আবার বাঙলা ভাগের ষড়যন্ত্র

লেখক
একর্ষি

পূর্বপ্রকাশিতের পর

এখন দেখা যাক ভূপৃষ্ঠে রাঢ়-বরেন্দ্র (সমগ্র পঞ্চগৌড়) কীভাবে এলো৷ এবার অতীতের পিছনে ফিরে তাকানো যাক---৷ ভূপৃষ্ঠে (পৃথিবীর প্রাকৃতিক মানচিত্রে) প্রায় ৬৫ কোটি বৎসর পূর্বের একটা ছবি নিরক্ষরেখার উত্তরে পূর্ব-পশ্চিম বরাবর প্রসারিত এক মহাসাগর, আর তার উত্তরে ও দক্ষিণে দুই স্থল ভাগ--- উত্তরে আঙ্গারা ও দক্ষিণে গণ্ডোয়ানাল্যাণ্ড মাঝে টেথিস মহাসাগর৷ কোটি কোটি বৎসর ধরে প্রাকৃতিক ক্ষয়কারী শক্তির প্রভাবে টেথিসের দু’পাশের পার্বত্য স্থলভাগ ক্ষয় পেয়ে পেয়ে উচ্চতা হারাতে লাগল৷ ক্ষয়প্রাপ্ত তরঙ্গায়িত গণ্ডোয়ানার পূর্বাঞ্চল পরিচয় পেল রাঢ় নামে৷ এও প্রায় ৩০ কোটি বছর আগের ঘটনা৷ এদিকে ক্ষয়ীভূত পদার্থগুলো টেথিসের তলদেশে জমতে লাগল কোটি কোটি বছর ধরে৷ তারপর এখন থেকে প্রায় ১০ কোটি বছরের আগের ঘটনা৷ গিরিভূমি রাঢ় (রাঢ় প্রাচীন অষ্ট্রিক ভাষার শব্দ যার মানে রক্তমৃত্তিকার দেশ) ততদিনে মানে  বহু কোটি কোটি বছর আগেই তৈরী হয়ে গিয়েছে, এটা  অবশ্য পশ্চিম রাঢ়৷ গিরিজনি প্রক্রিয়ায় (মহীখাত ও পাতসংস্থান তত্ত্ব অনুসারে) টেথিসের বুকচিরে উঠে এল পৃথিবীর উচ্চতম পর্বতমালা হিমালয়৷ হিমালয় থেকে নেমে এল গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র ও অন্যান্য নদ নদী, সঙ্গে বহন করতে থাকল নুড়ি-বালি-পলি, সঞ্চয় করতে থাকল হিমালয় ও গণ্ডোয়ান মধ্যবর্তী সাগরে৷ অবশ্য তার আগেই রাঢ়ের ওপর দিয়ে বয়ে আসা অনেক জলধারার বয়ে আনা বালি-পলিতে, (গণ্ডোয়ানার পূর্বে তথা পশ্চিম রাঢ়ের পূর্বে) গড়ে উঠেছে পূর্বরাঢ়৷ তার মানে ব্যাপারটা দাঁড়াল---লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি বছর পূর্বে পশ্চিম রাঢ়ের নদী বাহিত বালি পলি পশ্চিমরাঢ়ের পূর্বের সাগরের বুকে সঞ্চয় করে গড়ে তুলল পূর্বরাঢ়৷ আর পূর্বরাঢ়ের জন্মের বহু কোটি বছর পরে তৈরী হল হিমালয়৷ তার অনেক পরে হিমালয় থেকে বেরিয়ে এল গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র৷ তারও লক্ষ লক্ষ বছর পর এদের  বালি পলি তৈরী করল উত্তরভারত ও বিদেহ-বরেন্দ্রভূমি৷ তারপর রাঢ় থেকে উৎপন্ন  নদ-নদী ও হিমালয় থেকে বালি পলিতে সৃষ্টি হল সমতট৷ তারপর তৈরী হল বঙ্গ - ডবাক, পরে সৃষ্টি হল উপবঙ্গ বা শ্রীভূমি৷ অর্থাৎ বাঙালীস্তানের ভূ-পরিচয়ে  পশ্চিমরাঢ় সবচেয়ে প্রাচীন ভূখণ্ড---কমপক্ষে ৩০কোটি  বছরের প্রাচীন ভূভাগ৷ পূর্বরাঢ়ের বয়স ১০ কোটিরও বেশি, কেননা তা হিমালয় সৃষ্টির আগেই তৈরী হয়ে গেছে৷ সেই তুলনায় বরেন্দ্র অনেক নবীন৷

মাটির পৃথিবীতে মানুষের ভৌম পরিচয়টা (ভূপৃষ্ঠে ভৌগোলিক অবস্থানগত পরিবেশ পরিচয়) ও তার ইতিহাসটা জানা ও জানানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ৷ একটা নির্দিষ্ট দেশ-ভূমিতে তার জন্ম-কর্ম, ভাল-মন্দ, ভূত-ভবিষ্যৎ৷ তার  খাদ্য-পোষাক, বাসস্থান, দেহাভাসঘটন, রুচি মূল্যবোধ, ভাষা-সংস্কৃতি, সামাজিক মেলামিশা ও পারস্পরিক আদান-প্রদান ধর্মীয় চেতনা, সমাজনীতি- রাষ্ট্রনীতি- অর্থনীতি--- সবকিছুই হয় জন্মভূমির মধ্যে থেকে৷ আর ওই ভৌত সামাজিক পরিবেশে মনেরই সব কিছু দিকের বিকাশকে সঙ্গে নিয়ে তার এগিয়ে চলা (যা মননভাত সামবায়িক ভৌম সংকলন-সংস্কার মাত্র)৷ তাই দার্শনিক শ্রেষ্ঠ শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার বললেন--- ইতিহাস হল মনস্তাত্ত্বিক বিকাশের ধারা৷ আরও বললেন---‘‘নিজের নিজের শক্তিতে প্রত্যেকে এগিয়ে চলবে ও সামূহিক জীবনকে চরিতার্থ করবে -এটাই হল ইতিহাসের মূলমন্ত্র৷’’

প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ডঃ নীহারঞ্জন রায় বললেন--- মানুষের (বাঙালীর) ‘‘ইতিহাস বলিতে হইলে প্রথমেই বলিতে হয় নরতত্ত্ব (রেস্‌)  ও জনতত্ত্বের (এথনিসিটি) কথা  ও তাহারই সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি জড়িত ভাষাতত্ত্ব কথা৷’’

বাঙালীর ইতিহাসের দ্বিতীয় কথা, বাঙলার দেশ-পরিচয়৷ কাজের বাংলাদেশের সত্য ভৌগোলিক পরিচয় ও বাঙালীর ইতিহাসের কথা৷’’ আরও বললেন--- জাতি ও দেশ হইতেছে সমাজ-রচনার ঐতিহ্য ও পরিবেশ৷’’

দূর্র্ভগ্যের বিষয়, আজো বাঙালী তার প্রকৃত ইতিহাস বিষয়ে একরকম অন্ধকারে৷ এরই অনিবার্য ফলশ্রুতিতে শুধু  অতি সাধারণ বাঙালী-ই নয়, সেই সঙ্গে তথাকথিত প্রাগ্রসর অনেক বাঙালীই কেবল বিজ্ঞান মনস্কতার অভাবেই নয়--- প্রকৃত ইতিহাস চেতনাব, ইতিহাস ও ভৌগোলিক জ্ঞানের অভাবেও অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারে আচ্ছন্ন তাঁরা জাতিভেদ প্রথা, জাতিভেদ প্রথা উচ্চবংশ-নীচ বংশ (এ বংশ সূর্য বংশ বা চন্দ্র বংশ, বিষ্ণুর ঔরস জাত বংশ, ব্রহ্মার মুখজাত বংশ, অসুর বা দানব বংশ ইত্যাদি), বিষ্ণুর আর্য রক্ত---হীন অনার্য রক্তের উত্তর পুরুষ, ভ্রান্ত সম্প্রদায় ধারণায় দৃঢ় বিশ্বাস, শব্দার্থের অজ্ঞতায় নানা দেব দেবীর উদ্ভট ধারনা বা কল্পনা--- ইত্যাদি নানান ধরণের বিকৃত মানসিকতার শিকার৷ ইতিহাস ও ভূগোলের প্রকৃত জ্ঞান ও তার থেকে তৈরী হওয়া বাস্তব বুদ্ধি ও বিশেষ জ্ঞানে ভরা শিক্ষা মানুষকে অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার ও  ভ্রান্ত আবেগ থেকে মুক্তি  দিতে পারে, সঠিক দিশাও দেখাতে পারে৷ তা হলে মানুষ কখনো মিথ্যা প্ররোচনায় ও শোষকের পাতা ফাঁদে পা দেবে না, উপরন্তু সাম্রাজ্যবাদী-স্বার্থন্বেষী-ধান্দাবাজ- মতলববাজদের অপপ্রচারে অভিসন্ধি-শোষণের ছলাকলাও সহজেই ধরা পড়ে যাবে৷ তাইতো ইতিহাস ও ভূগোলের  চর্র্চ এত গুরুত্বপূর্ণ৷ তাই দার্শনিক শ্রেষ্ঠ শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার বললেন---যে শাস্ত্র মানুষের আধ্যাত্মিক চেতনা বাড়ায়, তার বৌদ্ধিক প্রাখর্য আনে, যা সাহিত্য,শিল্প,বিজ্ঞান, প্রযুক্তিবিদ্যা, সমাজবিদ্যা ইত্যাদি জনকল্যাণকর জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসার ঘটায় ও যা মানুষকে এক সুদৃঢ় ভূমিতে প্রতিষ্ঠিত করে তাই ইতিহাস পদবাচ্য৷ ‘‘ইতি হসতি ইত্যর্থে ইতিহাসঃ৷’’ অর্থাৎ সামুহিক জীবনের একটা উজ্জ্বল প্রতিচ্ছবি যা পাঠ করে মানুষ বিশেষ প্রেরণা পাবে৷’’ ‘ইতি হসতি’---অর্থ হচ্ছে ---গৌরবোজ্জ্বল মানব মহিমার জাজ্বল্যমান দৃষ্টান্ত৷ প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও সমাজতত্ত্ববিদ ড, আহমদ শরীফ বললেন---‘‘বাঙালীর সত্যকার ইতিহাস জানা ও জানানো দরকার৷ ---আমরা জানি, ঘটনার বিন্যাস ইতিহাস নয়, চেতনার অনুসরণ ও চিত্রনই ইতিহাস৷ কারণ মন ও মননই মানুষের সামান্যকৃত অভিব্যক্তি স্থানিক ও কালিক আবর্তন-বিবর্তন কিংবা অনবর্তনের ধারায় অনুধাবন ও বিশ্লেষণ৷’’ অথচ একশ্রেণীর মহামন্যী ইতিহাসের ছাত্র শিক্ষকদের দিকে তীক্ষ্ন ব্যঙ্গবাণ ছুড়ে দেয়---ওই যে সব ডেড্‌ সাবজেক্ট্‌-এর জ্যান্তমরা! এঁরা কী কিম্ভূত! নাকী অদ্ভূত! নাকী ভূতের ভূত! (ক্রমশঃ)