আনন্দমার্গের  সমাজশাস্ত্রে নারীর স্থান

লেখক
সুশীলা দেবী

সমাজ সম্পর্কে আনন্দমার্গ দর্শনের প্রণেতা শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী বলেছেন–‘‘নীতিবাদের স্ফূরণ থেকে বিশ্বমানবত্বে প্রতিষ্ঠা–এ দুয়ের মাঝখানে রয়েছে যেটুকু অবকাশ তাকে অতিক্রম করার যে মিলিত প্রয়াস তারই নাম সামাজিক প্রগতি, আর যারা মিলেমিশে চেষ্টা করে এই অবসরটুকু জয় করবার প্রয়াসে রত হয়েছে তাদের নাম একটা সমাজ৷’’ সমাজ  সম্পর্কে এই স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গীর পরিচয় ইতোপূর্বে মানুষ পায়নি৷ উপরিউক্ত সংজ্ঞা থেকেই ধারণা করা যায়, আনন্দমার্গের দর্শনশাস্ত্র, ধর্মশাস্ত্র ও সমাজশাস্ত্রের চিন্তাধারা প্রচলিত সমস্ত প্রকার দর্শন ও শাস্ত্রের তুলনায় উন্নত, স্বতন্ত্র ও বিপ্লবধর্মী, সর্বপ্রকার সংকীর্ণতামুক্ত উদার ও সার্বভৌম পথের দিশা পাওয়া যায় আনন্দমার্গের দর্শনে ও সমাজশাস্ত্রে৷ স্বাভাবিকভাবেই ভেদবুদ্ধি প্রসূত প্রচলিত সমাজশাস্ত্র অপেক্ষা আনন্দমার্গ সমাজশাস্ত্রে নারীর মূল্যায়ন করা হয়েছে পুরুষের সঙ্গে সমদৃষ্টিতে৷ বিশ্বমানবত্বের প্রতিষ্ঠা ও সামাজিক প্রগতির যে ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস, সেখানে পুরুষের সাথে নারীর অধিকার ও দায়িত্ব সমভাবে স্বীকৃত৷ দৈহিক, মানসিক  ও আধ্যাত্মিক বিকাশের ক্ষেত্রেও নারী–পুরুষের সমান সুযোগ থাকছে৷

পুরুষ শাসিত সমাজে নারী যে তার উপযুক্ত মর্যাদা আজও পায়নি একথা অস্বীকার করার উপায় নেই৷ শারীরিক দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে পুরুষ নারীকে তার  প্রয়োজনে ব্যবহার করেছে ও তার ওপর কর্তৃত্ব ফলিয়েছে৷ কিন্তু তার দৈহিক, মানসিক, আধ্যাত্মিক বিকাশের জন্যে কোন প্রয়াস কখনও করেনি৷ বরং নানা বিধিনিষেধের ডোরে বেঁধে নারীর প্রগতিকে রুদ্ধ করার প্রয়াস চলেছে৷ সমাজশাস্ত্রের রচয়িতারাও নারীকে তার প্রাপ্য মর্যাদা দিতে শুধু কার্পন্য করেননি তাই নয়, কঠোর সামাজিক নিয়মের গণ্ডীতে নারীর গতিবিধিকে করেছে সীমাবদ্ধ৷ আবার অনুষ্ঠানে, ধর্মাচারণে নানা বিধিনিষেধের জালে আবদ্ধ করে রাখতে চেয়েছে, সঙ্কুচিত করেছে নারীর অধিকার শাস্ত্রের দোহাই দিয়ে আবার শাস্ত্রের অপব্যাখ্যা করে বাল্যবিবাহ, সতীদাহের মতো অমানবিক, নিষ্ঠুর প্রথাগুলিও সমাজের বুকে চাপিয়ে দিয়েছিল তথাকথিত সমাজপতিরা৷ হিন্দু সমাজের অধঃপতনের কারণই হচ্ছে সমাজশাস্ত্রের কঠোরতা ও নারীপুরুষের মধ্যে বৈষম্যমূলক সামাজিক বিধিনিয়ম৷

তবে নারীর দুর্গতির অন্যতম কারণ যেমন পুরুষ শাসিত সমাজব্যবস্থা, তেমনি নারী জাতির উন্নতিসাধনে, তার প্রতি অবিচারের প্রতিবাদে গর্জে উঠতে প্রতিবিধান করতে এগিয়ে এসেছে সেই পুরুষই৷ বাল্যবিবাহ, সতীদাহের মতো নিষ্ঠুর প্রথা রোধ করতে অশেষ লাঞ্ছনা সহ্য করেছেন বিদ্যাসাগর, রামমোহন৷ নারীর প্রতি অবহেলা, বঞ্চনা ও অনাদরের প্রতিবাদে কলম ধরেছিলেন শরৎচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথের মতো গুণীজনেরা৷ তথাপি সমাজশাস্ত্রের দোহাই দিয়ে নারীকে আজও অবলা করে রাখার প্রয়াস একেবারে থেমে যায়নি৷ নারীও অনেক ক্ষেত্রে তথাকথিত সমাজশাস্ত্র রচিত বিধিনিষেধকেই ঈশ্বর সৃষ্ট বিধান বলেই মেনে নিয়েছে৷

ভারতীয় সভ্যতায় রাষ্ট্র অপেক্ষা সমাজের মূল্য অনেক বেশী বিশেষ করে হিন্দু সভ্যতায় রাষ্ট্রের ভূমিকা খুবই গৌণ করে দেখা হতো৷ সমাজের ভেতর থেকেই এখানে সভ্যতার উন্মেষ৷ রাষ্ট্রের আইন অপেক্ষা এখানে সমাজের বিধানগুলি অনেক বেশী শক্তি ধরে৷ তাই রাষ্ট্রের আইনে অপরাধ হলেও বাল্যবিবাহ, পণপ্রথার মতো অমানবিক প্রথাগুলি সমাজ থেকে আজও পুরোপুরি উচ্ছেদ করা সম্ভব হয়নি৷ সেই কারণেই রাষ্ট্রে আইন বলবৎ করে সামাজিক প্রথার পরিবর্ত্তন সম্ভব নয়৷

এমনকি সতীদাহের মতো নিষ্ঠুর ঘটনাও কিছুদিন আগেও ঘটেছে সমাজশাস্ত্রের দোহাই দিয়ে৷ নারীর দুঃখ মোচনে যাঁরা সচেষ্ট হয়েছিলেন তাঁরাও রাষ্ট্রের আইনের ওপর নির্ভর করেছেন, সমাজশাস্ত্রে আঁচড় কাটতে সাহস পাননি৷ এমনকি তথাকথিত প্রগতিবাদীরাও অসার বিজ্ঞানের বুলি কপচালেও অযৌক্তিক কুসংস্কার ভরা সামাজিক প্রথার মূলে কুঠারাঘাত করতে পারেননি৷ আনন্দমার্গের সমাজশাস্ত্র সেই দুরূহ কাজটি করেছে৷ শাস্ত্রের দোহাই দিয়ে নারীর ওপর চাপিয়ে দেওয়া সমস্ত অন্যায়–বিচার ও কুসংস্কারের বোঝা ঝেড়ে ফেলে সমাজকে নোতুন করে সঞ্জীবিত করার লক্ষ্যে আনন্দমার্গের সমাজশাস্ত্র রচিত হয়েছে৷

ভারতবর্ষের অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় বাঙালী জনগোষ্ঠী শিক্ষায়, সংসৃক্তিতে মুক্ত চিন্তাধারায় অনেক এগিয়ে এমন একটি ধারণা প্রচলিত আছে৷ এর সবটাই মিথ্যা নয়৷ ঊনবিংশ শতাব্দীর নবজাগরণে নেতৃত্বের পুরোভাগে ছিলেন বাঙলার মণীষীরাই৷ সমাজ সংস্কারে রামমোহন, বিদাসাগর, বিজ্ঞানে প্রফুল্লচন্দ্র রায়, জগদীশচন্দ্র বোস, সাহিত্যে বঙ্কিমচন্দ্র, শরৎচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, রাজনীতিতে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন, সুভাষচন্দ্র ধর্মনীতিতে বিবেকানন্দ, অরবিন্দের ন্যায় দেশবরেণ্য বিশ্ববন্দিত ব্যষ্টির আবির্ভাব হয়েছিল বাঙলায়৷ নারী জাতীও সেদিন পিছিয়ে ছিলেন না৷ তাই নারী এখানে অনেক বেশী স্বাধীন, অনেক বেশী সমাজ সচেতন৷ তাই সতীদাহের মতো অমানবিক নিষ্ঠুর কু–প্রথার প্রভাব ভারতবর্ষের কোন কোন রাজ্যে বিক্ষিপ্ত ভাবে থাকলেও বাঙলায় তা অকল্পনীয়৷ তবু নারী এখানেও তার সামাজিক মর্যাদায় আজও প্রতিষ্ঠিত হতে পারে নি৷ তথাকথিত প্রগতিবাদী বাঙলাতেও নারী নানা বৈষম্যের শিকার৷ কারণ প্রচলিত সমাজশাস্ত্রের কু–প্রভাব আজও পুরুষের মজ্জায় মজ্জায় রয়ে গেছে৷ কিন্তু নারী যতদিন পিছিয়ে থাকবে, অবদমিত হয়ে থাকবে ততদিন যথার্থ সমাজ ঘটন সম্ভব নয়৷ আর ধর্মের দোহাই দিয়ে যে শাস্ত্র সমাজের বুকে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে তার থেকে মুক্তি পাওয়াও দূরূহ৷ তাই নারী রাষ্ট্রক্ষমতার শীর্ষে থেকেও কুসংস্কারের আবর্জনায় ভরা তথাকথিত সমাজ শাস্ত্রের বিধানে বন্দী৷

অথচ মানবসভ্যতার অগ্রগতিতে নারীর অবদান অস্বীকার করার উপায় নেই৷ দর্শনে, আধ্যাত্মিকতায়, সমাজ সংস্কারে, শিক্ষায়, বিজ্ঞানে সমাজের সর্বক্ষেত্রে পুরুষের ন্যায় নারীর ভূমিকাও মানব জাতিকে গৌরবান্বিত করেছে৷ তথাপি তথাকথিত সমাজশাস্ত্রের বিধানে বৈষম্যের শিকার নারী৷ নারীর প্রতি এই বৈষম্যমূলক আচরণের বিরুদ্ধে আজ প্রয়োজন তীব্র ধিক্কার জানানো৷ আর এখানে এগিয়ে আসতে হবে নারীকেও, নারী স্বাধিকার পুনরুদ্ধারের জন্যে নেতৃত্বের পুরোভাগে নারীকেই থাকতে হবে৷ শিক্ষায়, অর্থোপার্জনে, সামাজিক মর্যাদায় নারীকেও হতে হবে পুরুষের সমকক্ষ৷ তারই বলিষ্ঠ পথ নির্দেশনা আছে শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী প্রবর্তিত সমাজশাস্ত্রে৷

শুধু নারী জাতিই নয়, বিশ্বের সকল সম্প্রদায়ের সকল মানুষের প্রয়োজন বুঝে তাদের মনের কথা ভেবেই সমাজের বিধিনিষেধগুলো তৈরী করেছেন আনন্দমার্গ সমাজশাস্ত্রের প্রবর্তক৷ নারীপুরুষের সমান মর্যাদা সমানাধিকার আনন্দমার্গ সমাজশাস্ত্রে স্বীকৃত৷ স্ত্রী–পুরুষগত কোনরকম ভেদবুদ্ধি যা নারীর প্রতি সামাজিক অবিচারকে প্রশ্রয় দেয়, নারীকে সমাজে হীন মনে করার প্রবণতা দেখা দেয়, এই ধরনের বৈষম্যমূলক চিন্তার কোন অবকাশ আনন্দমার্গ সমাজশাস্ত্রে নেই৷

এখনও বিশ্বের বহু দেশে নারীকে পুরুষের ভোগোপাদান বলে মনে করা হয়৷ আধ্যাত্মিক সাধনার উপযুক্ত নয় নারী, এমন সামাজিক বিধানও আছে৷ জাতিচ্যুত, বিধবা মেয়েদের সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগ দেবার ক্ষেত্রেও নানা বিধিনিষেধ আছে৷ আনন্দমার্গ সমাজশাস্ত্র প্রবর্তিত সমাজব্যবস্থায় এই ধরনের অযৌক্তিক ও বৈষম্যমূলক চিন্তাধারাকে গ্রহণ করা হয়নি৷ আনন্দমার্গ সমাজশাস্ত্রে আধ্যাত্মিক অনুশীলনে, ধর্মীয় ও সামাজিক আচার অনুষ্ঠানে কোন নারীকেই অনুপযুক্ত বিবেচনা করা হয় না৷ নারীকে এখানে পুরুষের সঙ্গে সমদৃষ্টিতেই দেখা হয়৷ পুরুষের ন্যায় নারীরও এখানে দৈহিক, মানসিক, আধ্যাত্মিক বিকাশের সমান সুযোগ আছে৷ তাই সমাজের প্রগতিতে আনন্দমার্গ সমাজশাস্ত্র অনুযায়ী স্ত্রী–পুরুষের সমান অধিকার ও সমান দায়িত্ব৷ স্ত্রী–পুরুষ একে অপরকে শ্রেষ্ঠ মনে করার কোন সুযোগ এখানে নেই৷ আনন্দমার্গ সমাজশাস্ত্রে নারীর স্থান পুরুষের নীচে নয়, পুরুষের পাশেই সমমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত৷

আনন্দমার্গ সমাজশাস্ত্রে নারী যে মর্যাদা ও স্বীকৃতি পেয়েছে তা অক্ষুণ্ণ রাখতে নারীদের হতে হবে দায়িত্বশীল৷ শুধু অধিকার নয়, এক বলিষ্ঠ সমাজ ঘটনের দায়ভাগও নারীকে নিতে হবে৷ কারণ শুধু নারীর অধিকার ও মর্যাদা ফিরিয়ে দিতেই আনন্দমার্গ সমাজশাস্ত্র রচিত হয়নি৷ মানব মনের বিকাশ ও বিস্তারের উপযুক্ত সার্বজনীন, যুক্তিনিষ্ঠ ও মনোবিজ্ঞান সম্মত যে সমাজশাস্ত্রের প্রবর্তন শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী করেছেন সেখানে প্রচলিত সমাজশাস্ত্রের ন্যায় নারীকে তিনি উপেক্ষা ও অবহেলা করেননি৷ সমাজের সেই যথার্থ প্রগতি তখনই সম্ভব নারী–পুরুষ উভয়েরই সার্বিক বিকাশের সমান সুযোগ থাকবে৷ সমাজের সেই যথার্থ প্রগতির দিকে লক্ষ্য রেখেই আনন্দমার্গ সমাজশাস্ত্রে নারীকে তার উপযুক্ত স্থান দেওয়া হয়েছে৷ তাই নারী–পুরুষের মধ্যে কোন রকম ভেদবুদ্ধি ও বৈষম্যের স্থান এখানে নেই৷  আনন্দমার্গ সমাজশাস্ত্র সর্বপ্রকার কুসংস্কার ও ভাবজড়তামুক্ত এক নোতুন পথের দিশারী৷ প্রবর্তকের ভাষায় ‘‘জগতের পরিবর্তনশীলতাকে সামনে রেখে এক চলমান সামাজিক কাঠামোর অস্তিত্ব তথা বিকাশের জন্যে যে ধরনের সার্বজনীন, যুক্তিনিষ্ঠ ও মনোবিজ্ঞানসম্মত সমাজশাস্ত্রের দরকার আনন্দমার্গ সমাজশাস্ত্র সেই সকল গুণে অন্বিত৷’’