ডামরুঘুটু গ্রামোন্নয়ন প্রকল্ ঃ কিছু কথা

লেখক
জ্যোতিবিকাশ সিন্‌হা

শতকোটি জন্মের পর মানুষ দুর্লভ মানবজন্ম লাভ করে আর এই  মানবজন্মের প্রকৃত লক্ষ্য হলো আধ্যাত্মিক সাধনার মাধ্যমে পরমপুরুষের পানে এগিয়ে চলতে চলতে একদিন কোন এক শুভ মুহূর্তে সেই পরম ভূমাসত্তার সাথে মিলে মিশে এক হয়ে যাওয়া৷ বর্তমান পৃথিবীতে জড়বাদী পুঁজিবাদী অশুভ শক্তির বহুমুখী আগ্রাসনে শোষিত,বঞ্চিত,নিপীড়িত মানুষ শুধুমাত্র অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে এতটাই বিপর্যস্ত হয়ে থাকে যে ধর্ম সাধনার মানসিকতা ও সামর্থ্য দুইই হারিয়ে ফেলে৷ অন্যায়, অবিচার, দুর্নীতির করাল গ্রাসে ন্যায়-নীতি, ধর্ম সাধনা, সত্যনিষ্ঠা, আধ্যাত্মিকতা, মানবতা সবই ভুলুন্ঠিত হতে বাধ্য হয়৷ এই পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণের জন্যে মহান দার্শনিক ঋষি শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার যিনি আধ্যাত্মিক গুরু হিসেবে শ্রী শ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী নামে পরিচিত, একদিকে ‘‘আনন্দমার্গ’’ দর্শনের দ্বারা মানুষের সার্বিক কল্যাণে ধর্ম সাধনার পথ নির্দেশনা ও অপরদিকে সামাজিক অর্থনৈতিক দর্শন ‘‘প্রাউট’’ এর মাধ্যমে সত্যিকারের শোষণহীন সমাজ রচনার বাস্তব প্রয়োগভিত্তিক, বিজ্ঞানসম্মত দিগনির্দেশ দিয়েছেন৷ এর ফলে ‘‘আত্মমোক্ষার্থং জগদ্বিতায়চঃ’’ আদর্শের সার্থক রূপায়নের দ্বারা জগতের সর্র্বত্মক কল্যাণ সাধন ও ব্যষ্টিগত ক্ষেত্রে ধর্ম সাধনার পথে মানুষ দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে চলতে পারবে৷ এই যুগপৎ লক্ষ্যকে সামনে রেখে তিনি তাঁর সংঘটনের প্রধান কেন্দ্র ‘আনন্দনগর’’ পশ্চিমবঙ্গের একেবারে পিছিয়ে পড়া অনুন্নত জেলা পুরুলিয়ার প্রত্যন্ত পাহাড়ী অঞ্চলে প্রতিষ্ঠা করেন৷ এই স্থান নির্বাচনের ক্ষেত্রে সেই অঞ্চলের ঐতিহাসিক ভূতাত্ত্বিক-নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য, ভৌগোলিক অবস্থান, আধ্যাত্মিক মাহাত্ম্য ইত্যাদি বহুবিধ কারণের মধ্যে একটি ছিল আদিবাসী অধ্যুষিত এই অঞ্চলের অধিবাসীগণের সামাজিক, অর্থনৈতিক, শিক্ষাগত অনগ্রসরতা৷ গড়জয়পুরের রাজা ও রাণীর দান হিসেবে প্রাপ্ত এক দুর্গম বনজঙ্গল পরিবেষ্টিত পাহাড়ী অঞ্চলে মানবতার কল্যাণে উৎসর্গীকৃত প্রাণ তাঁর সর্বত্যাগী অনুগামী সন্ন্যাসীগণের অক্লান্ত পরিশ্রমে গড়ে তোলেন ‘‘বিশ্বের আলোকবর্তিকা আনন্দনগর’’৷ একে একে প্রতিষ্ঠিত হয় প্রাথমিক বিদ্যালয়, উচ্চ বিদ্যালয়,মহাবিদ্যালয়, হাসপাতাল, শিশুসদন (অনাথাশ্রম), পশু চিকিৎসা কেন্দ্র, মূক - বধির -দৃষ্টিহীনদের জন্যে সেবা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রভৃতি বহু জনহিতকর প্রকল্প৷ আনন্দনগরের চতুস্পার্শস্থ গ্রামগুলিতে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অর্থনৈতিক উন্নতির বিস্তার হতে থাকলো দুর্বার গতিতে৷ আর পিছিয়ে পড়া সাধারণ আদিবাসী মানুষজনের সার্বিক  উন্নয়নে ও নবজাগরণে শঙ্কিত হয়ে কায়েমী স্বার্থবাদী জড়বাদী গোষ্ঠী ১৯৬৭ সালের ৫ই মার্চ সুপরিকল্পিত ও সুসংঘটিত ভাবে আঘাত হানলো উন্নয়নের প্রাণকেন্দ্রে---অসহায় দুর্বল মানুষের সেবায়  নিয়োজিত কাঠামোগুলো ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দেওয়া হলো, ৫ জন সর্বত্যাগী সন্ন্যাসীকে নির্মমভাবে হত্যা করা হলো৷ তারা হলেন আচার্য অভেদানন্দ অবধূত,আচার্য সচ্চিদানন্দ অবধূত,আচার্য ভরত কুমার- আচার্য প্রভাস কুমার,আচার্য অবোধ কুমার৷ এই দিনটি আনন্দমার্গীগণ ‘‘দধীচি দিবস’’ হিসেবে পালন করেন৷ পরবর্ত্তীকালেও আনন্দমার্গের উপর বহুবার এইধরণের আঘাত এসেছে, কিন্তু সমস্ত প্রতিকূলতাকে নস্যাৎ করে দিয়ে, পরমপুরুষের কৃপায় ও মানবতাপ্রেমী সর্বসাধারণের শুভেচ্ছায় আনন্দনগর আবার সেজে উঠেছে সমস্ত উন্নয়নমুখী সেবামূলক প্রকল্প বাস্তবায়নের লক্ষ্যে৷ মার্গগুরু শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তিজীর জন্মশতবর্ষ উপলক্ষ্যে আনন্দনগরের একটি অনুন্নত আদিবাসী অধ্যুষিত গ্রাম ‘ডামরুঘুটু’ তে ‘‘প্রাউটিষ্ট ইয়ূনিবার্র্সল’’ এর পক্ষ থেকে শুরু করা হয়েছে ‘‘আদর্শ গ্রামোন্নয়ন প্রকল্প’’এই প্রকল্পের মাধ্যমে গ্রামটিকে স্বয়ংসম্পূর্ণ স্বনির্ভর গ্রাম হিসেবে গড়ে তোলা হচ্ছে ও ভবিষ্যতে একইভাবে এই ধরণের  প্রকল্প আশেপাশের গ্রামগুলিতে ও অন্যান্য স্থানে প্রসারিত করার পরিকল্পনা রয়েছে৷ ইতোমধ্যেই মহিলাদের স্বনির্ভর করার লক্ষ্যে ‘‘সেলাই প্রশিক্ষণ কেন্দ্র’’ প্রথম থেকে দশম শ্রেণীর ছাত্র ছাত্রাদের জন্যে ‘‘নিঃশুল্ক প্রশিক্ষণ’’ ও একাদশ শ্রেণীর ঊধের্বর ছাত্রছাত্রাদের জন্যে ‘‘নিঃশুল্ক কম্পিউটার প্রশিক্ষণ’’ এর ব্যবস্থা করা হয়েছে৷ গ্রামবাসীগণের স্বাস্থ্য সচেতনতা ও সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির জন্যে  প্রশিক্ষণ, ফলের চারাগাছ বিতরণ, গ্রামের রাস্তা সংস্কার, পাঠাগার নির্মাণ ইত্যাদি কাজও মসৃণভাবে চলছে৷ পরবর্তী পদক্ষেপে গো-পালন, জলসেচ ,পানীয় জলের সুব্যবস্থা, সমবায় প্রথায় কৃষিকাজ প্রভৃতি প্রকল্প শুরু করা হবে৷

এই বিশাল কর্মযজ্ঞের সার্থক রূপায়নে বিপুল অর্থ প্রয়োজন৷ ইতোমধ্যে অনেকেই আর্থিক ও অন্যান্য প্রকারে সাহায্য করেছেন ও করছেন৷ সকল শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানবদরদী মানুষের কাছে আমাদের আবেদন, এই শুভকাজে সামর্থ্য অনুযায়ী (সম্ভব হলে সামর্থ্যের বাইরে গিয়েও) সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন যাতে পরম শ্রদ্ধেয় প্রাণপ্রিয় ‘‘বাবার’’ জন্মশতবর্ষে আমরা সকলে মিলে এই জনহিতকর প্রকল্পগুলিকে সাফল্যমণ্ডিত করতে পারি৷

একথাও ঠিক যে অশুভ শক্তির বিষাক্ত ফণা অতর্কিতে ছোবল মারতেই পারে, তবে আনন্দমার্গ, প্রাউট ও মানব জাতির অগ্রগতির ইতিহাসের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে পরমপিতার আশীর্বাদে সমস্ত বাধাবিপত্তিকে অতিক্রম করে আমরা সংকল্প সাধনে সফল হবই ও দুর্লভ মনুষ্য জন্মকে সার্থক করবই, --- এই হোক আমাদের দৃঢ় অঙ্গীকার৷