অতীতের মতো বাঙালী কবে  আত্মসচেতন হবে

লেখক
জ্যোতিবিকাশ সিন্হা

আমরা দেখে শিখি,  পড়ে শিখি, নয়তো ঠেকে শিখি৷  মানুষ হিসেবে জীবনের ছোট্ট পরিসরে  বিপুলা এই পৃথিবীর কতটুকুই বা  আমরা দেখতে পারি! তাই দেখে শেখার সুযোগ বা ক্ষমতা  দুটোই আমাদের সীমিত--পড়ে শেখার সুযোগটাই  সবচেয়ে বেশী৷ দেশের কথা, জাতির কথা ,পৃথিবীর কথা, নিজেদের অতীত ঐতিহ্য-সংসৃকতির  কথা আমরা ভূগোল, ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান ইত্যাদি বই পড়েই  জানতে পারি৷  ছোটবেলায় বিভিন্ন পুস্তকে  রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ, নেতাজী সুভাষ, রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুল , শ্রী অরবিন্দ, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন, জগদীশচন্দ্র বসু, মেঘনাদ সাহা, আচার্য্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় প্রমুখ মনীষীগণের  ও অগ্ণিযুগের বীর বিপ্লবী মাস্টারদা সূর্য সেন,  ক্ষুদিরাম বসু, রাসবিহারী বসু,  প্রফুল্ল চাকী, বিনয়-বাদল-দীণেশ, মাতঙ্গিনী হাজরা প্রমুখ স্বাধীনতা সংগ্রামীদের জীবনী ও আত্মত্যাগের কাহিনী পাঠ করে কিশোর মন গর্বে -আনন্দে ভরে উঠত৷ সেই মনীষীগণের , বীর দেশপ্রেমিকগণের জীবন ও জীবনাদর্শ তারুণ্যের সজীবতাকে দেশপ্রেমের ভাবনায় উদ্বুদ্ধ ও অনুপ্রাণিত করতো৷ একজন বাঙালী কিশোর হিসেবে নিজেকে অত্যন্ত গর্বিত মনে হতো৷ ছোটবেলার সেই উন্নত বাঙালী-চেতনা আজও বাঙলা ও বাঙালীর গৌরবময় অতীত ঐতিহ্য সংসৃকতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল করে রেখেছে৷  বাঙলার কৃতী সন্তানদের জীবনাদর্শ, সংগ্রামী চেতনা, দেশমাতৃকার শৃঙ্খলমোচনের জন্য  জীবন-পণ সর্বদাই অন্তরের অন্তঃস্থল উদ্বেলিত করে রাখে৷

শিক্ষা-দীক্ষা, জ্ঞান -বিজ্ঞান, ত্যাগ-তিতিক্ষা সবক্ষেত্রেই  বাঙালী অগ্রগণ্য৷ নদীমাতৃক এই বাঙলার মানুষজন সুদূর অতীত থেকেই  অতীব সহজসরল জীবনযাপনে অভ্যস্ত৷  নদী অববাহিকার সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা ভূ-প্রকৃতি বাঙালীকে দিয়েছে স্বয়ংভরতা ও অনুভূতিপ্রবণ মন ৷ প্রেম-প্রীতি-ভালবাসার নিগড়ে  বাঁধা বাঙালী জীবনের মূল সূরটি ঐক্য ও মিলনের সূত্রেই বিধৃত৷ তাই বাঙালী অপরের  দুঃখে  কাঁদে,  অপরের সুখে হাসে৷ অচেনা-অজানা অতিথিকেও  বাঙালী সমাদরে আপন করে নেয়৷  বাঙলা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন শাসকের  শাসনাধীন ছিল৷  ওই সমস্ত শাসকবর্গের  যারা বাঙলার মানুষকে ভালবেসেছে, বাঙালীও তাঁদের আপন করে নিয়েছে আর পারস্পরিক ভাষা-আচার-ব্যবহার-সংসৃকতির আদান-প্রদানের মেলবন্ধনে আবদ্ধ করেছে৷  কিন্তু যে প্রশাসকেরা বাঙালীর অন্তর্নিহিত প্রাণশক্তিকে, জাতিসত্তা ও ঐতিহ্যকে আঘাত করেছে, বাঙলার মানুষ তাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে গর্জে উঠেছে, প্রয়োজনে সমুচিত জবাব দিতে সশস্ত্র সংগ্রামেও অবতীর্ণ হয়েছে৷ বিশেষতঃ ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনকালে সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজ শাসকবর্গের লক্ষ্যই ছিল বাঙালী ঐক্যকে বিনষ্ট করে দেওয়া--- বাঙালীর জাতিসত্তাকে অবদমিত করে রাখা৷  এই উদ্দেশ্য সাধনের  নিমিত্ত ইংরেজরা মুষ্টিমেয় স্বার্থপর,  ক্ষমতালোভী ব্যষ্টিবর্গকে বিভিন্ন  উপাধি -উপঢৌকন ও পদের টোপ দিয়ে নিজেদের পেটুয়া বশংবদ অনুচরে পরিণত করে৷  অতঃপর তাদের দিয়ে  বাঙালী জনগণের মধ্যে বিভেদ বিভাজন সৃষ্টি করে বাঙালীর সামগ্রিক ঐক্যে ফাটল ধরিয়ে মনোবল ভেঙ্গে দেওয়ার চেষ্টা করে৷  শুধু তাই নয়,  দেশীয় শিক্ষাপদ্ধতিতে ইংরেজী ও ইংরেজীয়ানার অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে  বাঙলা ভাষাকে  অবদমনের চেষ্টা করে৷  ইংরেজী-ভাষা ও সংস্কৃতিতে  আধাশিক্ষিতদের  অধিক সরকারী  সুযোগ-সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে ইংরেজ -অনুগত বাহিনী তৈরী করে৷  এখানেই না থেমে  ব্রিটিশ শাসককুল বাঙলাকে ভাঙার চক্রান্তেও সামিল হয়৷  ১৯০৫ সালে  লর্ড কার্জনের বাঙলা ভাগের প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে  সচেতন বাঙালী প্রতিবাদে গর্জে ওঠে ও ‘‘বঙ্গভঙ্গ-রদ’’ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে৷  বাঙালী ঐক্য বজায় রাখার উদ্দেশ্যে  রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রাখী-বন্ধন অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন৷

 আন্দোলনের প্রাবল্যে বঙ্গভঙ্গ সাময়িকভাবে রোখা গেলেও পরবর্তীকালে বাঙলা বহুধাবিভক্ত হয়ে  পুনর্গঠিত বিভিন্ন প্রদেশের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে৷  ১৯৪৭ সালের আগষ্ট মাসে স্বাধীনতালাভের সময় দ্বিজাতিতত্ত্বের  ভিত্তিতে ভারতবর্ষ ভেঙ্গে ভারত ও পাকিস্তান নামক দুইটি রাষ্ট্র সৃষ্টির ফলে সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বাঙলা ও বাঙালী৷  বাঙলার খণ্ডাংশগুলি  মূল বাঙলা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একটি ক্ষুদ্রাংশ ‘‘পশ্চিমবঙ্গ’’  নামে  ভারত রাষ্ট্রে  বাঙালীর নিজস্ব ঠিকানা হিসেবে চিহ্ণিত হলো৷ দেশভাগের ক্ষত হিসেবে পূর্ব-পাকিস্তান, অধুনা বাংলাদেশ রাষ্ট্র থেকে যে লক্ষ লক্ষ বাঙালী ‘‘লোকবিনিময়’’ প্রক্রিয়ায় ভারতে চলে আসতে বাধ্য হলেন তাঁদের স্থান হলো বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে৷  এ সকল ছিন্নমূল বাঙালীর পুনর্বাসনের যথাযোগ্য ব্যবস্থা করার বিষয়ে স্বাধীনোত্তর ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকলেও  কোনও এক অজ্ঞাত কারণে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে  উদাসীন থাকার ফলে  বিভিন্ন শরণার্থী শিবির থেকে হতভাগ্য বাঙালীর দল জীবন ও জীবিকার সন্ধানে বিভিন্ন প্রদেশে ছড়িয়ে পড়তে বাধ্য হলেন৷  সর্বস্ব হারিয়ে  এক ভাসমান জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয়ে শোষিত , বঞ্চিত, নিপীড়িত অবস্থায়  দিনাতিপাত করাই তাঁদের বিধিলিপি হয়ে উঠল৷ ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামে যে বাঙালীর অবদান সবথেকে বেশি, যাদের রক্ত ঝরেছে সর্র্বধিক--- সেই বাঙালীর বৃহদংশ ভিন্ন ভাষা-ভাষী রাজ্যগুলির  করুণার পাত্র হয়ে নিজস্ব  ভাষা-সংসৃকতি ও  অধিকার থেকে আজ বঞ্চিত৷  সেই বাঙালী আজ  কোনও রাজ্যের ‘‘বাঙালী খেদাও ’’  বা বাঙালী বিতাড়ন অভিযান  আবার অসমের মতো রাজ্যে  নাগরিক অধিকার হরণ--- ডি-ভোটার করণ  ইত্যাদি চক্রান্তের শিকার৷

সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শাসকেরা উপলব্ধি করেছিল যে বাঙালীর ঐক্য ও সংগ্রামী চেতনা,  বুদ্ধি ও শক্তি,  প্রতিবাদী কন্ঠস্বর, তাদের একাধিপত্য বিস্তারে বিশাল বাধাস্বরূপ৷  তাই তাদের একমাত্র লক্ষ্য ছিল বাঙালীর  ঐক্য ও মনোবলকে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করে দেওয়া৷ স্বাধীন  ভারতের হিন্দি সাম্রাজ্যবাদী শাসকবর্গও একই পথের পথিক ও একই মতের শরিক হয়ে ব্রিটিশদের প্রদর্শিত পথেই বাঙালী বিদ্বেষ জারি রেখেছে আর বাঙালীর                ভাষা-সংসৃকতি-শিক্ষা-জীবনচর্র্যর উপর হিন্দি আগ্রাসনের চক্রান্তে লিপ্ত রয়েছে৷  এমতাবস্থায় পাহাড় প্রমাণ সাঁড়াশি চাপে  বিভিন্ন প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত বাঙালীরা অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে ভবিতব্যকে মেনে নিয়ে নিজের দেশ, ভূমি, মুখের ভাষা, কৃষ্টি ঐতিহ্য হারিয়ে রিক্ত নিঃস্ব অবস্থায় এক নিস্তেজ নিষ্প্রভজীবনযাপন করে চলেছে৷  এমন কি পশ্চিমবঙ্গে বসবাসকারী বাঙালীরাও বর্তমানে নিজস্ব জাতিসত্তা ও ঐতিহ্যকে ভুলে যেতে বসেছে৷ শিক্ষা-সাহিত্য-সংস্কৃতিতে নিরন্তর নগ্ণ হিন্দী আগ্রাসনের ফলে ও  জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বর্ধিত সুযোগ সুবিধা পাওয়ার আশায় পঙ্গপালের মতো ছুটে চলেছে আর নিজের শিকড় ছিঁড়ে স্বখাতসলিলে নিক্ষিপ্ত হচ্ছে৷

 বাঙালীর স্বকীয়তা বা বাঙালীয়ানা বর্তমানে কয়েকটি  তিথি ও দিবসের আনুষ্ঠানিক আচারে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে৷ পয়লা বৈশাখ, ২৫ শে বৈশাখ, ২২শে শ্রাবণ, নেতাজী জয়ন্তী পালন, বা কিছু বাঙালী পূজাপার্বণের অনুষ্ঠান আর  এতদুপলক্ষে সাহিত্য সংসৃকতি চর্র্চ ভিন্ন  অন্য কোনো বিষয়ে তথাকথিত বাঙালী-চেতনার  প্রকাশ লক্ষিত হয় না৷  অন্যান্য রাজ্য বা রাষ্ট্রে বাঙালী নিধন ,  নির্র্যতন , নিপীড়নের  বিরুদ্ধে সক্রিয় প্রতিবাদ কতিপয় ক্ষুদ্র উদ্যোগ ব্যতীত সচরাচর অনুপস্থিত৷  এমন কি পশ্চিমবঙ্গকে ভাঙ্গার রাজনৈতিক, সাম্প্রদায়িক ও সন্ত্রাসবাদী চক্রান্তের বিরুদ্ধে সার্বিকভাবে  গণআন্দোলন গড়ে ওঠে নি৷ ‘‘আমরা বাঙালী’’-র মতো কিছু সংঘটন ছাড়া আর কোনো  বড়ো রাজনৈতিক দল (শাসক বা বিরোধী) সমগ্র পশ্চিমবঙ্গে আন্দোলনের জোয়ার  তোলেনি৷  বরং  অনেকে এতে ইন্ধন জোগানোর চেষ্টা করেছে৷ রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ, অরবিন্দ, নেতাজী সুভাষ, সূর্যসেন, ক্ষুদিরামের বাঙলা কি এখনো ঘুমিয়ে থাকবে , ঝিমিয়ে থাকবে? বাঙলা মায়ের করুণ মুখ, বাঙালীজাতিসত্তার নীরব আর্তনাদ,  বাঙালীর উপরে এই চরম নির্র্যতন কি অনন্তকাল ধরে চলতে থাকবে? বাঙালী কি ঠেকেও শিখবে না?  একজন সচেতন বাঙালী হিসেবেং বিশ্বাস রাখি ঃ ঘুমন্ত আগ্ণেয়গিরির মতো বাঙালী জাতির এই অবসাদ সাময়িক--- অতর্কিতেই কোনো এক সঠিক ও সজীব নেতৃত্বের অগ্ণিস্ফূলিঙ্গের অনুঘটকে অবশ্যই দুরন্ত আগ্ণেয়গিরির জ্বালামুখ বিস্ফোরিত হয়ে উত্তাল বিক্ষোভের লাভা স্রোত দিগবিদিকে উৎক্ষিপ্ত হবে ও  বিশ্বের সকল বাঙালী ধর্মমত, বর্ণ,সম্প্রদায়গত ভেদ-ভাবহীন,  জাতিসত্তা ও  জাত্যভিমান জাগ্রত করবে ও বাঙালীর নিজস্ব বাসভূমি ‘‘বাঙালীস্তান’’ প্রতিষ্ঠা করবে--- কারণ বাঙালী জাতির সামনে এছাড়া আর কোন পথ খোলা নেই