‘ধর্ম’ নিয়ে বিভ্রান্তি দূর হোক

লেখক
সত্যসাধন সরকার

বর্তমানে বিজেপি ও তার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ‘ধর্ম’কে মাধ্যম করে আপন আপন রাজনৈতিক ফায়দা তোলার প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমেছে৷ বিজেপি তো শুরু থেকে ধর্মের সেন্টিমেন্টকে প্রধান হাতিয়ার করে রাজনৈতিক ময়দানে লড়াই করতে নেমে বর্তমানে কেন্দ্রে ক্ষমতা দখল করেছে৷ এখন সামনের ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনী যুদ্ধে জয়লাভের জন্যেও এখন অন্যান্য সমস্ত অস্ত্র ছেড়ে ধর্মকেই একমাত্র হাতিয়ার করে নিয়েছে৷ বিজেপি’র কাছে এখন বোধ হয় আর এমন কিছু ইস্যু নেই যাতে নিজেদের কৃতিত্ব বা সাফল্য দেখিয়ে জনগণের দরবারে পুনরায় বোট ভিক্ষা করে৷ ‘আচ্ছে দিন’ও এল না, সুইসব্যাঙ্ক থেকে কালো টাকাও ফেরানো গেল না, গরীব জনসাধারণের ব্যাঙ্ক একজোট ১৫ লক্ষ টাকা জমা করার প্রতিশ্রুতিও সম্পূর্ণ ফ্লপ করলো, তার ওপর বিমুদ্রাকরণ ও জি-এস-টি নিয়ে জনগণের অত্যন্ত তিক্ত অভিজ্ঞতা৷ তাই শেষ পর্যন্ত একটাই উপায় সস্তায় ধর্মীয় সেন্টিমেন্ট৷ বাবরি মসজিদ ভেঙ্গে রামমন্দির গড়ার আন্দোলনে নেমে বিজেপি ক্ষমতায় এসেছিল৷ পরে যদিও মোদিজী বার বার বুক ফুলিয়ে বললেন, বিভেদ নয় সবার উন্নয়নই আমাদের সরকারের নীতি, কিন্তু কাজের বেলায় রথ উল্টো দিকে চলল৷ গোমাংস (মহিষমাংস নয়)সহ নানান্ ইস্যুতে কেন্দ্রীয় সরকার তথা শাসকদল সেই সাম্প্রদায়িক সেন্টিমেন্টকেই উস্কে দিয়ে জনগণের আবেগকে নিজেদের পক্ষে আনতে দিবারাত্র ব্যস্ত৷

আর, এই করতে গিয়ে এরা ধর্মের চরম অবমূল্যায়ন ঘটাচ্ছে৷ ধর্মকে স্রেফ একটা সাম্প্রদায়িক সেণ্টিমেণ্ট হিসেবে জনগণের সামনে তুলে ধরছে৷

আর শুধু বিজেপি-ই বা বলি কেন, আজকের প্রায় সমস্ত বুদ্ধিজীবী সমাজ ধর্ম নিয়ে, চরমভাবে বিভ্রান্তিমূলক প্রচারের ফলে বেশিরভাগ জনসাধারণ ধর্মকে শুধুমাত্র একটা সাম্প্রদায়িক সেন্টিমেন্ট বা সাম্প্রদায়িক কিছু বাহ্যিক ক্রিয়াকলাপ বা অনুষ্ঠানের বেশি কিছু ভাবতে পারে না৷ তার ওপরে ভাবেন, ধর্ম হল যুক্তি বিরোধী একরাশ কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসের সমষ্টি৷ তাই ধর্মের প্রতি বেশিরভাগ শিক্ষিত মানুষদের একটা নাসিকা কুঞ্চন ভাব সব সময়ই পরিলক্ষিত হয়৷

আসলে তাঁরা ধর্মের স্বরূপ সম্পর্কে কিছু বোঝেন না, বা বুঝতে চেষ্টা করেন না৷

ধর্ম সম্পর্কে মানুষের ধোঁয়াশা ভাবনা দূর করে’ শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী বলেছেন, ‘ধর্ম’ শব্দটির অর্থ হ’ল (ধৃ+মন্) কোনো সত্তা যে সত্তাগত বৈশিষ্ট্য ধারণ করে রেখেছে,যা ওই সত্তার পরিচিত বহন করে৷ যেমন আগুনের ধর্ম দহন করা, জলের ধর্ম ভিজিয়ে দেওয়া, তেমনি ‘মানুষ’ হিসেবে তার একটা সত্তাগত বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা অন্যান্য প্রাণীর নেই --- সেটাই ‘মানুষের’র পরিচিতি বহন করে৷ আহার, নিদ্রা, ভয় ও সংখ্যাবৃদ্ধি --- সমস্ত জীবেরই বৈশিষ্ট্য, কিন্তু মানুষের প্রধান বৈশিষ্ট্য হল, প্রতিটি মানুষ সুখ চায় আর তা সীমিত সুখ নয়, অনন্ত সুখ বা আনন্দ৷ তাই পেট ভরলেই মানুষ সন্তুষ্ট হয়ে যায় না৷ সে অনেক কিছু চায়--- সে চাওয়ার শেষ নেই৷ সে যত পায়, ততই চায়, আনন্দপ্রাপ্তির জন্যে প্রথমে মানুষ পার্থিব ভোগের দিকে আকৃষ্ট হয়--- সে ধন আহরণ করে, ক্ষমতা প্রতিপত্তি অর্জনে তৎপর হয়৷ কিন্তু এ সমস্ত তাকে প্রকৃত আনন্দ দিতে পারে না৷

শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী বলছেন, ‘‘সীমিত সম্পদ, ক্ষমতা প্রতিপত্তি--- এগুলো মানুষের বাসনার নিবৃত্তি ঘটাতে পারে না বরং ভোগের প্রবৃত্তি উত্তরোত্তর বাড়িয়ে দেয়৷’’

তাহলে মানুষ মূলতঃ কী চায়৷ মানুষের অনন্ত ক্ষুধা বলে দেয়, মানুষ ‘অনন্ত’ কিছু চায়? আর অনন্ত হ’ল একমাত্র ‘ব্রহ্ম’৷ ‘ব্রহ্ম’ কথাটির অর্থই অনন্ত৷ ‘হত্বাদ্ ব্রহ্ম, বৃংহনত্বাদ্ ব্রহ্ম’ যা নিজে অনন্ত ও অপরকেও অনন্ত করতে পারে৷ তাই শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তিজীর ভাষায়, ‘‘মানুষের অনন্ত ভোগবাসনার পশ্চাতে এই ব্রহ্মোপলব্ধি বাসনাই প্রচ্ছন্নভাবে থেকে যায়৷ অতএব ব্রহ্ম সম্প্রাপ্তিই মানুষের ধর্ম৷ ইচ্ছার পরিপূর্তিই হ’ল আনন্দ৷ তাই ব্রহ্মপ্রাপ্তিতে ও তৎপ্রচেষ্টায় সংলগ্ণ হয়েই মানুষ যথার্থ আনন্দলাভ করে৷’ ‘আনন্দসূত্রম্’ গ্রন্থে আরও বলা হয়েছে, ‘‘হদেষণা প্রণিধানঞ্চ ধর্ম’’ বৃহৎ অর্থাৎ ব্রহ্মলাভের প্রয়াস ও তারজন্যে যে অনুশীলন’’--- তাই হ’ল মানুষের ধর্ম৷

আর ধর্ম যেহেতু সত্তার পরিচিতি বাহক স্বীয় বৈশিষ্ট্য, তাই মানুষ মাত্রেরই ধর্ম এক৷ সমস্ত আগুনের ধর্ম যেমন এক, সমস্ত জলের ধর্ম যেমন এক, তেমনি সমস্ত মানুষেরও ধর্ম এক--- তাকে বলা যায় মানবধর্ম বা ভাগবত ধর্ম (ভগবান প্রাপ্তির এষণা)৷

তাই ধর্ম কোনো কোনোও সাম্প্রদায়ভিত্তিক পরিচিতি বা ভাবাবেগ নয়৷ কোনো সম্প্রদায়ভিত্তিক আচার-অনুষ্ঠানকেও প্রকৃতপক্ষে ধর্ম বলা সঙ্গত নয়৷

তাই ‘ধর্মে’র এই প্রকৃত অর্থ বুঝতে হবে৷ এই ধর্মের কথা মুনী-ঋষি থেকে শুরু করে স্বামী বিবেকানন্দ, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ---সমস্ত মনীষীরাই বলেছেন৷ ধর্মের এই ব্যাখ্যাই যুগপুরুষ শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী কম্বুকন্ঠে প্রচার করে গেছেন৷ মানুষ ধর্মের এই প্রকৃত ব্যাখ্যা--- প্রকৃত অর্থ উপলব্ধি করুক৷ ‘আসুন, ‘সমস্ত মানুষের এক ধর্ম--- এই মহান সত্যকে আমরা হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করি৷ আর এই কথাই প্রতিটি মানুষকে বোঝাই৷ আজকে বুদ্ধিজীবীরাও এই সত্যকে উপলব্ধি করুন ও তাঁরা তাঁদের লেখার মাধ্যমে, বক্তব্যের মাধ্যমে এই কথাটাই মানুষের মধ্যে প্রচার করুন৷

কারণ এর মধ্যে রয়েছে আজকের সমাজের বহুবিধ সমস্যার সমাধানের চাবিকাঠি৷ কায়েমী স্বার্থের তল্পিবাহকরা আজ ধর্মের বিকৃত অর্থ মানুষের সামনে তুলে ধরে মানব সমাজের মধ্যে নানান্ ভেদ-বিভেদের প্রাচীর নির্র্মণ করেছে৷ ফলে মানবসমাজের ঐক্য ও সংহতি বিনষ্ট হচ্ছে৷ এই ভেদ-বিভেদের সমস্ত প্রাচীর ভাঙ্গতে হবে৷ আর এটাই হবে মানবসমাজের দ্রুত অগ্রগতির--- মানব সমাজের সার্বিক উন্নয়ন তথা প্রগতির অত্যাবশ্যক শর্ত৷

এর ফলে বিশ্বভ্রাতৃত্বের প্রতিষ্ঠা হবে৷ সবাই পরস্পরের হাত ধরে জীবনের সর্বক্ষেত্রে এগিয়ে চলতে সমর্থ হবে৷ আজ পারিস্পরিক লড়াইয়ে যে শক্তি ও অর্থ বিনষ্ট হচ্ছে তা যদি সবার সার্বিক উন্নয়নের কাজে লাগানো যায় তাহলে যে দ্রুততর গতিতে মানব সমাজের প্রগতিশীল উন্নয়ন সম্ভব হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই৷