অসমে ১.৩৯ কোটি বাঙালী বিতাড়নের প্রতিবাদে

সংবাদদাতা
নিজস্ব সংবাদদাতা
সময়

অসমে ১.৩৯ কোটি বাঙালী বিতাড়নের চক্রান্তের প্রতিবাদে গত ১৮ই জানুয়ারী কোলকাতায় জীবনদীপ ভবন থেকে আমরা বাঙালীর নেতৃবৃন্দ ও সমর্থকদের এক বিক্ষোভ মিছিল রাসেল ষ্ট্রীটে অসম ভবনে সামনে এসে পৌঁছায়৷ এখানে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে আমরা বাঙালীর বিক্ষোভ সমাবেশ৷ সমাবেশে আমরা বাঙালীর বিভিন্ন বক্তারা অসম সরকারের বাঙালী বিতাড়নের চক্রান্তের তীব্র প্রতিবাদ জানান৷ এই সমাবেশে অসমের মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সানওয়ালের কুশপুত্তলিকাও দাহ করা হয়৷

বিক্ষোভ সমাবেশে অসম সরকারের বাঙালী বিরোধী চক্রান্তের প্রতিবাদে বক্তব্য রাখেন আমরা বাঙালী সচিব বকুল চন্দ্র রায়, সহ সচিব তারাপদ বিশ্বাস, শুভেন্দু ঘোষ, জয়ন্ত দাশ, বিভূতি দত্ত প্রমুখ৷  আমরা বাঙালীর কেন্দ্রীয় সচিব বকুল চন্দ্র রায় বলেন ঃ---স্বাধীনতার  প্রাক্ মুহূর্তেই অসম থেকে বাঙালীদের  উৎখাত করার ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছিল৷ যার ফলে ১৯৪৭-এর জুূন মাসে গণভোটের নাটক  করে বাঙালী অধ্যুষিত  অসমের  একটি জেলা শ্রীহট্টকে  পাকিস্তানে  ঠেলে দেওয়া  হয়েছিল৷ তার পরবর্তীকালে  লোকগণনার  প্রহসনে ১৯৫১ সালে বাঙালীদের  সংখ্যাতত্ত্বের কারচুপিতে সংখ্যালঘু বানানো হয়েছিল৷

বস্তুতঃ ১৯৫০ সাল হতেই অসম থেকে বাঙালীদের বিতাড়নের জন্যে এখানকার স্থায়ীভাবে বসবাসকারী বাঙালী সহ সম্পূর্ণ বৈধভাবে ওপার বাঙলা থেকে উদ্বাস্তু হয়ে আগত বাঙালীদের বারবার ঘর-বাড়ী জ্বালানো, আক্রমণ, গণহত্যা প্রভৃতি সংঘটিত করা হয়েছে৷

তিনি আরও বলেন---মহান দার্শনিক ও ইতিহাসবিদ্ শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার তাঁর ‘বাংলা ও বাঙালী’ গ্রন্থে লিখেছেন, ১৯১২ সালে যখন অসম প্রদেশ তৈরী হয়, তখন দেখা যায় অসম প্রদেশের আর্থিক অবস্থা ভাল নয়৷ কলকাতা পৌরসভার বার্ষিক আয়ের চেয়ে নবসৃষ্ট অসমের বার্ষিক আয় কম৷ তাই এই নবসৃষ্ট রাজ্যের আর্থিক অবস্থা দৃঢ় করবার জন্যে বাঙলার সিলেট, কাছাড় ও উত্তর-পূর্ব রংপুর জেলা তিনটিকে নবসৃষ্ট অসম রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করে দেওয়া হয়৷ রংপুর রইল বাঙলায় আর উত্তর-পূর্ব রংপুর গেল অসমে৷ এটি একটি বিসদৃশ ব্যাপার৷ তাই ইংরেজরা উত্তর-পূর্ব রংপুর জেলার নাম পরিবর্তন করে নতুন নাম দেন গোয়ালপাড়া৷ তবে জেলা সদর থেকে যায় ধুবড়ীতেই৷ পরবর্তীকালে গোয়ালপাড়া জেলাটি দ্বিধাবিভক্ত হয়েছে৷ (১) ধুবড়ী, (২) কোকড়াঝাড়, (৩) গোয়ালপাড়া৷

তাই অসমের এই সমস্ত এলাকাতে বাঙালীরাই আসল ভূমিপুত্র, এতে কোনও সন্দেহের অবকাশ নেই৷ আজকের অসমিয়া সংসৃকতির উৎসকেন্দ্র কামরূপী সংসৃকতি, যা রাঢ়-গাঙ্গেয় সভ্যতা-সংসৃকতির সঙ্গে ব্রহ্মপুত্র সংসৃকতির মিশ্রিত সংস্করণ৷ আরও লক্ষ্যণীয়, বাঙালীদের ভোটেই এতদিন অসমের সরকার নির্বাচিত হয়েছে৷ আজ সেই বাঙালীদেরই বলা হচ্ছে বিদেশী!

আমরা বাঙালীর সহ সচিব তারাপদ বিশ্বাস বলেন---দেশভাগের বলি, পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত পঞ্জাবী, সিন্ধ্রি, গুর্জর প্রভৃতি উদ্বাস্তুদের পর্যায়ক্রমে আইন করে ভারত সরকার নাগরিকত্ব প্রদান করল৷ কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালী উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্ব না দিয়ে ট্রাইব্যুন্যাল, ডিটেনশন ক্যাম্পে পাঠানোর ব্যবস্থা করে চলেছে৷ স্বাধীনতার পর ৭০ বছরে ভারতবর্ষে বহুবার শাসক বদল হয়েছে৷ কিন্তু দেশভাগের বলি বাঙালী উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্ব প্রদানের পরিবর্তে বিদেশী বানানোর নীতি বদলায়নি৷

তিনি আরও বলেন, এটা কারো অজানা নয় যে, অতীতে উগ্রপন্থী ‘সারা আসাম ছাত্র সংস্থা’ (‘আসু’)-র নেতৃত্বেই ভারতের সংবিধান তথা গণতান্ত্রিক আদর্শকে পদদলিত করে তারা লক্ষ লক্ষ বাঙালীর ঘরবাড়ী জ্বালিয়েছিল, বেপরোয়াভাবে খুন-জখম চালিয়েছিল৷ কুখ্যাত ‘নেলী-গণহত্যা কাণ্ড’ তাদেরই কাজ৷ সেই জঙ্গী জনগোষ্ঠীকে দিল্লীতে ডেকে নিয়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী তাদের সন্তুষ্টির জন্যেই অসাংবিধানিক ‘অসম চুক্তি’ করে৷ পরে ওই ‘অসম চুক্তি’র ভিত্তিতে সংশোধিত হয় ভারতের নাগরিকত্ব আইন৷ বলা বাহুল্য এটি ছিল লক্ষ লক্ষ বাঙালীকে রাষ্ট্রহীন করার পাকাপাকি ব্যবস্থা৷

সেদিন একমাত্র আমরা বাঙালী সংস্থা এর তীব্র প্রতিবাদ করেছিল৷ গত ৩১ ডিসেম্বর ২০১৭ বর্তমান অসম রাজ্য সরকার নাগরিকপঞ্জীর প্রথম পর্যায়ের তালিকা প্রকাশ করেছে৷  তাতে সিংহভাগ বাঙালী সহ ১.৩৯ কোটি অসমিয়াবাসী নাগরিকের নাম নেই৷ ফলে এখানকার বাঙালীরা অত্যন্ত উদ্বিগ্ণ ও উৎকণ্ঠিত৷ নাগরিকপঞ্জীতে নাম না থাকার দোলাচলে আশ্বাস ও পাল্টা হুঙ্কার দুইই চলছে৷ বাস্তবিকপক্ষে নাগরিকত্ব আইন বাঙালীদের পক্ষে নেই৷ তাই এটা স্পষ্ট যে অসমের বাঙালীদের সিংহভাগকে রাষ্ট্রহীন, দেশহীন করে ডিটেন্শন ক্যাম্পে বন্দী করে তাদের ওপর ষ্টীম রোলার চালানোর ব্যবস্থা হচ্ছে৷

‘আমরা বাঙালী’ বিভিন্ন সময় অসমের বাঙালীদের ওপর নির্যাতনের প্রতিবাদে আন্দোলন চালিয়ে এসেছে৷ বর্তমানে অসমের বাঙালীদের চরম সংকট মুহূর্ত্তে দলমত নির্বিশেষে সমস্ত বাঙালীদের ঐক্যবদ্ধ ভাবে বাঙালী নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলার জন্যে ‘আমরা বাঙালী’ অসম, ত্রিপুরা, পশ্চিমবঙ্গ, ঝাড়খণ্ড, বিহার সহ বিভিন্ন রাজ্যে বসবাসকারী বাঙালীদের, সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষদের আহ্বান জানাচ্ছে৷