অথ সরিত কথা

লেখক
জয়ন্তী চক্রবর্তী

পৃথিবীর ৩ভাগ জল, একভাগ স্থল ৷ তবু এই এক ভাগের তৃষ্ণাও মেটাবার মত যথেষ্ট জল আজ আর এই নীল গ্রহে নেই৷ বিবেচনাহীন অপচয়ই তার একমাত্র কারণ৷ আমরা নদীর তীরে বসতি শুরু করেছি তারপর জীবন যাপনের যাবতীয় বর্জ্র্য ছঁুড়ে দিয়েছি নদীরই জলে৷ নদীর তীরে কলকারখানা করেছি, বিষাক্ত রাসায়নিক বর্জ্য ফেলে ফেলে দূষিত করে দিয়েছি মায়ের দুধের মত পবিত্র মধুর অমৃত সমান জলধারাকে৷ যত্রতত্র বাঁধ দিয়ে উন্নয়নের নামে ডেকে এনেছি নদীর মৃত্যুকে৷ অপরিনামদর্শী এই আমরাই আবার নদী কে মাতা বলি, দেবী বলি, পাঁঠা বলি দিয়ে গঙ্গা পূজো করি৷ গঙ্গা তীরে ১০৮টি প্রদীপ জ্বালিয়ে আরতি করি, প্লাস্টিকে মোড়া শাড়ি ছুঁড়ে দিই গঙ্গাজলে---মাতা পরবেন৷ অশিক্ষা, কুসংস্কার, অপরিণামদর্শিতা ছাড়াও আমাদের সবচেয়ে বড় দোষ হ’ল আমরা বড় অকৃতজ্ঞ৷ আজ সর্বনাশের শেষ ধাপে দাঁড়িয়ে যখন দেখতে পাচ্ছি পানীয় জল ক্রমশই দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠছে তখন আমাদের সামান্য একটু টনক নড়েছে৷ ভূ-গর্ভের জল নলকূপ বসিয়ে তুলে নিতে নিতে ক্রমশঃ নিঃস্ব হয়ে গেছে সে সঞ্চয়ও৷ দারুণ গ্রীষ্মের দিনে অধিকাংশ নলকূপে জল ওঠে না৷ যেখানে তা ওঠে--- সে জলও ভীষণভাবে আর্সেনিক দুষ্ট৷ মানুষ কলস ভর্তি করে তরল গরল নিয়ে ঘরে ফিরছেন৷ সেই গরল পান করে কেউ আক্রান্ত হচ্ছেন দূরারোগ্য চর্ম রোগে, কেউ অন্ধ হয়ে যাচ্ছেন কেউ বা হারাচ্ছেন চলা ফেরার ন্যুনতম শক্তিটুকু৷

তাহলে উপায় কি? না---ভয়ানক কঠিন কিছু নয়৷ নদীর অধিকার নিয়ে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের পথে পৃথিবীকে এগিয়ে যেতে বলব না আমি৷ বলব না , নতুন কোনো গ্রহের সন্ধান করতে যেখানে প্রচুর পেয় জল আছে৷ বলব না কোন অলৌকিক শক্তি বলে বা বিভাজনের বিশেষ কোন কারসাজিতে সমুদ্রের লবণাক্ত জলকে মিষ্টি জলে রূপান্তরিত করে তুলতে৷

আমি শুধু ৩টি কাজের কথা বলব যা প্রতিদিনের দিন যাপনের সঙ্গে একান্তভাবে অভ্যাস করে নিতে হবে আর ৩টি দীর্ঘ মেয়াদি কাজের কথা বলব যা জাতীয় বা সরকার স্তরে উদ্যোগ নিয়ে গড়ে তুলতে হবে৷ নিষ্ঠা ও সততার সঙ্গে এই ৩+ ৩= ৬টি কাজ করতে পারলে আমার মনে হয় না আগামী পৃথিবীতে পানীয় জলের অভাব বলে কিছু থাকবে৷

নিত্যকরনীয় ব্যক্তিগত ৩টি উদ্যোগ হল যথাক্রমে---

১৷   প্রতিটি বাড়িতে, ফ্ল্যাটে, আবাসনে হাসপাতালে স্কুলে, কলেজে অফিসে কিংবা হোটেলে বৃষ্টির জল সংরক্ষণ করে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে৷

২৷   জলের অপচয় বন্ধ করার জন্য ট্যাপের সঙ্গে বিশেষ পদ্ধতি চালু করতে হবে৷ তাতে প্রয়োজনের অতিরিক্ত শোধিত জল খরচ হবে না৷ এতে বিদ্যুতেরও সাশ্রয় হবে৷

৩৷ বাড়ির আনাজ , সব্জি, চাল, ডাল, ধোয়া জল দিয়েই বাগান পরিচর্র্য করতে হবে৷ চাষের মাঠে ন্যুনতম জল ভাল লাগে এমন প্রজাতির ধান বা সব্জি বা অন্যশষ্যের চাষ করতে হবে৷ কল খুলে বাসন ধোবার অভ্যস ছাড়তে হবে৷ রাস্তার কল থেকে জল পড়ে যাওয়া বন্ধ করতে হবে৷

সরকারী স্তরে উদ্যোগ নিতে হবে এমন ৩টি করণীয় বিষয় হল---

১৷   প্রচুর পরিমানে পুকুর, দীঘি ইত্যাদি খনন ও সংরক্ষণ করতে হবে৷ নদীখাত অগভীর হয়ে গেলে তা আবার কাটিয়ে পর্যাপ্ত জল ধারণের উপযুক্ত করতে হবে৷ এর ফলে ভূ-গর্ভস্থ দর্ের স্তর ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাবে৷ এই পদ্ধতিতেই রাজস্থানের মরুভূমির বুকে আজ ভূগর্ভস্থ জলন্তর বৃদ্ধি করা সম্ভব হয়েছে৷

২৷   নদীকে রক্ষা করার জন্য নদী তীর বরাবর সশস্ত্র সৈনিক নিয়োগ করতে হবে৷ জলে ময়লা ফেললেই যেন আইনানুগ কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়৷ এমনকি নৌকা, জাহাজ বা স্টীমারে প্রভৃতি জলযান থেকেও কোন আপত্তিকর বস্তু নদীতে ফেলা না হয় সেদিকে সচেতন থাকতে হবে৷

৩৷ নদী তীর বরাবর ও রাজপথ বরাবর দুই দিকে প্রচুর পরিমানে গাছ লাগাতে হবে৷ বট, অশ্বত্থ ও বিল্ব ফলের গাছ লাগনই উচিত যাতে মানুষ সেগুলো না কাটে৷ গাছ লাগালে বৃষ্টি বাড়বে ৷ সংরক্ষিত জলে বাড়বে৷ নদীর বুকে জল বাড়বে৷ চাষের মাঠে সেচ দিতে লাগবে না৷

সুজলা সুফলা ধরিত্রী হয়ে আনবে সুস্থ সুন্দর জীবনের আশ্বাস৷

পরবর্তী প্রজন্মের জন্য এ টুকু কি আমরা করত পারি না? সন্তান সন্ততির মুখের থেকে পানীয় জলের পাত্রটুকু যে আমরা কেড়ে নিতে চলেছে৷ এই নির্মম সত্যিটা আর বুঝব কবে?