আঞ্চলিক শ্রীবৃদ্ধির পথ ধরে গড়ে উঠবে বিশ্বায়ণ

লেখক
প্রভাত খাঁ

মানুষই পারে স্রষ্টার সৃষ্টিকে সার্থক করতে  কিন্তু সেই কাজটি করতে হবে ঐক্যবদ্ধভাবে ও অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে৷ এই মহান কর্মের বাস্তবায়নের বিজ্ঞানসম্মত ও যুক্তিপূর্ণ পথ নির্দ্দেশনা দিয়েছেন প্রাউট  দর্শনের  প্রবক্তা  শ্রদ্ধেয় প্রভাতরঞ্জন সরকার৷

আঞ্চলিকতার  পথ ধরে  বিশ্বায়নের পথে এগুতে  হবে ঐক্যবদ্ধভাবে মানবসমাজকে৷

প্রথমেই বলতে বাধ্য হচ্ছি এই যে বিশ্বায়ন এটা হলো এক মহান প্রচেষ্টা যেখানে  সকলে এক হয়ে চলার প্রয়াসে রত থাকবে৷

ভৌগোলিক আবিষ্কার ,ভৌতবিজ্ঞানের উন্নতির ফলে এই গ্রহের মানুষ জানতে পারে  এই পৃথিবীর  অবস্থাটা কেমন৷ মানুষে সঙ্গে মানুষের  পরিচয় হয়৷ ঔপনিবেশিক  সাম্রাজ্যবাদ নানা কৌশলে  বিভিন্ন  দেশে তার শোষণের সাম্রাজ্য বিস্তার করে৷

পর পর দুটো  বিশ্বযুদ্ধ সারা পৃথিবীর মানুষকে জানিয়ে দিয়ে গেল বাঁচতে হলে শোষণের  উপর যে সমৃদ্ধি  শুধু  তাতে  নির্ভর করলে চলবে না৷ পৃথিবীর প্রতিটি  অঞ্চলকে  সামাজিক ও সাংস্কৃতিক , আর্থিক দিক থেকে স্বয়ং সম্পূর্ণ হতে হবে৷ সবের্বাপরি মানুষের  সমাজকে একসূত্রে ঐক্যবদ্ধ হয়েই এগুতে হবে৷ তাই সকলকে  স্বীকার করে নিতে হবে যে সকলেরই অর্থাৎ সৃষ্ট জীব জন্তু গাছপালার সেই স্রষ্ঠা এক ও  অদ্বিতীয় তাঁকে  যে নামেই ডাকা  হোক না কেন৷  সেই ঐক্যবোধকে  জাগ্রত  করতে মানুষের  সঙ্গে মানুষের যে আত্মীক যোগসূত্র  তাকে স্বীকার  করে নিতে হবে৷ তার জন্য আত্মীক বিকাশের  অতীব প্রয়োজন৷ এই আত্মীক বিকাশই পারে এক মানব সমাজ  এর বন্ধনকে  সদূঢ় করতে৷ সেই যে আত্মীক জ্ঞান, যে জ্ঞান মানুষকে  নিয়ে যাবে বৃহৎ এষণার দিকে৷ সার্থক বিশ্বায়ণের দিকে৷

আর এটা হবে আরোহন পদ্ধতিতে অর্র্থৎ নিম্ন থেকে উপরের দিকে অর্র্থৎ উপরের দিকে ও  ব্যাপকতরভাবে চলা৷ আর সকল সৃষ্ট  সত্ত্বাকে সঙ্গে নিয়ে চলতে হবে সেই ‘সংগচ্ছধবং এর পথ ধরে৷’ নব্যমানবতাবোধের  পবিত্র স্পর্শে সৃষ্টির  মধুর রহস্য কে স্বীকৃতি দিয়েই৷ শোষণের  উপর সমৃদ্ধির  যে হিংসাশ্রয়ী অকল্যাণকর ভাবনা  যা অদ্যাবধি  পৃথিবীকে ধবংস ও শোষণ করে  এসেছে তাকে পরিহার করেই৷ বর্তমান পথ নিছক শোষণের পথ৷ এই শিক্ষা মানবসমাজ পেয়েছে পর পর দুটি  ভয়ংকর  হিংসাশ্রয়ী বিশ্বযুদ্ধের  ধবংসের মুখোমুখি  হয়ে৷ তাই বলতেই হয় পৃথিবীর রাষ্ট্র শক্তিগুলো কিছুটা বাঁচার তাগিদেই  ইউ.এন ও এর জন্ম দেয়৷

এই ইউ এন ও যেন সেই বিশ্ব রাষ্ট্রের ইঙ্গিত বহন করছে৷ কিন্তু  আজকের পৃথিবীতে মানুষের  জীবনে যেটি সবচেয়ে বড়ো অভাব সেই নৈতিকতা,  সততা, আধ্যাত্মিকতা,ত্যাগ, নিষ্ঠা সেবা , চারিত্রিক দৃঢ়তা থেকে বহুদূরে৷ ভুলে গেলে চলবে না যে সাম্প্রদায়িকতা, বিচ্ছিন্নতা, ক্ষুদ্র জাত পাত, কালো ও সাদা  রংয়ের  ভেদাভেদ করেই সাম্রাজ্যবাদী শক্তি পৃথিবীকে  শোষণ করে চলেছে৷ এটাকে রুখতে হবে  আত্মজ্ঞানের  মাধ্যমে৷ মহান দার্শনিক  শ্রদ্ধেয় প্রভাতরঞ্জন সরকার তাই  মানুষ গড়ার মহান কাজে  হাত দিয়েছেন৷

সাম্রাজ্য হারিয়ে পৃথিবীর ধনী রাষ্ট্রগুলি আজ যে  পথে চলেছে  সেটাতে  যতটা না পৃথিবীর  কল্যাণ হবে তার  চেয়ে বেশী অকল্যাণ  হবে ধনী রাষ্ট্রগুলির মেকী উপর থেকে চাপানো বিশ্বায়নের কূটচালে৷ সেই বড়ো বড়ো ধনী রাষ্ট্রগুলিযেমন আমেরিকা, ব্রিটেন, চীন, ফ্রান্স, এমনকি  রাশিয়া ইত্যাদি তাদের সাহায্য দিচ্ছে  ব্যবসা বাণিজ্য করতে, কৃষ্টি সাংস্কৃতিক  উন্নয়নে এফ.ডি.আই (ফরেন ডাইরেক্ট ইনভেসমেন্ট) সরাসরি  বৈদেশিক  বিনিয়োগ  মাধ্যমে৷ সেটাতে হয়তো কিছুটা অভাব মিটবে কিন্তু  ছদ্মবেশে নোতুন রাষ্ট্রগুলির উপর  আধিপত্য বিস্তার করে আরো নানাভাবে  শোষন করার ফন্দি  ছাড়া কিছুই নয়৷ রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে বিরোধ, সংঘর্ষ, অশান্তি পাকিয়ে তারা দাদাগিরির মাধ্যমে  আরো বেশী করে শোষণ করার এই কুৎসিত ষড়যন্ত্রেই লিপ্ত৷

তাই প্রত্যেক রাষ্ট্রকে  ব্লকস্তর থেকে  আর্থিক  সামাজিক দিক থেকে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে অর্র্থৎ আত্মনির্ভরশীল হয়ে প্রত্যেক  অঞ্চলকে  এগুতে হবে বৃহতের এষণাকে সার্থক করে ঐক্যের মহান নব্যমানবতাবাদের  বন্ধনের লক্ষ্যে৷

বর্তমানে শোষক রাষ্ট্রগুলির বিশ্বায়ন এক  ভয়ংকর  শোষণের পাতা ফাঁদ৷ এতে বিশ্ব স্রষ্ঠার  কল্যাণধর্মী মহান উদ্দেশ্য কোনদিন সফল হবে না৷

তাই প্রাউটের  বিশ্বায়নের যে চিন্তাধারা  তারই কিছুটা আলোচনা  করার প্রয়োজন৷ শ্রদ্ধেয় শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকারের মতে আপেক্ষিক জগতে যতো মতবাদ  আছে সবগুলিই সীমিত৷ একমাত্র নব্যমানবতাবাদ ভিত্তিক সামাজিক অর্থনৈতিক তত্ত্ব---প্রাউটই শোষণ মুক্তির পথ৷ এতে ইজমের কোন লক্ষণই নেই৷ সব কিছুকে  আপন বলে মনে করলে সবাই আত্মীয়  হয় যায়, ভেদাভেদ  থাকে না৷

এই পৃথিবী গ্রহের ব্যষ্টি বিশেষ যেন সারা পৃথিবীর ব্লকগুলি৷ তাই  ব্লকগুলির সার্বিক ভাবে সামাজিক . অর্থনৈতিক , সাংস্কৃতিক বিকাশ ঘটিয়ে  স্বয়ংসম্পূর্ণভাবে গড়ে  তুলে আঞ্চলিক শ্রীবৃদ্ধি  ঘটিয়ে  বিশ্বায়নের পথে এগুতে হবে৷  মানুষগুলি যেন ব্লক শরীরে সচেতন কোষ বিশেষ৷  তাই সচেতন  কোষ গুলির জীবনে  অবশ্যই ত্রয়ীর বিকাশ অর্থাৎ শারীরিক মানসিক ও আধ্যাত্মিক  বিকাশ ঘটাতে হবে৷  কারণ নব্যমানবতাবাদী  না হলে তো বিশ্বৈকতা বোধ জাগ্রত হবে  না৷ শ্রী সরকারের মতে ব্লকগুলি  হবে অর্থনৈতিক  এলাকা,  তাই অর্থনৈতিক  পরিকল্পনাকে  হতে হবে ব্লকভিত্তিক৷

তাই বিশ্বৈকতার অগ্রগতি হবে ঊর্দ্ধমুখী আরোহন পদ্ধতি৷ শ্রী সরকারের মতে প্রাউট অর্থনীতিতে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিতে হবে ব্লকস্তরীয় পরিকল্পনা সংস্থাগুলিকে ৷ এটি হবে সার্থক সামাজিকরণের ব্লকস্তরীয় বাস্তবায়ন৷ ব্যষ্টি মানুষ বাস  করে ব্লকস্তরে৷ তাই  আপেক্ষিক জগতে এটাই হবে অগ্রগতির  প্রাথমিক স্তর বিশেষ৷

প্রাউটের অর্থনৈতিক পরিকল্পন  মেসিনারী মুখ্যতঃ কাজ করবে (কেন্দ্র , রাজ্য, জেলা ও ব্লকস্তরে)৷ তবে ওয়ার্ল্ড গভর্ণমেন্ট  প্রতিষ্ঠার  পরে গ্লোবালস্তরেও এই  পরিকল্পনা মেসিনারী প্রযোজ্য হবে৷

ভূমির  সর্বাধিক  উপযোগিতা গ্রহণের  লক্ষ্যে  প্রাউটের দৃষ্টিতে  ব্লকের সীমানা পুনবির্ন্যাস আবশ্যিক৷ পাশাপাশি  ব্লকে উর্বর  অংশের  সঙ্গে  উর্বর জমির  সংযুক্তিকরণ আবশ্যিক৷ আর  অনুর্বর  জমির সঙ্গে  অনুর্বর  জমির সংযুক্তিকরণ  ঘটিয়ে  অনুর্বর  জমির উন্নয়নে যৌথ পরিকল্পনা নিতে হবে৷ কয়েকটি  নির্দিষ্ট তত্ত্বের  ভিত্তিতে  ব্লকগুলির সীমানা নির্র্ধরিত  হবে৷ বর্তমানে রাজনৈতিক বিচার বিবেচনার ভিত্তিতে ব্লক সীমানা নির্ধারিত  হয়৷ এতে অর্থনৈতিক  উন্নয়ন ব্যাহত হয়৷  এর পরিবর্তন আবশ্যিক৷

নিম্নলিখিত বিষয়গুলিকে  ভিত্তি করে  ব্লকগুলিকে   উন্নয়ণমুখী করতে  সীমানা নির্র্ধরণ  করতে হবে৷

১. সংশ্লিষ্ট এলাকার ভূ-প্রকৃতি  (নদী-উপত্যকার  কথা স্মরণে রেখে)

২. জলবায়ুর অবস্থা

৩. জমির ঢাল

৪. স্থানীয় মৃত্তিকার  প্রকৃতি

৫. স্থানীয় বাসিন্দাদের  সামাজিক ও অর্থনৈতিক  প্রয়োজন ও সমস্যা ৷

৬. এলাকার পশুপাখী ও উদ্ভিদের কথা

৭. সেখানকার মানুষের শারীরিক, মানসিক আশা আকাঙ্ক্ষার  কথা৷ শ্রী সরকারের মতে বিকেন্দ্রীকৃত অর্থনৈতিক  পরিকল্পনায় এই বৈজ্ঞানিক ও বিধিসম্মত সীমানা নির্ধারণই ভিত্তি হিসাবে নেওয়া আবশ্যিক ৷

এই মহান সৃষ্টি যথা হতে এসেছে তথায় ফিরিয়া  যায়৷  তাই এক হতে  বহু আর বহু হতে সেই বিরাট একে সবই মিলিত  হবে৷  এই বিজ্ঞান সম্মত ভাবনাই  আজ বিশ্বায়নের  দিকে  টেনে নিয়ে চলেছে সৃষ্টিকে৷ তাই প্রাউটের  এই  মহান আহবানের  কথা ভেবে পৃথিবীর সকল মানুষকে এক সুন্দর মানুষের  সমাজ ঘটনের সুবিস্তৃত পথ ধরে এগিয়ে চলার শপথ নিয়ে  সংগচ্ছধবং মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হয়েই এগিয়ে  চলতে হবে৷

‘‘জগৎ জুড়িয়া একজাতি শুধু জাতির নাম মানুষ জাতি৷

একই পৃথিবীর স্তন্যে লালিত একই রবিশশী মোদের সাথি৷’’

---কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত

তাই প্রাউট কে জেনে সবাই বিশ্বায়নের পথে  হাঁটার মানসিকতা তৈরীতে উদ্বুদ্ধ হোন৷ সেই বিরাট  কে জানাই তো মানুষের লক্ষ্য৷