ ।
ভারতের ইতিহাসে মদালসা এক মহান চরিত্র৷ তিনি তার পুত্রের জন্যে দু’টি উপদেশ রেখে গিয়েছিলেন৷ প্রথম উপদেশ ছিল---জীবনে সব রকম সঙ্গই পরিত্যাগ করবে৷ যদি একান্তই তা না পার, তবে সৎসঙ্গ করবে৷ দ্বিতীয়টা ছিল---জীবনে সর্বপ্রকার কামনা বাসনাই ত্যাগ করবে৷ যদি একাস্তই তা না পার, তবে কেবল মোক্ষের বাসনা রাখবে৷
গুরু তিন প্রকারের, শিষ্যও তিন প্রকারের৷ মানুষের অভিব্যক্তিও তিন প্রকারের, বৈদ্যকেও তিন প্রকারের বলা হয়ে থাকে৷ অধম বৈদ্য তিনি, যিনি কেবল ওষুধ বলে দেন, মধ্যম বৈদ্য তিনি যিনি ওষুধ তো বলেই দেন, সঙ্গে সঙ্গে এটাও জেনে নেন যে রোগী সেটা ব্যবহার করতে পারবে কী না৷ যিনি উত্তম বৈদ্য তিনি ওষুধও বলে দেন, জেনেও নেন, আর সঙ্গে সেটা ব্যবহারের ব্যবস্থাও করে দেন৷ অধম ও মধ্যম স্তরের বৈদ্য বস্তুতঃ বৈদ্য নয়, কেবল উত্তম স্তরের বৈদ্যই বাস্তবিক বৈদ্য৷ সেই রকমই অধম স্তরের গুরু ভাল ভাল কথা শুণিয়ে দেন৷ মধ্যম স্তরের গুরুও ভাল কথা শুণিয়ে দেন, আবার তার সম্বন্ধে জেনেও নেন৷ উত্তম স্তরের গুরু ভাল কথা শুণিয়ে দেন, জিজ্ঞেস করে
আসলে মানুষ সুখও চায় না, দুঃখও চায় না....মানুষ চায় মানসিক শান্তি, মানসিক স্বস্তি৷ প্রাত্যহিক জীবনে মানুষ কত শত লোকের সংস্পর্শে আসে৷ মাঝে মাঝে কারো কারো সঙ্গে তার সংঘর্ষও বেধে যায়৷ তাহলে মানসিক শান্তি বা স্বস্তি সে পাবে কী করে
যারা অন্যের প্রতি অবিচার করে তাদের অন্যের কাছ থেকে অবিচার সইতেও হয়৷ যারা অবিচার করে তারা সংগ্রামকালে মানসিক ভারসাম্য খুইয়ে বসে৷ যারা অন্যের প্রতি অবিচার করে না তারা অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রামে মানসিক সন্তুলন বজায় রাখতে সক্ষম হয়৷ যারা মানসিক শান্তির অধিকারী তাদের এটা একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য৷
অনেকদিন আগে রাঁচীতে আমি স্মৃতি, মস্তিষ্ক সঞ্জাত স্মৃতি ও অমস্তিষ্ক সঞ্জাত স্মৃতি সম্বন্ধে কিছু বলেছিলুম৷
জানা মানে হ’ল একটা বিশেষ মানসিক প্রক্ষেপ৷ না-জানাও হ’ল আরেকটা বিশেষ ধরনের মানসিক প্রক্ষেপ৷ একটা ধনাত্মক, অপরটা ঋণাত্মক৷ সুতরাং দু’টোই মানসিক প্রক্ষেপ৷ তাই বেদে বলা হয়েছে
‘‘নাহং মনো সুবেদেতি নো ন বেদেতি বেদ চ৷
যো নস্তং বেদ তৎবেদ নো ন বেদেতি৷৷’’
বৈদিক ঋষি বলছেন, আমি এমন কথা মনে করছি না যে আমি জানি৷ আবার আমি এমন কথাও মনে করছি না যে আমি জানি না৷ কারণ, আমি জানি অথবা আমি জানি না---এই দুটোই মানসিক প্রক্ষেপ৷ আর যা’ পরম তত্ত্ব তা’ মানসিক তত্ত্বের ঊধের্ব৷ সুতরাং মানসিক ভাবনা অনুযায়ী বা মানসিক সামর্থ্য অনুযায়ী তাকে রূপ দেওয়া বা রূপান্তরিত করা সম্ভব নয়৷
আজকের আলোচনায় যে দু’টো বিষয় নেওয়া হবে–‘‘গুহা ও সৎসঙ্গ’’–প্রথমে পৃথকভাবে ও পরবর্তী স্তরে একসঙ্গে এদের পর্যালোচনা করা হবে৷ গুহা শব্দটির দু’টি অর্থ৷ প্রথম ব্যাখ্যা সংস্কৃত থেকে ইংরেজী করলে দাঁড়ায় ‘‘cave wherein God resides’’৷ পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানের যোগীরা এই ব্যাখ্যাকে খুব বেশী আক্ষরিক অর্থে নিয়ে থাকে, ভাবে যে পরমচৈতন্যের সঙ্গে একাত্ম হওয়ার একমাত্র উপায় সমাজ থেকে বিমুখ হয়ে গুহার মধ্যে দিন কাটানো৷ সবকিছুই যদি পরমপুরুষেরই অংশ হয় তাহলে এই সমাজও তো তাই তাঁর একাংশকে অস্বীকার করা মানে তাঁকেই পুরোপুরি অস্বীকার করা৷ এইভাবে যাঁকে অস্বীকার করছি, তাঁকেই লাভ করার প্রয়াস একটি অস্বাভাবিক ব্যাপার৷ তাই জগতকে
‘‘ভূমা–বৃত্তিগত ভারসাম্য’’ শব্দগুচ্ছ ব্যবহূত হয় কেবলমাত্র ভূমার ক্ষেত্রে, জীবের ক্ষেত্রে নয় । বৃত্তি মনের আভোগ, তারা মনের ভাবাবেগসম্পন্ন অভিব্যক্তি । এই বৃত্তিসমূহের ফলশ্রুতি হচ্ছে নির্দিষ্ট মনের সংস্কার । সংস্কারের মধ্যে আছে সংবেগ যার অন্তর্নিহিত শক্তি জীবদেহকে সেইদিকে প্রচালিত করে । এই সংস্কার পরবর্তীকালে অনুষ্ঠিত সব কর্মের মূল কারণ যা জীবদেহকে ভোগ করতেই হবে । তাই সৎকর্মের মাধ্যমে সৎ সংস্কার তৈরী করতে সকলকে সচেষ্ট থাকতে হবে । কিন্তু সংস্কার ভোগের সে৷ সে৷ এও সতর্ক থাকতে হবে যাতে সেই সময়ে অন্য সংস্কার তৈরী হয়ে না যায় ।
বৃত্তির তিনটি দিক
ধর্ম বৈবহারিক, সৈদ্ধান্তিক নয়৷ কে ধার্মিক আর কে ধার্মিক নয়, সেটা তার বিদ্যা, ৰুদ্ধি দিয়ে, পদমর্যাদা নিয়ে প্রমাণ হয় না৷ ধার্মিক কে? সেটা প্রমাণ হয় তার আচরণ দিয়ে৷ অধার্মিক কে? সেটা প্রমাণ হয় তার আচরণ দিয়ে৷ যে ধার্মিক হতে চায়, তাকে আচরণের দৃষ্টান্ত তৈরী করতে হৰে, আচরণ শোধরাতে হৰে৷ পুঁথি পড়ে কেউ বিদ্বান হয় না৷ কিন্তু বিদ্যা কী?
পরমপুরুষের একটি নাম হচ্ছে ‘জগদ্বন্ধু’৷ কেন তাঁকে জগদ্বন্ধু বলা হয়? সংস্কৃত ভাষায় ‘জগৎ’ শব্দ ‘গম’ ধাতু থেকে নিষ্পন্ন হয়েছে৷ ‘গম্’ মানে যাওয়া৷ ‘জগৎ’ মানে চলা বা যাওয়া যার স্বভাব৷ এখানে চলা বা যাওয়াটাই শব্দটার মুখ্য ভাব৷ এই বিশ্বের সব কিছুই চলছে৷ কোনো কিছুই স্থির নয়৷ এমনকি ধ্রুবতারা পর্যন্ত স্থির নয়৷ সব কিছুই ঘুরছে৷ কাজেই বিশ্বকে বলা হয় জগৎ৷ পরমপুরুষ হচ্ছেন জগতের বন্ধু৷
সমাজে প্রধান ব্যষ্টি যেমন আচরণ করেন, জনসাধারণ তেমনই অনুকরণ ও অনুসরণ করে৷ মানব সমাজে যে দুর্গতি এসেছে তার কারণ অনেক নয়, মাত্র একটাই৷ আর সেটা সমাজে নেতাদের দুর্নীতি৷
নেতাদের বিচারশীলতা কম হলেও জনসাধারণ তাঁদের চিন্তা-ভাবনাকে চোখ বুঁজে মেনে নেয়৷ তাদের বত্তৃণতা বা অভিনয় লাখ লাখ ব্যষ্টিকে সম্মোহিত করে রাখে৷ তাই কোন দেশে বা সমাজে ৰেশী ক্লেশ ও দারিদ্র্য দেখলে ৰুঝতে হৰে সেই দেশে বা সমাজে নেতার পাপে এমন হয়েছে৷
এটা সর্ববাদী সম্মত সত্য যে তন্ত্রের প্রবর্তক ছিলেন সদাশিব৷ সাধকদের সুবিধার জন্যে সদাশিব ও পাবর্তী কী করেছিলেন পার্বতী প্রশ্ণ করতেন, সাধারণ মানুষের মনে যে সমস্ত প্রশ্ণ উঠতে পারে ওই সমস্ত প্রশ্ণ করতেন৷ আর সদাশিব প্রশ্ণের উত্তর দিতেন৷ পার্বতীর প্রশ্ণ ছিল জ্ঞানাত্মক তথা পরিপ্রশ্ণাত্মক ৷ একে বলা হয় নিগম আর শিবের উত্তরকে বলা হয় আগম৷
‘‘আগতং শিববক্তেভ্যো গতং চ গিরিজা শ্রুতৌ৷
মতং চ বাসুদেবস্য তস্মাৎ আগম উচ্যতে৷৷’’
গতরাতে আমি এই পরিদৃশ্যমান জগতে বিভিন্ন সম্ভাবনাপুর্ণ অস্তিত্ব, যেমন---অণু মানসসত্তা ও চিতিসত্তা সম্পর্কে বলেছিলুম৷ পরম চিত্তিশক্তির যে অন্তর্মুখী গতি (বহির্মুখী গতিতে পঞ্চভৌতিক জগতের উৎপত্তি) তারই এক স্তরে মানুষের সৃষ্টি৷ এই অন্তর্মুখী গতিতে পঞ্চভৌতিক জগতের উৎপত্তি) তারই এই স্তরে মানুষের সৃষ্টি৷ এই অন্তর্মুখী গতি পরম চিতিশক্তিতে ফিরে আসার জন্যে৷
মানুষ সাধনা করে ঈশ্বর প্রাপ্তির জন্যে৷ এখন ঈশ্বর সম্প্রাপ্তিটা কেমন জিনিস –না, নিজের সত্তাটা, নিজের অস্তিত্বৰোধটা পরমপুরুষে মিলিয়ে দেওয়া৷ এই মিলিয়ে দেওয়ার উপায়টা কী সাধনার দ্বারা নিজেকে, নিজের সমগ্র সত্তাৰোধকে পরমপুরুষের কাছে নিয়ে যাওয়া ও এর সঙ্গে সঙ্গে আর কী করা –না, কীর্তনের দ্বারা পরমপুরুষকে আকৃষ্ট করে তাঁকে নিজের নিকটে নিয়ে আসা৷
সূক্ষ্ম নন্দনতত্ত্বের ওপর আধারিত নান্দনিক অভীপ্সা যখন একটা নির্দিষ্ট উচ্চ মানে পৌঁছে যায় তাকে বলে মিষ্টিসিজম্৷ আর এই মিষ্টিসিজম্ যখন মানবীয় গরিমা মহিমার শীর্ষে বা শ্রেষ্ঠত্বের পর্যায়ে চলে আসে তাকে বলে আধ্যাত্মিকতা (spirituality) এখন মিষ্টিসিজম্ কী মিষ্টিসিজম্ হ’ল সীমার সঙ্গে অসীমের, ক্ষুদ্র ‘আমি’র সঙ্গে ৰৃহৎ ‘আমি’র বা আত্মার সঙ্গে পরমাত্মার সম্পর্ক নির্ণয়ের এক নিরন্তর প্রয়াস৷
পরমপুরুষের পরম রচনাত্মক শক্তি নিজ আন্তরিকতা তথা ভূমামনের চেতনাশক্তির সাহায্যে ভৌতিক জগতের জড় অথবা জীব সত্তার বিভিন্ন রূপ প্রদান করে থাকে৷ প্রত্যেক বস্তু তাঁরই রচনা, প্রত্যেক বস্তু তাঁরই দ্বারা সংরক্ষিত ও পালিত হয়ে থাকে৷ শেষ পর্যন্ত তাঁরই কারণে বিরাট ভূমামনে সমস্ত জাগতিক সত্তার অন্তিম পরিণতি ঘটে যায়৷ অর্থাৎ পরমসত্তার মানসিক আধার ভূমিতে সব কিছুর লয় হয়ে যায়৷ এই কারণে আমি বলি কোন বস্তুই ক্ষুদ্র নয়, কোন বস্তুই অনাবশ্যক নয়৷ যদি অগুন্তি প্রোটোপ্লাজম দ্বারা এই সামূহিক শরীর তৈরী হয়ে থাকে, তাহলে তোমার মনও একটি সামূহিক মন৷ এছাড়া প্রত্যেক প্রোটোপ্লাজম একটি জীবিত সত্তা৷ আর এই কারণে প্রত্যেক জীবিত সত্তার
জীবের আধার প্রয়োজন৷ আধার ছাড়া হ’লে সে ব্রহ্ম–সমুদ্রে মিশে যায়৷ যেমন পুকুরে একবাটি জল, যতক্ষণ বাটি আছে ততক্ষণ বাটির জলও আছে, কিন্তু বাটি সরিয়ে নিলে বাটির জল পুকুরের জলেই মিশে যায়৷ যে জলের আধার ছিল বাটি, সেই আধার সরিয়ে নেবার পর তার জল পুকুরের জলের সঙ্গে এক হয়ে যায়৷ এইরূপ আধার হীন হ’লে জীবও ব্রহ্মে মিশে যায়৷
মহাভারত একটা ইতিহাস৷ ইতিবৃত্তের যে অংশ শিক্ষাপ্রদ, যার দ্বারা ধর্ম–র্থ–কাম–মোক্ষ্ প্রাপ্তি হয় আর যার মধ্যে নীতিবাক্য থাকে, সেটাই ইতিহাস৷
মহাভারতে আছে যে যুধিষ্ঠিরকে যক্ষ চারটি প্রশ্ণ করেছিল৷ যুধিষ্ঠির মানে যুদ্ধে ভিতরে তথা বাইরে চলতে থাকা সংঘর্ষের মধ্যে যে স্থির থাকে–যুধি স্থির ইত্যর্থে যুধিষ্ঠির৷
প্রশ্ণগুলি ছিল–‘কস্য মোদতে’, সুখী কে ‘কা বার্তা’ সবচেয়ে বড় কথা কী ‘কীম্ আশ্চর্যম্’, সবচেয়ে আশ্চর্যজনক বস্তু কী ‘ক পন্থা’ সবচেয়ে সত্য পথ কী প্রথম প্রশ্ণের উত্তরে যুধিষ্ঠির বললেন–
‘‘দিবস্যাষ্টমে ভাগে শাকং পচতি যো গৃহে৷
চিতিশক্তির মহাজাগতিক ৰন্ধনে সবাই ৰদ্ধ৷ যতক্ষণ সৃষ্টি আছে, পরমপুরষেরও প্রতিটি বস্তুর সঙ্গে ওতযোগ ও প্রোতযোগের ৰন্ধন রয়েছে৷ কেউ যদি বলে যে অন্য কারোর তার প্রয়োজন নেই, আমি একলাই থাকব, কারোর সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই– এটা বলা তার পক্ষে অনুচিত কাজ হবে৷ পৃথিবীতে কেউ একলা থাকতে পারে না৷ দেখ, তোমার জলের প্রয়োজন, তার জন্যে তুমি কি কোদাল নিয়ে মাটি খুঁড়ে একা একাই কুঁয়ো বানিয়ে দেবে তোমার জুতোর প্রয়োজন এরজন্যে নিজেই জুতো তৈরী করতে বসে যাবে বস্ত্রের প্রয়োজন, তাই নিজেই বস্ত্র তৈরীতে লেগে যাবে – না, এটা সম্ভব নয়৷ সকলেই সকলের ওপর নির্ভরশীল৷
গতকাল রাতে বলেছিলাম–মন যাঁর ভাবনা নিতে পারে না ও মনের ভাববার যে শক্তি আছে, সেই শক্তি যাঁর থেকে আসে, তিনিই হচ্ছেন পরমপুরুষ৷ এইজন্যে পরমপুরুষের কাছে লুকোনো কিছু নেই৷ এই যে মন, তা আসলে কী জিনিস পরমপুরুষের মৌলিক সত্তা যখন ঘনীভূত হয়ে যায়, তাতে জড়জগৎ–প্রপঞ্চের্ উৎপত্তি হয়ে থাকে৷ আর সেই প্রপঞ্চ যখন পরমপুরুষের আকর্ষণে তাঁর দিকে চলা শুরু করে দেয়, তখন অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষের কারণে জড়সত্তা চূর্ণীভূত হয়ে মনে রূপান্তরিত হয়ে থাকে৷ যেখানে মনের বিকাশ নেই সেখানে আমরা পাই গাছপালা, জীবজন্তু৷ আর যেখানে মনের অধিক বিকাশ হয়েছে, সেখানে আমরা পাই মানুষকে৷
গতকাল রাতে বলেছিলাম–মন যাঁর ভাবনা নিতে পারে না ও মনের ভাববার যে শক্তি আছে, সেই শক্তি যাঁর থেকে আসে, তিনিই হচ্ছেন পরমপুরুষ৷ এইজন্যে পরমপুরুষের কাছে লুকোনো কিছু নেই৷ এই যে মন, তা আসলে কী জিনিস পরমপুরুষের মৌলিক সত্তা যখন ঘনীভূত হয়ে যায়, তাতে জড়জগৎ–প্রপঞ্চের্ উৎপত্তি হয়ে থাকে৷ আর সেই প্রপঞ্চ যখন পরমপুরুষের আকর্ষণে তাঁর দিকে চলা শুরু করে দেয়, তখন অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষের কারণে জড়সত্তা চূর্ণীভূত হয়ে মনে রূপান্তরিত হয়ে থাকে৷ যেখানে মনের বিকাশ নেই সেখানে আমরা পাই গাছপালা, জীবজন্তু৷ আর যেখানে মনের অধিক বিকাশ হয়েছে, সেখানে আমরা পাই মানুষকে৷
এই যে শরীর, এই যে মন, এ সবের জন্যে তো অর্থের, অন্ন–বস্ত্রের আবশ্যকতা আছে! ঠিক কথা৷ মানুষ অর্থোপার্জনের চেষ্টা করবে, ঘরবাড়ী, জমি–জায়গার জন্যে চেষ্টা করবে৷ এ সবই ঠিক৷ কিন্তু যখন এই চেষ্টা করবে, চেষ্টা করার সময় মনে এই ভাবনা রাখতে হবে যে, ‘‘আমি এই সব পাওয়ার জন্যে চেষ্টা করছি এইজন্যে যে এ সব আমার আধ্যাত্মিক সাধনার সহায়ক হবে৷ এই সব জাগতিক বস্তুর লাভের উদ্দেশ্যে এ সবের সাধনা করছি না৷’’ মানুষ যখন নিজের স্থূল ভাবকে সূক্ষ্মভাবে রূপান্তরিত করতে থাকবে, তখন ক্রমশঃ সে বৈয়ষ্টিক ভাবনার দ্বারা পরিচালিত না হয়ে সামূহিক ভাবনার দ্বারা পরিচালিত হতে থাকবে৷
প্রণিপাতেন পরিপ্রশ্ণেন সেবয়া৷* আধ্যাত্মিক প্রগতি তিনটি তত্ত্বের ওপর নির্ভরশীল–প্রণিপাত, পরিপ্রশ্ণ, সেবা৷ ‘প্রণিপাত’ মানে এক অদ্বিতীয় শাশ্বত সত্তা পরমপুরুষের প্রতি পূর্ণ আত্মসমর্পণ৷ এক্ষেত্রে সাধকের মনোভাব হচ্ছে এই যে বিশ্বের যা কিছু সবই পরমপুরুষের, আমার বলতে কিছু নেই৷ এটা হ’ল প্রণিপাত৷ আর যার অহংৰোধ রয়েছে, যে ভাবছে তার বিদ্যা–ৰুদ্ধি, ধন–সম্পত্তি বা অন্যান্য যাবতীয় বস্তু তার বৈয়ষ্টিক সম্পত্তি, সে সবচেয়ে ৰড় মূর্খ৷
গুরু তিন প্রকারের, শিষ্যও তিন প্রকারের৷ মানুষের অভিব্যক্তিও তিন প্রকারের, বৈদ্যকেও তিন প্রকারের বলা হয়ে থাকে৷ অধম বৈদ্য তিনি, যিনি কেবল ওষুধ বলে দেন, মধ্যম বৈদ্য তিনি যিনি ওষুধ তো বলেই দেন, সঙ্গে সঙ্গে এটাও জেনে নেন যে রোগী সেটা ব্যবহার করতে পারবে কী না৷ যিনি উত্তম বৈদ্য তিনি ওষুধও বলে দেন, জেনেও নেন, আর সঙ্গে সেটা ব্যবহারের ব্যবস্থাও করে দেন৷ অধম ও মধ্যম স্তরের বৈদ্য বস্তুতঃ বৈদ্য নয়, কেবল উত্তম স্তরের বৈদ্যই বাস্তবিক বৈদ্য৷ সেই রকমই অধম স্তরের গুরু ভাল ভাল কথা শুণিয়ে দেন৷ মধ্যম স্তরের গুরুও ভাল কথা শুণিয়ে দেন, আবার তার সম্বন্ধে জেনেও নেন৷ উত্তম স্তরের গুরু ভাল কথা শুণিয়ে দেন, জিজ্ঞেস করে
ধৃতরাষ্ট্রঃ উবাচ অর্থাৎ ধৃতরাষ্ট্র জিজ্ঞাসা করছেন ঃ
‘‘ধর্মক্ষেত্রে কুরুক্ষেত্রে সমবেতা যুযুৎসবঃ৷
মামকাঃ পাণ্ডবাশ্চৈব কিমকুর্বত সঞ্জয়৷৷’’
সমাজে সম্মানিত আর বয়স্ক লোকেদের আচার–ব্যবহার অন্যের কাছে আদর্শস্বরূপ যুগের পর যুগ ধরে মানুষ তার অনুসরণ ও অনুকরণ করে চলেঙ্গ আজ মানুষের সমাজে এক চরম দুর্দিন আর দুর্দশা সমুপস্থিত, আর তার একটাই কারণ, সমাজের ত্রুটিপূর্ণ নেতৃত্ব। মানুষ অন্ধের মত অর্বাচীন নেতাকেও অনুসরণ করে। নেতারা বড় বড় কথা, অ৷–ভি৷ আর নাটুকেপনা দিয়ে হাজার হাজার মানুষকে সম্মোহিত ও আকর্ষিত করে। এটা জেনে রাখবে যেকোনো দেশে, যে–কোনো মানুষের দারিদ্র্য আর দুর্দশার পেছনে রয়েছে নেতাদের পাপ। যারা যথার্থ নেতা তাদের সদা সতর্ক থাকতে হবে আর ভাবতে হবে সবচেয়ে ভালভাবে মানব সমাজের সেবা কীকরে করা যায়। তাদের সবসময় সতর্ক থাকতে হবে যে তাদের নির্দেশনার
জীবনের গতি সর্বদা পরম লক্ষ্যের দিকে কিন্তু জড় প্রকৃতি তাকে সবসময় নিজের দিকে আকর্ষণ করার চেষ্টা করতে থাকে৷ নিজের সঙ্গে লড়াই করতে করতে মানুষের শক্তি যখন আর কিছুই করতে পারে না, সেই সময়ের যে অবস্থা তাকে বলে মৃত্যু৷ এমনিতে শরীর থেকে প্রাণশক্তি যখন বেরিয়ে যায়, সেই সময়ের যে পরিস্থিতি তাকে মৃত্যু বলা হয়---এটা স্বাভাবিক তথা গৌণ মৃত্যু৷ কিন্তু মানুষের আবার অকাল মৃত্যুও হয়৷ আসলে প্রকৃতির এই আসুরী শক্তির সঙ্গে সংগ্রাম করে নিজেকে চরম লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার যে প্রয়াস তাকেই জীবন বলে৷ তমোগুণী বৃত্তিগুলো সমাজের সর্বত্র ব্যাপ্ত থেকে মানুসের চরম লক্ষ্যপ্রাপ্তির পথে বাধা সৃষ্টি করছে৷ যে এই আসুরী বৃত্ত
যে মানুষের যেমন আজীব তথা আভোগ, তদনুযায়ী তার স্থূল শরীর মেলে৷ যার মনে কেবল খাবার বাসনাই রয়েছে, পরমপুরুষ তাকে শুয়োরের শরীর দেবেন, যত খুশী সে খেতে পারবে৷ যার মনে ক্রোধ বেশী, তার মোষের শরীর মিলবে---যত বেশী ক্রুদ্ধ হতে চায়, হতে পারবে৷ আবার যার মনে পরমপুরুষের সান্নিধ্য লাভের বাসনা জাগবে, সে খুব উন্নত মানব শরীর লাভ করবে, সাত্ত্বিক শরীর লাভ করবে৷ যেমন আভোগ, তদনুযায়ী মানুষকে চলতে হয়৷
আজ সকাম প্রার্থনা ও সগুণ উপাসনার নিরর্থকতা প্রসঙ্গে সংক্ষেপে কিছু বলতে চাই৷ ’’
পরমপুরুষ কোনো জাগতিক পরিমাপের আওতায় আসেন না৷ তাই কোনো প্রকার গুণগত অভিব্যক্তিই তাকে বাঁধতে পারে না৷ তিনি গুণাধীশ ও সব রকম গুণগত বন্ধনের বাইরে৷ পূজা বা উপাসনা জিনিসটা প্রশস্তিমূলকও adorative) হতে পারে, আবার বিশুদ্ধ ভাবাত্মকও ideative) হতে পারে কিন্তু তা কখনো সগুণাত্মক attributional) হতে পারে না৷
‘আত্মমোক্ষার্থং জগদ্ধিতায় চ’, এটি একজন সাধকের জীবনের আদর্শ হওয়া উচিত৷ মানুষের কাজ করা উচিত, আর কাজ করার সময়ে মনে রাখা দরকার, সে যা কিছুই করছে তা আত্মমোক্ষের জন্যে৷
আমাদের এই পৃথিবীতে প্রাগৈতিহাসিক যুগে প্রথম যে ভাষা উচ্চারিত হয়েছিল তা প্রায় ৬ লক্ষ বছর আগে৷ ভাষা তো এল কিন্তু বৌদ্ধিক মান বলে তখন কিছুই ছিল না৷ আধুনিক মানুষ এসেছে প্রায় এক লক্ষ বছর আগে৷ তাদের ভাষা ছিল কিন্তু তখনও ৰৌদ্ধিক মান তত উন্নত ছিল না৷ সে কারণে তাদের ভাষার শব্দসম্ভার অতি অল্প সংখ্যক৷ উন্নত প্রজাতির বানরদের মধ্যে শব্দের সংখ্যা ৮০০৷ আর একদম অবনত পর্যায়ের মানুষদের মধ্যে শব্দের সংখ্যা হচ্ছে কিঞ্চিদধিক ৯০০৷ কিন্তু আধুনিক ফরাসী ভাষাতেই শব্দসম্ভার চার লক্ষেরও অধিক৷
পরমপুরুষের পরম রচনাত্মক শক্তি নিজ আন্তরিকতা তথা ভূমামনের চেতনাশক্তির সাহায্যে ভৌতিক জগতের জড় অথবা জীব সত্তার বিভিন্ন রূপ প্রদান করে থাকে৷ প্রত্যেক বস্তু তাঁরই রচনা, প্রত্যেক বস্তু তাঁরই দ্বারা সংরক্ষিত ও পালিত হয়ে থাকে৷ শেষ পর্যন্ত তাঁরই বিরাট ভূমামনে সমস্ত জাগতিক সত্তার অন্তিম পরিণতি ঘটে যায়৷ অর্থাৎ পরমসত্তার মানসিক আধার ভূমিতে সব কিছুর লয় হয়ে যায়৷ এই কারণে আমি বলি কোন বস্তুই ক্ষুদ্র নয়, কোন বস্তুই অনাবশ্যক নয়৷ যদি অগুন্তি প্রোটোপ্লাজম দ্বারা এই সামূহিক শরীর তৈরী হয়ে থাকে, তাহলে তোমার মনও একটি সামূহিক মন৷ এছাড়া প্রত্যেক প্রোটোপ্লাজম একটি জীবিত সত্তা৷ আর এই কারণে প্রত্যেক জীবিত সত্তার নিজস্
আগে বলেছিলুম, ভালো কাজের জন্যে জিদ্ চাই৷ তাই সাধকের মনে জিদ্ থাকা দরকার৷ শাস্ত্রে আছে, পার্বতী শিবকে জিজ্ঞাসা করলেন, কে এই সংসারে উন্নতি করে, কী তার রহস্য দেখতে পাচ্ছি, কেউ বড় বড় কাজ করে জীবনে মহান হয়, কেউ বা শুয়ে বসেই থাকে চিরকাল৷ কেউ কেউ তো কলুর বলদ হয়েই থেকে যায়, আবার কারো কারো উন্নতি হয়৷ কেউ অনেক পড়েও খারাপ ফল করে, কেউ বা অল্প পড়েও ভাল ফল করে৷ এই সমস্ত কিছুর পিছনে রহস্য কী
উত্তরে শিব বললেন,
‘‘ফলিষ্যতীতি বিশ্বাসঃ সিদ্ধের্প্রথমলক্ষণ৷
দ্বিতীয়ং শ্রদ্ধয়া যুক্তং তৃতীয়ং গুরুপূজনম্৷৷
চতুর্থো সমতাভাবঃ পঞ্চমেন্দ্রিয়নিগ্রহ৷
আমি অবশ্যই বর্তমান কালকে অস্বীকার বা অবহেলা করতে পারি না। এর অর্থ আমাকে অবশ্যই মনে রাখতে হবে আমি কোথায় আছি আর ঠিক বর্তমানে আমাকে কী করতে হবে। কিন্তু বর্তমান কাকে বলব? আমরা জানি বর্তমান, অতীত আর ভবিষ্যতকে নিয়ে কাল তিনটি। এই তিন ধরনের কাল আসলে কী বস্তুতঃ বর্তমান কাল বলে ঠিক কোন কিছু নেই। আমি যখন কিছু বলি, তুমি ততক্ষণাৎ তা শুণতে পাও না। কিছুটা বিরতির পরে তুমি সেটা শুণতে পাও। তাহলে সেই বিরতিটা কী শব্দ বায়ুর দ্বারা বাহিত হয়ে কাণে পৌঁছতে যে সময় লাগে সেটাই বিরতি। আর যখন তা তুমি শোণ সেটা আমার কাছে কিন্তু অতীত, আর তোমার কাছে তা ভবিষ্যৎ কেননা অল্পক্ষণ পরে তুমি তা শুণতে পাচ্ছ
এখন ভারতবর্ষ ও আধ্যাত্মিকতা সম্পর্কে কিছু আলোচনা করা যাক৷ এই দেশের নাম ভারতবর্ষ৷ জানতো, পৃথিবীতে যা কিছু শব্দ আছে সবই অর্থপূর্ণ৷ গ্রামের নামই হোক বা নদীর নাম, সবেরই একটা অর্থ আছে৷ এ দেশের নাম ভারতবর্ষ কেন রাখা হ’ল? প্রাচীনকালে এখানকার বাসিন্দা ছিল দ্রাবিড়, অষ্ট্রিক ও মঙ্গোলিয়ন৷ আর্যরা যখন এল তখন তারা এর নামকরণ করলে ‘ভারতবর্ষ’৷ এমন নাম কেন করা হ’ল?
পরমসত্তা যখন প্রকৃতির ৰন্ধন থেকে মুক্ত, সেই অবস্থা হচ্ছে নির্গুণ আর ৰন্ধনযুক্ত পরমসত্তা সগুণ৷ সগুণেও আছে দু’টি বিভাগ–একটা তার রূপময় অস্তিত্ব আর অন্যটি অরূপ৷
মানুষের মধ্যে যে ৰুদ্ধি, ৰোধি, আমি–ৰোধ (I-feeling) ইত্যাদি আছে এরা সব অরূপ৷ সেই রকম সগুণ ৰ্রহ্মেরও ৰুদ্ধি, ৰোধি ও আমি–ৰোধ অরূপ৷ সেইজন্যে সেগুলির কোনটাই আমরা দেখতে পাই না৷
তন্ত্রের সঙ্গে বেদের আদর্শগত তফাৎ বেশী বললে যথেষ্ট হবে না, বলা উচিত খুব বেশী৷ তন্ত্র হ’ল সম্পূর্ণ বৈবহারিক Practical), তন্ত্র অস্বাভাবিক কোন কিছুকে সমর্থন করে না৷ ফলে তন্ত্রের মধ্যে স্বাভাবিরতা থাকায় সেটা সমাজে সহজেই গৃহীত ও সহজেই আদৃত হয়৷ মানুষ একে সহজেই নিজের জিনিস বলে মনে করতে পারে৷ যেমন বেদে একটা শ্লোকে আছে---‘উত্তিষ্ঠত জাগ্রত প্রাপ্য ররান্ নিৰোধত’--- ওঠো, জাগো, উপযুক্ত আচার্যের নিকট সত্বর উপস্থিত হও ও সাধনা মার্গে চলতে শুরু করো৷ এতখানিতে বেদ ও তন্ত্রে মিল আছে৷
মানুষের সামনে দুটি পথ–একটি শ্রেয়ের পথ, অন্যটি প্রেয়ের পথ৷ প্রেয়ের পথে মানুষ পায় ক্ষণিক সুখ, আর শেষে দুঃখ৷ আর শ্রেয়ের পথে চললে তাতে সাময়িক দূুঃখ–ক্লেশ এলেও শেষপর্যন্ত সেই পথেই মানুষের ৰৃহত্তর কল্যাণ সাধিত হয়৷ মানুষ যখন প্রেয়ের পথ ধরে তখন সে যুক্তির দ্বারা পরিচালিত না হয়ে সেন্টিমেন্টের (ভাবপ্রবণতার) বশে চলে আর যখন শ্রেয়ের পথ নেয়,তখনও যুক্তির দ্বারা নয়, কল্যাণৰোধের ভাবনার দ্বারা প্রেষিত হয়ে চলে৷ ভাবে, এই যে পথে আমি চলেছি, কাজ করছি, এটা কল্যাণের পথ– মঙ্গলের পথ৷ এই পথেই জনসেবা–জনকল্যাণ সর্বাধিক হবে৷
সমাজে মানবিক প্রয়াস যেমন চারটে স্তরে বিন্যস্ত হয়ে রয়েছে –– কাম, অর্থ, ধর্ম, মোক্ষ৷ এই চতুর্ধাবিন্যস্ত মানুষের কর্মৈষণা তথা কর্মতৎপরতাকে আমরা বলি ‘চতুর্বর্গ’৷ এই চতুর্বর্গের মিলিত প্রয়াসেই সমাজের সামূহিক কল্যাণ, সামূহিক পরিণতি৷ কোনোটা সম্পূর্ণ ভাবে জাগতিক তথা পাঞ্চভৌতিক ক্ষেত্রে, কোনোটা পাঞ্চভৌতিক ক্ষেত্রের সঙ্গে মানসিক ক্ষেত্রকে সংযুক্ত করেছে, কোনোটা কেবল মানসিক আর কোনোটা মানসিক ক্ষেত্র ছেড়ে আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে গিয়ে পৌঁছে যাচ্ছে, এই ভাবে বিভক্ত হয়ে রয়েছে৷ মানুষের অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসগৃহ –– এই যে পাঞ্চভৌতিক প্রয়োজনগুলো, এগুলো হ’ল কাম৷ তার পরেই হ’ল অর্থ – যা মানুষ বিভিন্ন ধরনের
সমাজে সম্মানিত আর বয়স্ক লোকেদের আচার–ব্যবহার অন্যের কাছে আদর্শস্বরূপ যুগের পর যুগ ধরে মানুষ তার অনুসরণ ও অনুকরণ করে চলে৷ আজ মানুষের সমাজে এক চরম দুর্দিন আর দুর্দশা সমুপস্থিত, আর তার একটাই কারণ, সমাজের ত্রুটিপূর্ণ নেতৃত্ব৷ মানুষ অন্ধের মত অর্বাচীন নেতাকেও অনুসরণ করে৷ নেতারা বড় বড় কথা, অঙ্গ–ভঙ্গি আর নাটুকেপনা দিয়ে হাজার হাজার মানুষকে সম্মোহিত ও আকর্ষিত করে৷ এটা জেনে রাখবে যেকোনো দেশে, যে–কোনো মানুষের দারিদ্র্য আর দুর্দশার পেছনে রয়েছে নেতাদের পাপ৷ যারা যথার্থ নেতা তাদের সদা সতর্ক থাকতে হবে আর ভাবতে হবে সবচেয়ে ভালভাবে মানব সমাজের সেবা কীকরে করা যায়৷ তাদের সবসময় সতর্ক থাকতে হবে যে তাদের নির্দেশন
‘সৎ’ কী ও ‘অসৎ’ কী– এ সম্পর্কে যে বিচারৰোধ তাকে সদাসৎ বিবেক বলে, যা ‘সৎ’–কে ‘অসৎ’ থেকে ও ‘অসৎ’–কে ‘সৎ’ থেকে পৃথক করে দেয়৷ ‘সৎ’ কী লৌকিক ভাষায় ‘সৎ’ মানে ভালো– সৎ ব্যষ্টি, সজ্জন ব্যষ্টি৷ আর আধ্যাত্মিক অর্থে ‘সৎ’ মানে অপরিণামী সত্তা– যাতে কোনো পরিবর্তন হয় না৷ আর ‘অসৎ’ মানে যা পরিণামী, যার অবস্থান্তর ঘটে৷ ‘সৎ’ বস্তু একই, বাদবাকী সব অসৎ৷ ‘অসৎ’ মানে খারাপ নয়, পরিবর্তনশীল৷
গতকাল রাতে বলেছিলাম–মন যাঁর ভাবনা নিতে পারে না ও মনের ভাববার যে শক্তি আছে, সেই শক্তি যাঁর থেকে আসে, তিনিই হচ্ছেন পরমপুরুষ৷ এইজন্যে পরমপুরুষের কাছে লুকোনো কিছু নেই৷ এই যে মন, তা আসলে কী জিনিস? পরমপুরুষের মৌলিক সত্তা যখন ঘনীভূত হয়ে যায়, তাতে জড়জগৎ–প্রপঞ্চের্ উৎপত্তি হয়ে থাকে৷ আর সেই প্রপঞ্চ যখন পরমপুরুষের আকর্ষণে তাঁর দিকে চলা শুরু করে দেয়, তখন অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষের কারণে জড়সত্তা চূর্ণীভূত হয়ে মনে রূপান্তরিত হয়ে থাকে৷ যেখানে মনের বিকাশ নেই সেখানে আমরা পাই গাছপালা, জীবজন্তু৷ আর যেখানে মনের অধিক বিকাশ হয়েছে, সেখানে আমরা পাই মানুষকে৷
এই যে শরীর, এই যে মন, এ সবের জন্যে তো অর্থের, অন্ন–বস্ত্রের আবশ্যকতা আছে ঠিক কথা৷ মানুষ অর্থোপার্জনের চেষ্টা করবে, ঘরবাড়ী, জমি–জায়গার জন্যে চেষ্টা করবে৷ এ সবই ঠিক৷ কিন্তু যখন এই চেষ্টা করবে, চেষ্টা করার সময় মনে এই ভাবনা রাখতে হবে যে, ‘‘আমি এই সব পাওয়ার জন্যে চেষ্টা করছি এইজন্যে যে এ সব আমার আধ্যাত্মিক সাধনার সহায়ক হবে৷ এই সব জাগতিক বস্তুর লাভের উদ্দেশ্যে এ সবের সাধনা করছি না৷’’ মানুষ যখন নিজের স্থূল ভাবকে সূক্ষ্মভাবে রূপান্তরিত করতে থাকবে, তখন ক্রমশঃ সে বৈয়ষ্টিক ভাবনার দ্বারা পরিচালিত না হয়ে সামূহিক ভাবনার দ্বারা পরিচালিত হতে থাকবে৷
সর্বাজীবে সর্বসংস্থে ৰৃহন্তে তস্মিন্ হংসো ভ্রাম্যতে ব্রহ্মচক্রে৷
পৃথগাত্মানং প্রেরিতারঞ্চ মত্বা জুষ্টস্ততস্তেনামৃতত্৷৷*
তোমরা জান বিশ্বের সবাই পরমপুরুষের সন্তান৷ তিনিই এই বিশ্ব সৃষ্টি করেছেন৷ তিনিই সৃষ্টি করেছেন এই জগৎকে, সৃষ্টি করেছেন এই সমস্ত জীবিত প্রাণীকুলকে৷
দুধের মধ্যে যে রকম ঘি ব্যাপ্ত হয়ে থাকে আর মন্থন করলে সেটা ওপরে উঠে আসে, ঠিক সেই রকম তোমার মধ্যে পরমপুরুষ ব্যাপ্ত আছেন সাধনারূপী মন্থনের দ্বারা তুমি তাঁকে পেয়ে যাবে৷ মন্থন করলে যে মাখন বেরিয়ে আসে, সেটাই পরমপুরুষ৷ তিনি তোমার ভিতরে আছেন ঘরের মধ্যে কোনো দেবতাকে তুমি বাহ্যিক পূজা করে, বহিরঙ্গিক সাধনার দ্বারা তাঁকে পাবে না৷ বরং সেটার দ্বারা তুমি তাঁর থেকে আরো দূরে সরে যাবে৷
কর্মমার্গ, কর্মযোগ একটা পথ, সাধনাও একটা পথ, ও সেই পথ ধরে লক্ষ্যের দিকে চলতে হচ্ছে৷ জ্ঞানমার্গ (জ্ঞানযোগ)–সেও সাধনার একটা পথ৷ সেই পথ ধরেও লক্ষ্যের দিকে চলতে হচ্ছে৷ কিন্তু ভক্তি একটা পথ নয়, ভক্তি হ’ল লক্ষ্য, যেখানে পৌঁছুতে চাইছি৷ সেই জায়গাটা৷ সুতরাং ভক্তি কোনো cult নয় অর্থাৎ কোনো বিধি, সাধনা–বিধি নয়৷ ভক্তি হ’ল লক্ষ্য যেখানে পৌঁছুতে চাইছি৷
পরমাত্মাকে ভুলে গিয়ে যে কেবল সংগীতচর্চার মধ্যেই রয়ে গেছে, তাকে আমরা বলি গন্ধর্ব৷ এই জন্যে সংগীত–শাস্ত্রকে বলা হয় গন্ধর্ববিদ্যা৷ গন্ধর্ব অবস্থায় থেকে দু’চার লাখ বছর বাদে কিছু সংস্কার ক্ষয় হয়ে গেলে, সে আবার মনুষ্য–জীবন পাবে৷ এটা খুবই কষ্টকর অবস্থা৷
এই রকমেরই হয় যক্ষ৷ তারা পরমাত্মার কাছে চায় অলৌকিক শক্তি৷ প্রাচীনকালে তিন হাজার বছর আগে আমাদের পূর্বপুরুষেরা খুব যক্ষের পূজো করত যাতে মৃত্যুর পর যক্ষ হতে পারে৷ আজকাল লোকে সেই পূজাস্থলকে ব্রহ্মস্থান বলে৷ ব্রহ্মস্থান মানে যক্ষের স্থান৷
পরমাত্মাকে ভুলে গিয়ে যে কেবল সংগীতচর্চার মধ্যেই রয়ে গেছে, তাকে আমরা বলি গন্ধর্ব৷ এই জন্যে সংগীত–শাস্ত্রকে বলা হয় গন্ধর্ববিদ্যা৷ গন্ধর্ব অবস্থায় থেকে দু’চার লাখ বছর বাদে কিছু সংস্কার ক্ষয় হয়ে গেলে, সে আবার মনুষ্য–জীবন পাবে৷ এটা খুবই কষ্টকর অবস্থা৷
এই রকমেরই হয় যক্ষ৷ তারা পরমাত্মার কাছে চায় অলৌকিক শক্তি৷ প্রাচীনকালে তিন হাজার বছর আগে আমাদের পূর্বপুরুষেরা খুব যক্ষের পূজো করত যাতে মৃত্যুর পর যক্ষ হতে পারে৷ আজকাল লোকে সেই পূজাস্থলকে ব্রহ্মস্থান বলে৷ ব্রহ্মস্থান মানে যক্ষের স্থান৷
মানুষের অস্তিত্ব স্থূল, সূক্ষ্ম ও কারণ এই তিন জগতেই৷ মানুষ কেবলমাত্র পাঞ্চভৌতিক জীব নয়, কেবল মানসিক জীবও নয়, আবার শুধুমাত্র আত্মিক সত্তাও নয়৷ তিনে মিলে মানুষের অস্তিত্ব৷ মানুষের অভিব্যক্তিগুলো, অভিস্ফূর্ত্তিগুলো তিনটি তত্ত্বেই, তিনটি স্তরেই হয়ে থাকে৷
প্রত্যেক বস্তুর নিজের নিজের ধর্ম আছে, নিজস্ব স্বাভাবিক লক্ষণ আছে৷ সেই লক্ষণ দেখেই মানুষ সংশ্লিষ্ট বস্তুর সঙ্গে পরিচিত হয়, তার নামকরণ করে৷ প্রত্যেক সত্তার, প্রত্যেক জীবের নিজের নিজের ধর্মে অটুট থাকা শ্রেয়স্কর৷
সোণা ও লোহার নিজেদের পৃথক পৃথক ধর্ম আছে৷ ঠিক তেমনি মানুষেরও নিজের ধর্ম আছে৷ মানুষ যদি নিজের ধর্ম থেকে, মানব ধর্ম থেকে দূরে সরে যায় তবে তাকে মানুষ বলব না৷ মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব তার নিজের ধর্মেই নিহিত৷ তাই তার পক্ষে স্বধর্মে সুদৃঢ় থাকাই বাঞ্ছনীয়৷
গত রাতে আমি এই পরিদৃশ্যমান জগতে বিভিন্ন সম্ভাবনাপূর্ণ অস্তিত্ব, যেমন---অণু মানসসত্তা ও চিতিসত্তা সম্পর্কে বলেছিলুম৷ পরম চিত্তিশক্তির যে অন্তর্মুখী গতি (বহির্মুখী গতিতে পঞ্চভৌতিক জগতের উৎপত্তি) তারই এক স্তরে মানুষের সৃষ্টি৷ এই অন্তর্মুখী গতি পরম চিতিশক্তিতে ফিরে আসার জন্যে৷
মানসপট আর মনের ময়লা
নির্গুণ ব্রহ্মের কোনো রূপ নেই৷ তিনি নিরাকার৷ এই ব্রহ্মই সগুণ ব্রহ্মরূপে (যা নির্গুণ ব্রহ্মের কার্যান্বিত রূপ), প্রকৃতির সহায়তায় ব্রহ্মভাবের জন্ম দেন, সেই সগুণ ব্রহ্ম প্রতিটি ধূলিকণায় ব্যাপ্ত আছেন৷ আমার মানসপটের ওপর ব্রহ্মের প্রতিচ্ছায়া পড়ছে, আর এই প্রতিচ্ছায়া কিরকম ভালভাবে পড়বে তা নির্ভর করে আমারই সংস্কারের ওপর৷ মানসপট যত ময়লাযুক্ত হবে, তার ওপর ততখানিই খারাপ প্রতিফলন পড়বে৷ সাধনার দ্বারা আমরা মনের এই ময়লাকে পরিষ্কার করি৷
মানুষের বিচারেই ছোট-বড় তো! মানুষের মনটাই তো ছোট ৷ সেই মন দিয়ে সে বিচার করে৷ সুতরাং গোড়াতেই ভেবে দেখ বিচারের মাপকাঠি কী রকম ? নদীর জল মাপতে গেলে হাত দিয়েও মাপা যায় , যেমন কত হাত জল ইত্যাদি কিন্তু সমুদ্রের চেয়েও বড় যদি কোন জলাশয় থাকতো আরও মুশকিল হত৷
কখনও এই পরিস্থিতি আসতে পারে তুমি বিরাট শক্তিশালী সত্তার কাছে পৌঁছে গেছ, যাকে তুমি খুব ভয় পাও৷ এই যে শক্তিশালী সত্তা, তার শক্তি বা তার সাহস আসছে কোথা থেকে? সেও তোমার পিতার কাছে থেকেই আসছে৷ নিজের শক্তি বলে কারোর কিছু আছে কি? না, তা নেই৷ খাদ্য, হাওয়া, জল, মাটি ইত্যাদি দ্বারা পরমপিতা শক্তি প্রদান করেন৷ ধর, এক বিরাট শক্তিশালী পালোয়ান– সেটা কি তার নিজের শক্তি? না, তা নয়৷ সে শক্তি তোমার পরমপিতার৷ তাই তার থেকে তুমি ভয় কেন পাবে?
সৃষ্টিরহস্যের মূলে পৌঁছোবার জন্যে মানুষের যে এষণা তার থেকেই জন্ম হয়েছিল অধ্যাত্মবাদের৷ প্রকৃতির জগতে একদিকে বিভীষিকা আবার অন্যদিকে অনুপম সৌন্দর্য, তার পেছনে মূল কারণটা কী?
সাধনার ভিত্তিভূমি নৈতিকতা৷ প্রথমেই মনে রাখা দরকার যে এই নৈতিকতা (morality) সাধকের চরম লক্ষ্য (ultimate goal) নয়, আর এই নৈতিকতায় প্রতিষ্ঠিত হওয়া বা মর্যালিষ্ট হওয়া সাধকের জীবনে এমন কোনো একটা অবস্থা নয় যা অন্য কারুর চরম আদর্শ হতে পারে৷ সাধনামার্গে যাত্রা শুরু করবার ঠিক প্রথম ক্ষণটিতেই সাধকের যে মানসিক সামঞ্জস্যের প্রয়োজন সেটারই নাম নৈতিকতা বা মরালিটি৷...
এই পৃথিবীতে মানুষের আবির্ভাব হয়েছে আজ থেকে প্রায় দশ লাখ বছর আগে৷ তখন থেকেই মানুষের মনে সুখপ্রাপ্তির এষণা ছিল, আজও আছে, সর্বদা থাকবে৷ এই সুখপ্রাপ্তির এষণার দ্বারা অর্থাৎ একটা মানসিক অভীপ্সার দ্বারা–যার পূর্ত্তির জন্যে মানুষ চেষ্টাশীল হয়–প্রেষিত হয়ে সুদূর অতীতে ধর্ম জীবনে পদার্পণ করেছিল৷ এই এষণা কেবল মানুষের মধ্যেই রয়েছে, জন্তু–জানোয়ারের মধ্যে নেই ৷ তবে হ্যাঁ, যে সব জন্তু–জানোয়ার মানুষের সংস্পর্শে বাস করে, মানুষের সঙ্গে যাদের একটা বোঝাপড়া হয়েছে তাদের মধ্যেও অল্প পরিমাণে এই এষণা রয়েছে৷ কিন্তু স্ফুটতরভাবে রয়েছে কেবল মানুষের মধ্যে৷ এই এষণা মানুষের মধ্যে রয়েছে বলেই তার নাম মানুষ৷ ‘মানুষ’ শব্দের
আমি নানান স্থানে, নানান অনুষ্ঠানে একটা কথা বলেছি–মানসিক সাম্য অথবা মানসিক সাম্যাবস্থা৷ ভগবান শিবের একটি উক্তি আছে, জীবনে সম্পূর্ণ সফল হওয়ার পিছনে চতুর্থ তত্ত্বটি হ’ল ‘সমতাভাব’, অর্থাৎ মানসিক সাম্য, মানসিক ভারসাম্য৷ মনে কোন রকম কম্প্লেক্স রাখলে চলবে না৷ না মহামান্যতা ৰোধ, না হীনমন্যতা ৰোধ৷
বিশ্বৰ্রহ্মাণ্ডে মূলসত্তা একটিই, তা হচ্ছে চিতিশক্তি৷ এই চিতিশক্তি চৈতন্যসত্তা আবার শক্তিসত্তাও বটে– এইভাবে চিতিশক্তি দুইয়েরই কাজ করে৷ এইজন্যেই একে চিতিশক্তি বলা হয়৷ বস্তু নয় কিন্তু বস্তুকে যে রূপ প্রদান করে তাই শক্তি বা প্রকৃতি৷ এই প্রকৃতিই বস্তুতে রূপ প্রদান করে প্রকারভেদ সৃষ্টি করে৷
আত্মজ্ঞানই হ’ল মুক্তির লক্ষণ, আর এই আত্মজ্ঞান মানুষ তখনই পায় যখন সে নিজ সুকর্মের ফলে মানুষের শরীর লাভ করে৷ মানবদেহ লাভ করলে তবে আত্মজ্ঞান হয়৷ দেখ, পশুজীবন ও মানবজীবন এই দু’য়ের মধ্যে মুখ্য পার্থক্য কী দুই–ই পরমাত্মার সন্তান৷ একটি কুকুর, একটি বিড়াল আর একজন মানুষ–সবই পরমাত্মার সন্তান৷ কিন্তু দু’য়ের মধ্যে পার্থক্যটা এই যে, মানুষের ৰুদ্ধি উন্নত৷ মানুষ ৰোঝে যে শ্রেয় ও প্রেয়ের মধ্যে পার্থক্য কোথায় পশু এটা ৰুঝতে পারে না কারণ–তার মন ও ৰুদ্ধি অনুন্নত৷ পশুজীবন হ’ল জড়ের উপাসক৷ যে কোন পশুকে তুমি দেখবে যে সব সময় জড়ভোগে ব্যস্ত থাকে৷ জড়জগতের বাইরে তার আর কোনো দ্বিতীয় জগৎ নেই৷ মানুষের আছে স্থূল জগৎ কিন্তু এ
যোগ কী? তোমারা জান যে সংস্কৃত শব্দভাণ্ডারের প্রায় প্রতিটি শব্দের দু’টো করে মানে হয়৷ একটি হ’ল ব্যুৎপত্তিগত অর্থে সংস্কৃতে যাকে বলা হয় ভাবারূঢ়ার্থ, দ্বিতীয়টি হ’ল সাধারণ প্রচলিত অর্থ অর্থাৎ লোকে যে অর্থে শব্দটাকে সচরাচর ব্যবহার বা প্রয়োগ করে থাকে৷ এটির সংস্কৃত নাম যোগারূঢ়ার্থ৷
উদাহরণস্বরূপ, ধর, ‘পঞ্চানন’ শব্দটি৷ শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থ অর্থাৎ ভাবারূঢ়ার্থ হচ্ছে ‘যার পাঁচটা মুখ আছে’৷ যোগারূঢ়ার্থ হচ্ছে শিব৷ দেশে পঞ্চানন নামে কত শত ভদ্রলোক আছেন৷ এখানে আসল অর্থটা হ’ল এমন কেউ বা এমন কিছু যার পাঁচটা মুখ আছে৷
প্রাচীনকালে দীক্ষার দু’টি পদ্ধতি ছিল৷ এই দুই দীক্ষা পদ্ধতির মধ্যে প্রথম ছিল বৈদিকী দীক্ষা৷ দ্বিতীয় তান্ত্রিকী দীক্ষা অর্থাৎ প্রথমে ৰৈদিক বিচার–আচার–পদ্ধত অনুযায়ী দীক্ষা আর তন্ত্রানুসারী দীক্ষা৷ বৈদিকী দীক্ষার মুখ্য মন্ত্র ছিল গায়ত্ত্রী মন্ত্র৷ বৈদিকী দীক্ষার মূলনীতি ছিল ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করার সৎপথ তথা আনন্দম্–এর পথ–নির্দেশ করা৷ তান্ত্রিকী দীক্ষার মূল নীতি ছিল সেই পথে এগিয়ে চলা৷ প্রথমটায় পরমাত্মার কাছে পথ– প্রদর্শনের জন্যে প্রার্থনা করা, আর দ্বিতীয়টিতে সাধক এগিয়ে চলে সেই পথে৷ তাই তান্ত্রিকী দীক্ষালাভের পরে সাধককে গুরুর নির্দেশানুসারে অগ্রসর হতে হয়৷
গতকাল রাতে বলেছিলাম–মন যাঁর ভাবনা নিতে পারে না ও মনের ভাববার যে শক্তি আছে, সেই শক্তি যাঁর থেকে আসে, তিনিই হচ্ছেন পরমপুরুষ৷ এইজন্যে পরমপুরুষের কাছে লুকোনো কিছু নেই৷ এই যে মন, তা আসলে কী জিনিস? পরমপুরুষের মৌলিক সত্তা যখন ঘনীভূত হয়ে যায়, তাতে জড়জগৎ–প্রপঞ্চের্ উৎপত্তি হয়ে থাকে৷ আর সেই প্রপঞ্চ যখন পরমপুরুষের আকর্ষণে তাঁর দিকে চলা শুরু করে দেয়, তখন অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষের কারণে জড়সত্তা চূর্ণীভূত হয়ে মনে রূপান্তরিত হয়ে থাকে৷ যেখানে মনের বিকাশ নেই সেখানে আমরা পাই গাছপালা, জীবজন্তু৷ আর যেখানে মনের অধিক বিকাশ হয়েছে, সেখানে আমরা পাই মানুষকে৷
প্রত্যেক বস্তুর নিজের নিজের ধর্ম আছে, নিজস্ব স্বাভাবিক লক্ষণ আছে৷ সেই লক্ষণ দেখেই মানুষ সংশ্লিষ্ট বস্তুর সঙ্গে পরিচিত হয়, তার নামকরণ করে৷ প্রত্যেক সত্তার, প্রত্যেক জীবের নিজের নিজের ধর্মে অটুট থাকা শ্রেয়স্কর৷
সোণা ও লোহার নিজেদের পৃথক পৃথক ধর্ম আছে৷ ঠিক তেমনি মানুষেরও নিজের ধর্ম আছে৷ মানুষ যদি নিজের ধর্ম থেকে, মানব ধর্ম থেকে দূরে সরে যায় তবে তাকে মানুষ বলব না৷ মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব তার নিজের ধর্মেই নিহিত৷ তাই তার পক্ষে স্বধর্মে সুদৃঢ় থাকাই বাঞ্ছনীয়৷
‘সৎ’ কী ও ‘অসৎ’ কী– এ সম্পর্কে যে বিচারৰোধ তাকে সদাসৎ বিবেক বলে, যা ‘সৎ’–কে ‘অসৎ’ থেকে ও ‘অসৎ’–কে ‘সৎ’ থেকে পৃথক করে দেয়৷ ‘সৎ’ কী? লৌকিক ভাষায় ‘সৎ’ মানে ভালো– সৎ ব্যষ্টি, সজ্জন ব্যষ্টি৷ আর আধ্যাত্মিক অর্থে ‘সৎ’ মানে অপরিণামী সত্তা– যাতে কোনো পরিবর্তন হয় না৷ আর ‘অসৎ’ মানে যা পরিণামী, যার অবস্থান্তর ঘটে৷ ‘সৎ’ বস্তু একই, বাদবাকী সব অসৎ৷ ‘অসৎ’ মানে খারাপ নয়, পরিবর্তনশীল৷
মানুষের অভীষ্ট পরমপুরুষকে লাভ করতে জ্ঞান, কর্ম, ভক্তি তিনেরই প্রয়োজন৷ জ্ঞান ও কর্মের মাধ্যমে ভক্তির জাগরণ হয়৷ আর এই ভক্তিই মানুষকে ভুমানন্দ প্রাপ্তির পানে নিয়ে চলে৷
ভক্তি ত্রুটি থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত কিন্তু জ্ঞান ও কর্ম তা নয়৷ জ্ঞানলাভ প্রায়শঃই মানুষকে অলস ও অহংকারী রূপে তৈরী করে৷ আর কর্মও মানুষের মধ্যে আনে আত্মম্ভরিতা৷ সাধক এই দু’য়ের ত্রুটি থেকে মুক্ত হতে না পারলে কেবলা ভক্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয় না যা পরমপুরুষকে পাবার জন্যে অতীব প্রয়োজন৷ তাই ৰুদ্ধিমান সাধক সেই উপায়ই অবলম্বন করবে যা তাকে জ্ঞান ও কর্মের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে মুক্ত রাখবে৷
(১৯৮০ সালের ১লা জানুয়ারী ‘আন্তর্জাতিক নববর্ষ’ উপলক্ষ্যে প্রদত্ত প্রবচন৷)
এই বিশ্বৰ্রহ্মাণ্ডে যা কিছু আছে সবই দেশ–কাল–পাত্রে আধৃত৷ কাল জিনিসটা কী? –না, কাল হচ্ছে ক্রিয়ার গতিশীলতার ওপর মানসিক পরিমাপ (Mental measurement of motivity of action)৷ দেশ আছে–সে চক্রাকারে বিবর্তিত হয়ে চলেছে৷ সেই বিবর্তনকে মেপে চলেছে মন৷ সেই মাপাটার নাম কাল৷ ব্যাপকভাবে এই কালকে বলব মহাকাল আর তার খণ্ডগত হিসেবকে বলব কাল৷ দেশগত বিবর্ত্তন না থাকলে কাল থাকে না৷ অর্থাৎ দেশ–পাত্র রহিত কাল হয় না৷
সংকোচনেই দুঃখ, আর ব্যাপ্তিতে পাওয়া যায় সুখ৷ মানুষ যখন ক্ষুদ্র ৰুদ্ধি তথা ক্ষুদ্র ভাবনার দ্বারা প্রেষিত হয়ে কাজ করে তখন সে ছোট হয়ে যায়, দুঃখ পায়, আর ৰৃহৎ ভাবনা নিয়ে কাজ করলে আনন্দ পায়, শান্তি পায়৷ যে মানুষ ক্ষুদ্র ভাবনা নিয়ে কাজ করে তার কী হয়? তার পথই বা কী? তার পথ বিশ্লেষণের পথ৷ এককে খণ্ড খণ্ড করার পথ৷ আর যে ৰৃহৎ ভাবনা নিয়ে কাজ করে, সে কী করে? সে অনেককে এক করে৷ তার পথ সংশ্লেষণের৷ তাই, সংশ্লেষণই জীবন ব্দম্ভুব্ধড়ন্দ্বব্দন্ব্ ন্ব্দ প্তন্ন্দ্রন্দ্বগ্গ সংশ্লেষণেই শান্তি ব্দম্ভুব্ধড়ন্দ্বব্দন্ব্ ন্ব্দ হ্মন্দ্ব্ত্রন্তুন্দ্বগ্গ আর বিশ্লেষণ মানে মৃত্যু প্তম্ভব্দন্ব্দ ন্ব্দ স্তুন্দ্ব্ত্রব্ধড়গ্গ৷
সাধনার ভিত্তিভূমি নৈতিকতা৷ প্রথমেই মনে রাখা দরকার যে এই নৈতিকতা (morality) সাধকের চরম লক্ষ্য (ultimate goal) নয়, আর এই নৈতিকতায় প্রতিষ্ঠিত হওয়া বা moralist হওয়া সাধকের জীবনে এমন কোনো একটা অবস্থা নয় যা অন্য কারুর চরম আদর্শ হতে পারে৷ সাধনামার্গে যাত্রা শুরু করবার ঠিক প্রথম ক্ষণটিতেই সাধকের যে মানসিক সামঞ্জস্যের প্রয়োজন সেটারই নাম নৈতিকতা বা morality৷...
পরমপুরুষের গুণ বর্ণন করা সম্ভব নয়৷ তবুও মানুষ আত্মতৃপ্তির জন্যে কিছু বলার, কিছু বর্ণনা করার চেষ্টা করে থাকে৷ বলা হয়েছে ––
‘‘প্রভুমীশমনীশমশেষ্ গুণহীনমহেশ গণাভরণম্৷’’
পরমপুরুষের গুণের আর শেষ নেই৷ আর মানুষের ক্ষুদ্র মন, ক্ষুদ্র কণ্ঠ সেই অশেষ গুণের বর্ণনা করবে কী করে? কবি পদ্মদন্ত পরমপুরুষের গুণের বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন ––
‘‘অসিতগিরিসমং স্যাৎ কজ্জ্বলং সিন্ধুপাত্রে
সুরতরুবরশাখা লেখনীপত্র মুর্বী৷
লিখতি যদি গৃহীত্বা সারদা সর্বকালং
তথাপি তব গুণানামীশ পারং ন যাতি৷৷’’
‘সৎ’ কী ও ‘অসৎ’ কী– এ সম্পর্কে যে বিচারৰোধ তাকে সদাসৎ বিবেক বলে, যা ‘সৎ’–কে ‘অসৎ’ থেকে ও ‘অসৎ’–কে ‘সৎ’ থেকে পৃথক করে দেয়৷ ‘সৎ’ কী? লৌকিক ভাষায় ‘সৎ’ মানে ভালো– সৎ ব্যষ্টি, সজ্জন ব্যষ্টি৷ আর আধ্যাত্মিক অর্থে ‘সৎ’ মানে অপরিণামী সত্তা– যাতে কোনো পরিবর্তন হয় না৷ আর ‘অসৎ’ মানে যা পরিণামী, যার অবস্থান্তর ঘটে৷ ‘সৎ’ বস্তু একই, বাদবাকী সব অসৎ৷ ‘অসৎ’ মানে খারাপ নয়, পরিবর্তনশীল৷
এই বিশ্বৰ্রহ্মাণ্ডে যা কিছু আছে সবই দেশ–কাল–পাত্রে আধৃত৷ কাল জিনিসটা কী? ক্রিয়ার গতিশীলতার ওপর মানসিক পরিমাপ –– ত্তন্দ্বুব্ধ্ত্রপ্ত প্পন্দ্ব্ত্রব্দব্ভব্জন্দ্ প্সন্দ্র প্পপ্সব্ধন্লন্ব্ধম্ভ প্সন্দ্র ন্তুব্ধন্প্সু৷ দেশ আছে৷ সে চক্রাকারে বিবর্ত্তিত হয়ে চলেছে৷ এই মাপাটার নাম কাল৷ ব্যাপকভাবে এই কালকে বলব মহাকাল৷ আর তার খণ্ডগত হিসেবকে বলব কাল৷ দেশগত বিবর্তন না থাকলে কাল থাকে না৷ অর্থাৎ দেশ–পাত্র রহিত কাল হয় না৷
‘‘যাবন্নক্ষীয়তে কর্ম শুভঞ্চাশুভমেবচ,
তাবন্নজায়তে মোক্ষো ণৃণাং কল্পশতৈরপি৷
যথা লৌহময়ৈঃ পাশৈঃ পাশৈঃ স্বর্ণময়ৈরপি,
তথা ৰদ্ধো ভবেজ্জীবো কর্মাভিশ্চ শুভাশুভৈঃ৷৷’’
(তন্ত্র)
এখন সংক্ষেপে ‘‘ওঁকার ও ইষ্টমন্ত্র’’ সম্বন্ধে তোমাদের কিছু বলব৷ জেনে বা না জেনে প্রতিটি জৈবিক সত্তা পরমপুরুষকে ভালবাসে, তাঁর ভালবাসা পেতে চায়৷ আর সৃষ্টির ঊষালগ্ণ থেকেই (আমি মানুষের সভ্যতার শুরু থেকে না বলে বলছি মানুষ সৃষ্টির প্রথম অবস্থা থেকে) তাদের সমস্ত আশা–আকাঙক্ষা জ্ঞাতে–জ্ঞাতে সেই পরমপুরুষের দিকেই প্রধাবিত হয়ে চলেছে৷
ওঁম্–কার কী? বেদে ওঁম্–কার সম্বন্ধে বলা হয়েছে–
‘‘সবে বেদা যৎপদমামনন্তি তপাংসি সর্বাণি চ যদ্ বদন্তি৷
যদিচ্ছন্তো ৰ্রহ্মচর্যং চরন্তি তত্তে পদং সংগ্রহেণ ব্রুবীম্যোমিত্যেতদ্৷৷’’
মানুষ সাধনা করে ঈশ্বর প্রাপ্তির জন্যে৷ এখন ঈশ্বর সম্প্রাপ্তিটা কেমন জিনিস? –না, নিজের সত্তাটা, নিজের অস্তিত্বৰোধটা পরমপুরুষে মিলিয়ে দেওয়া৷ এই মিলিয়ে দেওয়ার উপায়টা কী? সাধনার দ্বারা নিজেকে, নিজের সমগ্র সত্তাৰোধকে পরমপুরুষের কাছে নিয়ে যাওয়া ও এর সঙ্গে সঙ্গে আর কী করা? –না, কীর্তনের দ্বারা পরমপুরুষকে আকৃষ্ট করে তাঁকে নিজের নিকটে নিয়ে আসা৷
পূর্ব প্রকাশিতের পর,
ৰজ্রযানী তন্ত্রের যুগে তিন ধরণের তারা ছিলেন৷ ভারতে পূজিতা হতেন উগ্রতারা আর চীনে ভ্রামরী তারা৷ ভ্রামরী তারা বলা হ’ত কেননা রঙটা ভ্রমরের মত কালো৷ আর কিংপুরুষবর্ষে (সংস্কৃতে তিববতকে কিংপুরুষবর্ষ বলা হয়)৷ কেন ৰলা হয় তাও জেনে রাখো৷ তিববতে পুরুষ আর মেয়েদের পোষাক- পরিচ্ছদ অনেকটা এক রকমই-ঢিলাঢালা আলখাল্লা৷
তাই দূর থেকে ৰোঝা যায় না কে পুরুষ আর কে নারী৷ তাই ‘কিংপুরুষঃ’ মানে---ও কি পুরুষ? এটা বুঝতে গোলমাল হচ্ছে৷ তাই ‘কিং পুরুষঃ’---ও কি পুরুষ? আর ‘বর্ষ’ মানে দেশ৷ তাই ‘কিংপুরুষবর্ষ’ মানে যে দেশে পুরুষদের দেখে ৰোঝা যায় না ওরা পুরুষ কি না৷
বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে মূলসত্তা একটিই, তা হচ্ছে চিতিশক্তি৷ এই চিতিশক্তি চৈতন্যসত্তা আবার শক্তিসত্তাও বটে– এইভাবে চিতিশক্তি দুইয়েরই কাজ করে৷ এইজন্যেই একে চিতিশক্তি বলা হয়৷ বস্তু নয় কিন্তু বস্তুকে যে রূপ প্রদান করে তাই শক্তি বা প্রকৃতি৷ এই প্রকৃতিই বস্তুতে রূপ প্রদান করে প্রকারভেদ সৃষ্টি করে৷
কলিযুগ কী? যখন মানুষ ৰৌদ্ধিক অব্যবস্থা, ৰৌদ্ধিক অমিতব্যয়িতাকে নিয়ে চলতে থাকে, যখন তার শরীর ও মন আছে অথচ তার কর্মধারা বা আচরণ পশুর সমান হয়ে গেছে, সেই অবস্থাকেই বলে কলিযুগ৷ যে শুয়ে আছে, কী করতে হবে না করতে হবে ৰুঝতে পারছে না, সেই অবস্থাকে বলব কলিযুগ৷ বর্ত্তমান বিশ্বে চলছে কলিযুগ বিদ্বান ৰুদ্ধিমান ব্যষ্টি আর ধর্মের ব্যাখ্যাকারীরাও বলেন যে এটা কলিযুগ৷
সরস্বতী কোন বৈদিক দেবী নন। বেদেতে ‘সরস্বতী’ শব্দের উল্লেখ আছে কিন্তু সে সরস্বতী দেবী সরস্বতী নন। আগে ‘সরস্বতী’ শব্দটার মানে ৰলে দিই। সংস্কৃত ভাষায় ‘সরস্’ শব্দটার মানে হ’ল বড় জলাশয় অথবা শাদা রঙের আলো, শুভ্র জ্যোতিঃ। আর এই ‘সরস্’ যার আছে ইত্যর্থে ‘সরস্’ শব্দের উত্তর ‘মতুপ্’ প্রত্যয় করে ‘সর্স্বৎ’ শব্দ নিষ্পন্ন হচ্ছে যার স্ত্রীলিঙ্গের রূপ ‘সরস্বতী’। সরস্বতী মানে যার মধ্যে শাদা রঙের জ্যোতিঃ আছে অথবা যার অধীনে একটা বৃহৎ জলাশয় আছে। বেদে যে ‘সরস্বতী’ শব্দের উল্লেখ আছে : “অম্বিত মে নদীতমে দেবীতমে সরস্বতী”। এই সরস্বতী হ’ল একটা নদীর নাম। ‘নদী’ শব্দটাতেই ধরা পড়ে যাচ্ছে
আজ একজন সাধক মনকে একাগ্র করার পদ্ধতি সম্বন্ধে জানতে চেয়েছিল৷ তার প্রশ্ণ ছিল কীভাবে মন একাগ্রতার চরমাবস্থায় পৌঁছতে পারবে? এর উত্তর সব সাধকেরই জানা উচিত৷ ৰৌদ্ধিক বিচারে প্রতিটি জীবই তিন শ্রেণীভুক্ত–পশু, মানব ও দেবতা৷ আধ্যাত্মিক সাধনা হ’ল এক বিশেষ অভ্যাস যা পশুত্ব থেকে মানবত্বে ও মানবত্ব থেকে দেবত্বে প্রতিষ্ঠিত করে৷
কিছু মানুষ আছে যাদের মধ্যে এষণা আছে৷ কিন্তু তারা ঠিক পথ–নির্দেশনা পায়নি৷ তারা জানে যে, পরমপুরুষ তাদের জীবনের লক্ষ্য হওয়া উচিত, কিন্তু ঠিক ঠিক রাস্তা জানে না, সঠিক পথনির্দেশনা পায়নি৷ বই পড়ে সাধনা করা উচিত নয়, সাধনার জন্যে গুরু প্রয়োজন৷ বই পড়ে বা কারুর কাছে শুণে সাধনা করা বিপজ্জনকও কারণ এতে লক্ষ্য সম্পর্কে কোনো সুস্পষ্ট ধারণা তৈরী হয় না৷ কোন্ দিকে সে এগিয়ে যাচ্ছে ৰুঝতে পারে না৷ নৌকা চলছে, কিন্তু নৌকার যে চালক সে জানে না কোথায় যেতে হবে৷ তাহলে কী হবে? অযথা হয়রানি হবে৷ সে দুর্ঘটনারও শিকার হতে পারে৷
এই যে শরীর, এই যে মন, এ সবের জন্যে তো অর্থের, অন্ন–বস্ত্রের আবশ্যকতা আছে ঠিক কথা৷ মানুষ অর্থোপার্জনের চেষ্টা করবে, ঘরবাড়ী, জমি–জায়গার জন্যে চেষ্টা করবে৷ এ সবই ঠিক৷ কিন্তু যখন এই চেষ্টা করবে, চেষ্টা করার সময় মনে এই ভাবনা রাখতে হবে যে, ‘‘আমি এই সব পাওয়ার জন্যে চেষ্টা করছি এইজন্যে যে এ সব আমার আধ্যাত্মিক সাধনার সহায়ক হবে৷ এই সব জাগতিক বস্তুর লাভের উদ্দেশ্যে এ সবের সাধনা করছি না৷’’ মানুষ যখন নিজের স্থূল ভাবকে সূক্ষ্মভাবে রূপান্তরিত করতে থাকবে, তখন ক্রমশঃ সে বৈয়ষ্টিক ভাবনার দ্বারা পরিচালিত না হয়ে সামূহিক ভাবনার দ্বারা পরিচালিত হতে থাকবে৷
পরমপুরুষের স্বগতোক্তিটি কী? –না, সেই স্বগতোক্তি হচ্ছে ঃ
‘ময্যৈব সকলং জাতং ময়ি সর্বং প্রতিষ্ঠিতম্৷
ময়ি সর্বং লয়ং জাতি তদ্ ৰ্রহ্মাদ্বয়মস্ম্যহম্৷’
সব কিছু আমার থেকে উদ্ভূত হয়েছে, সব কিছু আমাতেই স্থিত রয়েছে, সব কিছু আমাতেই লীন হচ্ছে৷
‘ময্যৈব সকলং জাতং’৷ সব কিছু আমার থেকে সৃষ্ট হচ্ছে৷ অর্থাৎ তিনি চেয়েছিলেন যে তাঁর মনের মধ্যেই কিছু সৃষ্ট হোক, তাঁর মনের ভেতরেই একটা ভাবজগৎ তৈরী হোক, অর্থাৎ তিন তাঁর মানস কল্পনায় একটা বিশ্বসৃষ্টি রচনা করুন৷ আর তার ফলেই তৈরী হ’ল এই পরিদৃশ্যমান বিশ্ব৷
প্রাচীনকাল থেকেই লোকে বলে আসছে যে পরমপুরুষকে পাবার তিনটে পথ–জ্ঞান, কর্ম ও ভক্তি৷ তারা বলে, জ্ঞানের মাধ্যমে মানুষ ৰুঝে নেয় পরমাত্মা কী, মানুষ কী ও পরমাত্মাকে পাওয়ার মানে কী৷ এখন বিচার করতে হবে, জ্ঞান দিয়ে মানুষ কী ভাবে ৰুঝবে পরমাত্মা কী৷ মানুষের জ্ঞান–ৰুদ্ধির দৌড় আর কতদূর৷ মানুষের ৰ্রেন তো খুবই ছোট আর সেই ৰ্রেনও সে পেয়েছে পরমপুরুষের কাছ থেকেই,পরমাত্মার কাছ থেকেই৷ সেই ৰ্রেন দিয়ে সে কীভাবে পরমপুরুষকে পরিমাপ করবে সে কীভাবে ৰুঝবে পরমপুরুষ কেমন তাই লোকেরা যে বলে, মানুষ জ্ঞানের দ্বারা ৰুঝবে পরমপুরুষ কী, পরমাত্মা কী– একথা কতদূর সত্যি?
দুধের মধ্যে যে রকম ঘি ব্যাপ্ত হয়ে থাকে আর মন্থন করলে সেটা ওপরে উঠে আসে, ঠিক সেই রকম তোমার মধ্যে পরমপুরুষ ব্যাপ্ত আছেন সাধনারূপী মন্থনের দ্বারা তুমি তাঁকে পেয়ে যাবে৷ মন্থন করলে যে মাখন বেরিয়ে আসে, সেটাই পরমপুরুষ৷ তিনি তোমার ভিতরে আছেন ঘরের মধ্যে কোনো দেবতাকে তুমি বাহ্যিক পূজা করে, বহিরঙ্গিক সাধনার দ্বারা তাঁকে পাবে না৷ বরং সেটার দ্বারা তুমি তাঁর থেকে আরো দূরে সরে যাবে৷
যেসব দেশ অত্যন্ত ঠাণ্ডা সেই দেশগুলোতেই বসন্ত ঋতুর আবির্ভাব ভাল ভাবে ৰোঝা যায় ও লোকে বসন্ত ঋতুকে ভাল ভাবে খুশী মনে গ্রহণ করে৷ কিন্তু যেসব দেশে শীত প্রচণ্ড নয় সেইসব দেশে শরতেরই কদর বেশী৷ এই ৰাঙলাতেও জ্যোতিষিক মতে যাই হোক না কেন, ছ’টা ঋতুই আছে বটে কিন্তু আসলে তিনটে ঋতু–গ্রীষ্ম, বর্ষা ও শরৎ৷ শীত তো নামে মাত্র৷ গরম জামা বার করতে না করতেই আবার বাক্সে ভরতে হয়৷ সেই জন্যে এখানে শরৎকালের কদর সবচেয়ে বেশী৷ প্রধান ফসলটাও কেমন হবে শরতেই তার আন্দাজ পাওয়া যায়৷ বাকী বছরটা কেমন যাবে শরতেই তার আন্দাজ পাওয়া যায়৷ আকাশে শাদা মেঘ আর ধরিত্রীর কুশ–কাশ–শেফালী নূতন এক আমেজ এনে দেয়৷ তাই কেবল যে ভারতবর্ষের সংস্কৃত গ্
পরমসত্তা যখন প্রকৃতির ৰন্ধন থেকে মুক্ত, সেই অবস্থা হচ্ছে নির্গুণ আর ৰন্ধনযুক্ত পরমসত্তা সগুণ৷ সগুণেও আছে দু’টি বিভাগ–একটা তার রূপময় অস্তিত্ব আর অন্যটি অরূপ৷
মানুষের মধ্যে যে ৰুদ্ধি, ৰোধি, আমি–ৰোধ ঢ–ন্দ্রন্দ্বন্দ্বপ্তনু ইত্যাদি আছে এরা সব অরূপ৷ সেই রকম সগুণ ৰ্রহ্মেরও ৰুদ্ধি, ৰোধি ও আমি–ৰোধ অরূপ৷ সেইজন্যে সেগুলির কোনটাই আমরা দেখতে পাই না৷
ৰুদ্ধির মান অনুযায়ী জীবকে তিনটি শ্রেণীতে ভাগ করা যেতে পারে–পশু, মানব আর দেবতা৷ আমাদের মানব সমাজেও আমরা পাই মানবীয় আধারে পশু, মানবীয় আধারে মানব আর মানবীয় আধারে দেবতা৷
যেসব দেশ অত্যন্ত ঠাণ্ডা সেই দেশগুলোতেই বসন্ত ঋতুর আবির্ভাব ভাল ভাবে ৰোঝা যায় ও লোকে বসন্ত ঋতুকে ভাল ভাবে খুশী মনে গ্রহণ করে৷ কিন্তু যেসব দেশে শীত প্রচণ্ড নয় সেইসব দেশে শরতেরই কদর বেশী৷ এই ৰাঙলাতেও জ্যোতিষিক মতে যাই হোক না কেন, ছ’টা ঋতুই আছে বটে কিন্তু আসলে তিনটে ঋতু–গ্রীষ্ম, বর্ষা ও শরৎ৷ শীত তো নামে মাত্র৷ গরম জামা বার করতে না করতেই আবার বাক্সে ভরতে হয়৷ সেই জন্যে এখানে শরৎকালের কদর সবচেয়ে বেশী৷ প্রধান ফসলটাও কেমন হবে শরতেই তার আন্দাজ পাওয়া যায়৷ বাকী বছরটা কেমন যাবে শরতেই তার আন্দাজ পাওয়া যায়৷ আকাশে শাদা মেঘ আর ধরিত্রীর কুশ–কাশ–শেফালী নূতন এক আমেজ এনে দেয়৷ তাই কেবল যে ভারতবর্ষের সংস্কৃত গ্
যদি কোন ৰৃহৎ বা ভারী বস্তুকে কেউ এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যেতে চায়, তার পক্ষে সবচেয়ে ৰুদ্ধিমানের কাজ হবে সেই বস্তুটার ৰীজটাকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়া৷ একটা গোটা বটগাছকে এক স্থান থেকে অন্যত্র নিয়ে যাওয়া খুব শক্ত৷ কিন্তু সেই বটবৃক্ষের একটা ছোট্ট ৰীজকে নিয়ে যাওয়া সহজ৷ ৰীজটাকে নিয়ে গেলেই গাছটাকে নিয়ে যাওয়া হ’ল৷
প্রাচীন সংস্কৃত শব্দভাণ্ডারে বছরে ছ’টা ঋতুর উল্লেখ আছে৷ গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসন্ত৷ কিন্তু ভারতের অনেক স্থানে, বিশেষ করে সমুদ্রের তটবর্তী এলাকায় তথা পূর্ব ভারতে মূলতঃ চারটে ঋতু৷ সেগুলি হচ্ছে গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ ও শীত৷ ৰাঙলায় শীত ঋতু শেষ হতে না হতেই গরম শুরু হয়ে যায়৷ তাই বসন্ত ঋতু এখানে পনেরো দিনের জন্যেও স্থায়ী হয় না, আর হেমন্ত তো শীতেরই অঙ্গ৷
আমাদের শরীরে আটটি চক্র আছে৷ মূলাধার, স্বাধিষ্ঠান, মণিপুর, অনাহত ও বিশুদ্ধ– এই পাঁচ চক্র আর এর ওপর আজ্ঞাচক্র, গুরুচক্র ও সহস্রারচক্র*৷ এই হ’ল অষ্টকমল৷ পরমাত্মার লীলা এই অষ্টকমলকে নিয়ে৷
সাধনায় যখন মানুষ এগিয়ে যায় তখন কী হয়?
‘‘সর্বতঃ পাণিপাদং
তৎ সর্বতোক্ষিশিরোমুখম্৷
সর্বতঃ শ্রুতিমল্লোঁকে সর্বসাবৃত্য তিষ্ঠতি৷৷’’
এই অষ্টকমল যখন ফোটে, তা কেমন করে ফোটে? মানুষ যখন মনের সমস্ত ভাবনা নিয়ে পরমপুরুষেরই উপাসনা করে তখন সমস্ত ভাবনা, সমস্ত আকুতি একের দিকেই ছুটে যায়৷
গতে যেসব বস্তুকে আমরা নিত্য বলে মানি তাদের নিত্যতাপ্রদানকারীও পরমপুরুষ৷ বস্তু হ’ল প্রতিফলিত সত্তা–রিফ্লেক্টেড এণ্টিটি৷ চেতন বস্তুর মনঃশক্তিও তাঁর থেকেই এসেছে৷ তিনি সকলের প্রয়োজনের পূর্তি ঘটান–পিঁপড়ে থেকে হাতী পর্যন্ত, ছোট ছোট জীব থেকে সমুদ্রের বড় বড় জানোয়ার পর্যন্ত সকলের৷ এতই উদার তিনি৷ সেইজন্যেই তিনি জগতের কর্তা, অধিকর্তা, প্রভু৷ এই রকম উদারতা লাভ করতে পারলে তুমিও তিনি হয়ে যাবে৷
কখনও এই পরিস্থিতি আসতে পারে তুমি বিরাট শক্তিশালী সত্তার কাছে পঁৌছে গেছ, যাকে তুমি খুব ভয় পাও৷ এই যে শক্তিশালী সত্তা, তার শক্তি বা তার সাহস আসছে কোথা থেকে? সেও তোমার পিতার কাছে থেকেই আসছে৷ নিজের শক্তি বলে কারোর কিছু আছে কি? না, তা নেই৷ খাদ্য, হাওয়া, জল, মাটি ইত্যাদি দ্বারা পরমপিতা শক্তি প্রদান করেন৷ ধর, এক বিরাট শক্তিশালী পালোয়ান– সেটা কি তার নিজের শক্তি? না, তা নয়৷ সে শক্তি তোমার পরমপিতার৷ তাই তার থেকে তুমি ভয় কেন পাবে?
মানুষ সাধনা করে ঈশ্বর প্রাপ্তির জন্যে৷ এখন ঈশ্বর সম্প্রাপ্তিটা কেমন জিনিস? –না, নিজের সত্তাটা, নিজের অস্তিত্বৰোধটা পরমপুরুষে মিলিয়ে দেওয়া৷ এই মিলিয়ে দেওয়ার উপায়টা কী? সাধনার দ্বারা নিজেকে, নিজের সমগ্র সত্তাৰোধকে পরমপুরুষের কাছে নিয়ে যাওয়া ও এর সঙ্গে সঙ্গে আর কী করা? –না, কীর্তনের দ্বারা পরমপুরুষকে আকৃষ্ট করে তাঁকে নিজের নিকটে নিয়ে আসা৷
দুধের মধ্যে যে রকম ঘি ব্যাপ্ত হয়ে থাকে আর মন্থন করলে সেটা ওপরে উঠে আসে, ঠিক সেই রকম তোমার মধ্যে পরমপুরুষ ব্যাপ্ত আছেন সাধনারূপী মন্থনের দ্বারা তুমি তাঁকে পেয়ে যাবে৷ মন্থন করলে যে মাখন বেরিয়ে আসে, সেটাই পরমপুরুষ৷ তিনি তোমার ভিতরে আছেন ঘরের মধ্যে কোনো দেবতাকে তুমি বাহ্যিক পূজা করে, বহিরঙ্গিক সাধনার দ্বারা তাঁকে পাবে না৷ বরং সেটার দ্বারা তুমি তাঁর থেকে আরো দূরে সরে যাবে৷
আমি নানান স্থানে, নানান অনুষ্ঠানে একটা কথা বলেছি–মানসিক সাম্য অথবা মানসিক সাম্যাবস্থা৷ ভগবান শিবের একটি উক্তি আছে, জীবনে সম্পূর্ণ সফল হওয়ার পিছনে চতুর্থ তত্ত্বটি হ’ল ‘সমতাভাব’, অর্থাৎ মানসিক সাম্য, মানসিক ভারসাম্য৷ মনে কোন রকম কম্প্লেক্স রাখলে চলবে না৷ না মহামান্যতা ৰোধ, না হীনমন্যতা ৰোধ৷
পাঞ্চভৌতিক উপাদানে তৈরী এই জড় জগতটাকে যেমন উপেক্ষা করা যায় না, মানুষের মন যা চৈত্তিক ধাতু (Ectoplasmic stuff) দিয়ে তৈরী, তাকেও তেমনি উপেক্ষা করা যায় না৷ ঘর্ষণে প্রতিঘর্ষণে জড়জগৎ থেকেই মনের উদ্ভব হয়৷ আবার ঘর্ষণে প্রতিঘর্ষণে মানসিক অনুশীলনে মন থেকেই আত্মার বিস্তৃতি ঘটে৷ এই কারণে মানসিক অনুশীলনকেও উপেক্ষা করা যায় না৷ আর মানসিক অনুশীলনের পরে যখন মানুষের সত্তা অধিকতর আত্মিক স্তরে উন্নীত হতে থাকে তখন স্বাভাবিক নিয়মেই সে পরমপুরুষের সঙ্গে মিলে যেতে চায়, মিশে যেতে চায়৷ ক্ষুদ্রত্বকে ৰৃহত্ত্বে পর্যবসিত করতে চায়, কারণ বিস্তারিত হওয়া একটা মানবধর্ম–এটা একটা ভাগবৎ ধর্ম৷
সৃষ্টির প্রারম্ভের আগের কথা৷ সে সময় দেশ–কাল–পাত্রের মত সাপেক্ষ সত্তা ছিল না৷ একমাত্র ছিল অখণ্ড অসীম, ৰৃহৎ, সর্বব্যাপী সত্তা, আর সেই সত্তার সাক্ষিত্বরূপে ছিলেন পরমপুরুষ৷ সেই অখণ্ড সৃষ্টির রচয়িতা পরমপুরুষ নিজেকেই অনেক রূপে নানাপ্রকারে অভিব্যক্ত করলেন৷
‘‘ত্বং স্ত্রী ত্বং পুমানসি, ত্বং কুমার উত বা কুমারী৷
ত্বং জীর্নোদণ্ডেন বঞ্চয়সি ত্বং জাতো ভবসি বিশ্বতোমুখঃ৷’’
‘‘নীলঃ পতংগো হরিতো লোহিতাক্ষ
স্তত্তিদ্গর্ভ ঋতবঃ সমুদ্রাঃ৷
অনদিমত্বং বিভুত্বেণ বর্ত্তসে
যতোজাতানি ভুবনানি বিশ্ব৷৷’’
(ইতোমধ্যেই ‘যজ্ঞ প্রসঙ্গে’ (১) প্রবচনটি প্রকাশ করা হয়েছে৷ ‘যজ্ঞ প্রসঙ্গে’ প্রদত্ত অন্যান্য প্রবচনগুলি ক্রমান্বয়ে প্রকাশ করা হবে৷ –সম্পাদক)
যজ্ঞ সম্বন্ধে বলছিলাম৷ বলেছিলাম, যজ্ঞ শব্দটার আসল মানে হ’ল কর্ম৷ ‘যজ্’ ধাতু আর ‘কৃ’ ধাতুর মানে একই রকমের৷ যজ্ঞ বা কর্ম তিন ধরনের –– জাগতিক কর্ম, পিতৃকর্ম, আর দৈবকর্ম৷ আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্যে দেবী বা দেবতাদের উদ্দেশ্যে যে কর্ম করা হয় তাকে বলা হয় দৈবযজ্ঞ, পিতৃলোকের জন্যে যা করা হয় তাকে বলা হয় পিতৃযজ্ঞ ও জগতের জন্যে যা করা হয় তাকে বলা হয় জাগতিক কর্ম বা সামাজিক কর্ম৷
‘‘ঈশ্বর–প্রণিধান’’ জিনিসটা... দাঁড়াচ্ছে–মনকে সেই পরমাশ্রয়ে প্রতিষ্ঠিত করবার জন্যে তাঁর পানে ছুটিয়ে নিয়ে চলা৷ তাই ঈশ্বর–প্রণিধান জিনিসটা সম্পূর্ণ ভাবাশ্রয়ী–সম্পূর্ণতই একটা মানস ঙ্(আধ্যাত্মিক) প্রচেষ্টা৷ এতে চীৎকার করে লোক জড় করবার বা ঢ়াক–ঢ়োল পিটিয়ে ভক্তি দেখাবার অবকাশ নেই৷....
জীবনের গতি সর্বদা পরম লক্ষ্যের দিকে কিন্তু জড় প্রকৃতি তাকে সবসময় নিজের দিকে আকর্ষণ করার চেষ্টা করতে থাকে৷ নিজের সঙ্গে লড়াই করতে করতে মানুষের শক্তি যখন আর কিছুই করতে পারে না, সেই সময়ের যে অবস্থা তাকে বলে মৃত্যু৷ এমনিতে শরীর থেকে প্রাণশক্তি যখন বেরিয়ে যায়, সেই সময়ের যে পরিস্থিতি তাকে মৃত্যু বলা হয়---এটা স্বাভাবিক তথা গৌণ মৃত্যু৷ কিন্তু মানুষের আবার অকাল মৃত্যুও হয়৷ আসলে প্রকৃতির এই আসুরী শক্তির সঙ্গে সংগ্রাম করে নিজেকে চরম লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার যে প্রয়াস তাকেই জীবন বলে৷ তমোগুণী বৃত্তিগুলো সমাজের সর্বত্র ব্যাপ্ত থেকে মানুসের চরম লক্ষ্যপ্রাপ্তির পথে বাধা সৃষ্টি করছে৷ যে এই আসুরী বৃত্ত
ইষ্ট ও আদর্শের মধ্যে কী সম্পর্ক? ইষ্ট ব্যতিরেকে মানুষ নিজেকে আদর্শে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে না৷ তেমনই আদর্শ ছাড়া ইষ্টে প্রতিষ্ঠিত হওয়া অসম্ভব৷ দৃষ্টান্ত দিয়ে ৰলতে গেলে নীচের উদাহরণটি উল্লেখ করা যেতে পারে৷ প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর আগে, কোন দুই দেশের মধ্যে লড়াই চলছিল যাদের ধর্মমত (ৰৌদ্ধ) একই ছিল৷ সৈনিকেরা যখন যুদ্ধে যেত তখন তাদের মায়েরা নিজ নিজ সন্তানদের জীবনের সুরক্ষার জন্যে ভগবান ৰুদ্ধের কাছে প্রার্থনা করত৷ ভগবান ৰুদ্ধ কী করৰেন? এদের ৰাঁচাৰেন না ওদের ৰাঁচাৰেন?
কিছু দিন আগে বাঙ্গালোরে সাধকদের সামনে পাপ ও পুণ্য সম্পর্কে কিছু বলেছিলুম কিন্তু এখানে একটি ছেলে আমাকে অনুরোধ করেছে সে সম্পর্কে আরও কিছু বলবার জন্যে৷ তাই আমি তার ‘আদেশ’ প্রতিপালন করছি মাত্র৷ বলা হয়েছে,
‘‘ত্যজ দুর্জনসংসর্গং ভজ সাধুসমাগমম্৷
কুরুপুণ্যমহোরাত্রং স্মর নিত্যমনিত্যতাম্ ৷৷’’
***
গতরাতে আমি মানুষ জীবনের বিভিন্ন স্তরে, বিভিন্ন দিশায় যে চলে সে সম্বন্ধে কিছু ৰলেছিলুম৷ এখন, জীবনের সফলতা লাভের প্রসঙ্গে এক চিরন্তন প্রশ্ণ আছে৷ কিছু মানুষ অনেক কিছু করেও শেষপর্যন্ত ব্যর্থ হয়, আবার কিছু মানুষ অল্প সময়ের জন্যে কিছু করে আর সাফল্যের শিরোপায় ভূষিত হয়৷ এর পিছনে রহস্যটি কী? কেন একজন সফল হয়, আর একজন তা হয় না?
সূক্ষ্ম নন্দনতত্ত্বের ওপর আধারিত নান্দনিক অভীপ্সা যখন একটা নির্দিষ্ট উচ্চ মানে পৌঁছে যায় তাকে বলে মিষ্টিসিজম্৷ আর এই মিষ্টিসিজম্ যখন মানবীয় গরিমা মহিমার শীর্ষে বা শ্রেষ্ঠত্বের পর্যায়ে চলে আসে তাকে বলে আধ্যাত্মিকতা (spirituality)৷ এখন মিষ্টিসিজম্ কী? মিষ্টিসিজম্ হ’ল সীমার সঙ্গে অসীমের, ক্ষুদ্র ‘আমি’র সঙ্গে ৰৃহৎ ‘আমি’র বা আত্মার সঙ্গে পরমাত্মার সম্পর্ক নির্ণয়ের এক নিরন্তর প্রয়াস৷
‘‘এক এব সুহূদ্ধর্ম নিধনেহপ্যনুযাতি যঃ’’৷ ধর্মই তোমার একমাত্র সুহৃদ (এক ধরণের বন্ধু যা মৃত্যুর পরেও মানুষের সঙ্গে থেকে যায়)৷ সংস্কৃতে ‘বন্ধু’ শব্দের কয়েকটিই প্রতিশব্দ রয়েছে৷
‘‘অত্যাগসহনো বন্ধুঃ সদৈবানুমতঃ সুহৃদ৷
একক্রিয়ং ভবেন্মিত্রং সমপ্রাণাঃ সখা স্মৃতঃ৷৷’’
‘‘অত্যাগসহনো বন্ধুঃ’’৷ যে বিচ্ছেদ–বেদনা সহ্য করতে পারে না সে–ই বন্ধু৷ যার সঙ্গে তোমার ভালবাসার সম্পর্ক এতই দৃঢ় যে তোমার বিচ্ছেদ তার কাছে অসহনীয় বলে মনে হচ্ছে তাকেই বলব বন্ধু৷ পারস্পরিক স্নেহ–ভালবাসার এই বন্ধন এতই দৃঢ় যে সে তোমার কাছ থেকে দূরে থাকতে পারে না–তোমার সঙ্গে বিচ্ছেদ সহ্য করতে পারে না৷
গড়পড়তা ৰৌদ্ধিক মাপের একজন মানুষের কাছে জল ও বরফ দু’টি পৃথক সত্তা কিন্তু যারা সত্য সম্পর্কে অল্পকিছু জানে তারা ৰোঝে জলের ঘনীভূত রূপই বরফ৷ একইভাবে সাধারণ মানের মানুষ যখন একটা পাত্র ও কুম্ভকারের ঙ্মযে পাত্রটি তৈরী করেছেৰ মধ্যে একটা বিরাট পার্থক্য দেখে, ব্রহ্মজ্ঞানী সেখানে দুই–কে একইভাবে দেখে৷ এই যে জগত আর ব্রহ্ম–এ দু’টো কি পৃথক সত্তা না তারা অবিভাজ্য, একটা সত্য আর অন্যটা কি মিথ্যা? এ দু’টো সত্তার মধ্যে যে পার্থক্য চোখে পড়ে তা কি সত্য না মায়া?–এ ধরনের প্রশ্ণ বা চিন্তা–ভাবনা ব্রহ্মজ্ঞদের মনে কখনও আসে না৷
প্রতিটি কাজেই তোমাদের জানা উচিত কোন্টা কী ও কীজন্যে, কেন কেন এটা করছ, কেন ওটা করছ না৷ অতীতে আমি অনেকবারই বলেছি যে মানবসমাজ একটা একক সত্তা৷ এটা অবিভাজ্য, এটাকে নানান টুকরোয় বা অংশে ভাগ করা যায় না, কারণ মূলতঃ মানবতা এক৷
য একো জালবানীশত ঈশনীভিঃ
সর্বালঁলোকানীশত ঈশনীভিঃ৷
য এবৈক উদ্ভবে সম্ভবে চ
য এতদ্বিদুরমৃতাস্তে ভবন্তি৷৷*
এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড যিনি সৃষ্টি করেছেন তিনি একজন বিরাট জাদুগর৷ তিনি তাঁর পরম ঐন্দ্রজালিক শক্তিবলে বিশ্ব সৃষ্টি করেছেন, তাকে নিয়ন্ত্রণও করছেন তিনিই৷ সৃষ্টিতে এমন কেউ নেই, এমন কিছুই নেই যাকে তিনি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না বা করেন না৷ সত্যি বলতে কি, এই বিশ্ব চরাচরের প্রতিটি সত্তাই তাঁকে মেনে চলে, তিনি তাঁর প্রাকৃত শক্তির মাধ্যমে সবাইকার ওপর, সব কিছুর ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখেন৷
অপি চেৎ সুদুরাচারো ভজতে মামনন্যভাক্৷
সোপি পাপবিনির্মুক্তো মুচ্যতে ভবৰন্ধনাৎ৷৷*
‘দুরাচারী’ তাকেই বলে যার কাজে সমাজ প্রভাবিত হয়, ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যার আচরণ সমাজের পক্ষে ক্ষতিকারক৷ আর যে দুরাচারীকে অন্য দুরাচারীরা তাদের সমাজে ‘দুরাচারী’ বলে থাকে সে হ’ল সুদুরাচারী৷ শাস্ত্রে বলা হয়েছে, তর্কশাস্ত্রেও বলা হয়েছে, যেমন কর্ম তেমনি প্রতিকর্ম৷ তবে স্থান–কাল–পাত্রের পরিবর্তন ঘটলে প্রতিকর্মেরও কম–বেশী তারতম্য ঘটে থাকে৷
মানুষ মাত্রেই সূর্যালোকের সাহায্যে দেখে থাকে৷ বলতে পারি, সূর্য হ’ল মানুষের চক্ষুস্বরূপ৷ কিন্তু চোখের কোন ত্রুটি থাকলে মানুষ দেখতে পায় না৷ তার জন্যে সূর্যকে তো আর দায়ী করা যায় না৷
এই জগতে তোমরা মুখ্যতঃ তিন ধরনের মানুষ দেখতে পাবে ঃ উত্তম, মধ্যম ও অধম৷ প্রথম শ্রেণীর মানুষ বলব তাদের যাদের চিন্তায়, বাচনিকতায় ও কর্মে মিল আছে অর্থাৎ তারা যেমনটি ভাবে তেমনটিই বলে৷ আবার যেমনটি বলে তেমনটি কাজেও করে৷ এরা হ’ল উত্তম শ্রেণীর মানুষ৷
দ্বিতীয় শ্রেণীর মানুষ হ’ল তারা যাদের চিন্তায় ও বাক্যে মিল নেই৷ কিন্তু তারা মুখে যা বলে কাজে তা–ই করে, অর্থাৎ তারা মনে মনে ভাবে এক রকম কিন্তু মুখে বলে আর এক রকম৷ তবে তারা মুখে যা বলে কাজেও তা–ই করে৷ এরা হ’ল মধ্যম শ্রেণীর মানুষ৷
এই মহাবিশ্ব অজস্র স্পন্দনের সমাহার৷ এই যে পরিদৃশ্যমান জগৎ যাকে সাধারণ ভাবে ‘প্রপঞ্চ’ আখ্যায় অভিহিত করে থাকি তা মূলতঃ মানস জগৎ ও অতিমানস জগতের অধিক্ষেত্রভুক্ত৷ এই স্পন্দনরাজি সংখ্যায় অসংখ্য....অগুন্তি কিন্তু অনন্ত নয়৷ যদি তারা অনন্ত হত তাহলে সৃষ্টিটাও অনন্ত হত৷ তবে হ্যাঁ, তরঙ্গ–রাজির সংখ্যা অজস্র....অগণিত৷ কিন্তু তা কোন মতেই অনন্ত নয়৷
‘আমি পরমপুরুষের দাসানুদাস, তাঁর কাজ তিনিই করছেন, আমি তাঁর যন্ত্রমাত্র’–এই যে মানসিকতা একেই বলে ‘প্রপত্তি’৷ ‘প্রপত্তি’ শব্দের ব্যুৎপত্তি হ’ল ঃ প্র–পত্ ক্তিন্ ঞ্চ প্রপত্তি৷ প্রপত্তিভাবের সাধক দুঃখকে দুঃখ, সুখকে সুখ বলে আদৌ মনে করেন না বস্তুতঃ সুখ–দুঃখকে তিনি সমভাবে প্রসন্নচিত্তে গ্রহণ করেন৷
যে পরোপকার করে সে মহৎ৷ পরোপকার করার জন্যে অনেক টাকা–পয়সার দরকার নেই৷ তোমার কাছে বর্তমানে যে সম্পদ আছে তাতেই তুমি পরোপকার কর৷ শরীর যদি সবল থাকে তাহলে শরীর দিয়ে কর, অর্থ থাকলে অর্থ দিয়ে কর, ৰুদ্ধি থাকলে ৰুদ্ধি দিয়ে কর–আর কিছু না থাকলে সদ্ভাবনা দিয়ে কর৷ পরোপকারের দ্বারাই মানুষ মহৎ হয়, আর যেখানে পরোপকারের ভাবনা নেই সেখানে সে ক্ষুদ্র বা ছোট হয়ে যায়৷
মানব সভ্যতার ঊষালগ্ণ থেকে মানুষ বলে আসছে আর তাই দিয়ে সাধারণ মানুষকে ভয় দেখিয়ে বলছে যে যদি তুমি এটা করো তবে স্বর্গ পাবে আর যদি না করো তবে নরকে যাবে৷ একটা হ’ল স্বর্গ বা বেহেস্ত (Heaven), অপরটা হ’ল নরক বা দোজখ্ (Hell)৷ এ বিষয়ে কত রঙ-বে-রঙের চিত্র দেখিয়ে সাধারণ বিশ্বাসপ্রবণ মানুষকে ৰোঝানো হয় যে নরকবাসীদের কী দুঃসহ যাতনায় না ভুগতে হয়৷ আর যারা কর্মগুণে স্বর্গে যায় তারা কী অপূর্ব আনন্দে না দিন কাটায়৷ তারা সোণার পালঙ্কে শোয়, রুপোর পালঙ্কে পা বিছিয়ে আরাম করে আর শুয়ে শুয়ে তারা চর্ব-চূষ্য-লেহ্য-পে ভোগ করে৷ গত কয়েক হাজার বছর ধরে এই ধরনের বহুতর গাল-গল্প চলে আসছে, এই ধরনের ডগমা বা ভাবজড়তা শাখা প্রশাখায় প
জীবের আধার প্রয়োজন৷ আধার ছাড়া হ’লে সে ব্রহ্ম–সমুদ্রে মিশে যায়৷ যেমন পুকুরে একবাটি জল, যতক্ষণ বাটি আছে ততক্ষণ বাটির জলও আছে, কিন্তু বাটি সরিয়ে নিলে বাটির জল পুকুরের জলেই মিশে যায়৷ যে জলের আধার ছিল বাটি, সেই আধার সরিয়ে নেবার পর তার জল পুকুরের জলের সঙ্গে এক হয়ে যায়৷ এইরূপ আধার হীন হ’লে জীবও ব্রহ্মে মিশে যায়৷
এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে যা কিছু আছে সবই দেশ–কাল–পাত্রে আধৃত৷ কাল জিনিসটা কী? ক্রিয়ার গতিশীলতার ওপর মানসিক পরিমাপ –– Mental measurement of motivity of action৷ দেশ আছে৷ সে চক্রাকারে বিবর্ত্তিত হয়ে চলেছে৷ এই মাপাটার নাম কাল৷ ব্যাপকভাবে এই কালকে বলব মহাকাল৷ আর তার খণ্ডগত হিসেবকে বলব কাল৷ দেশগত বিবর্তন না থাকলে কাল থাকে না৷ অর্থাৎ দেশ–পাত্র রহিত কাল হয় না৷
আগে বলেছিলুম, ভালো কাজের জন্যে জিদ্ চাই৷ তাই সাধকের মনে জিদ্ থাকা দরকার৷ শাস্ত্রে আছে, পার্বতী শিবকে জিজ্ঞাসা করলেন, কে এই সংসারে উন্নতি করে, কী তার রহস্য? দেখতে পাচ্ছি, কেউ বড় বড় কাজ করে জীবনে মহান হয়, কেউ বা শুয়ে বসেই থাকে চিরকাল৷ কেউ কেউ তো কলুর বলদ হয়েই থেকে যায়, আবার কারো কারো উন্নতি হয়৷ কেউ অনেক পড়েও খারাপ ফল করে, কেউ বা অল্প পড়েও ভাল ফল করে৷ এই সমস্ত কিছুর পিছনে রহস্য কী?
উত্তরে শিব বললেন,
‘‘ফলিষ্যতীতি বিশ্বাসঃ সিদ্ধের্প্রথমলক্ষণ৷
দ্বিতীয়ং শ্রদ্ধয়া যুক্তং তৃতীয়ং গুরুপূজনম্৷৷
চতুর্থো সমতাভাবঃ পঞ্চমেন্দ্রিয়নিগ্রহ৷
যারা অনন্যমনসা–অনন্যভাক্ হয়ে পরমপুরুষের ভজনা করে, জাগতিক অন্যান্য চিন্তা–ভাবনাকে পরিত্যাগ করে মানসচিন্তায় সুকোমল মসৃণতা নিয়ে কেবল পরমপুরুষের দিকেই এগিয়ে যায় তারা গোপী৷ এই রকম ধরণের গোপীদের ছবি আঁকা যায় না৷ কারণ গোপীর গোপীত্ব তার অন্তরের সুকোমল ভাবরাজি, তার অন্তরের অন্তঃস্থলে নিহিত৷ এটা একেবারে ভেতরের জিনিস–মনের জিনিস৷ এই ধরণের ভক্তি ভাবসমন্বিত গোপীদের ভাষাও ব্যক্ত করা যায় না৷
ভক্তের সম্পর্কে, সাধকের সম্পর্কে, পরমপুরুষের প্রতি যার প্রেম রয়েছে তার সম্পর্কে ভগবান কৃষ্ণের কিছু মূল্যবান উক্তি রয়েছে৷ এ সম্বন্ধে আজ আমি কিছু বলব৷
ভগবান বলছেন,
‘‘শ্রেয়ান্ স্বধর্মো বিগুণঃ
পরধর্মাৎ স্বানুষ্ঠিতাৎ৷
স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়ঃ
পরধর্মো ভয়াবহঃ৷৷’’
...ব্রহ্মাস্মি বিজ্ঞান যদি কেবল শাব্দিক স্তরে সীমিত থাকে, তাতেও কোন কাজ হবে না৷ এ জন্যে ‘সোহং’ মন্ত্রের পরিচ্ছেদহীন ভাবনা নিতে হবে৷ এই যে অ–পরিচ্ছিন্ন ভাবনা, এ ভাবনা বাচনিক জপে সম্ভব নয়৷ মানস তথা অধ্যাত্মসাধনার এই যে সূক্ষ্মবিজ্ঞান, এটা তন্ত্রেরই আবিষ্কার ঙ্মতন্ত্র ও যোগের মধ্যে মূলতঃ কোন পার্থক্য নেই৷ তন্ত্রেরই সূক্ষ্মতর সাধনার নাম যোগমার্গৰ৷ সাধনামার্গে জপক্রিয়া ও ধ্যানক্রিয়া মহাকৌলেরই ব্যবস্থা৷ কেবল জপেও কোন কাজ হবে না, যদি মন্ত্রের গতিধারার সঙ্গে মনের গতিধারা সমান তালে না চলে৷ মনে মনে জপও করছি, আবার তার সঙ্গে অন্যের ক্ষতির চিন্তাও করছি–এ ধরনের জপ নিষ্ফল৷ জপক্রিয়ায় সাফল্য লাভ করতে গেলে স
জ্ঞান সাধনা
প্রত্যেক বস্তুর মধ্যে পরমাত্মাকে দর্শন করার মানুষের যে প্রয়াস সেটা তার জ্ঞানসাধনা তাহলে জ্ঞানসাধনার সিদ্ধি কী? সকল বস্তুকে পরমাত্মা–রূপে দেখা৷ যদি কেউ তা করতে পারে তাহলে জ্ঞানসাধনায় সিদ্ধিলাভ হ’ল কি না বা তার ফল কী হ’ল, তা ৰোঝবার জন্যে কাউকে জিজ্ঞাসা করারও প্রয়োজন পড়বে না৷ যখন সবকিছুর মধ্যে পরমাত্মার স্বরূপ দেখবে তখন নিজেই ৰুঝে নেবে যে জ্ঞানসাধনায় সিদ্ধিলাভ হয়ে গেছে৷
আত্মস্থীকরণ
এখন সংক্ষেপে ‘‘ওঁকার ও ইষ্টমন্ত্র’’ সম্বন্ধে তোমাদের কিছু বলব৷ জেনে বা না জেনে প্রতিটি জৈবিক সত্তা পরমপুরুষকে ভালবাসে, তাঁর ভালবাসা পেতে চায়৷ আর সৃষ্টির ঊষালগ্ণ থেকেই (আমি মানুষের সভ্যতার শুরু থেকে না বলে বলছি মানুষ সৃষ্টির প্রথম অবস্থা থেকে) তাদের সমস্ত আশা–আকাঙক্ষা জ্ঞাতে–জ্ঞাতে সেই পরমপুরুষের দিকেই প্রধাবিত হয়ে চলেছে৷
ওঁম্–কার কী? বেদে ওঁম্–কার সম্বন্ধে বলা হয়েছে–
‘‘সবে বেদা যৎপদমামনন্তি তপাংসি সর্বাণি চ যদ্ বদন্তি৷
যদিচ্ছন্তো ব্রহ্মচর্যং চরন্তি তত্তে পদং সংগ্রহেণ ব্রুবীম্যোমিত্যেতদ্৷৷’’
মানুষের অস্তিত্ব স্থূল, সূক্ষ্ম ও কারণ এই তিন জগতেই৷ মানুষ কেবলমাত্র পাঞ্চভৌতিক জীব নয়, কেবল মানসিক জীবও নয়, আবার শুধুমাত্র আত্মিক সত্তাও নয়৷ তিনে মিলে মানুষের অস্তিত্ব৷ মানুষের অভিব্যক্তিগুলো, অভিস্ফূর্ত্তিগুলো তিনটি তত্ত্বেই, তিনটি স্তরেই হয়ে থাকে৷
যত কিছু বস্তু আছে সবই মরণধর্মী, মরণশীল৷ চার বছরের ছেলে যখন চব্বিশ বছরের যুবক হয় তখন চার বছরের ছেলেটা মরে যায়৷ তাকে তুমি আর কোথাও পাবে না৷ সে মরে গেছে৷ কিন্তু চার বছরের ছেলের যে আধার আর চব্বিশ বছরের ছেলের যা আধার– দু’টো আধার একই সত্তার৷ অর্থাৎ ব্যষ্টি অপরিবর্তিত থাকে৷ শ্রীরমেশ চার বছরের ছেলের মধ্যেও ছিল, চব্বিশ বছরের যুবকের শরীরের মধ্যেও ছিল, আর এখন ওই রমেশ আশি বছরের বুড়োর মধ্যেও আছে৷ তারপর একদিন শরীরটা জ্বলে গেল৷ এটাও একটা পরিবর্তন হ’ল৷ তারপর আবার একদিনের এক শিশুর মধ্যে সেই রমেশ জন্ম নিল৷ কিন্তু রমেশের বর্তমান পরিবারের লোকে তো আর পূর্বের পরিবেশের সঙ্গে পরিচিত ছিল না, তাই তারা তার নাম দিলেন
আমি অবশ্যই বর্তমান কালকে অস্বীকার বা অবহেলা করতে পারি না৷ এর অর্থ আমাকে অবশ্যই মনে রাখতে হবে আমি কোথায় আছি আর ঠিক বর্তমানে আমাকে কী করতে হবে৷ কিন্তু বর্তমান কাকে বলব?
আমরা জানি বর্তমান, অতীত আর ভবিষ্যতকে নিয়ে কাল তিনটি৷ এই তিন ধরনের কাল আসলে কী? বস্তুতঃ বর্তমান কাল বলে ঠিক কোন কিছু নেই৷ আমি যখন কিছু বলি, তুমি ততক্ষণাৎ তা শুণতে পাও না৷ কিছুটা বিরতির পরে তুমি সেটা শুণতে পাও৷ তাহলে সেই বিরতিটা কী? শব্দ বায়ুর দ্বারা বাহিত হয়ে কাণে পৌঁছতে যে সময় লাগে সেটাই বিরতি৷ আর যখন তা তুমি শোণ সেটা আমার কাছে কিন্তু অতীত, আর তোমার কাছে তা ভবিষ্যৎ কেননা অল্পক্ষণ পরে তুমি তা শুণতে পাচ্ছ৷
কর্মমার্গ, কর্মযোগ একটা পথ, সাধনাও একটা পথ, ও সেই পথ ধরে লক্ষ্যের দিকে চলতে হচ্ছে৷ জ্ঞানমার্গ (জ্ঞানযোগ)–সেও সাধনার একটা পথ৷ সেই পথ ধরেও লক্ষ্যের দিকে চলতে হচ্ছে৷ কিন্তু ভক্তি একটা পথ নয়, ভক্তি হ’ল লক্ষ্য, যেখানে পৌঁছুতে চাইছি৷ সেই জায়গাটা৷ সুতরাং ভক্তি কোনো ন্তুব্ভপ্তব্ধ নয় অর্থাৎ কোনো বিধি, সাধনা–বিধি নয়৷ ভক্তি হ’ল লক্ষ্য যেখানে পৌঁছুতে চাইছি৷
দ্বিতীয় গুণটা হ’ল প্রতাপ administration অর্থাৎ শাসন আছে৷ সবাই ভালবেসে হোক, ভয়েই হোক, তাঁকে মানবে৷ শাস্ত্রে বলা হয়েছে, বিশ্বব্রহ্মান্ডের সবাই পরমপুরুষকে মানছে৷ কেন মানছে?
কিছু মানুষ আছে যাদের মধ্যে এষণা আছে৷ কিন্তু তারা ঠিক পথ–নির্দেশনা পায়নি৷ তারা জানে যে, পরমপুরুষ তাদের জীবনের লক্ষ্য হওয়া উচিত, কিন্তু ঠিক ঠিক রাস্তা জানে না, সঠিক পথনির্দেশনা পায়নি৷ বই পড়ে সাধনা করা উচিত নয়, সাধনার জন্যে গুরু প্রয়োজন৷ বই পড়ে বা কারুর কাছে শুণে সাধনা করা বিপজ্জনকও কারণ এতে লক্ষ্য সম্পর্কে কোনো সুস্পষ্ট ধারণা তৈরী হয় না৷ কোন্ দিকে সে এগিয়ে যাচ্ছে ৰুঝতে পারে না৷ নৌকা চলছে, কিন্তু নৌকার যে চালক সে জানে না কোথায় যেতে হবে৷ তাহলে কী হবে? অযথা হয়রানি হবে৷ সে দুর্ঘটনারও শিকার হতে পারে৷
(১৯৮০ সালের ১লা জানুয়ারী ‘আন্তর্জাতিক নববর্ষ’ উপলক্ষ্যে প্রদত্ত প্রবচন৷)
এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে যা কিছু আছে সবই দেশ–কাল–পাত্রে আধৃত৷ কাল জিনিসটা কী? –না, কাল হচ্ছে ক্রিয়ার গতিশীলতার ওপর মানসিক পরিমাপ (Mental measurement of motivity of action)৷ দেশ আছে–সে চক্রাকারে বিবর্তিত হয়ে চলেছে৷ সেই বিবর্তনকে মেপে চলেছে মন৷ সেই মাপাটার নাম কাল৷ ব্যাপকভাবে এই কালকে বলব মহাকাল আর তার খণ্ডগত হিসেবকে বলব কাল৷ দেশগত বিবর্ত্তন না থাকলে কাল থাকে না৷ অর্থাৎ দেশ–পাত্র রহিত কাল হয় না৷
একটা প্রদীপ থেকে মানুষ অজস্র প্রদীপ জ্বালাতে পারে৷ ঠিক তেমনি একটা মানব–দীপ থেকে আমরা অজস্র মানব–দীপ জ্বালাতে পারি৷ এতে কারও মহত্ত্ব, শ্রেষ্ঠত্ব বা বাহাদুরী কমে না, বরং বাড়ে৷ এটা আনন্দের কথা তো বটেই, গৌরবেরও কথা যে, ইতিহাসের যে যুগসন্ধিতে আমরা দাঁড়িয়ে আছি ঠিক এই ধরনের যুগসন্ধি এর আগে কখনও আসে নি৷ এর আগে পৃথিবীতে কখনও এত মানুষ ভালো হবার জন্যে একত্রিত হয়নি আর সমাজের, মানবতার তথা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সেবার জন্যে এত মানুষ আগে কখনও আসেন নি৷
কিছুদিন আগে ‘মানসাধ্যাত্মিক সাধনার স্তরবিন্যাস’ পুস্তকে বলা হয়েছে যে মানুষের অগ্রগতির চারটে স্তর রয়েছে–যতমান, ব্যতিরেক, একেন্দ্রিয় ও বশীকার৷ এই চারটে স্তরের ভেতর দিয়ে মানুষকে এগিয়ে চলতে হয়৷ এ সম্বন্ধে যা বক্তব্য তা ওই বইয়ে স্পষ্ট ভাষায় লিখে দিয়েছি৷ এখন, মানুষের জীবনটা কী রকম কোথা থেকে তার শুরু, কোথায় বা তার শেষ?
জগতে যেসব বস্তুকে আমরা নিত্য বলে মানি তাদের নিত্যতাপ্রদানকারীও পরমপুরুষ৷ বস্তু হ’ল প্রতিফলিত সত্তা–রিফ্লেক্টেড এণ্টিটি৷ চেতন বস্তুর মনঃশক্তিও তাঁর থেকেই এসেছে৷ তিনি সকলের প্রয়োজনের পূর্তি ঘটান–পিঁপড়ে থেকে হাতী পর্যন্ত, ছোট ছোট জীব থেকে সমুদ্রের বড় বড় জানোয়ার পর্যন্ত সকলের৷ এতই উদার তিনি৷ সেইজন্যেই তিনি জগতের কর্তা, অধিকর্তা, প্রভু৷ এই রকম উদারতা লাভ করতে পারলে তুমিও তিনি হয়ে যাবে৷
এই যে শরীর, এই যে মন, এ সবের জন্যে তো অর্থের, অন্ন–বস্ত্রের আবশ্যকতা আছে ঠিক কথা৷ মানুষ অর্থোপার্জনের চেষ্টা করবে, ঘরবাড়ী, জমি–জায়গার জন্যে চেষ্টা করবে৷ এ সবই ঠিক৷ কিন্তু যখন এই চেষ্টা করবে, চেষ্টা করার সময় মনে এই ভাবনা রাখতে হবে যে, ‘‘আমি এই সব পাওয়ার জন্যে চেষ্টা করছি এইজন্যে যে এ সব আমার আধ্যাত্মিক সাধনার সহায়ক হবে৷ এই সব জাগতিক বস্তুর লাভের উদ্দেশ্যে এ সবের সাধনা করছি না৷’’ মানুষ যখন নিজের স্থূল ভাবকে সূক্ষ্মভাবে রূপান্তরিত করতে থাকবে, তখন ক্রমশঃ সে বৈয়ষ্টিক ভাবনার দ্বারা পরিচালিত না হয়ে সামূহিক ভাবনার দ্বারা পরিচালিত হতে থাকবে৷
সাধনায় কুলকুণ্ডলিনীকে ঊর্ধ্বগতি করতে না পারলে মন্ত্র জপ একেবারেই অর্থহীন হয়ে পড়ে৷ কুলকুণ্ডলিনীকে ঊধের্ব নিয়ে যাবার প্রক্রিয়াকে বলা হয় ‘পুরশ্চরণ প্রক্রিয়া’, আর মন্ত্রচৈতন্য বলতে অবশ্য আসলে ৰোঝায় সঠিকভাবে মন্ত্রের ভাব গ্রহণ করা৷ অর্থ ৰুঝে মন্ত্র জপ করলে মন্ত্রচৈতন্য বিধি সহজে নিষ্পন্ন হতে পারে৷ অর্থ না ৰুঝে জপক্রিয়া করা মানে সময়ের অপব্যবহার ছাড়া আর কিছুই নয়৷
আজ গীতার একটা শ্লোক নিয়ে আলোচনা করব৷ শ্লোকটাকে গাইডিং বা কন্ড্রোলিং শ্লোকও বলতে পার৷ ব্যাখ্যাটা বিস্তৃতভাবেই করব৷ ধৃতরাষ্ট্রঃ উবাচ (ধৃতরাষ্ট্র বললেন) –
‘‘ধর্মক্ষেত্রে কুরুক্ষেত্রে সমবেতা যুযুৎসবঃ৷
মামকাঃ পাণ্ডবাশ্চৈব কিমকুর্বত সঞ্জয়৷৷’’
ৰুদ্ধির মান অনুযায়ী জীবকে তিনটি শ্রেণীতে ভাগ করা যেতে পারে–পশু, মানব আর দেবতা৷ আমাদের মানব সমাজেও আমরা পাই মানবীয় আধারে পশু, মানবীয় আধারে মানব আর মানবীয় আধারে দেবতা৷
পরমসত্তা যখন প্রকৃতির ৰন্ধন থেকে মুক্ত, সেই অবস্থা হচ্ছে নির্গুণ আর ৰন্ধনযুক্ত পরমসত্তা সগুণ৷ সগুণেও আছে দু’টি বিভাগ–একটা তার রূপময় অস্তিত্ব আর অন্যটি অরূপ৷
মানুষের মধ্যে যে ৰুদ্ধি, ৰোধি, আমি–ৰোধ ঢ–ন্দ্রন্দ্বন্দ্বপ্তনু ইত্যাদি আছে এরা সব অরূপ৷ সেই রকম সগুণ ব্রহ্মেরও ৰুদ্ধি, ৰোধি ও আমি–ৰোধ অরূপ৷ সেইজন্যে সেগুলির কোনটাই আমরা দেখতে পাই না৷
আর্যরা ভারতে বসবাস করার পরে অনার্য সমাজে জন্মেছিলেন এক বিরাট পুরুষ৷ মঙ্গোলীয়–আর্য মিশ্র কুলে জাত এই বিরাট পুরুষ ছিলেন উন্নতনাসা ও শুভ্রকান্তি৷ ইনি ছিলেন মহাতান্ত্রিক, মহাযোগী৷ অনার্য সমাজের এই মহাপুরুষ শিব নামে প্রসিদ্ধ ছিলেন৷ একাধারে এত গুণ মানুষের মধ্যে যে থাকতে পারে এ কথা লোকে ভাবতে পারে না, তাই তাঁকে বলা হ’ত গুণাতীত বা নির্গুণ পুরুষ৷ তন্ত্রসাধনার ফলে এই শিব অর্জন করেছিলেন অলোকসামান্য শক্তি৷ এই শক্তিকে তিনি লাগিয়ে গেছলেন জনকল্যাণের কাজে৷ তন্ত্রশাস্ত্রকে সুসংৰদ্ধরূপ ইনিই দিয়েছিলেন৷ তাই তান্ত্রিকের বা যোগীর ইনি ছিলেন গুরু–ইনি ছিলেন পিতা৷ এই ৰ্রহ্মজ্ঞ মহাপুরুষের
শাস্ত্রীয় নির্র্দেশ অনুযায়ী মানুষের উন্নতির জন্যে তিনটি তত্ত্ব আবশ্যক৷ তিনটি তত্ত্ব কী?–না, শ্রবণ, মনন ও নিদিধ্যাসন৷ প্রথমে দেখা যাক্–শাস্ত্র বলতে কী ৰোঝায়? ‘‘শাসনাৎ তারয়েৎ যস্তু সঃ শাস্ত্রঃ পরিকীর্ত্তিতাঃ৷ ’’এখানে ‘শাসন’ মানে হচ্ছে–অনুশাসন৷ শাসন ও অনুশাসন একই জিনিস৷ ইংরেজীতে ‘অনুশাসন’ বলতে ৰোঝায়–Discipline, Code of discipline.
ভগবান শংকরাচার্য বলেছিলেন–
‘‘ত্যজ দুর্জনসংসর্গং ভজ সাধু সমাগমম্৷
কুরুপুণ্যম্ অহোরাত্রম্ স্মরনিত্যম্ অনিত্যতাম্৷৷’’
মানসপট আর মনের ময়লা
নির্গুণ ব্রহ্মের কোনো রূপ নেই৷ তিনি নিরাকার৷ এই ব্রহ্মই সগুণ ব্রহ্মরূপে (যা নির্গুণ ব্রহ্মের কার্যান্বিত রূপ), প্রকৃতির সহায়তায় ব্রহ্মভাবের জন্ম দেন, সেই সগুণ ব্রহ্ম প্রতিটি ধূলিকণায় ব্যাপ্ত আছেন৷ আমার মানসপটের ওপর ব্রহ্মের প্রতিচ্ছায়া পড়ছে, আর এই প্রতিচ্ছায়া কিরকম ভালভাবে পড়বে তা নির্ভর করে আমারই সংস্কারের ওপর৷ মানসপট যত ময়লাযুক্ত হবে, তার ওপর ততখানিই খারাপ প্রতিফলন পড়বে৷ সাধনার দ্বারা আমরা মনের এই ময়লাকে পরিষ্কার করি৷
সূক্ষ্ম নন্দনতত্ত্বের ওপর আধারিত নান্দনিক অভীপ্সা যখন একটা নির্দিষ্ট উচ্চ মানে পৌঁছে যায় তাকে বলে মিষ্টিসিজম্৷ আর এই মিষ্টিসিজম্ যখন মানবীয় গরিমা মহিমার শীর্ষে বা শ্রেষ্ঠত্বের পর্যায়ে চলে আসে তাকে বলে আধ্যাত্মিকতা (spirituality)৷ এখন মিষ্টিসিজম্ কী? মিষ্টিসিজম্ হ’ল সীমার সঙ্গে অসীমের, ক্ষুদ্র ‘আমি’র সঙ্গে ৰৃহৎ ‘আমি’র বা আত্মার সঙ্গে পরমাত্মার সম্পর্ক নির্ণয়ের এক নিরন্তর প্রয়াস৷
গড়পড়তা ৰৌদ্ধিক মাপের একজন মানুষের কাছে জল ও বরফ দু’টি পৃথক সত্তা কিন্তু যারা সত্য সম্পর্কে অল্পকিছু জানে তারা ৰোঝে জলের ঘনীভূত রূপই বরফ৷ একইভাবে সাধারণ মানের মানুষ যখন একটা পাত্র ও কুম্ভকারের ঙ্মযে পাত্রটি তৈরী করেছেৰ মধ্যে একটা বিরাট পার্থক্য দেখে, ব্রহ্মজ্ঞানী সেখানে দুই–কে একইভাবে দেখে৷ এই যে জগত আর ব্রহ্ম–এ দু’টো কি পৃথক সত্তা না তারা অবিভাজ্য, একটা সত্য আর অন্যটা কি মিথ্যা? এ দু’টো সত্তার মধ্যে যে পার্থক্য চোখে পড়ে তা কি সত্য না মায়া?–এ ধরনের প্রশ্ণ বা চিন্তা–ভাবনা ব্রহ্মজ্ঞদের মনে কখনও আসে না৷
বৃক্ষলতার কিছু বিশেষ গুণ আছে৷ যেমন, মাটির নীচে থেকে রস টেনে নেওয়া৷ মানুষ নিতে পারে না৷ জন্তু–জানোয়াররাও নিতে পারে না৷ কিন্তু বৃক্ষলতারা মাটির থেকে রস টেনে নিতে পারে৷ বাতাস থেকেও এরা কিছু খাদ্য নেয়৷ যদিও জীবজন্তু, মানুষও কিছুটা তা করে, কিন্তু উদ্ভিদের মত অতটা নয়৷ একে আমরা বলতে পারি উদ্ভিদ–ধর্ম৷ বৃক্ষলতা পায়ের সাহায্যে খাদ্যগ্রহণ করে৷ তোমরা জান কি না?
কিছুদিন আগে ‘মানসাধ্যাত্মিক সাধনার স্তরবিন্যাস’ পুস্তকে বলা হয়েছে যে মানুষের অগ্রগতির চারটে স্তর রয়েছে–যতমান, ব্যতিরেক, একেন্দ্রিয় ও বশীকার৷ এই চারটে স্তরের ভেতর দিয়ে মানুষকে এগিয়ে চলতে হয়৷ এ সম্বন্ধে যা বক্তব্য তা ওই বইয়ে স্পষ্ট ভাষায় লিখে দিয়েছি৷ এখন, মানুষের জীবনটা কী রকম কোথা থেকে তার শুরু, কোথায় বা তার শেষ?
‘‘অন্যচ্ছ্রেয়োন্যদুতৈব প্রেয়স্তে উভে নানার্থে পুরুষং সিনীতঃ৷
তয়োঃ শ্রেয় আদদানস্য সাধু ভবতি হীয়তের্থাদ্ য উ প্রেয়োবৃণীতে৷৷’’
দু’টি মুখ্য বৃত্তি মানুষকে পরিচালিত করছে৷ একটি শ্রেয় আর অন্যটি প্রেয়৷ এদের মধ্যে মৌলিক পার্থক্যটা কী? একটি জড়াভিমুখী (Analytical by nature) অর্থাৎ স্বাভাবিক বিশ্লেষণাত্মক আর অন্যটি আত্মাভিমুখী (Synthetical) অর্থাৎ সংশ্লেষণাত্মক৷ তাহলে কোন্ মানুষটি কিরকম সেটি ৰুঝব কী করে? সেই মানুষটি দু’য়ের মধ্যে কোন্ বৃত্তি দ্বারা পরিচালিত, সেটা দেখেই তাকে চিনে নিতে পারব৷
সাধনার ভিত্তিভূমি নৈতিকতা৷ প্রথমেই মনে রাখা দরকার যে এই নৈতিকতা (morality) সাধকের চরম লক্ষ্য (ultimate goal) নয়, আর এই নৈতিকতায় প্রতিষ্ঠিত হওয়া বা মর্যালিষ্ট হওয়া সাধকের জীবনে এমন কোনো একটা অবস্থা নয় যা অন্য কারুর চরম আদর্শ হতে পারে৷ সাধনামার্গে যাত্রা শুরু করবার ঠিক প্রথম ক্ষণটিতেই সাধকের যে মানসিক সামঞ্জস্যের প্রয়োজন সেটারই নাম নৈতিকতা বা মর্যালিটি৷...
পরমপুরুষের কাছ থেকে কোন কিছু প্রার্থনা করা উচিত কি? লোকে বলে–
‘‘মাঙ্না মরণ সমান হ্যায়
মৎ কোই মাঙো ভিখ্৷
বিন মাঙে মোতি মিলে,
মাঙে মিলে না ভিখ৷৷’’
ৰুদ্ধিমান ব্যষ্টি শৈশব অবস্থা থেকেই ধর্মসাধনা করৰে৷ কারণ মানুষের শরীর দুর্লভ, আর তার থেকেও দুর্লভ সেই জীবন যা সাধনার দ্বারা সার্থক হয়েছে৷ সব কাজ সঠিক সময়ে করা উচিত৷ যেমন আষাঢ় মাসে ধান রোপণ করা উচিত, আর অঘ্রাণে কাটা উচিত৷ কেউ যদি অঘ্রাণে রোপণ করে তবে সমস্যা হয়ে যাৰে৷ ফসল হৰে না৷ ঠিক ওই রকম কেউ যদি ভাবে ৰৃদ্ধ বয়সে ধর্মসাধনা করৰ, তাহলে খুব ৰড় ভুল হয়ে যাৰে৷ কারণ ৰৃদ্ধাবস্থা সমস্ত মানুষের জীবনে নাও আসতে পারে৷ কালকের সূর্যোদয় তোমার জীবনে নাও আসতে পারে৷ তাই কোন কাজ কালকের জন্যে ফেলে রাখা উচিত নয়৷ যখনই কিছু ভাল কাজ করার ইচ্ছা হয় তো তখনই করে নাও৷ তৎক্ষণাৎ করে নাও৷
আমাদের শরীরে আটটি চক্র আছে৷ মূলাধার, স্বাধিষ্ঠান, মণিপুর, অনাহত ও বিশুদ্ধ– এই পাঁচ চক্র আর এর ওপর আজ্ঞাচক্র, গুরুচক্র ও সহস্রারচক্র*৷ এই হ’ল অষ্টকমল৷ পরমাত্মার লীলা এই অষ্টকমলকে নিয়ে৷
সাধনায় যখন মানুষ এগিয়ে যায় তখন কী হয়?
‘‘সর্বতঃ পাণিপাদং
তৎ সর্বতোক্ষিশিরোমুখম্৷
সর্বতঃ শ্রুতিমল্লোঁকে সর্বসাবৃত্য তিষ্ঠতি৷৷’’
এই অষ্টকমল যখন ফোটে, তা কেমন করে ফোটে? মানুষ যখন মনের সমস্ত ভাবনা নিয়ে পরমপুরুষেরই উপাসনা করে তখন সমস্ত ভাবনা, সমস্ত আকুতি একের দিকেই ছুটে যায়৷
গতরাতে আমি এই পরিদৃশ্যমান জগতে বিভিন্ন সম্ভাবনাপুর্ণ অস্তিত্ব, যেমন---অণু মানসসত্তা ও িিতসত্তা সম্পর্কে বলেছিলুম৷ পরম চিত্তিশক্তির যে অন্তর্মুখী গতি (বহির্মুখী গতিতে পঞ্চভৌতিক জগতের উৎপত্তি) তারই এক স্তরে মানুষের সৃষ্টি৷ এই অন্তর্মুখী গতিতে পঞ্চভৌতিক জগতের উৎপত্তি) তারই এই স্তরে মানুষের সৃষ্টি৷ এই অন্তর্মুখী গতি পরম চিতিশক্তিতে ফিরে আসার জন্যে৷
তন্ত্রের সঙ্গে বেদের আদর্শগত তফাৎ বেশী বললে যথেষ্ট হবে না, বলা উচিত খুব বেশী৷ তন্ত্র হ’ল সম্পূর্ণ বৈবহারিক (Practical), তন্ত্র অস্বাভাবিক কোন কিছুকে সমর্থন করে না৷ ফলে তন্ত্রের মধ্যে স্বাভাবিরতা থাকায় সেটা সমাজে সহজেই গৃহীত ও সহজেই আদৃত হয়৷ মানুষ একে সহজেই নিজের জিনিস বলে মনে করতে পারে৷ যেমন বেদে একটা শ্লোকে আছে---‘উত্তিষ্ঠত জাগ্রত প্রাপ্য ররান্ নিৰোধত’--- ওঠো, জাগো, উপযুক্ত আচার্যের নিকট সত্বর উপস্থিত হও ও সাধনা মার্গে চলতে শুরু করো৷ এতখানিতে বেদ ও তন্ত্রে মিল আছে৷
এই পৃথিবীতে মানুষের আবির্ভাব হয়েছে আজ থেকে প্রায় দশ লাখ বছর আগে৷ তখন থেকেই মানুষের মনে সুখপ্রাপ্তির এষণা ছিল, আজও আছে, সর্বদা থাকবে৷ এই সুখপ্রাপ্তির এষণার দ্বারা অর্থাৎ একটা মানসিক অভীপ্সার দ্বারা–যার পূর্ত্তির জন্যে মানুষ চেষ্টাশীল হয়–প্রেষিত হয়ে সুদূর অতীতে ধর্ম জীবনে পদার্পণ করেছিল৷ এই এষণা কেবল মানুষের মধ্যেই রয়েছে, জন্তু–জানোয়ারের মধ্যে নেই ৷ তবে হ্যাঁ, যে সব জন্তু–জানোয়ার মানুষের সংস্পর্শে বাস করে, মানুষের সঙ্গে যাদের একটা বোঝাপড়া হয়েছে তাদের মধ্যেও অল্প পরিমাণে এই এষণা রয়েছে৷ কিন্তু স্ফুটতরভাবে রয়েছে কেবল মানুষের মধ্যে৷ এই এষণা মানুষের মধ্যে রয়েছে বলেই তার নাম মানুষ৷ ‘মানুষ’ শব্দের
দুধের মধ্যে যে রকম ঘি ব্যাপ্ত হয়ে থাকে আর মন্থন করলে সেটা ওপরে উঠে আসে, ঠিক সেই রকম তোমার মধ্যে পরমপুরুষ ব্যপ্ত আছেন সাধনারূপী মন্থনের দ্বারা তুমি তাঁকে পেয়ে যাবে৷ মন্থন করলে যে মাখন বেরিয়ে আসে, সেটাই পরমপুরুষ৷ তিনি তোমার ভিতরে আছেন ঘরের মধ্যে কোনো দেবতাকে তুমি বাহ্যিক পূজা করে, বহিরাঙ্গিক সাধনার দ্বারা তাঁকে পাবে না৷ বরং সেটার দ্বারা তুমি তাঁর থেকে আরো দূরে সরে যাবে৷
পরমপুরুষের পরম রচনাত্মক শক্তি নিজ আন্তরিকতা তথা ভূমামনের চেতনাশক্তির সাহায্যে ভৌতিক জগতের জড় অথবা জীব সত্তার বিভিন্ন রূপ প্রদান করে থাকে৷ প্রত্যেক বস্তু তাঁরই রচনা, প্রত্যেক বস্তু তাঁরই দ্বারা সংরক্ষিত ও পালিত হয়ে থাকে৷ শেষ পর্যন্ত তাঁরই বিরাট ভূমামনে সমস্ত জাগতিক সত্তার অন্তিম পরিণতি ঘটে যায়৷ অর্থাৎ পরমসত্তার মানসিক আধার ভূমিতে সব কিছুর লয় হয়ে যায়৷ এই কারণে আমি বলি কোন বস্তুই ক্ষুদ্র নয়, কোন বস্তুই অনাবশ্যক নয়৷ যদি অগুন্তি প্রোটোপ্লাজম দ্বারা এই সামূহিক শরীর তৈরী হয়ে থাকে, তাহলে তোমার মনও একটি সামূহিক মন৷ এছাড়া প্রত্যেক প্রোটোপ্লাজম একটি জীবিত সত্তা৷ আর এই কারণে প্রত্যেক জীবিত সত্তার নিজস্
সমাজে সম্মানিত আর বয়স্ক লোকেদের আচার–ব্যবহার অন্যের কাছে আদর্শস্বরূপ যুগের পর যুগ ধরে মানুষ তার অনুসরণ ও অনুকরণ করে চলে৷ আজ মানুষের সমাজে এক চরম দুর্দিন আর দুর্দশা সমুপস্থিত, আর তার একটাই কারণ, সমাজের ত্রুটিপূর্ণ নেতৃত্ব৷ মানুষ অন্ধের মত অর্বাচীন নেতাকেও অনুসরণ করে৷ নেতারা বড় বড় কথা, অঙ্গ–ভঙ্গি আর নাটুকেপনা দিয়ে হাজার হাজার মানুষকে সম্মোহিত ও আকর্ষিত করে৷ এটা জেনে রাখবে যেকোনো দেশে, যে–কোনো মানুষের দারিদ্র্য আর দুর্দশার পেছনে রয়েছে নেতাদের পাপ৷ যারা যথার্থ নেতা তাদের সদা সতর্ক থাকতে হবে আর ভাবতে হবে সবচেয়ে ভালভাবে মানব সমাজের সেবা কীকরে করা যায়৷ তাদের সবসময় সতর্ক থাকতে হবে যে তাদের নির্দেশন
যে মানুষের যেমন আজীব তথা আভোগ,তদনুযায়ী তার স্থূল শরীর মেলে৷ যার মনে কেবল খাবার বাসনাই রয়েছে, পরমপুরুষ তাকে শুয়োরের শরীর দেবেন, যত খুশী সে খেতে পারবে৷ যার মনে ক্রোধ বেশী, তার মোষের শরীর মিলবে---যত বেশী ক্রুদ্ধ হতে চায়, হতে পারবে৷ আবার যার মনে পরমপুরুষের সান্নিধ্য লাভের বাসনা জাগবে, সে খুব উন্নত মানব শরীর লাভ করবে, সাত্ত্বিক শরীর লাভ করবে৷ যেমন আভোগ, তদনুযায়ী মানুষকে চলতে হয়৷
...ব্রহ্মাস্মি বিজ্ঞান যদি কেবল শাব্দিক স্তরে সীমিত থাকে, তাতেও কোন কাজ হবে না৷ এ জন্যে ‘সোহং’ মন্ত্রের পরিচ্ছেদহীন ভাবনা নিতে হবে৷ এই যে অ–পরিচ্ছিন্ন ভাবনা, এ ভাবনা বাচনিক জপে সম্ভব নয়৷ মানস তথা অধ্যাত্মসাধনার এই যে সূক্ষ্মবিজ্ঞান, এটা তন্ত্রেরই আবিষ্কার ঙ্মতন্ত্র ও যোগের মধ্যে মূলতঃ কোন পার্থক্য নেই৷ তন্ত্রেরই সূক্ষ্মতর সাধনার নাম যোগমার্গৰ৷ সাধনামার্গে জপক্রিয়া ও ধ্যানক্রিয়া মহাকৌলেরই ব্যবস্থা৷ কেবল জপেও কোন কাজ হবে না, যদি মন্ত্রের গতিধারার সঙ্গে মনের গতিধারা সমান তালে না চলে৷ মনে মনে জপও করছি, আবার তার সঙ্গে অন্যের ক্ষতির চিন্তাও করছি–এ ধরনের জপ নিষ্ফল৷ জপক্রিয়ায় সাফল্য লাভ করতে গেলে স
বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে মূলসত্তা একটিই, তা হচ্ছে চিতিশক্তি৷ এই চিতিশক্তি চৈতন্যসত্তা আবার শক্তিসত্তাও বটে– এইভাবে চিতিশক্তি দুইয়েরই কাজ করে৷ এইজন্যেই একে চিতিশক্তি বলা হয়৷ বস্তু নয় কিন্তু বস্তুকে যে রূপ প্রদান করে তাই শক্তি বা প্রকৃতি৷ এই প্রকৃতিই বস্তুতে রূপ প্রদান করে প্রকারভেদ সৃষ্টি করে৷
আমি নানান স্থানে, নানান অনুষ্ঠানে একটা কথা বলেছি–মানসিক সাম্য অথবা মানসিক সাম্যাবস্থা৷ ভগবান শিবের একটি উক্তি আছে, জীবনে সম্পূর্ণ সফল হওয়ার পিছনে চতুর্থ তত্ত্বটি হ’ল ‘সমতাভাব’, অর্থাৎ মানসিক সাম্য, মানসিক ভারসাম্য৷ মনে কোন রকম কম্প্লেক্স রাখলে চলবে না৷ না মহামান্যতা ৰোধ, না হীনমন্যতা ৰোধ৷
মানুষের করণীয় কী? জীবন একটা ব্রত৷ আমি বলেছি মানুষের জীবন একটা আদর্শের ধারাপ্রবাহ বিশেষ৷ অর্থাৎ মানব জীবন একটা ব্রত–জীবন মানেই ব্রত অস্তিত্ব মানেই ব্রত৷ ‘‘আত্মমোক্ষার্থং জগদ্ধিতায় চ’’–মানুষ যা–ই করুক না কেন, তা করা উচিত আত্মমোক্ষের জন্যে–তার নিজের মোক্ষের জন্যে, আর করা উচিত সমগ্র বিশ্বের উন্নতির জন্যে৷ মানুষের এই দু’টো কাজ করতে হবে অর্থাৎ মানুষের ব্রত হচ্ছে এই দু’টো কাজ৷
‘সৎ’ কী ও ‘অসৎ’ কী– এ সম্পর্কে যে বিচারৰোধ তাকে সদাসৎ বিবেক বলে, যা ‘সৎ’–কে ‘অসৎ’ থেকে ও ‘অসৎ’–কে ‘সৎ’ থেকে পৃথক করে দেয়৷ ‘সৎ’ কী? লৌকিক ভাষায় ‘সৎ’ মানে ভালো– সৎ ব্যষ্টি, সজ্জন ব্যষ্টি৷ আর আধ্যাত্মিক অর্থে ‘সৎ’ মানে অপরিণামী সত্তা– যাতে কোনো পরিবর্তন হয় না৷ আর ‘অসৎ’ মানে যা পরিণামী, যার অবস্থান্তর ঘটে৷ ‘সৎ’ বস্তু একই, বাদবাকী সব অসৎ৷ ‘অসৎ’ মানে খারাপ নয়, পরিবর্তনশীল৷
মানুষের সামনে দুটি পথ–একটি শ্রেয়ের পথ, অন্যটি প্রেয়ের পথ৷ প্রেয়ের পথে মানুষ পায় ক্ষণিক সুখ, আর শেষে দুঃখ৷ আর শ্রেয়ের পথে চললে তাতে সাময়িক দূুঃখ–ক্লেশ এলেও শেষপর্যন্ত সেই পথেই মানুষের ৰৃহত্তর কল্যাণ সাধিত হয়৷ মানুষ যখন প্রেয়ের পথ ধরে তখন সে যুক্তির দ্বারা পরিচালিত না হয়ে সেন্টিমেন্টের (ভাবপ্রবণতার) বশে চলে আর যখন শ্রেয়ের পথ নেয়,তখনও যুক্তির দ্বারা নয়, কল্যাণৰোধের ভাবনার দ্বারা প্রেষিত হয়ে চলে৷ ভাবে, এই যে পথে আমি চলেছি, কাজ করছি, এটা কল্যাণের পথ– মঙ্গলের পথ৷ এই পথেই জনসেবা–জনকল্যাণ সর্বাধিক হবে৷
যারা অনন্যমনসা–অনন্যভাক্ হয়ে পরমপুরুষের ভজনা করে, জাগতিক অন্যান্য চিন্তা–ভাবনাকে পরিত্যাগ করে মানসচিন্তায় সুকোমল মসৃণতা নিয়ে কেবল পরমপুরুষের দিকেই এগিয়ে যায় তারা গোপী৷ এই রকম ধরণের গোপীদের ছবি আঁকা যায় না৷ কারণ গোপীর গোপীত্ব তার অন্তরের সুকোমল ভাবরাজি, তার অন্তরের অন্তঃস্থলে নিহিত৷ এটা একেবারে ভেতরের জিনিস–মনের জিনিস৷ এই ধরণের ভক্তি ভাবসমন্বিত গোপীদের ভাষাও ব্যক্ত করা যায় না৷
আজ একজন সাধক মনকে একাগ্র করার পদ্ধতি সম্বন্ধে জানতে চেয়েছিল৷ তার প্রশ্ণ ছিল কীভাবে মন একাগ্রতার চরমাবস্থায় পৌঁছতে পারবে? এর উত্তর সব সাধকেরই জানা উচিত৷ ৰৌদ্ধিক বিচারে প্রতিটি জীবই তিন শ্রেণীভুক্ত–পশু, মানব ও দেবতা৷ আধ্যাত্মিক সাধনা হ’ল এক বিশেষ অভ্যাস যা পশুত্ব থেকে মানবত্বে ও মানবত্ব থেকে দেবত্বে প্রতিষ্ঠিত করে৷
যেসব দেশ অত্যন্ত ঠাণ্ডা সেই দেশগুলোতেই বসন্ত ঋতুর আবির্ভাব ভাল ভাবে ৰোঝা যায় ও লোকে বসন্ত ঋতুকে ভাল ভাবে খুশী মনে গ্রহণ করে৷ কিন্তু যেসব দেশে শীত প্রচণ্ড নয় সেইসব দেশে শরতেরই কদর বেশী৷ এই ৰাঙলাতেও জ্যোতিষিক মতে যাই হোক না কেন, ছ’টা ঋতুই আছে বটে কিন্তু আসলে তিনটে ঋতু–গ্রীষ্ম, বর্ষা ও শরৎ৷ শীত তো নামে মাত্র৷ গরম জামা বার করতে না করতেই আবার বাক্সে ভরতে হয়৷ সেই জন্যে এখানে শরৎকালের কদর সবচেয়ে বেশী৷ প্রধান ফসলটাও কেমন হবে শরতেই তার আন্দাজ পাওয়া যায়৷ বাকী বছরটা কেমন যাবে শরতেই তার আন্দাজ পাওয়া যায়৷ আকাশে শাদা মেঘ আর ধরিত্রীর কুশ–কাশ–শেফালী নূতন এক আমেজ এনে দেয়৷ তাই কেবল যে ভারতবর্ষের সংস্কৃত গ্
...বৈবহারিক ক্ষেত্রে কোন জিনিস কতটা সার্থক সেটা বিচার করে মন৷ পরিবর্তনশীল পরিবেশের সঙ্গে কোন ব্যবস্থাপত্র কতখানি মানিয়ে চলতে পারে সে বিচারও করে মন৷ খেয়ে পরে শান্তিতে থাকা–এগুলোও করা হয় মানসিক তৃপ্তির জন্যে৷ আর সব চাইতে বড় কথা, যে কোন মতবাদ সম্বন্ধেই বলা হোক না কেন, সমর্থনশাস্ত্র মননশীলতার ওপরই নির্ভরশীল৷ মানসিক ব্যাধি বা আধ্যাত্মিক ব্যাধিমাত্রই মায়াবাদ নয়৷ মাটির পৃথিবীর সঙ্গে, মানুষের মনের সঙ্গে যোগসূত্র রেখেও আধ্যাত্ম দর্শন প্রতিষ্ঠিত হতে পারে৷ আনন্দমার্গ তেমনি একটা দর্শন৷
গত রাতে আমি তোমাদের ‘মন্ত্র’ শব্দের যথাযথ অর্থ সম্বন্ধে অনেক কিছু বলেছিলুম৷ আমি বলেছিলুম যে ‘মন্ত্র’ শব্দের আধ্যাত্মিক অর্থ ও জাগতিক অর্থ এক নয়৷ আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে মন্ত্রের অর্থ হচ্ছে সেই সত্তা যা তোমাকে স্থায়ীভাবে মুক্তি প্রদান করবে৷ এর মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক ৰন্ধন থেকে তুমি চিরস্থায়ী নিবৃত্তি পেয়ে যাবে৷ আমি আরও বলেছিলুম যে ভারতীয় বর্ণমালায় সব ধ্বন্যাত্মক অভিব্যক্তিই মন্ত্র পদবাচ্য৷
...‘‘ঈশ্বর–প্রণিধান’’ জিনিসটা... দাঁড়াচ্ছে–মনকে সেই পরমাশ্রয়ে প্রতিষ্ঠিত করবার জন্যে তাঁর পানে ছুটিয়ে নিয়ে চলা৷ তাই ঈশ্বর–প্রণিধান জিনিসটা সম্পূর্ণ ভাবাশ্রয়ী–সম্পূর্ণতই একটা মানস ঙ্মআধ্যাত্মিকৰ প্রচেষ্টা৷ এতে চীৎকার করে লোক জড় করবার বা ঢ়াক–ঢ়োল পিটিয়ে ভক্তি দেখাবার অবকাশ নেই৷....
জীবনের গতি সর্বদা পরম লক্ষ্যের দিকে কিন্তু জড় প্রকৃতি তাকে সবসময় নিজের দিকে আকর্ষণ করার চেষ্টা করতে থাকে৷ নিজের সঙ্গে লড়াই করতে করতে মানুষের শক্তি যখন আর কিছুই করতে পারে না, সেই সময়ের যে অবস্থা তাকে বলে মৃত্যু৷ এমনিতে শরীর থেকে প্রাণশক্তি যখন বেরিয়ে যায়, সেই সময়ের যে পরিস্থিতি তাকে মৃত্যু বলা হয়---এটা স্বাভাবিক তথা গৌণ মৃত্যু৷ কিন্তু মানুষের আবার অকাল মৃত্যুও হয়৷ আসলে প্রকৃতির এই আসুরী শক্তির সঙ্গে সংগ্রাম করে নিজেকে চরম লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার যে প্রয়াস তাকেই জীবন বলে৷ তমোগুণী বৃত্তিগুলো সমাজের সর্বত্র ব্যাপ্ত থেকে মানুসের চরম লক্ষ্যপ্রাপ্তির পথে বাধা সৃষ্টি করছে৷ যে এই আসুরী বৃত্ত
‘‘মন এব মনুষ্যানাং কারণং বন্ধমোক্ষয়োঃ৷
বন্ধস্য বিষয়াসঙ্গী মুক্তো নির্বিষয়ং তথা৷৷’’
মনই মানুষের মুক্তি ও বন্ধনের কারণ হয়৷ কোন কাজ করার আগে মানুষ ভেবে নেয় যে সে মনপ্রধান জীব৷ বলা হয়েছে ‘‘মনঃ করোতি কর্মাণি৷’’
যে কাজ মনের সাহায্য ছাড়াই সম্পন্ন হয় তাকে বলে ‘ক্রিয়া’ ও যাতে মনের সাহায্য নিতে হয় তাকে বলে ‘কর্ম’৷
পাতক দু’প্রকারের৷ পাপ ও প্রত্যবায়৷ পাপও তিনপ্রকার হয়– ‘পাতক’, ‘অতিপাতক’ ও ‘মহাপাতক’৷ যা করা উচিত নয় কিন্তু করা হয়েছে তাকে বলে পাপ৷ যা করা উচিত কিন্তু করা হয়নি তাকে বলে প্রত্যবায়৷
সমাজে সম্মানিত আর বয়স্ক লোকেদের আচার–ব্যবহার অন্যের কাছে আদর্শস্বরূপ যুগের পর যুগ ধরে মানুষ তার অনুসরণ ও অনুকরণ করে চলেঙ্গ আজ মানুষের সমাজে এক চরম দুর্দিন আর দুর্দশা সমুপস্থিত, আর তার একটাই কারণ, সমাজের ত্রুটিপূর্ণ নেতৃত্বঙ্গ মানুষ অন্ধের মত অর্বাচীন নেতাকেও অনুসরণ করেঙ্গ নেতারা বড় বড় কথা, অ৷–ভি৷ আর নাটুকেপনা দিয়ে হাজার হাজার মানুষকে সম্মোহিত ও আকর্ষিত করেঙ্গ এটা জেনে রাখবে যেকোনো দেশে, যে–কোনো মানুষের দারিদ্র্য আর দুর্দশার পেছনে রয়েছে নেতাদের পাপঙ্গ যারা যথার্থ নেতা তাদের সদা সতর্ক থাকতে হবে আর ভাবতে হবে সবচেয়ে ভালভাবে মানব সমাজের সেবা কীকরে করা যায়ঙ্গ তাদের সবসময় সতর্ক থাকতে হবে যে তাদের
সৃষ্টির প্রারম্ভের আগের কথা৷ সে সময় দেশ–কাল–পাত্রের মত সাপেক্ষ সত্তা ছিল না৷ একমাত্র ছিল অখণ্ড অসীম, ৰৃহৎ, সর্বব্যাপী সত্তা, আর সেই সত্তার সাক্ষিত্বরূপে ছিলেন পরমপুরুষ৷ সেই অখণ্ড সৃষ্টির রচয়িতা পরমপুরুষ নিজেকেই অনেক রূপে নানাপ্রকারে অভিব্যক্ত করলেন৷
‘‘ত্বং স্ত্রী ত্বং পুমানসি, ত্বং কুমার উত বা কুমারী৷
ত্বং জীর্নোদণ্ডেন বঞ্চয়সি ত্বং জাতো ভবসি বিশ্বতোমুখঃ৷’’
‘‘নীলঃ পতংগো হরিতো লোহিতাক্ষ
স্তত্তিদ্গর্ভ ঋতবঃ সমুদ্রাঃ৷
অনদিমত্বং বিভুত্বেণ বর্ত্তসে
যতোজাতানি ভুবনানি বিশ্ব৷৷’’
কলিযুগ কী? যখন মানুষ ৰৌদ্ধিক অব্যবস্থা, ৰৌদ্ধিক অমিতব্যয়িতাকে নিয়ে চলতে থাকে, যখন তার শরীর ও মন আছে অথচ তার কর্মধারা বা আচরণ পশুর সমান হয়ে গেছে, সেই অবস্থাকেই বলে কলিযুগ৷ যে শুয়ে আছে, কী করতে হবে না করতে হবে ৰুঝতে পারছে না, সেই অবস্থাকে বলব কলিযুগ৷ বর্ত্তমান বিশ্বে চলছে কলিযুগ বিদ্বান ৰুদ্ধিমান ব্যষ্টি আর ধর্মের ব্যাখ্যাকারীরাও বলেন যে এটা কলিযুগ৷
পুরুষোত্তমের আকর্ষণী শক্তির কারণে আর জড়বস্তুর মধ্যে প্রবল সংঘর্েষর ফলস্বরূপ প্রতিসঞ্চর ধারায় মনের সৃষ্টি৷ প্রতিসঞ্চর ধারা পুরোটাই এই আকর্ষণী শক্তি-দ্বারা প্রভাবিত৷ সংঘর্ষ জড়বস্তুর মধ্যে খণ্ডীকরণের প্রবৃত্তি জাগায়৷ তাই ধীরে ধীরে বস্তুর একটা অংশ চূর্ণীভূত হয়ে যায় ও সেটাই মনের প্রথম বা প্রাথমিক অবস্থা৷ এই মন বস্তুতঃ চিত্ত ছাড়া কিছুই নয়৷ সেইজন্যে অবিকশিত প্রাণী ও উদ্ভিদের মনের অধিকাংশ ভাগই কেবল চিত্ত৷
সাধকের জীবনের কর্মধারা সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘‘আত্মমোক্ষার্থং জগদ্ধিতায় চ’’৷ মানুষ কাজ করবে, আর কাজ করার সময় মনে রাখবে যে, সে যা কিছু করছে আত্মমোক্ষের জন্যে৷ কিন্তু কোনো মানুষ যদি কেবলমাত্র আত্মমোক্ষের জন্যে সাধনা করে, অথচ সমাজ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করছে না–এ অবস্থায় তাকে কি আমরা স্বার্থপর বলব না? যদি সে জনসেবা না করে, যদি জনসাধারণের জন্যে তার মনে কোনো সহানুভূতি না থাকে, কেবলমাত্র আত্মমোক্ষের জন্যে সাধনা করে চলে, তার মধ্যে আত্মার প্রতি অনুরাগ থাকলেও তাকে আমরা স্বার্থপর বলব৷
কিছু মানুষ আছে যাদের মধ্যে এষণা আছে৷ কিন্তু তারা ঠিক পথ–নির্দেশনা পায়নি৷ তারা জানে যে, পরমপুরুষ তাদের জীবনের লক্ষ্য হওয়া উচিত, কিন্তু ঠিক ঠিক রাস্তা জানে না, সঠিক পথনির্দেশনা পায়নি৷ বই পড়ে সাধনা করা উচিত নয়, সাধনার জন্যে গুরু প্রয়োজন৷ বই পড়ে বা কারুর কাছে শুণে সাধনা করা বিপজ্জনকও কারণ এতে লক্ষ্য সম্পর্কে কোনো সুস্পষ্ট ধারণা তৈরী হয় না৷ কোন্ দিকে সে এগিয়ে যাচ্ছে ৰুঝতে পারে না৷ নৌকা চলছে, কিন্তু নৌকার যে চালক সে জানে না কোথায় যেতে হবে৷ তাহলে কী হবে? অযথা হয়রানি হবে৷ সে দুর্ঘটনারও শিকার হতে পারে৷
কিছু মানুষ আছে যাদের মধ্যে এষণা আছে৷ কিন্তু তারা ঠিক পথ–নির্দেশনা পায়নি৷ তারা জানে যে, পরমপুরুষ তাদের জীবনের লক্ষ্য হওয়া উচিত, কিন্তু ঠিক ঠিক রাস্তা জানে না, সঠিক পথনির্দেশনা পায়নি৷ বই পড়ে সাধনা করা উচিত নয়, সাধনার জন্যে গুরু প্রয়োজন৷ বই পড়ে বা কারুর কাছে শুণে সাধনা করা বিপজ্জনকও কারণ এতে লক্ষ্য সম্পর্কে কোনো সুস্পষ্ট ধারণা তৈরী হয় না৷ কোন্ দিকে সে এগিয়ে যাচ্ছে বুঝতে পারে না৷ নৌকা চলছে, কিন্তু নৌকার যে চালক সে জানে না কোথায় যেতে হবে৷ তাহলে কী হবে? অযথা হয়রানি হবে৷ সে দুর্ঘটনারও শিকার হতে পারে৷
শাস্ত্রে পরমপুরুষের একটি নাম ‘বিষ্ণু’৷ সংস্কৃত ‘বিশ্’ (প্রবেশ করা) ধাতু থেকে নিষ্পন্ন ‘বিষ্ণু’ শব্দের অর্থ হ’ল ব্যাপনশীল অর্থাৎ যিনি প্রতিটি সত্তার ভেতরে অনুপ্রবিষ্ট হয়ে রয়েছেন৷ অসীম অনন্ত অখণ্ড সর্বগ সর্বব্যাপী এই সত্তার জন্যেই বিশ্বের অন্যান্য খণ্ড সত্তাগুলো টিকে রয়েছে৷ জল না থাকলে যেমন মাছ থাকতে পারে না তেমনি পরমপুরুষ ছাড়া জীবও বাঁচতে পারে না, কোন কিছুরই অস্তিত্ব থাকতে পারে না৷ বস্তুতঃ তাঁর অস্তিত্বের জন্যেই সব কিছু অস্তিত্ববান৷ তবে একথাও ঠিক যে তিনি কোথাও প্রকট, কোথাও অপ্রকট৷
হনুমান ছিল খুব বড় ভক্ত৷ একবার হনুমানকে লোকে জিজ্ঞেস করল, দেখ হনুমান, তুমি তো শুধু ‘রাম–রাম’ করতে থাক– কিন্তু ‘রাম’ আর ‘নারায়ণ’ দু’য়ের মানেই তো বিষ্ণু– দুই–ই এক জিনিস, তা সত্ত্বেও ভুলেও তোমার মুখে ‘নারায়ণ’ নাম একবারও শোণা যায় না৷ শুধু ‘রাম’ই শোণা যায়৷ হনুমান বলল, ‘দেখ ভাই, একথা আমিও জানি যে ‘রাম’ আর ‘নারায়ণ’ দুই–ই এক৷’ যেমন ধর, তোমার নাম ‘কমলা দেবী’, কিন্তু ছোট ছোট শিশুরা তো তোমাকে ‘কমলা দেবী’ বলে ডাকবে না৷ কেউ ‘মা’ বলবে, কেউ ‘দিদি’ বলবে, আবার কেউ অন্য কিছু বলবে৷ তাই তোমারও তো অনেক নাম হয়ে গেল৷ ঠিক তেমনি একই পরমাত্মার কখনও ‘রাম’, কখনও ‘নারায়ণ’, এমন অনেক নাম হয়ে গেছে৷ তোমার নাম মনে কর নিরঞ্জন
আজ গীতার একটা শ্লোক নিয়ে আলোচনা করব৷ শ্লোকটাকে গাইডিং বা কন্ট্রোলিং শ্লোকও বলতে পার৷ ব্যাখ্যাটা বিস্তৃত ভাবেই করব৷ ধৃতরাষ্ট্রঃ উবাচ (ধৃতরাষ্ট্র বললেন) –
‘‘ধর্মক্ষেত্রে কুরুক্ষেত্রে সমবেতা যুযুৎসবঃ৷
মামকাঃ পাণ্ডবাশ্চৈব কিমকুর্বত সঞ্জয়৷৷’’
একটি শ্লোকে আছে,
‘‘তৃণাদপি সুনীচেন তরোরিব সহিষ্ণুনা৷
অমানীনং মানদেন কীর্ত্তনিয়ঃ সদা হরিঃ৷৷’’
কিছুদিন আগে ‘মানসাধ্যাত্মিক সাধনার স্তরবিন্যাস’ পুস্তকে বলা হয়েছে যে মানুষের অগ্রগতির চারটে স্তর রয়েছে–যতমান, ব্যতিরেক, একেন্দ্রিয় ও বশীকার৷ এই চারটে স্তরের ভেতর দিয়ে মানুষকে এগিয়ে চলতে হয়৷ এ সম্বন্ধে যা বক্তব্য তা ওই বইয়ে স্পষ্ট ভাষায় লিখে দিয়েছি৷ এখন, মানুষের জীবনটা কী রকম কোথা থেকে তার শুরু, কোথায় বা তার শেষ?
‘‘মোক্ষকারণসমগ্র্যাং ভক্তিরেব গরিয়সী৷’’ মোক্ষ কাকে লে? মোক্ষ হচ্ছে, প্রথমে নিজের দেহবোধকে স্থূল মনে এক করা, স্থূল মনকে সূক্ষ্ম মনে মিলিয়ে দেওয়া, সূক্ষ্ম মনকে বিশুদ্ধ ‘‘আমি’’-বোধে মিলিয়ে দেওয়া---আর শেষ পর্যন্ত ‘‘আমি’’-বোধকে আত্মায় সমাহিত করে দেওয়া৷ যখন ‘‘আমি’’-বোধ বিশুদ্ধ চৈতন্যের আওতার মধ্যে আসে, সেই অবস্থাকে লে মোক্ষ৷ মোক্ষপ্রাপ্তির জন্যে সাধককে নির্দিষ্ট উপায় অবলম্বন করতে হবে৷ সাধক লছে, বিভিন্ন উপায় বা পদ্ধতির মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ উপায় হচ্ছে ভক্তি, অর্থাৎ স্থূলতর সত্তাকে একমাত্র ভক্তির মাধ্যমে সূক্ষ্মতর সত্তায় এক করে দেওয়া সম্ভব৷ তাই ভক্তি হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ উপায়৷ শ্রুতিতে লা হয়েছে,
সাধনার ভিত্তিভূমি নৈতিকতা৷ প্রথমেই মনে রাখা দরকার যে এই নৈতিকতা (morality) সাধকের চরম লক্ষ্য (ultimate goal) নয়, আর এই নৈতিকতায় প্রতিষ্ঠিত হওয়া বা মরালিষ্ট হওয়া সাধকের জীবনে এমন কোনো একটা অবস্থা নয় যা অন্য কারুর চরম আদর্শ হতে পারে৷ সাধনামার্গে যাত্রা শুরু করবার ঠিক প্রথম ক্ষণটিতেই সাধকের যে মানসিক সামঞ্জস্যের প্রয়োজন সেটারই নাম নৈতিকতা বা মরালিটি৷...
গত রাতের ধর্মমহাচক্রে আমি বলেছি যে, কাল tempos eternal), স্বভাব nature) নিয়তি fate), যদৃচ্ছা accident), বা প্রপঞ্চ quinquelemental factors), কোনটাই জগতের মূলীভূত কারণ নয়৷ তাই এদের একটিও সাধনার লক্ষ্য হতে পারে না৷
এই যে শরীর, এই যে মন, এ সবের জন্যে তো অর্থের, অন্ন–বস্ত্রের আবশ্যকতা আছে ঠিক কথা৷ মানুষ অর্থোপার্জনের চেষ্টা করবে, ঘরবাড়ী, জমি–জায়গার জন্যে চেষ্টা করবে৷ এ সবই ঠিক৷ কিন্তু যখন এই চেষ্টা করবে, চেষ্টা করার সময় মনে এই ভাবনা রাখতে হবে যে, ‘‘আমি এই সব পাওয়ার জন্যে চেষ্টা করছি এইজন্যে যে এ সব আমার আধ্যাত্মিক সাধনার সহায়ক হবে৷ এই সব জাগতিক বস্তুর লাভের উদ্দেশ্যে এ সবের সাধনা করছি না৷’’ মানুষ যখন নিজের স্থূল ভাবকে সূক্ষ্মভাবে রূপান্তরিত করতে থাকবে, তখন ক্রমশঃ সে বৈয়ষ্টিক ভাবনার দ্বারা পরিচালিত না হয়ে সামূহিক ভাবনার দ্বারা পরিচালিত হতে থাকবে৷
যে পরোপকার করে সে মহৎ৷ পরোপকার করার জন্যে অনেক টাকা–পয়সার দরকার নেই৷ তোমার কাছে বর্তমানে যে সম্পদ আছে তাতেই তুমি পরোপকার কর৷ শরীর যদি সবল থাকে তাহলে শরীর দিয়ে কর, অর্থ থাকলে অর্থ দিয়ে কর, বুদ্ধি থাকলে বুদ্ধি দিয়ে কর–আর কিছু না থাকলে সদ্ভাবনা দিয়ে কর৷ পরোপকারের দ্বারাই মানুষ মহৎ হয়, আর যেখানে পরোপকারের ভাবনা নেই সেখানে সে ক্ষুদ্র বা ছোট হয়ে যায়৷
এটা মানব মনের স্বভাব যে, সে সব সময় অনুকূল পরিস্থিতিতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত রাখতে চায়৷ আমরা কদাচিঠ এ কথা বলি–‘‘হে পরমাত্মা, তুমি আমাকে কত কিছু না দিয়েছ, কত বৌদ্ধিক সম্পদে আর মানসোত্তর উপসম্পদায় না আমাকে ভূষিত করেছ তুমি আমাকে এত বেশী দিয়েছ কিন্তু আমি এর উপযুক্তই নই৷’’ মানুষ সাধারণতঃ নিজের অনুপপত্তিটাই, তার সীমিতত্ব বা ত্রুটিগুলিকেই বড় করে দেখে৷ তার কী নেই–সে সম্পর্কেই সে বেশী সচেতন থাকে৷ কিন্তু যখন তার কাছে অনেক ধনসম্পদ, অনেক মানসম্মান বা অন্য কোনো সম্পদ এসে যায়, সে কখনই বলে না–‘‘হে প্রভু, আমার কোনো যোগ্যতা নেই, তবু আমাকে এত বেশী দিচ্ছ’’ এ ধরনের কথা কখনই মানুষ বলে না৷ এভাবে মানুষ কখনই চিন্তা করে
সূক্ষ্ম নন্দনতত্ত্বের ওপর আধারিত নান্দনিক অভীপ্সা যখন একটা নির্দিষ্ট উচ্চ মানে পৌঁছে যায় তাকে বলে মিষ্টিসিজম্৷ আর এই মিষ্টিসিজম্ যখন মানবীয় গরিমা মহিমার শীর্ষে বা শ্রেষ্ঠত্বের পর্যায়ে চলে আসে তাকে বলে আধ্যাত্মিকতা (spirituality)৷ এখন মিষ্টিসিজম্ কী? মিষ্টিসিজম্ হ’ল সীমার সঙ্গে অসীমের, ক্ষুদ্র ‘আমি’র সঙ্গে বৃহৎ ‘আমি’র বা আত্মার সঙ্গে পরমাত্মার সম্পর্ক নির্ণয়ের এক নিরন্তর প্রয়াস৷
এই বস্তুজগতের সমস্ত কিছুই দেশ-কাল-পাত্রে আধারিত । প্রতিটি সৃষ্ট সত্তার, বিশেষ করে মানুষের স্বভাবই হ’ল আশ্রয়ের অনুসন্ধান করা । এই ভাসমান অনুসত্তার জন্যে একটা স্থায়ী আশ্রয় একান্ত আবশ্যক ।
এখন, শ্রেষ্ঠ আশ্রয় কী? দেশ-কাল-পাত্রাধিগত প্রতিটি সত্তাই ক্ষণস্থায়ী । তাই এই বিশ্বের কোন কিছুই তোমার স্থায়ী আশ্রয় হতে পারে না । যদি তুমি স্থায়ী আশ্রয় পেতে চাও, তাহলে তোমাকে তিন আপেক্ষিক তত্ত্বের ওপর আধারিত এই প্রকাশমান জগতের অধিক্ষেত্রের বাইরে যেতে হবে । আর আপেক্ষিকতার ঊর্ধ্বে যে পরম তত্ত্ব—তিনি হলেন পরমপুরুষ । তাই পরম পুরুষই তোমার একমাত্র আশ্রয় । তোমার আর দ্বিতীয় কোন আশ্রয় হতে পারে না ।
তোমাদের কাজ সামগ্রিক ভাবে সমাজকে নিয়ে ।
‘কর্মণা বদ্ধতে জীবঃ বিদ্যয়া তু প্রমুচ্যতে ।’
গত রাতে আমি এই পরিদৃশ্যমান জগতে বিভিন্ন সম্ভাবনাপূর্ণ অস্তিত্ব,যেমন—অণুমানসত্বা ও চিতিসত্তা সম্পর্কে বলেছিলুম ।পরম চিতিশক্তির যে অন্তর্মুখী গতি (বহির্মুখী গতিতে পঞ্চভৌতিক জগতের উৎপত্তি) তারই এক স্তরে মানুষের সৃষ্টি ।এইঅন্তর্মুখী গতি পরম চিতিশক্তিতে ফিরে আসার জন্যে । **এখন আমরা জানি শক্তির ঘনীভূত রূপ হচ্ছে জড় বস্তু । আবার এই জড়তত্ত্ব চূর্ণীভূত হলে (সুক্ষ্মক্ত্বের পথে চলতে থাকলে) মনের উৎপত্তি হয় । ধর তোমাকে খুব কষ্টকর শারীরিক পরিশ্রমের কাজ করতে হচ্ছে । এতে স্বাভাবিক ভাবে তু
কেউ কেউ পরমপুরুষকে চিতিশক্তি বলে অভিহিত করেন কিন্তু বাস্তবে পরমপুরুষ হলেন তার অতিরিক্ত কিছু। দর্শণের বড় বড় পন্ডিতেরা বলে থাকেন যে পরমপুরুষ হলেন জ্ঞাতৃসত্তা ও পরমাপ্রকৃভি হলেন ক্রিয়াশক্তি। তোমরা জানো যে ক্রিয়াশক্তি হ’ল একটা অন্ধাশক্তি মাত্র, এর পেছনে চৈতন্যশক্তির সমর্থন থাকতেই হবে। যখন পরমাপ্রকৃতি কাজ করা শুরু করেন, ক্রিয়াশক্তি যখন কোন কিছু সৃষ্টি করেন বা পালন করেন বা ধংস করেন, সৃষ্টি-স্থিতি-ধ্বংসমূলক তিনি যা কিছু করেন বা তাঁর যা কিছু বাস্তব ক্রীয়াশীলভা তার সবই কিন্তু ভূমা চৈতন্যের অনুমতিসাপেক্ষ।
মানব মনের একটা চিরন্তন প্রশ্ন হচ্ছে: তুমি কোত্থেকে এসেছ?আর তুমি যখন এসেছ তখন অবশ্যই তুমি কোন একটি বিশেষ স্থান থেকে এসেছ। তাই কোত্থেকে এসেছো...... কোথায় যাবে..... কীই বা করতে হবে? আর এই সামুহিক তথা বৈয়ষ্টিক সত্তা গুলি বা কোত্থেকে আসে?তোমরা জানো তো, এই বিশ্বের কোন কিছুই বিনাশ শীল নয়। এ জগতের সমস্ত কিছুই অবিনাশী। কোন
যখন কেউ কোন কাজ করে তাকে কিছু বিধি নিয়ম মেনে চলতে হয়। যাঁর এই নিয়ম কানুন তৈরি করার অধিকার আছে তাঁকে বলা হয় নিয়ন্ত্রক সত্তা।আমাদের এই মহাবিশ্বে অনেক কর্ম সংঘটিত হচ্ছে, অনেক রকমের অভিব্যক্তি নিরন্তর প্রকাশিত হয়ে চলেছে।বিভিন্ন তরঙ্গধারা নানা উৎস থেকে উৎসারিত হয়ে চলেছে। তাই এসবের জন্য একজন বেশ শক্তপোক্ত নিয়ন্ত্রক সত্তা থাকতেই হবে। কিন্তু সেই সত্তা একটা যন্ত্রের মত কাজ করে চলবেন না। তিনি অবশ্যই হবেন ভালোবাসার মূর্ত্ত প্রতিরূপ।
আজ একজন সাধক মনকে একাগ্র করার পদ্ধতি সম্বন্ধে জানতে চেয়েছিল৷ তার প্রশ্ণ ছিল কীভাবে মন একাগ্রতার চরমাবস্থায় পৌঁছতে পারবে? এর উত্তর সব সাধকেরই জানা উচিত৷ বৌদ্ধিক বিচারে প্রতিটি জীবই তিন শ্রেণীভুক্ত–পশু, মানব ও দেবতা৷ আধ্যাত্মিক সাধনা হ’ল এক বিশেষ অভ্যাস যা পশুত্ব থেকে মানবত্বে ও মানবত্ব থেকে দেবত্বে প্রতিষ্ঠিত করে৷
সংকোচনেই দুঃখ, আর ব্যাপ্তিতে পাওয়া যায় সুখ৷ মানুষ যখন ক্ষুদ্র বুদ্ধি তথা ক্ষুদ্র ভাবনার দ্বারা প্রেষিত হয়ে কাজ করে তখন সে ছোট হয়ে যায়, দুঃখ পায়, আর বৃহৎ ভাবনা নিয়ে কাজ করলে আনন্দ পায়, শান্তি পায়৷ যে মানুষ ক্ষুদ্র ভাবনা নিয়ে কাজ করে তার কী হয়? তার পথই বা কী? তার পথ বিশ্লেষণের পথ৷ এককে খণ্ড খণ্ড করার পথ৷ আর যে বৃহৎ ভাবনা নিয়ে কাজ করে, সে কী করে? সে অনেককে এক করে৷ তার পথ সংশ্লেষণের৷ তাই, সংশ্লেষণই জীবন (synthesis is life) সংশ্লেষণেই শান্তি (synthesis is peace) আর বিশ্লেষণ মানে মৃত্যু (analysis is death)৷
‘‘পিতা কস্য মাতা কস্য কস্য ভ্রাতা সহোদরাঃ৷
যারা অনন্যমনসা–অনন্যভাক্ হয়ে পরমপুরুষের ভজনা করে, জাগতিক অন্যান্য চিন্তা–ভাবনাকে পরিত্যাগ করে মানসচিন্তায় সুকোমল মসৃণতা নিয়ে কেবল পরমপুরুষের দিকেই এগিয়ে যায় তারা গোপী৷ এই রকম ধরণের গোপীদের ছবি আঁকা যায় না৷ কারণ গোপীর গোপীত্ব তার অন্তরের সুকোমল ভাবরাজি, তার অন্তরের অন্তঃস্থলে নিহিত৷ এটা একেবারে ভেতরের জিনিস–মনের জিনিস৷ এই ধরণের ভক্তি ভাবসমন্বিত গোপীদের ভাষাও ব্যক্ত করা যায় না৷
বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে মূলসত্তা একটিই, তা হচ্ছে চিতিশক্তি৷ এই চিতিশক্তি চৈতন্যসত্তা আবার শক্তিসত্তাও বটে– এইভাবে চিতিশক্তি দুইয়েরই কাজ করে৷ এইজন্যেই একে চিতিশক্তি বলা হয়৷ বস্তু নয় কিন্তু বস্তুকে যে রূপ প্রদান করে তাই শক্তি বা প্রকৃতি৷ এই প্রকৃতিই বস্তুতে রূপ প্রদান করে প্রকারভেদ সৃষ্টি করে৷
কর্মমার্গ, কর্মযোগ একটা পথ, সাধনাও একটা পথ, ও সেই পথ ধরে লক্ষ্যের দিকে চলতে হচ্ছে৷ জ্ঞানমার্গ (জ্ঞানযোগ)–সেও সাধনার একটা পথ৷ সেই পথ ধরেও লক্ষ্যের দিকে চলতে হচ্ছে৷ কিন্তু ভক্তি একটা পথ নয়, ভক্তি হ’ল লক্ষ্য, যেখানে পৌঁছুতে চাইছি৷ সেই জায়গাটা৷ সুতরাং ভক্তি কোনো ন্তুব্ভপ্তব্ধ নয় অর্থাৎ কোনো বিধি, সাধনা–বিধি নয়৷ ভক্তি হ’ল লক্ষ্য যেখানে পৌঁছুতে চাইছি৷
মানসপট আর মনের ময়লা
নির্গুণ ব্রহ্মের কোনো রূপ নেই৷ তিনি নিরাকার৷ এই ব্রহ্মই সগুণ ব্রহ্মরূপে (যা নির্গুণ ব্রহ্মের কার্যান্বিত রূপ), প্রকৃতির সহায়তায় ব্রহ্মভাবের জন্ম দেন, সেই সগুণ ব্রহ্ম প্রতিটি ধূলিকণায় ব্যাপ্ত আছেন৷ আমার মানসপটের ওপর ব্রহ্মের প্রতিচ্ছায়া পড়ছে, আর এই প্রতিচ্ছায়া কিরকম ভালভাবে পড়বে তা নির্ভর করে আমারই সংস্কারের ওপর৷ মানসপট যত মলযুক্ত হবে, তার ওপর ততখানিই খারাপ প্রতিফলন পড়বে৷ সাধনার দ্বারা আমরা মনের এই ময়লাকে পরিষ্কার করি৷
অনেকদিন পর্যন্ত সমাজ–সেবার কাজে লিপ্ত থাকার পর যখন প্রকৃত মানুষ তৈরী করার কথা ভাবা হ’ল তখন ১৯৫৫ সালের ৯ জানুয়ারী আনন্দমার্গের প্রতিষ্ঠা হয়ে গেল৷ প্রকৃতপক্ষে এর কিছু পূর্বেই আনন্দমার্গের কাজের সূত্রপাত হয়ে গিয়েছিল কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে যেটা হ’ল ১৯৫৫ সালে৷ কিন্তু প্রথমে ‘আনন্দমার্গ’ নামকরণ হয় নি৷ এর কয়েক মাস পরে ১৯৫৫ সালের শ্রাবণী পূর্ণিমার দিন ‘আনন্দমার্গ’ নামকরণ করা হ’ল৷ ১৯৪০ সালে শ্রাবণী পূর্ণিমার দিনেই এই কলকাতায় আমি প্রথম দীক্ষা দিয়েছিলুম৷ এরপরে অন্য কোন শ্রাবণী পূর্ণিমার দিন আমি কলকাতা বা বাঙলায় যাই নি৷
আগে বলেছিলুম, ভালো কাজের জন্যে জিদ্ চাই৷ তাই সাধকের মনে জিদ্ থাকা দরকার৷ শাস্ত্রে আছে, পার্বতী শিবকে জিজ্ঞাসা করলেন, কে এই সংসারে উন্নতি করে, কী তার রহস্য? দেখতে পাচ্ছি, কেউ বড় বড় কাজ করে জীবনে মহান হয়, কেউ বা শুয়ে বসেই থাকে চিরকাল৷ কেউ কেউ তো কলুর বলদ হয়েই থেকে যায়, আবার কারো কারো উন্নতি হয়৷ কেউ অনেক পড়েও খারাপ ফল করে, কেউ বা অল্প পড়েও ভাল ফল করে৷ এই সমস্ত কিছুর পিছনে রহস্য কী?
উত্তরে শিব বললেন,
‘‘ফলিষ্যতীতি বিশ্বাসঃ সিদ্ধের্প্রথমলক্ষণ৷
দ্বিতীয়ং শ্রদ্ধয়া যুক্তং তৃতীয়ং গুরুপূজনম্৷৷
চতুর্থো সমতাভাবঃ পঞ্চমেন্দ্রিয়নিগ্রহ৷
মানুষের করণীয় কী? জীবন একটা ব্রত৷ আমি বলেছি মানুষের জীবন একটা আদর্শের ধারাপ্রবাহ বিশেষ৷ অর্থাৎ মানব জীবন একটা ব্রত–জীবন মানেই ব্রত অস্তিত্ব মানেই ব্রত৷ ‘‘আত্মমোক্ষার্থং জগদ্ধিতায় চ’’–মানুষ যা–ই করুক না কেন, তা করা উচিত আত্মমোক্ষের জন্যে–তার নিজের মোক্ষের জন্যে, আর করা উচিত সমগ্র বিশ্বের উন্নতির জন্যে৷ মানুষের এই দু’টো কাজ করতে হবে অর্থাৎ মানুষের ব্রত হচ্ছে এই দু’টো কাজ৷
জগতে যেসব বস্তুকে আমরা নিত্য বলে মানি তাদের নিত্যতা প্রদানকারীও পরমপুরুষ৷ বস্তু হ’ল প্রতিফলিত সত্তা–রিফ্লেক্টেড এণ্ঢিটি৷ চেতন বস্তুর মনঃশক্তিও তাঁর থেকেই এসেছে৷ তিনি সকলের প্রয়োজনের পূর্তি ঘটান–পিঁপড়ে থেকে হাতী পর্যন্ত, ছোট ছোট জীব থেকে সমুদ্রের বড় বড় জানোয়ার পর্যন্ত সকলের৷ এতই উদার তিনি৷ সেইজন্যেই তিনি জগতের কর্তা, অধিকর্তা, প্রভু৷ এই রকম উদারতা লাভ করতে পারলে তুমিও তিনি হয়ে যাবে৷
সাথে চলার সংকল্প নিয়ে’ যারা একত্রিত হয়েছে পথের কণ্টক তাদের বাধা দিতে পারে না৷ বিশ্ব জয়ের সাধনায় যারা বিজয়-দুন্দুভি বাজিয়ে’ চলেছে ভীরু মনের সংশয়াকুল দৃষ্টি তাদের গতি রুদ্ধ করতে পারে না৷ মানুষ, তুমি এগিয়ে যাও৷ এগিয়ে’ চলার গানই তোমার মুখের একমাত্র ভাষা হোক৷ ---শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তি
দুধের মধ্যে যে রকম ঘি ব্যাপ্ত হয়ে থাকে আর মন্থন করলে সেটা ওপরে উঠে আসে, ঠিক সেই রকম তোমার মধ্যে পরমপুরুষ ব্যপ্ত আছেন সাধনারূপী মন্থনের দ্বারা তুমি তাঁকে পেয়ে যাবে৷ মন্থন করলে যে মাখন বেরিয়ে আসে, সেটাই পরমপুরুষ৷ তিনি তোমার ভিতরে আছেন ঘরের মধ্যে কোনো দেবতাকে তুমি বাহ্যিক পূজা করে, বহিরাঙ্গিক সাধনার দ্বারা তাঁকে পাবে না৷ বরং সেটার দ্বারা তুমি তাঁর থেকে আরো দূরে সরে যাবে৷
‘‘এষ হ দেবঃ প্রদিষোনুসর্বাঃ পূর্বো হ জাতঃ স উ গর্ভে অন্তঃ৷
স এব জাতঃ স জনিষ্যমানঃ প্রত্যঙ জনাংস্তিষ্ঠতি সর্বতো মুখঃ৷৷’’
(শ্বেতাশ্বেতরোপনিষদ)
কখনও কোনো অবস্থাতেই কোনো মানুষের মনে হীনম্মন্যতা থাকা উচিত নয়৷ আমি ছোট, এই বোধ থাকা উচিত নয়৷ কেউ নীচু নয় কেননা সকলেই পরমপিতার পুত্র, পরমপিতার সন্তান৷
শাস্ত্রে বলা হয়েছে, ‘প্রণিপাতেন পরিপ্রশ্ণেন সেবয়া’–মানুষপ্রণিপাত, পরিপ্রশ্ণ ও সেবা–এই তিনের সহায়তায় অর্থাৎ এই তিনের সমন্বয়ে পরমপুরুষের কাছে পৌঁছতে পারে৷ সাধক জীবনে সেবা তাই অনিবার্য৷ সেবার ভাবনা না থাকলে, দরজা বন্ধ করে বিশ ঘণ্ঢা সাধনা করলেও কোনো উন্নতি হবে না কারণ পরমপুরুষের আসন তোমার হৃদয়েও আছে, আবার বাইরেও আছে৷ তুমি ভিতরের আসনকে উজ্জ্বল করতে চাইবে, সেখানে দীপ জ্বালাবে আর বাইরের আসনকে অন্ধকারে রেখে দেবে, এতে কাজ হবে না৷ দীপ ভিতরেও জ্বালাতে হবে, বাইরেও জ্বালাতে হবে৷
জগতে যেসব বস্তুকে আমরা নিত্য বলে মানি তাদের নিত্যতাপ্রদানকারীও পরমপুরুষ৷ বস্তু হ’ল প্রতিফলিত সত্তা–রিফ্লেক্টেড এণ্ঢিটি৷ চেতন বস্তুর মনঃশক্তিও তাঁর থেকেই এসেছে৷ তিনি সকলের প্রয়োজনের পূর্তি ঘটান–পিঁপড়ে থেকে হাতী পর্যন্ত, ছোট ছোট জীব থেকে সমুদ্রের বড় বড় জানোয়ার পর্যন্ত সকলের৷ এতই উদার তিনি৷ সেইজন্যেই তিনি জগতের কর্তা, অধিকর্তা, প্রভু৷ এই রকম উদারতা লাভ করতে পারলে তুমিও তিনি হয়ে যাবে৷
ধর্ম বৈবহারিক, সৈদ্ধান্তিক নয়৷ কে ধার্মিক, কে ধার্মিক নয়–তা তার বিদ্যা, বুদ্ধি বা পদমর্যাদা থেকে প্রমাণিত হয় না৷ কে ধার্মিক তা প্রমাণিত হয় তার আচরণ থেকে৷ কে অধার্মিক তাও প্রমাণিত হয় তার আচরণ থেকে৷ যে ধার্মিক হতে চায়, তাকে তার আচরণ ঠিক করতে হবে৷
এখন ভারতবর্ষ ও আধ্যাত্মিকতা সম্পর্কে কিছু আলোচনা করা যাক৷ এই দেশের নাম ভারতবর্ষ৷ জানতো, পৃথিবীতে যা কিছু শব্দ আছে সবই অর্থপূর্ণ৷ গ্রামের নামই হোক বা নদীর নাম, সবেরই একটা অর্থ আছে৷ এ দেশের নাম ভারতবর্ষ কেন রাখা হ’ল? প্রাচীনকালে এখানকার বাসিন্দা ছিল দ্রাবিড়, অষ্ট্রিক ও মঙ্গোলিয়ন৷ আর্যরা যখন এল তখন তারা এর নামকরণ করলে ‘ভারতবর্ষ’৷ এমন নাম কেন করা হ’ল?
পরমসত্তা যখন প্রকৃতির বন্ধন থেকে মুক্ত, সেই অবস্থা হচ্ছে নির্গুণ আর বন্ধনযুক্ত পরমসত্তা সগুণ৷ সগুণেও আছে দু’টি বিভাগ–একটা তার রূপময় অস্তিত্ব আর অন্যটি অরূপ৷
মানুষের মধ্যে যে বুদ্ধি, বোধি, আমি–বোধ ঢ–ন্দ্রন্দ্বন্দ্বপ্তনু ইত্যাদি আছে এরা সব অরূপ৷ সেই রকম সগুণ ব্রহ্মেরও বুদ্ধি, বোধি ও আমি–বোধ অরূপ৷ সেইজন্যে সেগুলির কোনটাই আমরা দেখতে পাই না৷
কখনও এই পরিস্থিতি আসতে পারে তুমি বিরাট শক্তিশালী সত্তার কাছে পৌঁছে গেছ, যাকে তুমি খুব ভয় পাও৷ এই যে শক্তিশালী সত্তা, তার শক্তি বা তার সাহস আসছে কোথা থেকে? সেও তোমার পিতার কাছে থেকেই আসছে৷ নিজের শক্তি বলে কারোর কিছু আছে কি? না, তা নেই৷ খাদ্য, হাওয়া, জল, মাটি ইত্যাদি দ্বারা পরমপিতা শক্তি প্রদান করেন৷ ধর, এক বিরাট শক্তিশালী পালোয়ান– সেটা কি তার নিজের শক্তি? না, তা নয়৷ সে শক্তি তোমার পরমপিতার৷ তাই তার থেকে তুমি ভয় কেন পাবে?
যে মানুষের যেমন আজীব তথা আভোগ, তদনুযায়ী তার স্থূল শরীর মেলে৷ যার মনে কেবল খাবার বাসনাই রয়েছে, পরমপুরুষ তাকে শুয়োরের শরীর দেবেন, যত খুশী সে খেতে পারবে৷ যার মনে ক্রোধ বেশী, তার মোষের শরীর মিলবে---যত বেশী ক্রুদ্ধ হতে চায়, হতে পারবে৷ আবার যার মনে পরমপুরুষের সান্নিধ্য লাভের বাসনা জাগবে, সে খুব উন্নত মানব শরীর লাভ করবে, সাত্ত্বিক শরীর লাভ করবে৷ যেমন আভোগ, তদনুযায়ী মানুষকে চলতে হয়৷
মানুষের অস্তিত্ব স্থূল, সূক্ষ্ম ও কারণ এই তিন জগতেই৷ মানুষ কেবলমাত্র পাঞ্চভৌতিক জীব নয়, কেবল মানসিক জীবও নয়, আবার শুধুমাত্র আত্মিক সত্তাও নয়৷ তিনে মিলে মানুষের অস্তিত্ব৷ মানুষের অভিব্যক্তিগুলো, অভিস্ফূর্ত্তিগুলো তিনটি তত্ত্বেই, তিনটি স্তরেই হয়ে থাকে৷
রামচন্দ্র নাকি দুর্গাপূজা করেছিলেন--- তোমরা এ ধরণের একটা গল্পও শুণেছ বোধ হয়--- এটার প্রাসঙ্গিকতা কী, সেটা বলি৷ সে সম্বন্ধে বলতে গেলে আগে রামায়ণের কথা বলতে হয়৷ রামায়ণের গল্প ভারত,মালয়েশিয়া আর ইন্দোনেশিয়ার মানুষদের মুখে মুখে চলছে ..দু/চার হাজার বছর নয়, আজ অনেক হাজার বছর ধরে৷ তবে এই রামায়ণকে লিখিত রূপ প্রথম দিয়েছিলেন মহর্ষি বাল্মীকি৷ এই লিখিত রূপ যখন তিনি দিয়েছিলেন সেটা শিবের যুগের* অনেক পরে, বুদ্ধের যুগেরও পরে৷ তার দু’টো প্রমাণ আমাদের হাত রয়েছে৷ তার একটা প্রমাণ হচ্ছে,কোন্ বইটা কত পুরোনো সেটা তার ভাষা দেখে বোঝা যায়৷ ভাষাটা পুরোণো , তা হলে বইটাও পুরোণো৷ ভাষাটা নোতুন, তো বইটাও নোতুন৷ যা রামায়ণ
প্রাচীন সংসৃক্ত শব্দভাণ্ডারে বছরে ছ’টা ঋতুর উল্লেখ আছে৷ গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসন্ত৷ কিন্তু ভারতের অনেক স্থানে, বিশেষ করে সমুদ্রের তটবর্তী এলাকায় তথা পূর্ব ভারতে মূলতঃ চারটে ঋতু৷ সেগুলি হচ্ছে গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ ও শীত৷ বাঙলায় শীত ঋতু শেষ হতে না হতেই গরম শুরু হয়ে যায়৷ তাই বসন্ত ঋতু এখানে পনেরো দিনের জন্যেও স্থায়ী হয় না, আর হেমন্ত তো শীতেরই অঙ্গ৷
আমাদের শরীরে আটটি চক্র আছে৷ মূলাধার, স্বাধিষ্ঠান, মণিপুর, অনাহত ও বিশুদ্ধ– এই পাঁচ চক্র আর এর ওপর আজ্ঞাচক্র, গুরুচক্র ও সহস্রারচক্র*৷ এই হ’ল অষ্টকমল৷ পরমাত্মার লীলা এই অষ্টকমলকে নিয়ে৷
সাধনায় যখন মানুষ এগিয়ে যায় তখন কী হয়?
‘‘সর্বতঃ পাণিপাদং
তৎ সর্বতোক্ষিশিরোমুখম্৷
সর্বতঃ শ্রুতিমল্লোঁকে সর্বসাবৃত্য তিষ্ঠতি৷৷’’
এই অষ্টকমল যখন ফোটে, তা কেমন করে ফোটে? মানুষ যখন মনের সমস্ত ভাবনা নিয়ে পরমপুরুষেরই উপাসনা করে তখন সমস্ত ভাবনা, সমস্ত আকুতি একের দিকেই ছুটে যায়৷
গতরাতে আমি এই পরিদৃশ্যমান জগতে বিভিন্ন সম্ভাবনাপুর্ণ অস্তিত্ব, যেমন---অণু মানসসত্তা ও চিতিসত্তা সম্পর্কে বলেছিলুম৷ পরম চিতিশক্তির যে অন্তর্মুখী গতি (বহির্মুখী গতিতে পঞ্চভৌতিক জগতের উৎপত্তি) তারই এক স্তরে মানুষের সৃষ্টি৷ এই অন্তর্মুখী গতিতে পঞ্চভৌতিক জগতের উৎপত্তি) তারই এই স্তরে মানুষের সৃষ্টি৷ এই অন্তর্মুখী গতি পরম চিতিশক্তিতে ফিরে আসার জন্যে৷
জীবনের গতি সর্বদা পরম লক্ষ্যের দিকে কিন্তু জড় প্রকৃতি তাকে সবসময় নিজের দিকে আকর্ষণ করার চেষ্টা করতে থাকে৷ নিজের সঙ্গে লড়াই করতে করতে মানুষের শক্তি যখন আর কিছুই করতে পারে না, সেই সময়ের যে অবস্থা তাকে বলে মৃত্যু৷ এমনিতে শরীর থেকে প্রাণশক্তি যখন বেরিয়ে যায়, সেই সময়ের যে পরিস্থিতি তাকে মৃত্যু বলা হয়---এটা স্বাভাবিক তথা গৌণ মৃত্যু৷ কিন্তু মানুষের আবার অকাল মৃত্যুও হয়৷ আসলে প্রকৃতির এই আসুরী শক্তির সঙ্গে সংগ্রাম করে নিজেকে চরম লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার যে প্রয়াস তাকেই জীবন বলে৷ তমোগুণী বৃত্তিগুলো সমাজের সর্বত্র ব্যাপ্ত থেকে মানুসের চরম লক্ষ্যপ্রাপ্তির পথে বাধা সৃষ্টি করছে৷ যে এই আসুরী বৃত্ত
বুদ্ধিমান ব্যষ্টি শৈশব অবস্থা থেকেই ধর্মসাধনা করবে৷ কারণ মানুষের শরীর দুর্লভ, আর তার থেকেও দুর্লভ সেই জীবন যা সাধনার দ্বারা সার্থক হয়েছে৷ সব কাজ সঠিক সময়ে করা উচিত৷ যেমন আষাঢ় মাসে ধান রোপণ করা উচিত, আর অঘ্রাণে কাটা উচিত৷ কেউ যদি অঘ্রাণে রোপণ করে তবে সমস্যা হয়ে যাবে৷ ফসল হবে না৷ ঠিক ওই রকম কেউ যদি ভাবে দ্ধ বয়সে ধর্মসাধনা কর্র, তাহলে খুব বড় ভুল হয়ে যাবে৷ কারণ দ্ধাবস্থা সমস্ত মানুষের জীবনে নাও আসতে পারে৷ কালকের সূর্যোদয় তোমার জীবনে নাও আসতে পারে৷ তাই কোন কাজ কালকের জন্যে ফেলে রাখা উচিত নয়৷ যখনই কিছু ভাল কাজ করার ইচ্ছা হয় তো তখনই করে নাও৷ তৎক্ষণাৎ করে নাও৷
‘আত্মমোক্ষার্থং জগদ্ধিতায় চ’, এটি একজন সাধকের জীবনের আদর্শ হওয়া উচিত৷ মানুষের কাজ করা উচিত, আর কাজ করার সময়ে মনে রাখা দরকার, সে যা কিছুই করছে তা আত্মমোক্ষের জন্যে৷
......আমাদের এই শ্রাবণী পূর্ণিমা–অনেকেই জান, এটা জানা জিনিস আমি তখন খুবই ছোট্ট৷ তখন বিদ্যাসাগর কলেজে পড়ি৷ একদিন সন্ধ্যায় একটা ঘটনা ঘটল৷ একজন লোক–সে লোকটি দুষ্ট প্রকৃতির ছিল৷ আমরা এই কথাটা ব্যবহার করছি এই জন্যে যে আজ যে মানুষটা দুষ্ট, কাল সে সাধু হতে পারে৷ আজ যে মূঢ় কাল সে জ্ঞানী হতে পারে–এ সবকিছু আপেক্ষিক জগতের আপেক্ষিকতার দ্বারা অভিষিক্ত৷ তাই এর কোন শাশ্বত রূপ নেই৷ কোন মানুষকে স্থায়ীভাবে দুষ্ট বলা চলে না৷ সব সময় মনে রাখতে হবে যে আমি এই দুষ্টের ভেতরে যে ভাল জিনিসগুলো নিহিত রয়েছে সেইগুলোকেই জাগিয়ে দিয়ে, বাড়িয়ে দিয়ে একে ভাল করে তুলবো৷ ভাল মানে কী?–না, সংস্কৃত ‘ভদ্র’ শব্দ থেকে ‘ভাল’ শব্দটা এসে
পরমপুরুষের পরম রচনাত্মক শক্তি নিজ আন্তরিকতা তথা ভূমামনের চেতনাশক্তির সাহায্যে ভৌতিক জগতের জড় অথবা জীব সত্তার বিভিন্ন রূপ প্রদান করে থাকে৷ প্রত্যেক বস্তু তাঁরই রচনা, প্রত্যেক বস্তু তাঁরই দ্বারা সংরক্ষিত ও পালিত হয়ে থাকে৷ শেষ পর্যন্ত তাঁরই বিরাট ভূমামনে সমস্ত জাগতিক সত্তার অন্তিম পরিণতি ঘটে যায়৷ অর্থাৎ পরমসত্তার মানসিক আধার ভূমিতে সব কিছুর লয় হয়ে যায়৷ এই কারণে আমি বলি কোন বস্তুই ক্ষুদ্র নয়, কোন বস্তুই অনাবশ্যক নয়৷ যদি অগুন্তি প্রোটোপ্লাজম দ্বারা এই সামূহিক শরীর তৈরী হয়ে থাকে, তাহলে তোমার মনও একটি সামূহিক মন৷ এছাড়া প্রত্যেক প্রোটোপ্লাজম একটি জীবিত সত্তা৷ আর এই কারণে প্রত্যেক জীবিত সত্তার নিজস্
‘সৎ’ কী ও ‘অসৎ’ কী– এ সম্পর্কে যে বিচারবোধ তাকে সদাসৎ বিবেক বলে, যা ‘সৎ’–কে ‘অসৎ’ থেকে ও ‘অসৎ’–কে ‘সৎ’ থেকে পৃথক করে দেয়৷ ‘সৎ’ কী? লৌকিক ভাষায় ‘সৎ’ মানে ভালো– সৎ ব্যষ্টি, সজ্জন ব্যষ্টি৷ আর আধ্যাত্মিক অর্থে ‘সৎ’ মানে অপরিণামী সত্তা– যাতে কোনো পরিবর্তন হয় না৷ আর ‘অসৎ’ মানে যা পরিণামী, যার অবস্থান্তর ঘটে৷ ‘সৎ’ বস্তু একই, বাদবাকী সব অসৎ৷ ‘অসৎ’ মানে খারাপ নয়, পরিবর্তনশীল৷
মানুষ সাধনা করে ঈশ্বর প্রাপ্তির জন্য৷ এখন ঈশ্বর সম্প্রাপ্তিটা কেমন জিনিস? –না, নিজের সত্তাটা, নিজের অস্তিত্ববোধটা পরমপুরুষে মিলিয়ে দেওয়া৷ এই মিলিয়ে দেওয়ার উপায়টা কী? সাধনার দ্বারা নিজেকে, নিজের সমগ্র সত্তাবোধকে পরমপুরুষের কাছে নিয়ে যাওয়া ও এর সঙ্গে সঙ্গে আর কী করা?
এই যে শরীর, এই যে মন, এ সবের জন্যে তো অর্থের, অন্ন–বস্ত্রের আবশ্যকতা আছে ঠিক কথা৷ মানুষ অর্থোপার্জনের চেষ্টা করবে, ঘরবাড়ী, জমি–জায়গার জন্যে চেষ্টা করবে৷ এ সবই ঠিক৷ কিন্তু যখন এই চেষ্টা করবে, চেষ্টা করার সময় মনে এই ভাবনা রাখতে হবে যে, ‘‘আমি এই সব পাওয়ার জন্যে চেষ্টা করছি এইজন্যে যে এ সব আমার আধ্যাত্মিক সাধনার সহায়ক হবে৷ এই সব জাগতিক বস্তুর লাভের উদ্দেশ্যে এ সবের সাধনা করছি না৷’’ মানুষ যখন নিজের স্থূল ভাবকে সূক্ষ্মভাবে রূপান্তরিত করতে থাকবে, তখন ক্রমশঃ সে বৈয়ষ্টিক ভাবনার দ্বারা পরিচালিত না হয়ে সামূহিক ভাবনার দ্বারা পরিচালিত হতে থাকবে৷
মানসিক রূপান্তরণের দ্বারাই জীব মুক্তির পথ প্রশস্ত করতে পারে, আর সেটা তখনই সম্ভব হয় যখন জীব পরমপুরুষকে নিজের একমাত্র আভোগ বা আরাধ্য হিসেবে স্বীকার করে নেয়৷ মানুষের তথা সাধকের স্বভাবই হচ্ছে পরমপুরুষরূপ মানস–আভোগ থেকে উৎসারিত তরঙ্গসমূহের সঙ্গে একাত্ম হয়ে তাঁর সমস্ত গুণকে আত্মসাৎ করে নেওয়া৷ তাই বলা হয়েছে ঃ–
‘‘অপিচেৎ সুদূরাচারো ভজতে মামনন্যভাক৷
সো অপি পাপবিনির্মুক্তো মুচ্যতে ভববন্ধনাৎ৷৷’’
সুদূরাচারী কাকে বলব? দূরাচারী কথাটার অর্থ হচ্ছে সবচেয়ে নিকৃষ্ট ধরনের পাপী৷ আর সুদূরাচারী মানে হ’ল দূরাচারীও তার পাপের জন্যে তাকে ঘৃণা করে৷
পূর্ব প্রকাশিতের পর
কুসুমে সুরভি যে কেবল দেবতার কাম্য তা নয়৷ ভক্ত তার হৃদয়ের সুরভি দিয়ে মালা গাঁথে তার ইষ্টের জন্যে৷ কুসুমে সুরভি না থাকলে সে কুসুম ভক্তের কাছে কোন মূল্য বহন করে না৷ এখানে মনে রাখতে হবে, কুসুমের সুরভি আর ভক্তের হৃদয়ের কোমল মাধুরী দু’য়ে মিলে এক অনবদ্যতা এনে দেয়৷
দর্শনশাস্ত্র প্রথম লিখলেন (তখন অক্ষর উদ্ভাবিত হয়েছে) মহর্ষি কপিল*৷ লোকে তাঁর পাণ্ডিত্যে মুগ্ধ হ’ল৷ প্রথম দর্শনের প্রবক্তা হিসেবে সমাজের সমস্ত পণ্ডিতেরাই এক বাক্যে ‘‘আদি বিদ্বান’’ বলে তাঁর মাথায় সম্মানের শিরোপা চড়িয়ে দিলেন৷ রাঢ়ের এই সারস্বত পুরুষ সৃষ্টিরহস্যের মূল কারণগুলো সংখ্যাক্ষদ্ধ করে বিদ্বৎসমাজে সাজিয়ে তুলে ধরলেন৷...
আর্যরা ভারতে বসবাস করার পরে অনার্য সমাজে জন্মেছিলেন এক বিরাট পুরুষ৷ মঙ্গোলীয়–আর্য মিশ্র কুলে জাত এই বিরাট পুরুষ ছিলেন উন্নতনাসা ও শুভ্রকান্তি৷ ইনি ছিলেন মহাতান্ত্রিক, মহাযোগী৷ অনার্য সমাজের এই মহাপুরুষ শিব নামে প্রসিদ্ধ ছিলেন৷ একাধারে এত গুণ মানুষের মধ্যে যে থাকতে পারে এ কথা লোকে ভাবতে পারে না, তাই তাঁকে বলা হ’ত গুণাতীত বা নির্গুণ পুরুষ৷ তন্ত্রসাধনার ফলে এই শিব অর্জন করেছিলেন অলোকসামান্য শক্তি৷ এই শক্তিকে তিনি লাগিয়ে গেছলেন জনকল্যাণের কাজে৷ তন্ত্রশাস্ত্রকে সুসংবদ্ধরূপ ইনিই দিয়েছিলেন৷ তাই তান্ত্রিকের বা যোগীর ইনি ছিলেন গুরু–ইনি ছিলেন পিতা৷ এই ব্রহ্মজ্ঞ মহাপুরুষের দৃষ্টিতে উচ্চ–নীচ ভেদ ছিল ন
সংকোচনেই দুঃখ, আর ব্যাপ্তিতে পাওয়া যায় সুখ৷ মানুষ যখন ক্ষুদ্র বুদ্ধি তথা ক্ষুদ্র ভাবনার দ্বারা প্রেষিত হয়ে কাজ করে তখন সে ছোট হয়ে যায়, দুঃখ পায়, আর ক্ষৃহৎ ভাবনা নিয়ে কাজ করলে আনন্দ পায়, শান্তি পায়৷ যে মানুষ ক্ষুদ্র ভাবনা নিয়ে কাজ করে তার কী হয়? তার পথই বা কী? তার পথ বিশ্লেষণের পথ৷ এককে খণ্ড খণ্ড করার পথ৷ আর যে ক্ষৃহৎ ভাবনা নিয়ে কাজ করে, সে কী করে? সে অনেককে এক করে৷ তার পথ সংশ্লেষণের৷ তাই, সংশ্লেষণই জীবন (synthesis is life) সংশ্লেষণেই শান্তি (synthesis is peace) আর বিশ্লেষণ মানে মৃত্যু (analysis is death)৷
‘‘পিতা কস্য মাতা কস্য কস্য ভ্রাতা সহোদরাঃ৷
‘আমি পরমপুরুষের দাসানুদাস, তাঁর কাজ তিনিই করছেন, আমি তাঁর যন্ত্রমাত্র’–এই যে মানসিকতা একেই বলে ‘প্রপত্তি’৷ ‘প্রপত্তি’ শব্দের ব্যুৎপত্তি হ’ল ঃ প্র–পত্-ক্তিন্ = প্রপত্তি৷ প্রপত্তিভাবের সাধক দুঃখকে দুঃখ, সুখকে সুখ বলে আদৌ মনে করেন না বস্তুতঃ সুখ–দুঃখকে তিনি সমভাবে প্রসন্নচিত্তে গ্রহণ করেন৷
বলা হয়েছে, পরমাত্মার কৃপা হলে ‘মূকং করোতি বাচালং পঙ্গুং লঙঘয়তে গিরিম্’৷ অর্থাৎ যে মূক–বোবা সেও বাচাল হয়ে যায়, খুব কথা বলতে থাকে, আর পঙ্গুও পর্বত লঙঘন করতে পারে৷ পরমপুরুষের কৃপাতেই যে তা সম্ভব, এটা খুব সহজেই ক্ষোঝা যায়৷ কিন্তু আমি বলতে চাই– যে কোনো কাজই, মনে কর, মূক হয়তো বাচাল হচ্ছে না, কিন্তু কিছুটা কথা বলছে, পঙ্গু পর্বত লঙঘন করছে না, কিন্তু ধীরে ধীরে পাহাড়ে উঠছে– এটা কি মানুষ তার নিজের শক্তির সাহায্যে করে?
বৃক্ষলতার কিছু বিশেষ গুণ আছে৷ যেমন, মাটির নীচে থেকে রস টেনে নেওয়া৷ মানুষ নিতে পারে না৷ জন্তু–জানোয়াররাও নিতে পারে না৷ কিন্তু বৃক্ষলতারা মাটির থেকে রস টেনে নিতে পারে৷ বাতাস থেকেও এরা কিছু খাদ্য নেয়৷ যদিও জীবজন্তু, মানুষও কিছুটা তা করে, কিন্তু উদ্ভিদের মত অতটা নয়৷ একে আমরা বলতে পারি উদ্ভিদ–ধর্ম৷ বৃক্ষলতা পায়ের সাহায্যে খাদ্যগ্রহণ করে৷ তোমরা জান কি না?
মানুষ চলতে শুরু করেছে যখন, নিজের কথাটা যতটা ভেবেছে, অন্যের কথাটা ততটা ভাবেনি৷ অন্য মানুষের কথাও ভাবেনি, আর মনুষ্যেতর জীব–জন্তুর কথাও ভাবেনি, গাছ–পালার কথাও ভাবেনি৷ অথচ একটু ঠাণ্ডা মাথায় ভাবলে দেখা যাবে যে, নিজের কাছে নিজের অস্তিত্ব যতটা প্রিয়, প্রত্যেকের কাছে তাদের নিজের নিজের অস্তিত্ব ততটাই প্রিয়৷ আর সব জীবের এই নিজ অস্তিত্বপ্রিয়তাকে যথাযোগ্য মূল্য না দিলে সামগ্রিক ভাবে মানবিকতার বিকাশ অসম্ভব৷ মানুষ যদি ব্যষ্টি বা পরিবার,জাত বা গোষ্ঠীর কথা ভাবলো, সামগ্রিক ভাবে মানুষের কথা না ভাবলো–সেটা অবশ্যই ক্ষতিকর৷ কিন্তু মানুষ যদি সামগ্রিকভাবে জীবজগৎ, উদ্ভিদ জগতের কথা না ভাবলো সেটা কি ক্ষতিকর নয় মানবিক
পূর্ব প্রকাশিতের পর
যদি কোন বৃহৎ বা ভারী বস্তুকে কেউ এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যেতে চায়, তার পক্ষে সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ হবে সেই বস্তুটার বীজটাকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়া৷ একটা গোটা বটগাছকে এক স্থান থেকে অন্যত্র নিয়ে যাওয়া খুব শক্ত৷ কিন্তু সেই বটবৃক্ষের একটা ছোট্ট বীজকে নিয়ে যাওয়া সহজ৷ বীজটাকে নিয়ে গেলেই গাছটাকে নিয়ে যাওয়া হ’ল৷
এক এব সুহূদ্ধর্ম নিধনেহপ্যনুযাতি যঃ’’৷ ধর্মই তোমার একমাত্র সুহৃদ (এক ধরণের বন্ধু যা মৃত্যুর পরেও মানুষের সঙ্গে থেকে যায়)৷ সংস্কৃতে ‘বন্ধু’ শব্দের কয়েকটিই প্রতিশব্দ রয়েছে৷ ‘‘অত্যাগসহনো বন্ধুঃ সদৈবানুমতঃ সুহৃদ৷ একক্রিয়ং ভবেন্মিত্রং সমপ্রাণাঃ সখা স্মৃতঃ৷৷’’ ‘‘অত্যাগসহনো বন্ধুঃ’’৷ যে বিচ্ছেদ–বেদনা সহ্য করতে পারে না সে–ই বন্ধু৷ যার সঙ্গে তোমার ভালবাসার সম্পর্ক এতই দৃঢ় যে তোমার বিচ্ছেদ তার কাছে অসহনীয় বলে মনে হচ্ছে তাকেই বলব বন্ধু৷ পারস্পরিক স্নেহ–ভালবাসার এই বন্ধন এতই দৃঢ় যে সে তোমার কাছ থেকে দূরে থাকতে পারে না–তোমার সঙ্গে বিচ্ছেদ সহ্য করতে পারে না৷ এই পৃথিবীতে বাস্তবে দেখা যায়, প্রত্যেকেই তোমার
গত রাতে আমি এই পরিদৃশ্যমান জগতে বিভিন্ন সম্ভাবনাপূর্ণ অস্তিত্ব, যেমন---অণু মানসসত্তা ও চিতিসত্তা সম্পর্কে বলেছিলুম৷ পরম চিত্তিশক্তির যে অন্তর্মুখী গতি (বহির্মুখী গতিতে পঞ্চভৌতিক জগতের উৎপত্তি) তারই এক স্তরে মানুষের সৃষ্টি৷ এই অন্তর্মুখী গতি পরম চিতিশক্তিতে ফিরে আসার জন্যে৷
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
ড্ড পূর্ব প্রকাশিতের পর
আজকের আলোচ্য বিষয় হচ্ছে ‘যোগ ও তন্ত্র’৷ অনেকে জানতে আগ্রহী যে যোগ কী ও তন্ত্র কী, আর এদের মধ্যে মিল ও পার্থক্য কোথায়৷ প্রথমে যোগ নিয়ে আলোচনা করা যাক্৷
এখন ভারতবর্ষ ও আধ্যাত্মিকতা সম্পর্কে কিছু আলোচনা করা যাক৷ এই দেশের নাম ভারতবর্ষ৷ জানতো, পৃথিবীতে যা কিছু শব্দ আছে সবই অর্থপূর্ণ৷ গ্রামের নামই হোক বা নদীর নাম, সবেরই একটা অর্থ আছে৷ এ দেশের নাম ভারতবর্ষ কেন রাখা হ’ল? প্রাচীনকালে এখানকার বাসিন্দা ছিল দ্রাবিড়, অষ্ট্রিক ও মঙ্গোলিয়ন৷ আর্যরা যখন এল তখন তারা এর নামকরণ করলে ‘ভারতবর্ষ’৷ এমন নাম কেন করা হ’ল?
সমাজে মানবিক প্রয়াস যেমন চারটে স্তরে বিন্যস্ত হয়ে রয়েছে –– কাম, অর্থ, ধর্ম, মোক্ষ৷ এই চতুর্ধাবিন্যস্ত মানুষের কর্মৈষণা তথা কর্মতৎপরতাকে আমরা বলি ‘চতুর্বর্গ’৷ এই চতুর্বর্গের মিলিত প্রয়াসেই সমাজের সামূহিক কল্যাণ, সামূহিক পরিণতি৷ কোনোটা সম্পূর্ণ ভাবে জাগতিক তথা পাঞ্চভৌতিক ক্ষেত্রে, কোনোটা পাঞ্চভৌতিক ক্ষেত্রের সঙ্গে মানসিক ক্ষেত্রকে সংযুক্ত করেছে, কোনোটা কেবল মানসিক আর কোনোটা মানসিক ক্ষেত্র ছেড়ে আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে গিয়ে পৌঁছে যাচ্ছে, এই ভাবে বিভক্ত হয়ে রয়েছে৷ মানুষের অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসগৃহ –– এই যে পাঞ্চভৌতিক প্রয়োজনগুলো, এগুলো হ’ল কাম৷ তার পরেই হ’ল অর্থ – যা মানুষ বিভিন্ন ধরনের
‘সর্বাজীবে সর্বসংস্থে ক্ষৃহন্তে তস্মিন্ হংসো ভ্রাম্যতে ব্রহ্মচক্রে৷
পৃথগাত্মানং প্রেরিতারঞ্চ মত্বা জুষ্টস্ততস্তেনামৃতত্৷৷’
তোমরা জান বিশ্বের সবাই পরমপুরুষের সন্তান৷ তিনিই এই বিশ্ব সৃষ্টি করেছেন৷ তিনিই সৃষ্টি করেছেন এই জগৎকে, সৃষ্টি করেছেন এই সমস্ত জীবিত প্রাণীকুলকে৷
অতীতে কয়েকবারই আমি তোমাদের একটা গল্প শুণিয়েছিলুম হর–পার্বতী সংবাদ থেকে৷ গল্প আছে, একবার পার্বতী শিবকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “সাফল্য লাভের রহস্য কী”? উত্তরে শিব বলেছিলেন, সাফল্য লাভের সাতটি গোপন রহস্য আছে৷
‘ফলিষ্যতীতি বিশ্বাসঃ
সিদ্ধের্প্রথমলক্ষণ৷
দ্বিতীয়ং শ্রদ্ধয়া যুক্তং
তৃতীয়ং গুরুপূজনম্৷৷
চতুর্থো সমতাভাবো
পঞ্চমেন্দ্রিয়নিগ্রহ৷
ষষ্ঠঞ্চ প্রমিতাহারো
সপ্তমং নৈব বিদ্যতে৷৷
(শিবসংহিতা)
একটা গল্প আছে৷ একবার হনুমানকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, /আচ্ছা হনুমান, তুমি তো বড় ভক্ত৷ তুমি জান যে নারায়ণ ও রামের মধ্যে কোন মৌলিক পার্থক্য নেই, তবু তুমি সর্বদাই রামের নাম নাও, কদাপি ভুলেও নারায়ণের নাম নাও না৷ যদিও রাম ও নারায়ণ মূলগত ভাবে একই সত্তা, তবু তুমি এমনটি কর কেন?*
যোগ কী? তোমারা জান যে সংস্কৃত শব্দভাণ্ডারের প্রায় প্রতিটি শব্দের দু’টো করে মানে হয়৷ একটি হ’ল ব্যুৎপত্তিগত অর্থে সংস্কৃতে যাকে বলা হয় ভাবরূরার্থ, দ্বিতীয়টি হ’ল সাধারণ প্রচলিত অর্থ অর্থাৎ লোকে যে অর্থে শব্দটাকে সচরাচর ব্যবহার বা প্রয়োগ করে থাকে৷ এটির সংস্কৃত নাম যোগরূরার্থ৷
উদাহরণস্বরূপ, ধর, ‘পঞ্চানন’ শব্দটি৷ শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থ অর্থাৎ ভাবরূরার্থ হচ্ছে ‘যার পাঁচটা মুখ আছে’৷ যোগরূরার্থ হচ্ছে শিব৷ দেশে পঞ্চানন নামে কত শত ভদ্রলোক আছেন৷ এখানে আসল অর্থটা হ’ল এমন কেউ বা এমন কিছু যার পাঁচটা মুখ আছে৷
প্রাণায়ামের মত প্রত্যাহার যোগও স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়৷ কোন জীবিত সত্তার প্রাণবায়ুর গতিবিধিকে নিয়ন্ত্রণ করার যে পদ্ধতি তারই নাম প্রাণায়াম৷ ‘প্রাণান্ যময়ত্যেষ প্রাণায়ামঃ*৷ আধ্যাত্মিক সাধক এই প্রাণায়াম–পদ্ধতির দ্বারা দেহের প্রাণশক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করে৷
প্রাণায়াম সম্পর্কে একটা বিশেষ কথা মনে রাখতে হবে, প্রাণায়ামের সঙ্গে বিন্দুধ্যানের সম্পর্ক রয়েছে৷ প্রাণায়াম অভ্যাসকালে মনকে একটা নির্দিষ্ট বিন্দুতে নিক্ষদ্ধ রাখতে হবে৷ প্রাণায়ামকে যদি বিন্দু ধ্যান থেকে বিচ্যুত করে নেওয়া হয় তাতে নিজের মানস শক্তির ওপর নিয়ন্ত্রণ ব্যাহত হবে, মন চঞ্চল হয়ে পড়বে৷
‘জাগ্রৎ–স্বপ্ণ–সুষুপ্ চৈতন্যং যদ্ প্রকাশতে৷
তদ্ ব্রহ্মামিতি জ্ঞাত্বা সর্বক্ষন্ধৈঃ প্রমুচ্যতে৷৷’
মানুষের মনের চারটে স্তর–জাগ্রৎ, স্বপ্ণ, সুষুপ্তি ও তুরীয়৷ যখন চেতন মন পুরোপুরি সচেতন ও সক্রিয় সেটা মনের জাগ্রৎ অবস্থা৷ আমরা সবাই এই জাগ্রৎ অবস্থায় বেশীর ভাগ সময় কাটাই৷ যখন চেতন মান সচেতন ও সক্রিয় নয়, কিন্তু অবচেতন মন সজাগ ও কোন কিছুর দ্রষ্টা তাকে বলি স্বপ্ণ বা dream৷ যেখানে চেতন ও অবচেতন দুই–ই নিষ্ক্রিয় অবস্থায় চলে যায় তাকে বলে সুষুপ্তির অবস্থা৷ আর যেখানে চেতন, অবচেতন ও অচেতন–মনের এই তিন অবস্থাই নিষ্ক্রিয় থাকে ও চিতিশক্তিতে সমাহিত থাকে সেখানে তাকে মনের তুরীয়াবস্থা বলা হয়৷
আনন্দাদ্ধ্যেব খল্বিমানি ভূতানি জায়ন্তে৷
আনন্দেন জাতানি জীবন্তি৷
আনন্দং প্রয়ন্ত্যভি সংবিশন্তীতি৷৷’
তোমরা জান, অন্যান্য সকল বিষয়ে যত যত্নই নেওয়া হোক না কেন, তরকারিতে লবণ ঠিক মত না দিলে তা কখনও সুস্বাদু হয় না৷ তেমনই সসীম ও অসীমের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনের যাবতীয় প্রয়াস বিফল হয় যদি ভক্তির অভাব ঘটে৷
পরমপুরুষের স্বগতোক্তিটি কী? –না, সেই স্বগতোক্তি হচ্ছে ঃ
‘ময্যৈব সকলং জাতং ময়ি সর্বং প্রতিষ্ঠিতম্৷
ময়ি সর্বং লয়ং জাতি তদ্ ব্রহ্মাদ্বয়মস্ম্যহ৷’
সব কিছু আমার থেকে উদ্ভূত হয়েছে, সব কিছু আমাতেই স্থিত রয়েছে, সব কিছু আমাতেই লীন হচ্ছে৷
‘ময্যৈব সকলং জাতং’৷ সব কিছু আমার থেকে সৃষ্ট হচ্ছে৷ অর্থাৎ তিনি চেয়েছিলেন যে তাঁর মনের মধ্যেই কিছু সৃষ্ট হোক, তাঁর মনের ভেতরেই একটা ভাবজগৎ তৈরী হোক, অর্থাৎ তিন তাঁর মানস কল্পনায় একটা বিশ্বসৃষ্টি রচনা করুন৷ আর তার ফলেই তৈরী হ’ল এই পরিদৃশ্যমান বিশ্ব৷
পুরাণের যুগে তো রীতিমত অনেক গল্প তৈরী করা হয়েছিল দেবী-দেবতাদের নিয়ে৷ তাতে গণেশের স্ত্রী হচ্ছেন তুলসী ৷ কিন্তু কোন কোন পুরাণের মতে গণেশের স্ত্রী হলেন ষষ্ঠী দেবী৷ পৌরাণিক সমাজে শিশু ভূমিষ্ঠ হবার একমাসের মধ্যে ষষ্ঠীর একটা পূজো হয়৷ আবার কোনও কোনও পুরাণের মতে কার্ত্তিকের স্ত্রী হলেন ষষ্ঠী৷ আবার ভারতের কোন কোন অংশে প্রচলিত স্থানীয় পুরাণের মতে গণেশের স্ত্রীর নাম সন্তোষী দেবী৷ পুরাণকারদের মধ্যে পারস্পরিক মতভেদ অত্যন্ত প্রবল ৷ যাইহোক, গণেশের পাশে যে কলা-বৌ থাকে সে কি গণেশের স্ত্রী নয়? সে কে তাহলে?
প্রাচীন সংস্কৃত শব্দভাণ্ডারে বছরে ছ’টা ঋতুর উল্লেখ আছে৷ গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসন্ত৷ কিন্তু ভারতের অনেক স্থানে, বিশেষ করে সমুদ্রের তটবর্তী এলাকায় তথা পূর্ব ভারতে মূলতঃ চারটে ঋতু৷ সেগুলি হচ্ছে গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ ও শীত৷ ক্ষাঙলায় শীত ঋতু শেষ হতে না হতেই গরম শুরু হয়ে যায়৷ তাই বসন্ত ঋতু এখানে পনেরো দিনের জন্যেও স্থায়ী হয় না, আর হেমন্ত তো শীতেরই অঙ্গ৷
আমার মনে হয়, প্রপত্তি সম্পর্কে আমার কিছু বলা দরকার৷ বোধ হয়, সেটা আমার সামাজিক ও আধ্যাত্মিক দায়িত্ব ও কর্ত্তব্যও৷ সংস্কৃতে প্র–পত্+ ক্তিন প্রত্যয় করে ‘প্রপত্তি’ শব্দটি নিষ্পন্ন৷ প্রপত্তির পেছনে মূল ভাবটা, মূল তাৎপর্যটা হচ্ছে এই যে আমাদের এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে যা কিছু ঘটে চলেছে সবই পরমপুরুষের ইচ্ছার অভিপ্রকাশ৷ তার আদেশ(order) বিনা আগ্ণেয়গিরির অগ্ণ্যুদগীরণও হবে না, এমনকি একটা ঘাসের পাতাও নড়বে না৷ তাই পরমপুরুষ আগে থেকেই যেমনটি বন্দোবস্ত করে রেখেছেন, যেমনটি পরিকল্পনা করে রেখেছেন ঠিক তেমনটিই ঘটে চলেছে৷
রামচন্দ্র নাকি দুর্গাপূজা করেছিলেন--- তোমরা এ ধরণের একটা গল্পও শুণেছ বোধ হয়--- এটার প্রাসঙ্গিকতা কী, সেটা বলি৷ সে সম্বন্ধে বলতে গেলে আগে রামায়ণের কথা বলতে হয়৷ রামায়ণের গল্প ভারত,মালয়েশিয়া আর ইন্দোনেশিয়ার মানুষদের মুখে মুখে চলছে ..দু/চার হাজার বছর নয়, আজ অনেক হাজার বছর ধরে৷ তবে এই রামায়ণকে লিখিত রূপ প্রথম দিয়েছিলেন মহর্ষি বাল্মীকি৷ এই লিখিত রূপ যখন তিনি দিয়েছিলেন সেটা শিবের যুগের অনেক পরে, বুদ্ধের যুগেরও পরে৷ তার দু’টো প্রমাণ আমাদের হাত রয়েছে৷ তার একটা প্রমাণ হচ্ছে,কোন্ বইটা কত পুরোনো সেটা তার ভাষা দেখে বোঝা যায়৷ ভাষাটা পুরোণো , তা হলে বইটাও পুরোণো৷ ভাষাটা নোতুন, তো বইটাও নোতুন৷ যা রামায়ণ বা
আত্মজ্ঞানই হ’ল মুক্তির লক্ষণ, আর এই আত্মজ্ঞান মানুষ তখনই পায় যখন সে নিজ সুকর্মের ফলে মানুষের শরীর লাভ করে৷ মানবদেহ লাভ করলে তবে আত্মজ্ঞান হয়৷ দেখ, পশুজীবন ও মানবজীবন এই দু’য়ের মধ্যে মুখ্য পার্থক্য কী? দুই–ই পরমাত্মার সন্তান৷ একটি কুকুর, একটি বিড়াল আর একজন মানুষ–সবই পরমাত্মার সন্তান৷ কিন্তু দু’য়ের মধ্যে পার্থক্যটা এই যে, মানুষের বুদ্ধি উন্নত৷ মানুষ বোঝে যে শ্রেয় ও প্রেয়ের মধ্যে পার্থক্য কোথায়?
আনন্দমুর্তি‘আমি পরমপুরুষের দাসানুদাস, তাঁর কাজ তিনিই করছেন, আমি তাঁর যন্ত্রমাত্র’–এই যে মানসিকতা একেই বলে ‘প্রপত্তি’৷ ‘প্রপত্তি’ শব্দের ব্যুৎপত্তি হ’ল ঃ প্র–পত্ + ক্তিন্ = প্রপত্তি৷ প্রপত্তিভাবের সাধক দুঃখকে দুঃখ, সুখকে সুখ বলে আদৌ মনে করেন না বস্তুতঃ সুখ–দুঃখকে তিনি সমভাবে প্রসন্নচিত্তে গ্রহণ করেন৷
আর্যরা ভারতে বসবাস করার পরে অনার্য সমাজে জন্মেছিলেন এক বিরাট পুরুষ৷ মঙ্গোলীয়–আর্য মিশ্র কুলে জাত এই বিরাট পুরুষ ছিলেন উন্নতনাসা ও শুভ্রকান্তি৷ ইনি ছিলেন মহাতান্ত্রিক, মহাযোগী৷ অনার্য সমাজের এই মহাপুরুষ শিব নামে প্রসিদ্ধ ছিলেন৷ একাধারে এত গুণ মানুষের মধ্যে যে থাকতে পারে এ কথা লোকে ভাবতে পারে না, তাই তাঁকে বলা হ’ত গুণাতীত বা নির্গুণ পুরুষ৷ তন্ত্রসাধনার ফলে এই শিব অর্জন করেছিলেন অলোকসামান্য শক্তি৷ এই শক্তিকে তিনি লাগিয়ে গেছলেন জনকল্যাণের কাজে৷ তন্ত্রশাস্ত্রকে সুসংবদ্ধরূপ ইনিই দিয়েছিলেন৷ তাই তান্ত্রিকের বা যোগীর ইনি ছিলেন গুরু–ইনি ছিলেন পিতা৷ এই ব্রহ্মজ্ঞ মহাপুরুষের দৃষ্টিতে উচ্চ–নীচ ভেদ ছিল ন
প্রণিপাতেন পরিপ্রশ্ণেন সেবয়া৷ আধ্যাত্মিক প্রগতি তিনটি তত্ত্বের ওপর নির্ভরশীল–প্রণিপাত, পরিপ্রশ্ণ, সেবা৷ ‘প্রণিপাত’ মানে এক অদ্বিতীয় শাশ্বত সত্তা পরমপুরুষের প্রতি পূর্ণ আত্মসমর্পণ৷ এক্ষেত্রে সাধকের মনোভাব হচ্ছে এই যে বিশ্বের যা কিছু সবই পরমপুরুষের, আমার বলতে কিছু নেই৷ এটা হ’ল প্রণিপাত৷ আর যার অহংক্ষোধ রয়েছে, যে ভাবছে তার বিদ্যা–বুদ্ধি, ধন–সম্পত্তি বা অন্যান্য যাবতীয় বস্তু তার বৈয়ষ্টিক সম্পত্তি, সে সবচেয়ে বড় মূর্খ৷
‘প্রণিপাতেন পরিপ্রশ্ণেন সেবয়া৷’ আধ্যাত্মিক প্রগতি তিনটি তত্ত্বের ওপর নির্ভরশীল–প্রণিপাত, পঙ্গিরপ্রশ্ণ, সেবা৷ ‘প্রণিপাত’ মানে এক অদ্বিতীয় শাশ্বত সত্তা পরমপুরুষের প্রতি পূর্ণ আত্মসমর্পণ৷ এক্ষেত্রে সাধকের মনোভাব হচ্ছে এই যে বিশ্বের যা কিছু সবই পরমপুরুষের, আমার বলতে কিছু নেই৷ এটা হ’ল প্রণিপাত৷ আর যার অহংবোধ রয়েছে, যে ভাবছে তার বিদ্যা–বুদ্ধি, ধন–সম্পত্তি বা অন্যান্য যাবতীয় বস্তু তার বৈয়ষ্টিক সম্পত্তি, সে সবচেয়ে বড় মূর্খ৷
এই মহাবিশ্ব অজস্র স্পন্দনের সমাহার৷ এই যে পরিদৃশ্যমান জগৎ যাকে সাধারণভাবে ‘প্রপঞ্চ’ আখ্যায় অভিহিত করে থাকি তা মূলতঃ মানস জগৎ ও অতিমানস জগতের অধিক্ষেত্রভুক্ত৷ এই স্পন্দনরাজি সংখ্যায় অসংখ্য...অগুন্তি কিন্তু অনন্ত নয়৷ যদি তারা অনন্ত হত তাহলে সৃষ্টিটাও অনন্ত হত৷ তবে হ্যাঁ, তরঙ্গ-রাজির সংখ্যা অজস্র...অগণিত৷ কিন্তু তা কোনোমতেই অনন্ত নয়৷
.....আমাদের এই শ্রাবণী পূর্ণিমা–অনেকেই জান, এটা জানা জিনিস৷ আমি তখন খুবই ছোট্ট৷ তখন বিদ্যাসাগর কলেজে পড়ি৷ একদিন সন্ধ্যায় একটা ঘটনা ঘটল৷ একজন লোক–সে লোকটি দুষ্ট প্রকৃতির ছিল৷ আমরা এই কথাটা ব্যবহার করছি এই জন্যে যে আজ যে মানুষটা দুষ্ট, কাল সে সাধু হতে পারে৷ আজ যে মূঢ় কাল সে জ্ঞানী হতে পারে–এ সবকিছু আপেক্ষিক জগতের আপেক্ষিকতার দ্বারা অভিষিক্ত৷ তাই এর কোন শাশ্বত রূপ নেই৷ কোন মানুষকে স্থায়ীভাবে দুষ্ট বলা চলে না৷ সব সময় মনে রাখতে হবে যে আমি এই দুষ্টের ভেতরে যে ভাল জিনিসগুলো নিহিত রয়েছে সেইগুলোকেই জাগিয়ে দিয়ে, বাড়িয়ে দিয়ে একে ভাল করে তুলবো৷ ভাল মানে কী?–না, সংস্কৃত ‘ভদ্র’ শব্দ থেকে ‘ভাল’ শব্দটা এসে
শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তি
‘‘যচ্ছেদ্ বাঙ্মনসী প্রাজ্ঞস্তদ্
যচ্ছেদ্জ্ঞান আত্মনি৷
জ্ঞানমাত্মনি মহতি নিযচ্ছেৎ
তদ্ যচ্ছেচ্ছান্ত আত্মনি৷৷’’
আজকাল কিছু কিছু দ্ধিজীবী জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রগতি সম্পর্কে আলোচনায় মুখর৷ প্রথমতঃ, প্রগতি জিনিসটা সরলরেখায় চলে না৷ প্রগতি ব্যাপারটা হ’ল সংকোচ বিকাশী ও ছন্দায়িত৷ দ্বিতীয়তঃ, মনে রাখতে হবে যে প্রগতির গতি স্থানবিশেষে ও ক্ষেত্র অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন হয়৷ কোন্ ক্ষেত্রে প্রগতি ঘটছে, তদনুযায়ী প্রগতির গতি পরিবর্তিত হয়৷
এখন সংক্ষেপে ‘‘ওঁকার ও ইষ্টমন্ত্র’’ সম্বন্ধে তোমাদের কিছু বলব৷ জেনে বা না জেনে প্রতিটি জৈবিক সত্তা পরমপুরুষকে ভালবাসে, তাঁর ভালবাসা পেতে চায়৷ আর সৃষ্টির ঊষালগ্ণ থেকেই (আমি মানুষের সভ্যতার শুরু থেকে না বলে বলছি মানুষ সৃষ্টির প্রথম অবস্থা থেকে) তাদের সমস্ত আশা–আকাঙক্ষা জ্ঞাতে–জ্ঞাতে সেই পরমপুরুষের দিকেই প্রধাবিত হয়ে চলেছে৷
ওঁম্–কার কী? বেদে ওঁম্–কার সম্বন্ধে বলা হয়েছে–
‘‘সবে বেদা যৎপদমামনন্তি তপাংসি সর্বাণি চ যদ্ বদন্তি৷
যদিচ্ছন্তো ব্রহ্মচর্যং চরন্তি তত্তে পদং সংগ্রহেণ ব্রুবীম্যোমিত্যেতদ্৷৷’’
ক’দিন ধরেই আমি বলেছি ও বলে চলেছি যে তন্ত্রের একটা বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা প্রচলিত অন্য সব কিছু থেকেই আলাদা৷ আনন্দমার্গ যদিও মুখ্যতঃ তন্ত্রাশ্রয়ী কিন্তু আনন্দমার্গের আরও অনেকগুলো নিজস্ব বৈশিষ্ট্য রয়েছে৷ প্রথমতঃ আমি বলেছি, আমাদের আদর্শ অনুযায়ী কোন অবস্থাতেই কোন মানুষের ভয় পাবার কোন সঙ্গত কারণ নেই৷ তা সত্ত্বেও যদি কোন মানুষ ভয় পায়, বুঝতে হবে সে আদর্শবিরোধী কাজ করছে, যা তার করা উচিত নয় তেমন কাজ সে করছে৷ সুতরাং মনে রেখো, এমন কোন পরিস্থিতিই পৃথিবীতে আসতে পারে না যে পরিস্থিতিতে তোমাদের ভীত হবার দরকার পড়বে৷ বলা হয়েছে, পরমপুরুষ ভয়ের কাছেও ভয় অর্থাৎ মানুষ ভয়কে যেমনটি মনে করে, ভয় পরমপুরুষকে তেমনটি মনে করে৷
তন্ত্রের সঙ্গে বেদের আদর্শগত তফাৎ বেশী বললে যথেষ্ট হবে না, বলা উচিত খুব বেশী৷ তন্ত্র হ’ল সম্পূর্ণ বৈবহারিক (Practical), তন্ত্র অস্বাভাবিক কোন কিছুকে সমর্থন করে না৷ ফলে তন্ত্রের মধ্যে স্বাভাবিরতা থাকায় সেটা সমাজে সহজেই গৃহীত ও সহজেই আদৃত হয়৷ মানুষ একে সহজেই নিজের জিনিস বলে মনে করতে পারে৷ যেমন বেদে একটা শ্লোকে আছে---‘উত্তিষ্ঠত জাগ্রত প্রাপ্য ররান্ নির্োধত’--- ওঠো, জাগো, উপযুক্ত আচার্যের নিকট সত্বর উপস্থিত হও ও সাধনা মার্গে চলতে শুরু করো৷ এতখানিতে বেদ ও তন্ত্রে মিল আছে৷
গোপাল ঃ পরমপুরুষের একটি নাম হ’ল গোপাল৷ সংস্কৃতে ‘গো’ অর্থে কর্মেন্দ্রিয় ও জ্ঞানেন্দ্রিয় উভয়কেই বোঝায়, আর ‘পাল’ মানে যিনি পালন করেন৷
ধর, একটা মানুষ৷ এখন তার কেবল শরীরটাই রয়েছে, মন নেই আত্মা নেই কিংবা চিতিশক্তি বা ভূমাচৈতন্যও অবর্ত্তমান ৷ তাহলে সেই মানুষটা সমস্ত ইন্দ্রিয় থাকা সত্ত্বেও কাজ করতে পারবে না৷ গোপাল মানে হ’ল জীবাত্মা.....অণুচৈতন্য৷
গোবিন্দ ঃ সংস্কৃতে ‘গো’ মানে হ’ল কর্মেন্দ্রিয় ও জ্ঞানেন্দ্রিয় সমূহ৷ আর ‘বিন্দ’ মানে যিনি কোনো সত্তা বিশেষের বৈশিষ্ট্যকে স্ফূর্ত্তি ও প্রগতির ব্যাপারে সহায়তা করেন৷ তাই ‘গোবিন্দ’ মানেও দাঁড়াচ্ছে অণুচৈতন্য ৷
পূর্ব প্রকাশিতের পর
প্রশ্ণ হচ্ছে–যোগ কী? এখন যোগ সম্বন্ধে এ যাবৎ অজস্র ব্যাখ্যা, অজস্র টীকা–টিপ্পনী প্রচলিত রয়েছে৷ মহান্ দার্শনিক পতঞ্জলির মতে, ‘যোগশ্চিত্ত–বৃত্তিনিরোধঃ’৷ সংস্কৃত ‘যুন্জ্’ ধাতুর উত্তর ‘ঘঙ্’ প্রত্যয় যোগ করে ‘যোগ’ শব্দ নিষ্পন্ন হয়েছে৷ ‘যুন্জ্’ ধাতুর মানে যোগ করা, To add. যেমন– ২ + ২ = ৪৷ এটা যোগ করা হ’ল৷ যোগশ্চিত্তবৃত্তিনিরোধ্’ – পতঞ্জলি প্রদত্ত যোগের এই সংজ্ঞার সাথে যোগ বা addition–এর কোনো সম্পর্ক নেই৷
শাস্ত্রে বলা হয়েছে,
‘‘পার্শদ্ধো ভবেজ্জীবঃ পাশমুক্তো ভবেচ্ছিব৷’’
ব্যষ্টিসত্তা যখন মায়াজালে আবদ্ধ থাকে তখন তাকে বলে জীব বা অণুমন, অর্থাৎ জীবের বৈশিষ্ট্যই হ’ল ন্ধন৷ ব্রহ্মকৃপায় সাধনার দ্বারা যাঁরা এই বন্ধন ছিন্ন করে যখন নিজেকে মুক্ত করতে পারেন তখন তাঁরা শিবত্বে উন্নীত হন৷ শিব হলেন বন্ধনমুক্ত আর জীব বন্ধনযুক্ত৷
সৃষ্টির প্রারম্ভের আগের কথা৷ সে সময় দেশ–কাল–পাত্রের মত সাপেক্ষ সত্তা ছিল না৷ একমাত্র ছিল অখণ্ড অসীম, বৃহৎ, সর্বব্যাপী সত্তা, আর সেই সত্তার সাক্ষিত্বরূপে ছিলেন পরমপুরুষ৷ সেই অখণ্ড সৃষ্টির রচয়িতা পরমপুরুষ নিজেকেই অনেক রূপে নানাপ্রকারে অভিব্যক্ত করলেন৷
‘‘ত্বং স্ত্রী ত্বং পুমানসি, ত্বং কুমার উত বা কুমারী৷
ত্বং জীর্নোদণ্ডেন বঞ্চয়সি ত্বং জাতো ভবসি বিশ্বতোমুখঃ৷’’
‘‘নীলঃ পতংগো হরিতো লোহিতাক্ষ
স্তত্তিদ্গর্ভ ঋতবঃ সমুদ্রাঃ৷
অনদিমত্বং বিভুত্বেণ বর্ত্তসে
যতোজাতানি ভুবনানি বিশ্ব৷৷’’
সৃষ্টির প্রারম্ভের আগের কথা৷ সে সময় দেশ–কাল–পাত্রের মত সাপেক্ষ সত্তা ছিল না৷ একমাত্র ছিল অখণ্ড অসীম, বৃহৎ, সর্বব্যাপী সত্তা, আর সেই সত্তার সাক্ষিত্বরূপে ছিলেন পরমপুরুষ৷ সেই অখণ্ড সৃষ্টির রচয়িতা পরমপুরুষ নিজেকেই অনেক রূপে নানাপ্রকারে অভিব্যক্ত করলেন৷
‘‘ত্বং স্ত্রী ত্বং পুমানসি, ত্বং কুমার উত বা কুমারী৷
ত্বং জীর্নোদণ্ডেন বঞ্চয়সি ত্বং জাতো ভবসি বিশ্বতোমুখঃ৷’’
‘‘নীলঃ পতংগো হরিতো লোহিতাক্ষ
স্তত্তিদ্গর্ভ ঋতবঃ সমুদ্রাঃ৷
অনদিমত্বং বিভুত্বেণ বর্ত্তসে
যতোজাতানি ভুবনানি বিশ্ব৷৷’’
আগে বলেছিলুম, ভালো কাজের জন্যে জিদ্ চাই৷ তাই সাধকের মনে জিদ্ থাকা দরকার৷ শাস্ত্রে আছে, পার্বতী শিবকে জিজ্ঞাসা করলেন, কে এই সংসারে উন্নতি করে, কী তার রহস্য? দেখতে পাচ্ছি, কেউ বড় বড় কাজ করে জীবনে মহান হয়, কেউ বা শুয়ে বসেই থাকে চিরকাল৷ কেউ কেউ তো কলুর বলদ হয়েই থেকে যায়, আবার কারো কারো উন্নতি হয়৷ কেউ অনেক পড়েও খারাপ ফল করে, কেউ বা অল্প পড়েও ভাল ফল করে৷ এই সমস্ত কিছুর পিছনে রহস্য কী?
উত্তরে শিব বললেন,
‘‘ফলিষ্যতীতি বিশ্বাসঃ সিদ্ধের্প্রথমলক্ষণ৷
দ্বিতীয়ং শ্রদ্ধয়া যুক্তং তৃতীয়ং গুরুপূজনম্৷৷
চতুর্থো সমতাভাবঃ পঞ্চমেন্দ্রিয়নিগ্রহ৷
পরমসত্তা যখন প্রকৃতির বন্ধন থেকে মুক্ত, সেই অবস্থা হচ্ছে নির্গুণ আর বন্ধনযুক্ত পরমসত্তা সগুণ৷ সগুণেও আছে দু’টি বিভাগ–একটা তার রূপময় অস্তিত্ব আর অন্যটি অরূপ৷
মানুষের মধ্যে যে বুদ্ধি, বোধি, আমি–বোধ (I-feeling) ইত্যাদি আছে এরা সব অরূপ৷ সেই রকম সগুণ ব্রহ্মেরও বুদ্ধি, বোধি ও আমি–বোধ অরূপ৷ সেইজন্যে সেগুলির কোনটাই আমরা দেখতে পাই না৷
প্রাচীনকালে দীক্ষার দু’টি পদ্ধতি ছিল৷ এই দুই দীক্ষা পদ্ধতির মধ্যে প্রথম ছিল বৈদিকী দীক্ষা৷ দ্বিতীয় তান্ত্রিকী দীক্ষা অর্থাৎ প্রথমে ক্ষৈদিক বিচার–আচার–পদ্ধত অনুযায়ী দীক্ষা আর তন্ত্রানুসারী দীক্ষা৷ বৈদিকী দীক্ষার মুখ্য মন্ত্র ছিল গায়ত্ত্রী মন্ত্র৷ বৈদিকী দীক্ষার মূলনীতি ছিল ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করার সৎপথ তথা আনন্দম্–এর পথ–নির্দেশ করা৷ তান্ত্রিকী দীক্ষার মূল নীতি ছিল সেই পথে এগিয়ে চলা৷ প্রথমটায় পরমাত্মার কাছে পথ– প্রদর্শনের জন্যে প্রার্থনা করা, আর দ্বিতীয়টিতে সাধক এগিয়ে চলে সেই পথে৷ তাই তান্ত্রিকী দীক্ষালাভের পরে সাধককে গুরুর নির্দেশানুসারে অগ্রসর হতে হয়৷
ধর্ম বৈবহারিক, সৈদ্ধান্তিক নয়৷ কে ধার্মিক, কে ধার্মিক নয়–তা তার বিদ্যা, বুদ্ধি বা পদমর্যাদা থেকে প্রমাণিত হয় না৷ কে ধার্মিক তা প্রমাণিত হয় তার আচরণ থেকে৷ কে অধার্মিক তাও প্রমাণিত হয় তার আচরণ থেকে৷ যে ধার্মিক হতে চায়, তাকে তার আচরণ ঠিক করতে হবে৷
কাল বলেছিলুম যে, মানুষ কোন অবস্থাতেই পশু হতে পারে না৷ ঈশ্বরসৃষ্ট বিভিন্ন প্রাণীর মধ্যে একটা শাখা হ’ল মানুষ, একটা হ’ল উদ্ভিদ, আর একটা হ’ল পশু৷ পশুর মধ্যেও আবার স্তরবিন্যাস আছে, উদ্ভিদের মধ্যেও স্তরবিন্যাস আছে৷ সব উদ্ভিদ সমান নয়৷ সব পশুও সমান নয়৷ আবার মানুষেরও স্তরবিন্যাস আছে৷
‘‘সর্বে চ পশবঃ সন্তি তলবদ্ ভূতলে নরাঃ৷
তেষাং জ্ঞান প্রকাশায় বীরভাবঃ প্রকাশিতঃ
বীরভাবং সদা প্রাপ্য ক্রমেণ দেবতা ভবেৎ৷৷’’
বিশ্বক্ষ্রহ্মাণ্ডে মূলসত্তা একটিই,, তা হচ্ছে চিতিশক্তি৷ এই চিতিশক্তি চৈতন্যসত্তা আবার শক্তিসত্তাও বটে– এইভাবে চিতিশক্তি দুইয়েরই কাজ করে৷ এইজন্যেই একে চিতিশক্তি বলা হয়৷ বস্তু নয় কিন্তু বস্তুকে যে রূপ প্রদান করে তাই শক্তি বা প্রকৃতি৷ এই প্রকৃতিই বস্তুতে রূপ প্রদান করে প্রকারভেদ সৃষ্টি করে৷
বলা হয়েছে, পরমাত্মার কৃপা হলে ‘মূকং করোতি বাচালং পঙ্গুং লঙঘয়তে গিরিম্’৷ অর্থাৎ যে মূক–বোবা সেও বাচাল হয়ে যায়, খুব কথা বলতে থাকে, আর পঙ্গুও পর্বত লঙঘন করতে পারে৷ পরমপুরুষের কৃপাতেই যে তা সম্ভব, এটা খুব সহজেই বোঝা যায়৷ কিন্তু আমি বলতে চাই– যে কোনো কাজই, মনে কর, মূক হয়তো বাচাল হচ্ছে না, কিন্তু কিছুটা কথা বলছে, পঙ্গু পর্বত লঙঘন করছে না, কিন্তু ধীরে ধীরে পাহাড়ে উঠছে– এটা কি মানুষ তার নিজের শক্তির সাহায্যে করে?
কখনও এই পরিস্থিতি আসতে পারে তুমি বিরাট শক্তিশালী সত্তার কাছে পৌঁছে গেছ, যাকে তুমি খুব ভয় পাও৷ এই যে শক্তিশালী সত্তা, তার শক্তি বা তার সাহস আসছে কোথা থেকে? সেও তোমার পিতার কাছে থেকেই আসছে৷ নিজের শক্তি বলে কারোর কিছু আছে কি? না, তা নেই৷ খাদ্য, হাওয়া, জল, মাটি ইত্যাদি দ্বারা পরমপিতা শক্তি প্রদান করেন৷ ধর, এক বিরাট শক্তিশালী পালোয়ান– সেটা কি তার নিজের শক্তি? না, তা নয়৷ সে শক্তি তোমার পরমপিতার৷ তাই তার থেকে তুমি ভয় কেন পাবে?
মানুষ যদি সব সময় এই কথাটা মনে রাখে যে, আমাকে যে যাই বলুক না কেন, যত গালিই দিক না কেন, লোকের চোখে আমি যত ছোট, যত মূর্খ, যত গরীবই হই না কেন, আমি তো পরমপুরুষের বিস্তারিত দেহের একটা টুকরো মাত্র, তখন তার মধ্যে আর কোন গ্লানিই থাকে না, থাকতে পারে না৷ মানুষ হ’ল অসম্পূর্ণ, পরমপুরুষ সম্পূর্ণ৷ তাই মানুষের মধ্যে ত্রুটি থাকবেই৷ সে যত পরমপুরুষের বিরাট ভাবের দিকে এগিয়ে যাবে ততই সে ত্রুটিমুক্ত হতে থাকবে, আর যখন সে সম্পূর্ণ ত্রুটিমুক্ত হবে, তখন দেখা যাবে, সে পরমপুরুষের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে, আর সে আলাদা নেই৷
গোপাল ঃ পরমপুরুষের একটি নাম হ’ল গোপাল৷ সংস্কৃতে ‘গো’ অর্থে কর্মেন্দ্রিয় ও জ্ঞানেন্দ্রিয় উভয়কেই বোঝায়, আর ‘পাল’ মানে যিনি পালন করেন৷
ধর, একটা মানুষ৷ এখন তার কেবল শরীরটাই রয়েছে, মন নেই আত্মা নেই কিংবা চিতিশক্তি বা ভূমাচৈতন্যও অবর্ত্তমান ৷ তাহলে সেই মানুষটা সমস্ত ইন্দ্রিয় থাকা সত্ত্বেও কাজ করতে পারবে না৷ গোপাল মানে হ’ল জীবাত্মা.....অণুচৈতন্য৷
গোবিন্দ ঃ সংস্কৃতে ‘গো’ মানে হ’ল কর্মেন্দ্রিয় ও জ্ঞানেন্দ্রিয় সমূহ৷ আর ‘বিন্দ’ মানে যিনি কোনো সত্তা বিশেষের বৈশিষ্ট্যকে স্ফূর্ত্তি ও প্রগতির ব্যাপারে সহায়তা করেন৷ তাই ‘গোবিন্দ’ মানেও দাঁড়াচ্ছে অণুচৈতন্য ৷
ভগবান শংকরাচার্য বলেছিলেন–
‘‘ত্যজ দুর্জনসংসর্গং ভজ সাধু সমাগমম্৷
কুরুপুণ্যম্ অহোরাত্রম্ স্মরনিত্যম্ অনিত্যতাম্৷৷’’
‘‘এক এব সুহৃদ্ধর্ম নিধনেহপ্যনুযাতি যঃ’’৷ ধর্মই তোমার একমাত্র সুহৃদ্ (এক ধরণের বন্ধু যা মৃত্যুর পরেও মানুষের সঙ্গে থেকে যায়)৷ সংস্কৃতে ‘বন্ধু’ শব্দের কয়েকটিই প্রতিশব্দ রয়েছে৷
‘‘অত্যাগসহনো বন্ধুঃ সদৈবানুমতঃ সুহৃদ্৷
একক্রিয়ং ভবেন্মিত্রং সমপ্রাণাঃ সখা স্মৃতঃ৷৷’’
‘‘অত্যাগসহনো বন্ধুঃ’’৷ যে বিচ্ছেদ–বেদনা সহ্য করতে পারে না সে–ই বন্ধু৷ যার সঙ্গে তোমার ভালবাসার সম্পর্ক এতই দৃঢ় যে তোমার বিচ্ছেদ তার কাছে অসহনীয় বলে মনে হচ্ছে তাকেই বলব বন্ধু৷ পারস্পরিক স্নেহ–ভালবাসার এই বন্ধন এতই দৃঢ় যে সে তোমার কাছ থেকে দূরে থাকতে পারে না–তোমার সঙ্গে বিচ্ছেদ সহ্য করতে পারে না৷
শাস্ত্রে বলা হয়েছে---
‘‘শ্রবণায়াপি বহুভির্র্যে ন লভ্যঃ শৃন্বন্তোহপি বহবো যং ন বিদূ্যঃ৷
আশ্চর্র্যে বক্তা কুশলোহস্য লব্ধা আশ্চর্র্যে জ্ঞাতা কুশলানুশিষ্টঃ৷’’
মানুষের সমাজে কত লোকেরই না বাস৷ তাদের মধ্যে মুষ্টিমেয় মানুষই অধ্যাত্মজ্ঞান অর্জনের সুযোগ পেয়ে থাকেন৷ আবার তাদের মধ্যে খুব কম শতাংশ মানুষই হাতে কলমে আধ্যাত্মিক শিক্ষালাভের সুযোগ পেয়ে থাকেন৷ এর মূল কারণটা কী? কারণ হ’ল সাধনা বিজ্ঞান জিনিসটাই দুলর্ভ, আবার প্রকৃত অধ্যাত্মজিজ্ঞাসুর সংখ্যা আরও দুর্লভ আবার প্রকৃত গুরুর সংখ্যা আরও বেশী দুর্লভ৷
বৃক্ষলতার কিছু বিশেষ গুণ আছে৷ যেমন, মাটির নীচে থেকে রস টেনে নেওয়া৷ মানুষ নিতে পারে না৷ জন্তু–জানোয়াররাও নিতে পারে না৷ কিন্তু বৃক্ষলতারা মাটির থেকে রস টেনে নিতে পারে৷ বাতাস থেকেও এরা কিছু খাদ্য নেয়৷ যদিও জীবজন্তু, মানুষও কিছুটা তা করে, কিন্তু উদ্ভিদের মত অতটা নয়৷ একে আমরা বলতে পারি উদ্ভিদ–ধর্ম৷ বৃক্ষলতা পায়ের সাহায্যে খাদ্যগ্রহণ করে৷ তোমরা জান কি না?
জগতে যেসব বস্ তুকে আমরা নিত্য বলে মানি তাদের নিত্যতাপ্রদানকারীও পরমপুরুষ৷ বস্ তু হ’ল প্রতিফলিত সত্তা–রিফ্লেক্টেড এণ্ঢিটি৷ চেতন বস্ তুর মনঃশক্তিও তাঁর থেকেই এসেছে৷ তিনি সকলের প্রয়োজনের পূর্তি ঘটান–পিঁপড়ে থেকে হাতী পর্যন্ত, ছোট ছোট জীব থেকে সমুদ্রের বড় বড় জানোয়ার পর্যন্ত সকলের৷ এতই উদার তিনি৷ সেইজন্যেই তিনি জগতের কর্তা, অধিকর্তা, প্রভু৷ এই রকম উদারতা লাভ করতে পারলে তুমিও তিনি হয়ে যাবে৷
মানুষের করণীয় কী? জীবন একটা ব্রত৷ আমি বলেছি মানুষের জীবন একটা আদর্শের ধারাপ্রবাহ বিশেষ৷ অর্থাৎ মানব জীবন একটা ব্রত–জীবন মানেই ব্রত অস্তিত্ব মানেই ব্রত৷ ‘‘আত্মমোক্ষার্থং জগদ্ধিতায় চ’’–মানুষ যা–ই করুক না কেন, তা করা উচিত আত্মমোক্ষের জন্যে–তার নিজের মোক্ষের জন্যে, আর করা উচিত সমগ্র বিশ্বের উন্নতির জন্যে৷ মানুষের এই দু’টো কাজ করতে হবে অর্থাৎ মানুষের ব্রত হচ্ছে এই দু’টো কাজ৷
শাস্ত্রীয় নির্র্দেশ অনুযায়ী মানুষের উন্নতির জন্যে তিনটি তত্ত্ব আবশ্যক৷ তিনটি তত্ত্ব কী?–না, শ্রবণ, মনন ও নিদিধ্যাসন৷ প্রথমে দেখা যাক্–শাস্ত্র বলতে কী ক্ষোঝায়?
গীতায় বলা হয়েছে–
‘‘যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত৷
অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্৷৷
পরিত্রাণায় সাধূনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম্৷
ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে৷৷’’
মানসপট আর মনের ময়লা
নির্গুণ ব্রহ্মের কোনো রূপ নেই৷ তিনি নিরাকার৷ এই ব্রহ্মই সগুণ ব্রহ্মরূপে (যা নির্গুণ ব্রহ্মের কার্যান্বিত রূপ), প্রকৃতির সহায়তায় ব্রহ্মভাবের জন্ম দেন, সেই সগুণ ব্রহ্ম প্রতিটি ধূলিকণায় ব্যাপ্ত আছেন৷ আমার মানসপটের ওপর ব্রহ্মের প্রতিচ্ছায়া পড়ছে, আর এই প্রতিচ্ছায়া কিরকম ভালভাবে পড়বে তা নির্ভর করে আমারই সংস্কারের ওপর৷ মানসপট যত মলযুক্ত হবে, তার ওপর ততখানিই খারাপ প্রতিফলন পড়বে৷ সাধনার দ্বারা আমরা মনের এই ময়লাকে পরিষ্কার করি৷
মানুষের সবচেয়ে বড় শত্রু কে? কেউ বলে ভয়, কেউ বলে হীনমন্যতা৷ সূক্ষ্মভাবে যদি দেখা যায় তাহলে ৰোঝা যাবে যে হীনমন্যতার জন্ম ভয় থেকেই৷
ভয় দু’প্রকারের– যা বাহ্যবস্তু থেকে আসে(external source) যার উদ্ভব আমাদের অন্তস্তলে(internal source)৷ একটি শরীরের ভয়, অন্যটি মনের ভয়৷ ধর, এক বড় পশু এসে গেল৷ সেটি ‘হালুম’ বলে তোমাকে খেতে চায়৷ স্বভাবতঃই তুমি ওখান থেকে পালিয়ে যাবে৷ এই শারীরিক ভয়ের পিছনে আছে আত্মরক্ষার চেষ্টা আর তা কোনো ব্যাধি নয়৷ এটা স্বাভাবিক ব্যাপার, আর মানুষ নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী এইসব পরিস্থিতিতে সামঞ্জস্য স্থাপন করে নেয়৷
প্রাচীনকাল থেকেই লোকে বলে আসছে যে পরমপুরুষকে পাবার তিনটে পথ–জ্ঞান, কর্ম ও ভক্তি৷ তারা বলে, জ্ঞানের মাধ্যমে মানুষ ৰুঝে নেয় পরমাত্মা কী, মানুষ কী ও পরমাত্মাকে পাওয়ার মানে কী৷ এখন বিচার করতে হবে, জ্ঞান দিয়ে মানুষ কী ভাবে ৰুঝবে পরমাত্মা কী৷ মানুষের জ্ঞান–ৰুদ্ধির দৌড় আর কতদূর৷ মানুষের ব্রেন তো খুবই ছোট আর সেই ব্রেনও সে পেয়েছে পরমপুরুষের কাছ থেকেই,পরমাত্মার কাছ থেকেই৷ সেই ব্রেন দিয়ে সে কীভাবে পরমপুরুষকে পরিমাপ করবে সে কীভাবে ৰুঝবে পরমপুরুষ কেমন তাই লোকেরা যে বলে, মানুষ জ্ঞানের দ্বারা ৰুঝবে পরমপুরুষ কী, পরমাত্মা কী– একথা কতদূর সত্যি?
শাস্ত্রে বলা হয়েছে, ‘প্রণিপাতেন পরিপ্রশ্ণেন সেবয়া’–মানুষ প্রণিপাত, পরিপ্রশ্ণ ও সেবা–এই তিনের সহায়তায় অর্থাৎ এই তিনের সমন্বয়ে পরমপুরুষের কাছে পৌঁছতে পারে৷ সাধক জীবনে সেবা তাই অনিবার্য৷ সেবার ভাবনা না থাকলে, দরজা বন্ধ করে বিশ ঘণ্ঢা সাধনা করলেও কোনো উন্নতি হবে না কারণ পরমপুরুষের আসন তোমার হৃদয়েও আছে, আবার বাইরেও আছে৷ তুমি ভিতরের আসনকে উজ্জ্বল করতে চাইবে, সেখানে দীপ জ্বালাবে আর বাইরের আসনকে অন্ধকারে রেখে দেবে, এতে কাজ হবে না৷ দীপ ভিতরেও জ্বালাতে হবে, বাইরেও জ্বালাতে হবে৷
এখন ভারতবর্ষ ও আধ্যাত্মিকতা সম্পর্কে কিছু আলোচনা করা যাক৷ এই দেশের নাম ভারতবর্ষ৷ জানতো, পৃথিবীতে যা কিছু শব্দ আছে সবই অর্থপূর্ণ৷ গ্রামের নামই হোক বা নদীর নাম, সবেরই একটা অর্থ আছে৷ এ দেশের নাম ভারতবর্ষ কেন রাখা হ’ল? প্রাচীনকালে এখানকার বাসিন্দা ছিল দ্রাবিড়, অষ্ট্রিক ও মঙ্গোলিয়ন৷ আর্যরা যখন এল তখন তারা এর নামকরণ করলে ‘ভারতবর্ষ’৷ এমন নাম কেন করা হ’ল?
সৃষ্টির প্রারম্ভের আগের কথা৷ সে সময় দেশ–কাল–পাত্রের মত সাপেক্ষ সত্তা ছিল না৷ একমাত্র ছিল অখণ্ড অসীম, ক্ষৃহৎ, সর্বব্যাপী সত্তা, আর সেই সত্তার সাক্ষিত্বরূপে ছিলেন পরমপুরুষ৷ সেই অখণ্ড সৃষ্টির রচয়িতা পরমপুরুষ নিজেকেই অনেক রূপে নানাপ্রকারে অভিব্যক্ত করলেন৷
‘‘ত্বং স্ত্রী ত্বং পুমানসি, ত্বং কুমার উত বা কুমারী৷
ত্বং জীর্নোদণ্ডেন বঞ্চয়সি ত্বং জাতো ভবসি বিশ্বতোমুখঃ৷’’
‘‘নীলঃ পতংগো হরিতো লোহিতাক্ষ
স্তত্তিদ্গর্ভ ঋতবঃ সমুদ্রাঃ৷
অনদিমত্বং বিভুত্বেণ বর্ত্তসে
যতোজাতানি ভুবনানি বিশ্ব৷৷’’
একটা গল্প আছে যে এক জ্ঞানী আর এক ভক্ত আমবাগানে গেল৷ জ্ঞানী পর্যবেক্ষণ করা শুরু করল–এগুলি ল্যাংড়া আম, না হিমসাগর, না অন্য কোনো প্রজাতির আম৷ পৃথিবীতে প্রায় পনেরশো প্রজাতির আম আছে৷ জ্ঞানী দেখতে শুরু করল যে বাগানে আরও কত রকমের আম গাছ আছে৷ এই বিশ্লেষণ অনেকক্ষণ পর্যন্ত চলতে চলতে শেষ পর্যন্ত সূর্যাস্ত হ’ল আর আমের বাগানে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো৷ তখন জ্ঞানী তাড়াতাড়ি আবার কোন্ গাছে কত পাতা আছে, কত শাখা–প্রশাখা আছে, তা গুনতে শুরু করল৷ রাত বাড়তে থাকল৷ কিন্তু এর মধ্যে ভক্ত কী করল?
‘‘যাবন্নক্ষীয়তে কর্ম শুভঞ্চাশুভমেবচ,
তাবন্নজায়তে মোক্ষো ণৃণাং কল্পশতৈরপি৷
যথা লৌহময়ৈঃ পাশৈঃ পাশৈঃ স্বর্ণময়ৈরপি,
তথা ৰদ্ধো ভবেজ্জীবো কর্মাভিশ্চ শুভাশুভৈঃ৷৷’’
(তন্ত্র)
‘আত্মমোক্ষার্থং জগদ্ধিতায় চ’, এটি একজন সাধকের জীবনের আদর্শ হওয়া উচিত৷ মানুষের কাজ করা উচিত, আর কাজ করার সময়ে মনে রাখা দরকার, সে যা কিছুই করছে তা আত্মমোক্ষের জন্যে৷
মানব জীবনের লক্ষ্য কী? ঘাত–প্রতিঘাতের মাধ্যমে এগিয়ে চলতে হবে৷ সঞ্চরধারায় যে বিশুদ্ধ আত্মিক ভাব থেকে পঞ্চভূতাত্মক জড়জগতের উৎপত্তি বা প্রপঞ্চের সৃষ্টি হয়েছিল, প্রতিসঞ্চর ধারায় ওই প্রপঞ্চকে পুনরায় আত্মধাতুতে– মূলাধাতুতে রূপান্তরিত করতে হবে৷ এটাই মানবজীবনের লক্ষ্য, যেখান থেকে এসেছিল সেখানেই পঁৌছে যাওয়া৷ চক্রের আবর্তন পূর্ণ করা৷ এটাই মানবজীবনের লক্ষ্য৷ পশুজীবনের লক্ষ্য জড়তার উপাসনা করা৷ মানবজীবনের লক্ষ্য কেন্দ্রে (নিউক্লিয়াসে) পঁৌছে যাওয়া৷ এছাড়া মানবজীবনের দ্বিতীয় কোনো লক্ষ্য থাকতে পারে না৷ মানব জীবনের একমাত্র লক্ষ্য আধ্যাত্মিক সাধনা করা, অন্য কোনো সাধনা নয়৷
দুধের মধ্যে যে রকম ঘি ব্যাপ্ত হয়ে থাকে আর মন্থন করলে সেটা ওপরে উঠে আসে, ঠিক সেই রকম তোমার মধ্যে পরমপুরুষ ব্যাপ্ত আছেন সাধনারূপী মন্থনের দ্বারা তুমি তাঁকে পেয়ে যাবে৷ মন্থন করলে যে মাখন বেরিয়ে আসে, সেটাই পরমপুরুষ৷ তিনি তোমার ভিতরে আছেন ঘরের মধ্যে কোনো দেবতাকে তুমি বাহ্যিক পূজা করে, বহিরঙ্গিক সাধনার দ্বারা তাঁকে পাবে না৷ বরং সেটার দ্বারা তুমি তাঁর থেকে আরো দূরে সরে যাবে৷
মানুষের এই শরীরটা তৈরী হয়েছে অগণিত ছোট ছোট জীবকোষ দিয়ে৷ এরা দুই ধরনের–(১) এককোষী (Protozoic cells) ও (২) বহুকোষী (Metazoic cells)৷ শরীরের প্রতিটি অঙ্গ–প্রত্যঙ্গ এই প্রকার অসংখ্য জীবকোষ দিয়ে তৈরী৷ এক হিসেবে দেখতে গেলে মানুষের পুরা দৈহিক কাঠামোটাই একটা বড় রকমের বহুকোষী জীব ছাড়া কিছু নয়৷ প্রতিটি কোষের নিজস্ব মন, আত্মা সব কিছুই রয়েছে৷ তবে জীবকোষের মন মানুষের মনের থেকে ভিন্ন৷ এককোষী জীবের চেয়ে বহুকোষী জীবের মন অধিকতর বিকশিত৷ মানুষের মনটা হ’ল অণুমানস তথা অণুদেহের সমস্ত মানসশক্তির সমষ্টি৷ কাজেই মানবমন হ’ল একটা সামূহিক মন৷ ভূমামন যেমন ব্রহ্মাণ্ডের প্রতিটি সত্তার সঙ্গে ওতঃপ্রোত ভাবে জড়িত আছেন, অণুমা
আমাদের শরীরে আটটি চক্র আছে৷ মূলাধার, স্বাধিষ্ঠান, মণিপুর, অনাহত ও বিশুদ্ধ– এই পাঁচ চক্র আর এর ওপর আজ্ঞাচক্র, গুরুচক্র ও সহস্রারচক্র*৷ এই হ’ল অষ্টকমল৷ পরমাত্মার লীলা এই অষ্টকমলকে নিয়ে৷
সাধনায় যখন মানুষ এগিয়ে যায় তখন কী হয়?
‘‘সর্বতঃ পাণিপাদং
তৎ সর্বতোক্ষিশিরোমুখম্৷
সর্বতঃ শ্রুতিমল্লোঁকে সর্বসাবৃত্য তিষ্ঠতি৷৷’’
এই অষ্টকমল যখন ফোটে, তা কেমন করে ফোটে? মানুষ যখন মনের সমস্ত ভাবনা নিয়ে পরমপুরুষেরই উপাসনা করে তখন সমস্ত ভাবনা, সমস্ত আকুতি একের দিকেই ছুটে যায়৷
এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে কেবল পরমপুরুষই চরম সত্য–একমাত্র সত্য, একমাত্র অপরিণামী সত্তা, আর তাঁর সৃষ্ট বাকি সব কিছুই পরিণামী সত্তা অর্থাৎ তারা নিয়ত পরিবর্ত্তিত হয়ে চলেছে৷ তাই সেগুলোকে বলতে পারি আপেক্ষিক সত্য, চরম সত্য নয়৷ চরম সত্য হ’ল একমাত্র পরমপুরুষ৷ চরম সত্য সর্বদাই এক, তা কখনও দুই হতে পারে না৷
এই চরম সত্যের যে চক্রনাভি–তাতে কোন পরিবর্ত্তন নেই৷ কোন গতি নেই৷ আবার চরম অগতিও নেই, আপেক্ষিক স্থিতিশীলতাও নেই৷ অবশ্য এই চক্রনাভির বাইরে রয়েছে গতিশীলতা কিন্তু সেখানে অন্য কোনও দ্বিতীয় সত্তা সেই৷
প্রাচীন সংস্কৃত শব্দভাণ্ডারে বছরে ছ’টা ঋতুর উল্লেখ আছে৷ গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসন্ত৷ কিন্তু ভারতের অনেক স্থানে, বিশেষ করে সমুদ্রের তটবর্তী এলাকায় তথা পূর্ব ভারতে মূলতঃ চারটে ঋতু৷ সেগুলি হচ্ছে গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ ও শীত৷ ৰাঙলায় শীত ঋতু শেষ হতে না হতেই গরম শুরু হয়ে যায়৷ তাই বসন্ত ঋতু এখানে পনেরো দিনের জন্যেও স্থায়ী হয় না, আর হেমন্ত তো শীতেরই অঙ্গ৷
কিছুদিন আগে ‘মানসাধ্যাত্মিক সাধনার স্তরবিন্যাস’ পুস্তকে বলা হয়েছে যে মানুষের অগ্রগতির চারটে স্তর রয়েছে–যতমান, ব্যতিরেক, একেন্দ্রিয় ও বশীকার৷ এই চারটে স্তরের ভেতর দিয়ে মানুষকে এগিয়ে চলতে হয়৷ এ সম্বন্ধে যা বক্তব্য তা ওই বইয়ে স্পষ্ট ভাষায় লিখে দিয়েছি৷ এখন, মানুষের জীবনটা কী রকম কোথা থেকে তার শুরু, কোথায় বা তার শেষ?
‘সৎ’ কী ও ‘অসৎ’ কী– এ সম্পর্কে যে বিচারবোধ তাকে সদাসৎ বিবেক বলে, যা ‘সৎ’–কে ‘অসৎ’ থেকে ও ‘অসৎ’–কে ‘সৎ’ থেকে পৃথক করে দেয়৷ ‘সৎ’ কী? লৌকিক ভাষায় ‘সৎ’ মানে ভালো– সৎ ব্যষ্টি, সজ্জন ব্যষ্টি৷ আর আধ্যাত্মিক অর্থে ‘সৎ’ মানে অপরিণামী সত্তা– যাতে কোনো পরিবর্তন হয় না৷ আর ‘অসৎ’ মানে যা পরিণামী, যার অবস্থান্তর ঘটে৷ ‘সৎ’ বস্তু একই, বাদবাকী সব অসৎ৷ ‘অসৎ’ মানে খারাপ নয়, পরিবর্তনশীল৷
প্রত্যেক বস্তুর নিজের নিজের ধর্ম আছে, নিজস্ব স্বাভাবিক লক্ষণ আছে৷ সেই লক্ষণ দেখেই মানুষ সংশ্লিষ্ট বস্তুর সঙ্গে পরিচিত হয়, তার নামকরণ করে৷ প্রত্যেক সত্তার, প্রত্যেক জীবের নিজের নিজের ধর্মে অটুট থাকা শ্রেয়স্ক্র৷
সোণা ও লোহার নিজেদের পৃথক পৃথক ধর্ম আছে৷ ঠিক তেমনি মানুষেরও নিজের ধর্ম আছে৷ মানুষ যদি নিজের ধর্ম থেকে, মানব ধর্ম থেকে দূরে সরে যায় তবে তাকে মানুষ বলব না৷ মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব তার নিজের ধর্মেই নিহিত৷ তাই তার পবে স্বধর্মে সুদৃঢ় থাকাই বাঞ্ছনীয়৷
কিছু দিন আগে বা৷ালোরে সাধকদের সামনে পাপ ও পুণ্য সম্পর্কে কিছু বলেছিলুম কিন্তু এখানে একটি ছেলে আমাকে অনুরোধ করেছে সে সম্পর্কে আরও কিছু বলবার জন্যে৷ তাই আমি তার ‘আদেশ’ প্রতিপালন করছি মাত্র৷ বলা হয়েছে,
‘‘ত্যজ দুর্জনসংসর্গং ভজ সাধুসমাগমম্
কুরুপুণ্যমহোরাত্রং স্মর নিত্যমনিত্যতাম্“
আত্মজ্ঞানই হ’ল মুক্তির লক্ষণ, আর এই আত্মজ্ঞান মানুষ তখনই পায় যখন সে নিজ সুকর্মের ফলে মানুষের শরীর লাভ করে৷ মানবদেহ লাভ করলে তবে আত্মজ্ঞান হয়৷ দেখ, পশুজীবন ও মানবজীবন এই দু’য়ের মধ্যে মুখ্য পার্থক্য কী? দুই–ই পরমাত্মার সন্তান৷ একটি কুকুর, একটি বিড়াল আর একজন মানুষ–সবই পরমাত্মার সন্তান৷ কিন্তু দু’য়ের মধ্যে পার্থক্যটা এই যে, মানুষের ৰুদ্ধি উন্নত৷ মানুষ ৰোঝে যে শ্রেয় ও প্রেয়ের মধ্যে পার্থক্য কোথায়?
...বৈবহারিক ক্ষেত্রে কোন জিনিস কতটা সার্থক সেটা বিচার করে মন৷ পরিবর্তনশীল পরিবেশের সঙ্গে কোন ব্যবস্থাপত্র কতখানি মানিয়ে চলতে পারে সে বিচারও করে মন৷ খেয়ে পরে শান্তিতে থাকা–এগুলোও করা হয় মানসিক তৃপ্তির জন্যে৷ আর সব চাইতে বড় কথা, যে কোন মতবাদ সম্বন্ধেই বলা হোক না কেন, সমর্থনশাস্ত্র মননশীলতার ওপরই নির্ভরশীল৷ মানসিক ব্যাধি বা আধ্যাত্মিক ব্যাধিমাত্রই মায়াবাদ নয়৷ মাটির পৃথিবীর সঙ্গে, মানুষের মনের সঙ্গে যোগসূত্র রেখেও আধ্যাত্ম দর্শন প্রতিষ্ঠিত হতে পারে৷ আনন্দমার্গ তেমনি একটা দর্শন৷
.....আমাদের এই শ্রাবণী পূর্ণিমা–অনেকেই জান, এটা জানা জিনিস আমি তখন খুৰই ছোট্ট৷ তখন বিদ্যাসাগর কলেজে পড়ি৷ একদিন সন্ধ্যায় একটা ঘটনা ঘটল৷ একজন লোক–সে লোকটি দুষ্ট প্রকৃতির ছিল৷ আমরা এই কথাটা ব্যবহার করছি এই জন্যে যে আজ যে মানুষটা দুষ্ট, কাল সে সাধু হতে পারে৷ আজ যে মূর্খ কাল সে জ্ঞানী হতে পারে–এ সৰকিছু আপেক্ষিক জগতের আপেক্ষিকতার দ্বারা অভিষিক্ত৷ তাই এর কোন শাশ্বত রূপ নেই৷ কোন মানুষকে স্থায়ীভাবে দুষ্ট ৰলা চলে না৷ সৰ সময় মনে রাখতে হক্ষে যে আমি এই দুষ্টের ভেতরে যে ভাল জিনিসগুলো নিহিত রয়েছে সেইগুলোকেই জাগিয়ে দিয়ে, ৰাড়িয়ে দিয়ে একে ভাল করে তুলৰো৷ ভাল মানে কী?–না, সংসৃক্ত ‘ভদ্র’ শব্দ থেকে ‘ভাল’ শব্দটা
বলা হয়েছে, পরমাত্মার কৃপা হলে ‘মূকং করোতি বাচালং পঙ্গুং লঙঘয়তে গিরিম্’৷ অর্থাৎ যে মূক–বোবা সেও বাচাল হয়ে যায়, খুব কথা বলতে থাকে, আর পঙ্গুও পর্বত লঙঘন করতে পারে৷ পরমপুরুষের কৃপাতেই যে তা সম্ভব, এটা খুব সহজেই ক্ষোঝা যায়৷ কিন্তু আমি বলতে চাই– যে কোনো কাজই, মনে কর, মূক হয়তো বাচাল হচ্ছে না, কিন্তু কিছুটা কথা বলছে, পঙ্গু পর্বত লঙঘন করছে না, কিন্তু ধীরে ধীরে পাহাড়ে উঠছে– এটা কি মানুষ তার নিজের শক্তির সাহায্যে করে?
অনেকদিন পর্যন্ত সমাজ–সেবার কাজে লিপ্ত থাকার পর যখন প্রকৃত মানুষ তৈরী করার কথা ভাবা হ’ল তখন ১৯৫৫ সালের ৯ জানুয়ারী আনন্দমার্গের প্রতিষ্ঠা হয়ে গেল৷ প্রকৃতপক্ষে এর কিছু পূর্বেই আনন্দমার্গের কাজের সূত্রপাত হয়ে গিয়েছিল কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে যেটা হ’
আজ প্রশ্ণোত্তরের মাধ্যমে কিছু আলোচনা করব৷ অনেক সময় এমনি আলোচনার পরিবর্তে প্রশ্ণোত্তরের মাধ্যমে আলোচনা ভাল হয়৷
সংসৃক্তে একটা সূক্ত আছে৷ ঋক্বেদের শ্লোকগুলোকে শ্লোক না বলে বলা হয় ‘সূক্ত’৷ ‘সু’+ ‘উক্ত’= সূক্ত৷ ‘সু’ অর্থাৎ সুন্দর ভাবে, ‘বচ’ ধাতুর উত্তর ‘ক্ত’ প্রত্যয় যোগে নিষ্পন্ন হয় ‘উক্ত’ অর্থাৎ যা বলা হয়েছে৷ এমনি একটা সূক্ত হ’ল ঃ
‘‘অসতো মা সদ্গময়ো তমসো মা জ্যোতির্গময়ো
মৃত্যোর্মা অমৃতংগময়ো আবিরাবিঃ ময়ৈধি৷৷
রুদ্র যত্তে দক্ষিণং মুখম্ তেন মাং পাহি নিতাম্৷৷’’
‘‘যচ্ছেদ্ বাঙ্মনসী প্রাজ্ঞস্তদ্
যচ্ছেদ্জ্ঞান আত্মনি৷
জ্ঞানমাত্মনি মহতি নিযচ্ছেৎ
তদ্ যচ্ছেচ্ছান্ত আত্মনি৷৷’’
বুদ্ধির মান অনুযায়ী জীবকে তিনটি শ্রেণীতে ভাগ করা যেতে পারে–পশু, মানব আর দেবতা৷ আমাদের মানব সমাজেও আমরা পাই মানবীয় আধারে পশু, মানবীয় আধারে মানব আর মানবীয় আধারে দেবতা৷
আমি অবশ্যই বর্তমান কালকে অস্বীকার বা অবহেলা করতে পারি না৷ এর অর্থ আমাকে অবশ্যই মনে রাখতে হবে আমি কোথায় আছি আর ঠিক বর্তমানে আমাকে কী করতে হবে৷ কিন্তু বর্তমান কাকে বলব? আমরা জানি বর্তমান, অতীত আর ভবিষ্যতকে নিয়ে কাল তিনটি৷ এই তিন ধরনের কাল আসলে কী? বস্তুতঃ বর্তমান কাল বলে ঠিক কোন কিছু নেই৷ আমি যখন কিছু বলি, তুমি ততক্ষণাৎ তা শুণতে পাও না৷ কিছুটা বিরতির পরে তুমি সেটা শুণতে পাও৷ তাহলে সেই বিরতিটা কী? শব্দ বায়ুর দ্বারা বাহিত হয়ে কাণে পঁৌছতে যে সময় লাগে সেটাই বিরতি৷ আর যখন তা তুমি শোণ সেটা আমার কাছে কিন্তু অতীত, আর তোমার কাছে তা ভবিষ্যৎ কেননা অল্পক্ষণ পরে তুমি তা শুণতে পাচ্ছ৷ তাহলে কী করা উচিত?
ভক্তের সম্পর্কে
গড়পড়তা বৌদ্ধিক মাপের একজন মানুষের কাছে জল ও বরফ দু’টি পৃথক সত্তা কিন্তু যারা সত্য সম্পর্কে অল্পকিছু জানে তারা বোঝে জলের ঘনীভূত রূপই বরফ৷ একইভাবে সাধারণ মানের মানুষ যখন একটা পাত্র ও কুম্ভকারের (যে পাত্রটি তৈরী করেছে) মধ্যে একটা বিরাট পার্থক্য দেখে
ধর্ম বৈবহারিক, সৈদ্ধান্তিক নয়৷ কে ধার্মিক, কে ধার্মিক নয়–
পরমপুরুষের গুণ বর্ণন করা সম্ভব নয়৷ তবুও মানুষ আত্মতৃপ্তির জন্যে কিছু বলার, কিছু বর্ণনা করার চেষ্টা করে থাকে৷ বলা হয়েছে ––
‘‘প্রভুমীশমনীশমশেষ্ গুণহীনমহেশ গণাভরণম্৷’’
পরমপুরুষের গুণের আর শেষ নেই৷ আর মানুষের ক্ষুদ্র মন, ক্ষুদ্র কণ্ঠ সেই অশেষ গুণের বর্ণনা করবে কী করে? কবি পদ্মদন্ত পরমপুরুষের গুণের বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন ––
‘‘অসিতগিরিসমং স্যাৎ কজ্জ্বলং সিন্ধুপাত্রে
সুরতরুবরশাখা লেখনীপত্র মুর্বী৷
লিখতি যদি গৃহীত্বা সারদা সর্বকালং
তথাপি তব গুণানামীশ পারং ন যাতি৷৷’’
সংস্কৃত ‘নার
জ্ঞান সাধনা
প্রত্যেক বস্তুর মধ্যে পরমাত্মাকে দর্শন করার মানুষের যে প্রয়াস সেটা তার জ্ঞানসাধনা তাহলে জ্ঞানসাধনার সিদ্ধি কী? সকল বস্তুকে পরমাত্মা–রূপে দেখা৷ যদি কেউ তা করতে পারে তাহলে জ্ঞানসাধনায় সিদ্ধিলাভ হ’ল কি না বা তার ফল কী হ’ল, তা ক্ষোঝবার জন্যে কাউকে জিজ্ঞাসা করারও প্রয়োজন পড়বে না৷ যখন সবকিছুর মধ্যে পরমাত্মার স্বরূপ দেখবে তখন নিজেই ক্ষুঝে নেবে যে জ্ঞানসাধনায় সিদ্ধিলাভ হয়ে গেছে৷
আত্মস্থীকরণ
শাস্ত্রীয় নির্দেশ অনুযায়ী মানুষের উন্নতির জন্যে তিনটি তত্ত্ব আবশ্যক৷ তিনটি তত্ত্ব কী?–না, শ্রবণ, মনন ও নিদিধ্যাসন৷ প্রথমে দেখা যাক্–শাস্ত্র বলতে কী বোঝায়
মানসপট আর মনের ময়লা
যারা অনন্যমনসা–অনন্যভাক্ হয়ে পরমপুরুষের ভজনা করে, জাগতিক অন্যান্য চিন্তা–ভাবনাকে পরিত্যাগ করে মানসচিন্তায় সুকোমল মসৃণতা নিয়ে কেবল পরমপুরুষের দিকেই এগিয়ে যায় তারা গোপী৷ এই রকম ধরণের গোপীদের ছবি আঁকা যায় না৷ কারণ গোপীর গোপীত্ব তার অন্তরের সুকোমল ভাবরাজি, তার অন্তরের অন্তঃস্থলে নিহিত৷ এটা একেবারে ভেতরের জিনিস–মনের জিনিস৷ এই ধরণের ভক্তি ভাবসমন্বিত গোপীদের ভাষাও ব্যক্ত করা যায় না৷
সূক্ষ্ম নন্দনতত্ত্বের ওপর আধারিত নান্দনিক অভীপ্সা যখন একটা নির্দিষ্ট উচ্চ মানে পৌঁছে যায় তাকে বলে মিষ্টিসিজম্৷ আর এই মিষ্টিসিজম্ যখন মানবীয় গরিমা মহিমার শীর্ষে বা শ্রেষ্ঠত্বের পর্যায়ে চলে আসে তাকে বলে আধ্যাত্মিকতা ব্দহ্মন্ব্জন্ব্ধব্ভ্ত্রপ্৷ এখন মিষ্টিসিজম্ কী মিষ্টিসিজম্ হ’ল সীমার সঙ্গে অসীমের, ক্ষুদ্র ‘আমি’র সঙ্গে ক্ষৃহৎ ‘আমি’র বা আত্মার সঙ্গে পরমাত্মার সম্পর্ক নির্ণয়ের এক নিরন্তর প্রয়াস৷
বিশ্বক্ষ্রহ্মাণ্ডে মূলসত্তা একটিই, তা হচ্ছে চিতিশক্তি৷ এই চিতিশক্তি চৈতন্যসত্তা আবার শক্তিসত্তাও বটে– এইভাবে চিতিশক্তি দুইয়েরই কাজ করে৷ এইজন্যেই একে চিতিশক্তি বলা হয়৷ বস্তু নয় কিন্তু বস্তুকে যে রূপ প্রদান করে তাই শক্তি বা প্রকৃতি৷ এই প্রকৃতিই বস্তুতে রূপ প্রদান করে প্রকারভেদ সৃষ্টি করে৷
মানুষের করণীয় কী?