‘‘অগ্নিপথ’’ ভারতবর্ষকে অগ্ণিগর্ভ করে তুলবে না তো?

লেখক
সুকুমার সরকার

প্রকল্পের ঘোষণাতেই অনেকটা অগ্ণিগর্ভ হয়ে উঠেছে ভারতবর্ষ৷ মাত্র চার বছরের জন্য চাকরি৷ তারপর অনিশ্চিত ভবিষ্যত৷ অথচ এই চার বছর সেনার যাবতীয় ট্রেনিং ও অস্ত্র প্রশিক্ষণ সবই দেওয়া হবে৷ চার বছর পর সেনা থেকে অবসর৷ অবসরের সময় এককালীন কিছু অর্থ দেওয়া হবে৷ কোনো পেনশন নেই৷ সেনা থেকে অবসরের পর সরকারি ও বেসরকারি নিয়োগক্ষেত্রে অগ্রাধিকারের প্রতিশ্রুতি৷ তারপর আবার তরুণ-তরুণী নিয়োগ৷ যাঁদের বয়স ১৭-২১ বছরের মধ্যে হতে হবে৷ অর্থাৎ অগ্ণিপথ প্রকল্পে চাকরিপ্রাপ্ত অগ্ণিবীররা একুশ থেকে পঁচিশ বছরের মধ্যে আবার একটি অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মধ্যে পড়ে যাবেন৷ এই আশঙ্কাতেই অগ্ণিগর্ভ হয়ে উঠেছে ভারতবর্ষ৷ প্রকল্প চালু করতে পুঁজিবাদী সরকার দৃঢ় প্রতিজ্ঞ৷ আর সেই মতো সেনাবাহিনীর প্রধানদের দিয়ে বিবৃতিও দেওয়াচ্ছেন এই প্রকল্পের সুফল সম্পর্কে৷ তাঁদের বক্তব্য, চারবছর পরপর নতুন উদ্যোমি তরুণ-তরুণী সেনাবাহিনীতে যেমন আসবে, তেমনি অস্থায়ী ও কম বেতনের  এই ধরনের সেনাকর্মীদের থেকে যে অর্থ বাঁচবে তা দিয়ে সেনাসামগ্রী কিনে সেনাবাহিনীকে আধুনিক করা যাবে৷ যুক্তিটি যে অযৌক্তিক তা বোঝার জন্য বিশেষজ্ঞ হবার দরকার পড়ে না৷ আসলে কম পয়সায় বেশি সেনা নিয়োগ করাটা আসল উদ্দেশ্য৷ যেমন পশ্চিমবঙ্গের  সিভিক ভলেনটিয়ার৷ সামান্য আট দশ হাজার টাকা বেতন দিয়ে পুলিশের কাজ করানো হচ্ছে এঁদের দিয়ে৷ আর পশ্চিমবঙ্গে পুলিশ নিয়োগ প্রায় বাতিল৷ অস্থায়ী ও চুক্তিভিত্তিক নিয়োগই পুঁজিবাদীদের বেশি পছন্দ৷ তাতে অর্থও যেমন কম লাগে, ঝুকিও অনেক কম৷ রাজ্যে বা কেন্দ্রে এখন এই ধরনের নিয়োগই বেশি চলছে৷ কিন্তু পুলিশ বা সেনাবাহিনীতে এই ধরনের  নিয়োগ বোধহয় ঠিক নয়৷ প্রথমত দায়বদ্ধতা যেমন থাকবে না, তেমনি দেশাত্মবোধও আসবে না৷ মোদী সরকার যে অঙ্কে এই প্রকল্প চালু করতে মরিয়া, তা আপাত আর্থিক সুবিধা ও অল্প সময়ে বহু বেকারদের  চাকরির পথ পরিক্রমণ করানোর একটি বিষয় হয়তো আছে৷ আর একটি বিষয় থাকতে পারে, তা হলো সেনাবাহিনীতে নিয়োগের মধ্যে দিয়ে হিন্দু  জাতীয়তাবাদী দেশাত্মবোধে অনেক  বেশি সংখ্যক যুবক-যুবতীকে উদ্বুদ্ধ করানো৷ ভবিষ্যতে যা হিন্দুরাষ্ট্র ঘটনে সহায়ক হবে৷ এটা একটা অনুমান৷ কিন্তু আশঙ্কা, চার বছর পরপর এই যে এতসব অস্ত্র প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত যুবক যুবতী প্রায় বেকার হয়ে যাবেন এঁরা বিপথে গিয়ে হাতে অস্ত্র তুলে নেবেন না তো? দেশে গৃহযুদ্ধের পরিবেশ তৈরি হবে না তো? কেননা, একুশ থেকে পঁচিশ যে বয়সে তাঁরা চাকরিচ্যুত হয়ে ফিরে আসবেন সেই বয়সটা জীবনের নানান পরিকল্পনা গ্রহণের৷ সেখানে অর্থ ও অস্ত্র তাঁদের বেসামাল করে দেবে না তো? বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পরে আমরা দেখেছি অস্ত্র প্রশিক্ষিত বেকার মুক্তি যোদ্ধাদের একটি বিরাট অংশ অস্ত্রের ঝনঝনানি শুরু করেছিলেন৷ তাই অস্ত্র প্রশিক্ষিত যুবক-যুবতীদের বেকার রাখতে নেই৷ প্রতি চারবছর পর পর হাজার হাজার  অস্ত্র প্রশিক্ষিত যুবক-যুবতীদের যদি সরকার  বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে না পারে তখন এই আশঙ্কা থাকে না কি? আজ যে আর্থিক দায় থেকে উদ্ধার পেতে সরকার  ভারতবর্ষের মতো দেশের জন্য সেনাবাহিনীতে এমন অস্থায়ী নিয়োগের কথা ভাবছেন, তা শুভঙ্কর হবে বলে মনে হয় না৷ আমার তো মনে হচ্ছে তা বুমেরাং হয়ে ভারতবর্ষকে অগ্ণিগর্ভ করে তুলবে৷ ভারতবর্ষকে গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দেবে৷ অবশ্য প্রকল্পের ঘোষণাতেই অগ্ণিগর্ভ হয়ে উঠেছে দেশ৷ আর সরকার যদি জোর করে এই প্রকল্প চালু করেও, অস্থায়ী এই অগ্ণিবীররা যখন বেকার হয়ে ফিরে আসবেন তাঁদের আগুন কে প্রশমিত করার মতো কর্মক্ষেত্র সরকারের থাকবে কি? তা না হলে কিন্তু তাঁদের একটি বড় অংশ দেশের গৃহযুদ্ধের জন্য স্থায়ী কারণ উঠতে পারে৷ পুঁজিবাদীরা কি ভারতবর্ষকে সেইপথে ঠেলে দিতেই তাঁদের সমর্থিত সরকারকে দিয়ে এমন প্রকল্প চালু করতে মরিয়া? শুভবুদ্ধি সম্পন্ন বিচারশীল মানুষদের বিষয়টি নিয়ে ভাবা উচিত৷