আন্দোলনের নামে এই উচ্ছৃঙ্খলতা বঙ্গ সংস্কৃতির অঙ্গ নয়

লেখক
মনোজ দেব

ক্ষোভের যথেষ্ট কারণ আছে৷ অর্থনীতির বেহাল অবস্থা৷ নুন আনতে পান্তা ফুরায় দশা৷ গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মত বিভেদের বিল আইনে পরিণত হ’ল৷ ধুরন্ধর অর্থনীতির কারিগর ও রাষ্ট্রশক্তির নিয়ন্ত্রকরা অত্যন্ত সুচতুরভাবে একটি সামাজিক বিভেদ সৃষ্টিকারী বিলকে সংখ্যাধিক্যের জোরে লোকসভা, রাজ্যসভায় পাশ করিয়ে, রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরে আইনে পরিণত করল৷ কয়েক কোটি মানুষের সামনে নাগরিকহীনতার খাঁড়া ঝুলিয়ে দিল৷ অবৈধ অনুপ্রবেশকারী তক্মা সেঁটে দেবার ব্যবস্থা করল৷ এক ঢিলে অনেক পাখী মারতে চাইল মোদী সরকার৷ বেহাল অর্থনীতির দিক থেকে দৃষ্টিকে ঘুরিয়ে দেওয়া হ’ল, নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে এ নিয়ে আর কোন উচ্চবাচ্য নেই৷ সাম্প্রদায়িক বিভাজন যাদের রাজনৈতিক আদর্শ সেই পথে কয়েক ধাপ এগিয়ে যাওয়া হ’ল৷ ঠুনকো দেশপ্রেমের হুজুগে মাতিয়ে দিয়ে কিছু মানুষকে পাশে পাওয়ার চেষ্টা হ’ল৷

একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এইভাবে সামাজিক বিভেদের বিল আনা হ’ল কেন? কেনই বা আইনে পরিণত করা হ’ল? এই আইন গণতন্ত্রের ওপর আস্থা নয়, গণতন্ত্রের প্রতি হাস্যকর উপহাস৷ আইনের ভেতরে বাহিরে বিভেদ বিদ্বেষের বীজ লুকিয়ে কণ্ঠে যাদের ‘এক দেশ এক আইনের’র হুঙ্কার এই আইন তাদের কপটাচারিতার স্বরূপ উদ্ঘাটিত করে দিল৷

আইনের মধ্যে  থেকে গেল ধর্মীয় মতবাদের  মেরুকরণের বিদ্বেষ বিষ৷ আইনের বাইরে থেকে গেল পক্ষপাতমূলক আচরণের দুষ্টু অভিপ্রায়৷ আইনের প্রণেতারা পাকিস্তান, আফগানিস্তান, বাঙলাদেশ থেকে আগত অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের কথা বলেছেন৷ আইনের বাইরে থেকে গেল নেপাল সীমান্ত থেকে আসা,  শ্রীলঙ্কা থেকে আসা অনুপ্রবেশকারীরা৷ এই আইন দেশের নাগরিকদের প্রতি রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতা নয়, একটি সম্প্রদায়ের প্রতি ঘৃণা ও বিদ্বেষ উগরে দিয়েছে আর তথাকথিত হিন্দত্ব বাঙালী অনুপ্রবেশকারীদের সামনে নাগরিকত্বের খুঁড়োর কল ঝুলিয়ে দিয়েছে৷

এই আইন অনেকের অনেক আশঙ্কার কারণ অবশ্যই৷ আশঙ্কা থেকে ক্ষোভ সৃষ্টি হওয়াও স্বাভাবিক৷ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে প্রতিবাদ আন্দোলনের অধিকার অবশ্যই আছে৷ কিন্তু ক্ষোভের যে বহিঃপ্রকাশ পশ্চিমবঙ্গ ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে হচ্ছে তা মোটেই কাম্য নয়৷ এই আন্দোলন বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে আইনের প্রণেতা শাসকের হাতই শক্ত করবে৷ আন্দোলনের নামে ট্রেনে, বাসে অগ্ণিসংযোগ, যত্রতত্র ভাঙচূর মোটেই সুস্থ নাগরিকের লক্ষণ নয়৷ মনে রাখতে হবে ট্রেন, বাস অবরোধে শাসকের কিছু যায় আসে না৷ সাধারণ মানুষের ভোগান্তির শেষ থাকে না৷ অনেক অসহায় রোগীও পথে আটকে পড়ে, প্রাণান্তকর অবস্থা হয়৷ প্রতিবাদ আন্দোলন অবশ্যই হোক৷ কিন্তু ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ যেন সংযত থাকে৷ সভ্য সমাজ যেমন আইনের মাধ্যমে সামাজিক-সাম্প্রদায়িক বিভাজনের স্থায়ী ব্যবস্থাকে মেনে নেবে না, ঠিক তেমনি প্রতিবাদ আন্দোলনের নামে ট্রেন-বাসে আগুন দেওয়া, পথ অবরোধ করে সাধারণ মানুষকে বিপদের মধ্যে ফেলে উগ্র -উচ্ছৃঙ্খল আচরণও সাধারন মানুষ মেনে নেবে না৷

এইভাবে ট্রেনে-বাসে আগুন লাগিয়ে পথ অবরোধ করে সাধারণ মানুষকে বিপদের মুখে ঠেলে দিয়ে এই আন্দোলন বাম সংস্কৃতির অঙ্গ হতে পারে, বঙ্গ সংস্কৃতির অঙ্গ নয়৷ বাঙলা কোন দিন মানুষকে আন্দোলনের নামে বিভ্রান্ত করেনি, বিপথগামীও করেনি, উচ্ছৃঙ্খলতা করেনি৷ আন্দোলনের নামে এই উচ্ছৃঙ্খলতার উদ্দেশ্য হয়ত আন্দোলনকে বিপথে চালিত করে বিভাজনের আইন প্রণেতাদের উদ্দেশ্য সফল করা৷ নতুবা বাঙলার সভ্যতা ও সংস্কৃতির ইতিহাস সম্পর্কে আন্দোলনকারীরা অজ্ঞ অচেতন৷

অর্থনীতির বেহাল দশা থেকে দৃষ্টি ফেরাতে সামাজিক বিভেদের বিলকে আইনে পরিণত করতে হল্লার সৃষ্টি চতুর শাসক ও শোষকের ধুরন্ধর কৌশল, সেই কৌশলে সব বিরোধী দলই মাত হ’ল৷ যেখানে জয়-পরাজয় দলীয় বশংবদদের সংখ্যাধিক্যের জোরে হয়, সেখানে পরাজয় নিশ্চিত জেনে বিল পাশের ভোট বয়কট করে বিরোধিরা চাইলে বেহাল অর্থনীতির দশা নিয়ে আলোচনায় যেতে পারত৷

আসলে বিলের কি সমর্থক, কি বিরোধী প্রত্যেকেই দলীয় লাভ-লোকসানের হিসেব কষে পা ফেলে৷ দেশ ও দেশের নাগরিক এখানে গৌণ হয়ে যায়৷ নাগরিকের মূল্য শুধু সাধারণ নির্বাচনে ভোট দেওয়ার সময়৷

বিভাজনের বিল আইনে পরিণত হওয়ায় পূর্ব ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে কয়েক কোটি বাঙালীর জীবনে অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে৷ ব্যষ্টি ও দলীয় স্বার্থের বাইরে গিয়ে কোন দলই এই বাঙালীদের পাশে দাঁড়াবে না৷ তার নজির অসমেই আছে৷ স্বাধীনতার পর পরই অসমে বাঙালী বিতাড়ন শুরু হয়, সেখানকার কংগ্রেসী মুখ্যমন্ত্রীর প্রত্যক্ষ মদতে৷ বর্তমান পরিস্থিতিতে বাঙালীকে নিজের পথ নিজেকে বেছে নিতে হবে৷