বাঙালীর দুঃখ মোচন হয়নি কেন জবাব চাই, জবাব কই?

লেখক
ভবেশ বসাক

সময়ের স্রোতে বয়ে গেছে কত কিছু! সুখ-দুঃখের জীবন তরীতে আমরা বাঙালীরা শুধু দিয়েই গেলাম৷ পিছন ফিরে তাকালে স্পষ্ট হয়  কত শত ঘটনা৷ বাঙালী জাতি নিঃস্বার্থভাবে সেবা করে গেছে সমাজের উন্নতির লক্ষ্যে৷ নিজ ভূমিতে স্থান দিয়েছে অন্য অনেক জাতিকে, অন্নহীনকে অন্ন দিয়েছে, গৃহহীনকে স্থান দিয়েছেন নিজ গৃহে৷ লক্ষ্য সকলকে নিয়ে সুখে শান্তিতে বেঁচে থাকা৷ 

ইতিহাসের পাতাতে দেখেছি এদেশে একদিন পর্তুগীতজ, ফরাসী, ইংরেজ এল৷ তারা লুঠপাট করল, অত্যাচার করল, দেশের স্বাধীনতাকে কেড়ে নিল৷ পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হতে বাঙালীরা জীবনপণ করে অভূতপূর্ব সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ল৷  রাইফেল, মেশিনগানের গুলিতে কত-শত বাঙালীকে প্রাণ বিসর্জন দিতে হ’ল তার ইয়ত্তা নেই৷ ইংরেজদের তাঁবেদারি করে বাঙালীরা নিজেদের জীবনকে স্বাচ্ছন্দ্যময় করে সুখভোগ করতে পারত৷ কিন্তু তা না করে দেশের প্রয়োজনে, সমগ্র জাতির প্রয়োজনে ক্ষুদিরাম, প্রফুল্ল চাকী, বাঘা যতীন, সুর্যসেন প্রভৃতি অকাতরে তাঁদের জীবন উৎসর্গ করলেন৷ স্বাধীনতার শেষ জাগ্রত প্রহরী নেতাজীর সংগ্রাম ত্যাগ ও কষ্ট বরণের ইতিহাস কে না জানে! তাঁদের হাত ধরে যারা স্বাধীনতার স্বাদ পেল ও এদেশে শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হ’ল তারা বাঙলা ও বাঙালীর প্রতি আদৌ সুবিচার করল না৷ কাগজে-কলমে বাঙালী স্বাধীন হলেও  তাঁদের সুখ-সমৃদ্ধি ঘটল না৷ দেশভাগের যাঁতাকলে অন্নহীন, বস্ত্রহীন, গৃহহীন হয়ে উদ্বাস্তুর কুঠুরীতে বন্দী করা হ’ল লক্ষ লক্ষ বাঙালীকে৷ বাঙলা মায়ের দেহকে টুকরো-টুকরো করে পাশ্ববর্তী এলাকার সঙ্গে জুড়ে দিয়ে বাঙালীর প্রকৃত ভূখণ্ডকে  ক্ষুদ্র  ক্ষুদ্র করা হ’ল৷ সর্বহারা বাঙালী সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে, নিজ মেধাশক্তিতে বলীয়ান হয়ে কোনও ভাবে টিঁকিয়ে রেখেছে নিজের অস্তিত্বকে৷ শত বাধা-বিপত্তিকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যাওয়ার প্রবল ইচ্ছায় বাঙালী ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে বারবার৷ তবুও দমে যায়নি বাঙালী৷ শত দুঃখের বেড়াজাল ভেঙ্গে নূ্যনতম প্রয়োজনপূর্ত্তির জন্যে কঠোর সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছে বাঙালী৷ স্বাধীনতার পর বাঙালী জাতি সুর্যসেন, মাথা তুলে দাঁড়ানোর সময় থেকেই সংগ্রাম করে চলেছে৷ তার সংগ্রামের জোয়ারে গা ভাসিয়ে অনেক অবাঙালী নিজের স্বার্থটাকে বড় করে দেখেছে৷

আজ ভারতের বুকে শিল্পপতি জামশেদজী টাটা, জি.ডি.বিড়লা, আম্বানী গোষ্ঠী, বাজারিয়া গোষ্ঠীরা ও তাদের বশংবদ ভারতের শাসকশ্রেণী দেশ পরিচালকের ভূমিকায় বারে বারে ব্যর্থ হচ্ছে৷ বিশ্ব মানচিত্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভারতের অগ্রগতি হচ্ছে না---অথচ তারা ব্যষ্টিগতভাবে চরম সুখভোগ করে চলেছে৷ অবাঙালী শিল্পপতি, সমাজপতি, রাজনৈতিক নেতানেত্রীরা দেশের স্বার্থ কোনওদিন দেখেনি, আগামী দিনেও তাদের দ্বারা দেশের উন্নতি পরিলক্ষিত হওয়ার কোনও আশা নেই৷ অথচ তারাই আজ দেশের সর্বেসর্বা৷

দেশকে পরাধীনতার শৃঙ্খল-মুক্ত করতে নেতাজীর নেতৃত্বে অগনিত বাঙালী নিজেদের স্বার্থ ত্যাগ করলেন, চরম কষ্ট ভোগ করলেন এমনকি প্রাণ বিসর্জন দিলেন৷ এই দেশকে কুসংস্কার মুক্ত করতে রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগরকে সহায়তা করতে যে বাঙালী জাতি অগ্রগামী হয়েছিলেন যে বাঙালী জাতি রবীন্দ্রনাথের রাখী বন্ধন উৎসবের মাধ্যমে বাঙালী-অবাঙালী সকলকে এক সূত্রে গাঁথার জন্যে এগিয়ে এসেছিলেন---সেই বাঙালী জাতি আজ নিজ ভূমে উদ্বাস্তুর মত দিন কাটাচ্ছে৷ অসম, ত্রিপুরা, দার্জিলিংয়ে বাঙালীদের ‘বিদেশী’ আখ্যা দিয়ে দেশছাড়া করার নেশায় মত্ত বেশ কিছু অবাঙালী রাজনৈতিক নেতা, পুঁজিপতিরা৷ শুধু তাই নয়, পশ্চিমবঙ্গের মত রাজ্যেও বিভিন্ন উচ্চপদে তো বটেই, রাজনীতি থেকে শুরু করে অন্যান্য সমস্ত ক্ষেত্রেই বাঙালীদের দেখা মিলছে নামমাত্র৷ বাঙালীদের তাদের ন্যায্য অধিকার ছিনিয়ে নিতে হবে৷ কিন্তু এই পশ্চিমবঙ্গেরই কোণে কোণে ক্ষমতাচূ্যত সর্বহারার তকমাধারী ‘কমিউনিষ্ট’ ও তাদের সবুজ-গেরুয়ার মুখোশ পরা সাঙ্গপাঙ্গরা ওই পুঁজিপতি ও রাজনীতিকদের তাঁবেদারি করে বাঙালীকে ক্রমশঃ পিছনপানে টেনে চলেছে৷ সমস্ত বাঙালী জাতির অস্তিত্ব  আজ মহাসংকটে৷ প্রকৃত অর্থে এত লড়াই-সংগ্রামের পরে বাঙালীর এই চরম দুর্দশা কেন?---এর জবাব কে দেবে? এর উত্তর একটাই ---বাঙালীকেই কেড়ে নিতে হবে নিজ অধিকার, আজ বাঙালীকে জাগতে হবে, জাগাতে হবে৷