আমরা যোগ সাধনা করব কেন?

লেখক
আনন্দমার্গী

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

যোগের আধ্যাত্মিক দিক

আমরা মনের যে অংশ নিয়ে প্রাত্যহিক কাজকারবার করি তা কিন্তু আমাদের মনের অতি ক্ষুদ্র অংশ৷ আমাদের মনের অতি বহৎ অংশ–যেখানে রয়েছে বিপুল সম্পদ, ঐশ্বয্য–তা সাধারণতঃ আমাদের  অজ্ঞাতই থেকে যায়৷

এই মনের বিভিন্ন স্তর রয়েছে৷ এগুলিকে বলা হয় কোষ৷ মনের এই কোষগুলি হ’ল–কামময়  কোষ, মনোময় কোষ, অতিমানস কোষ, বিজ্ঞানময় কোষ ও হিরণ্ময় কোষ৷ কামময় কোষ হ’ল মনের স্থূল অংশ যাতে রয়েছে মনের বিভিন্ন স্থূল কামনা–বাসনা৷ তাই এই মনকে স্থূল মন বলা হয়৷ এই মন ইন্দ্রিয়সমূহের মাধ্যমে বহির্জগতের সঙ্গে সম্পর্কিত৷ এরপর মনের যে সূক্ষ্মতর স্তর আছে–তা হ’ল মনোময় কোষ৷ এই মনকে সূক্ষ্মমনও বলা হয়৷ গভীরভাবে চিন্তন, মনন, গবেষণা প্রভৃতি মনের এই স্তরে করা হয়৷ অর্থাৎ যাঁরা জ্ঞানী, কবি, লেখক, বিজ্ঞানী তাঁদের এই মনোময় কোষ জাগ্রত৷ এরপর রয়েছে অতিমানস, তারপর বিজ্ঞানময় ও তারপর মনের সূক্ষ্মতম কোষ–হিরণ্ময় কোষ৷ অতিমানস কোষে আধ্যাত্মিক চিন্তাভাবনার স্ফূরণ হয়৷ বিজ্ঞানময় কোষ জাগলে বিবেক সদাজাগ্রত হয়৷ তখন মানুষ সব সময় শুভ চিন্তা নিয়ে থাকে ও গভীর আধ্যাত্মিক অনুরাগ জাগে৷ হিরণ্ময় কোষ জাগ্রত হলে মানুষ আধ্যাত্মিক স্তরের পরমানন্দে ডুবে থাকতে পারে৷

এর ঊর্ধ্বে উঠলে মন আত্মাতে সমাহিত হয়৷ তখন তাঁর পূর্ণ আত্মোপলব্ধি হয়৷  মন আত্মাতে সমাহিত হলে জীবাত্মার সঙ্গে পরমাত্মার মিলন ঘটে৷ ‘সংযোগো যোগ ইত্যুক্তো জীবাত্মা–পরমাত্মনঃ’–অর্থাৎ জীবাত্মার সঙ্গে পরমাত্মার এই সংযোগই যোগের মূল কথা৷

সুস্থ শরীর ও শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মন ব্যতীত আত্মোপলব্ধি হয় না৷ আর তাই যম–নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম, ধ্যান–এ সবই যোগের অঙ্গ৷

মনের বিস্তার সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা

অন্যান্য শক্তিতরঙ্গের মত মনও তরঙ্গাকারে প্রবাহিত হয়৷ মনের যতই বিস্তার ঘটে এর তরঙ্গদৈর্ঘ্য ততই বৃদ্ধি পায়৷ অপরপক্ষে মনের সংকোচন যত বেশি হয়, ততই এ এর তরঙ্গদৈর্ঘ্য হ্রাস পায়৷ তখন মনের স্পন্দনাঙ্কও বৃদ্ধি পায়৷ স্পন্দনাঙ্ক বলতে বোঝায় এক সেকেণ্ডে মনে কতগুলি তরঙ্গ উত্থিত হয়৷ বৈজ্ঞানিক গবেষণাগারে মনের এই স্পন্দনাঙ্ক সম্পর্কিত তথ্য পাওয়া যায় ইলেকট্রো–এনসেফালোগ্র্ (ড্র.ড্র.ণ্ড) সাহায্যে৷ মনের এই তরঙ্গকে চার ভাগে ভাগ করা হয়৷–(১) বিটা তরঙ্গ, (২) আলফা তরঙ্গ, (৩) থিটা তরঙ্গ, (৪) ডেল্টা তরঙ্গ৷ 

(১) বিটা তরঙ্গ ঃ সাধারণতঃ মনের স্পন্দনাঙ্ক যখন হয় সেকেণ্ডে ১৩ বা তার চেয়ে বেশি, সে অবস্থায় মনের চঞ্চলতা বেশী থাকে, মনে থাকে অশান্তি৷ মানসিক শক্তিও বেশি থাকে না৷

(২) আলফা তরঙ্গ ঃ এ অবস্থায় মনের তরঙ্গদৈর্ঘ্য বৃদ্ধি পায় ও স্পন্দনাঙ্ক হ্রাস পেয়ে হয় সেকেণ্ডে ৮ থেকে ১২৷ এ অবস্থায় মনের স্থিরতা ও মনের শক্তিও বৃদ্ধি পায়৷

(৩) থিটা তরঙ্গ ঃ ধ্যানের দ্বারা মন যখন আরও স্থির ও শান্ত হয় তখন মনের তরঙ্গদৈর্ঘ্যের অধিকতর বিস্তার ঘটে৷ অপরপক্ষে মনের স্পন্দনাঙ্ক হ্রাস পেয়ে সেকেণ্ডে প্রায় ৪ থেকে ৭–এ পৌঁছয়৷ স্বাভাবিকভাবে মনের শক্তিও তখন বৃদ্ধি পায়৷

(৪) ডেল্টা তরঙ্গ ঃ ধ্যানের গভীরতায় মন আরও বিস্তার লাভ করে৷ মনের স্পন্দনাঙ্ক হ্রাস পেয়ে হয় সেকেণ্ডে ১ থেকে ৩৷ এ অবস্থায় মনে কোনও চঞ্চলতা থাকে না৷ মনে গভীর প্রশান্তি পরিলক্ষিত হয়৷

বলা বাহুল্য, কেবলমাত্র ধ্যানের সাহায্যেই এইভাবে মনের বিটা তরঙ্গকে ডেল্টা তরঙ্গে রূপান্তরিত ক’রে আনন্দময় অবস্থায় পৌঁছানো যায়৷

যোগের মাধ্যমে সমাজের শুদ্ধি

বর্তমানে মানুষের মনের চরম অস্থিরতা ও নীতিবোধের অভাবের প্রতিফলন সমগ্র সমাজে দেখা দিচ্ছে৷ তাই সমাজে আজ প্রায় সর্বত্রই দুর্নীতি, অশান্তি ও নানান ধরণের ঘৃণ্য অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে৷ প্রায় গোটা সমাজটাই আজ দূষিত হয়ে উঠেছে৷ আজকে এই সমাজের শুদ্ধি কেবল আইন ও প্রশাসনিক কঠোরতার দ্বারা সম্ভব নয়, তার সঙ্গে দরকার ব্যাপক নৈতিক ও সর্বসঙ্কীর্ণতামুক্ত আধ্যাত্মিক শিক্ষা৷ তাই চাই যোগের ব্যাপক চর্চা৷

এখানে বলা বাহুল্য, যোগের সঙ্গে জাত–পাত– সম্প্রদায়ের কোনও সম্পর্ক নেই৷ যোগের আদর্শ বলে, ‘মানব সমাজ এক ও অবিভাজ্য’, ‘মানুষ মানুষ ভাই ভাই, উঁচু কিংবা নীচু নাই৷’ তাই সমস্ত সঙ্কীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে সর্বত্র ব্যাপক যোগচর্চার দ্বারা এক সর্বাঙ্গসুন্দর মানব সমাজ গড়ে তুলুন৷